তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-কার হরতাল কে ডাকে! by এ কে এম জাকারিয়া
আদালতের রায় অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার সুযোগ নেই’—প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মধ্যে ভুল কিছু নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ নিয়ে যে একটি রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়ে গেল, সেটা স্পষ্ট। তত্ত্বাবধায়ক সরকার রক্ষায় কাল রোববার পুরো দিনের হরতাল ডেকেছে বিএনপি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এই খেলায় সরকারি দল আওয়ামী লীগের অবস্থান আপাতভাবে শক্তিশালী। খেলার শুরু দেখে যেমন ফলাফল ঠিক করে ফেলা যায় না, তেমনি শুরুতে শক্তিশালী মনে হওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষেই শেষ পর্যন্ত ফলাফল যাবে—এমন ধারণা করারও সুযোগ নেই। তবে সবচেয়ে বড় কথা, এই খেলাটা আদৌ শুরু করার বা এভাবে শুরু করার দরকার ছিল কি না, অন্য কোনো সহজ পথ ছিল কি না!
আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যেমন অসাংবিধানিক বলা হয়েছে, তেমনি বাস্তবতার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আদালত আগামী দুটি নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন। আর এই সরকারব্যবস্থা থেকে বিচার বিভাগকে মুক্তি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই বিষয়টি সংসদের মাধ্যমে ঠিক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমেই এর নিষ্পত্তি হতে হবে। বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত, এই অবস্থায় সংসদে বসে আলাপ-আলোচনা করে এর কতটুকু নিষ্পত্তি করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক।
এই বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী আদালতের রায় মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগামী নির্বাচনে থাকবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। আগামী দুটি নির্বাচন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে, আদালতের সেই পর্যবেক্ষণের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে বলা হয়েছে, সংসদ মনে করলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে বিচার বিভাগকে জড়িত করা যাবে না। এখানে আমি একটি ফর্মুলা চাই। বিরোধী দল সংসদে এসে এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য দিতে পারে। কোনো বিল সংসদে উত্থাপন করা হলে তার ওপর মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকে।’ প্রধানমন্ত্রী একদিকে যেমন বলেছেন, ‘সংসদীয় সরকার-পদ্ধতিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, সেভাবেই আগামী নির্বাচন হবে’; আবার আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হলে সে ফর্মুলা যে বিরোধী দলকেই দিতে হবে, তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থানকে কেউ বুদ্ধিদীপ্ত হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন শুরু করে, তখন বিএনপি এর বিরোধিতা করেই এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী গত মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়ার সেই উক্তি। ‘তিনি তো (খালেদা জিয়া) বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন, এখন উনি কোন পাগলের অধীনে নির্বাচন চান?’ তবে একই সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিএনপিই সংবিধানে যুক্ত করেছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন করতে গেলে যিনি প্রধান উপদেষ্টা হবেন, সেই সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অধীনে নির্বাচন না করার কথা আগেই ঘোষণা করে বসে আছে বিএনপি। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে চাইলে সে প্রস্তাব বিএনপিই দিক, এমনটিই চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। আর বিএনপি যদি সে ধরনের কিছু না করে, তবে আদালতের রায় মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচনের পথে যেতে চায় সরকার। রাজনৈতিকভাবে সরকার হয়তো এখন সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বা বিরোধী দলকে বেকায়দায় ফেলা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিলে, সরকারি দল বা প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কাকেই বাড়িয়ে তুলেছে।
বিরোধী দল বিএনপি হাইকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়ে হরতালও ডাকা হয়ে গেছে। জামায়াতে ইসলামীও একই ইস্যুতে একই দিন হরতাল ডেকেছে। একসময় যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য দিনের পর দিন হরতাল পালন করেছে আওয়ামী লীগ, এখন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে একই পথ ধরে এগোচ্ছে বিএনপি। ১৯৯৪ সালের মাগুরা নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল, তখন থেকে ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত হওয়ার আগে বছর দুয়েক সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘাত-সহিংসতায় কতজন প্রাণ হারিয়েছিল, তার হিসাব অন্তত আওয়ামী লীগের কাছে থাকা উচিত। আবার ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানের অধীনে নির্বাচন না করার দাবিতে আওয়ামী লীগ যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল, রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার পর এর পরিণতি হচ্ছে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির ঘটনা। আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত একই ধরনের ইস্যুতে একই ধরনের আন্দোলনের পুনরাবৃত্তিই কি ঘটতে যাচ্ছে দেশে? আগে যা করেছিল আওয়ামী লীগ, এখন তা করবে বিএনপি!
বিএনপি যে আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া মানবে না, তা আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে। আবার আওয়ামী লীগ এ নিয়ে ভালো-খারাপ যে উদ্যোগই নিক না কেন, বিএনপি যে তা মেনে নেবে না, সেটাও আওয়ামী লীগের জানা। বুঝেশুনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বলটি বিএনপির কোর্টে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করার কৌশল নিয়েছেন। কিন্তু কৌশল যত কৌশলেরই হোক, সরকারের এই অবস্থান রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই উসকে দেবে। আওয়ামী লীগ তবে কী করতে পারত?
সাধারণভাবে বললে বিএনটির অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে আগামী নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। আদালত যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বিচার বিভাগকে জড়িত না করার কথা বলেছেন, আবার বিএনপিও যেহেতু বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে, তাই নতুন একটি পথ খুঁজে বের করার কোনো বিকল্প নেই। বিএনপির কাছ থেকে এই প্রস্তাবের অপেক্ষা না করে তাই আওয়ামী লীগেরই উচিত ছিল একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ফর্মুলা জাতির সামনে তুলে ধরা। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এই কাজটি করে শুভ বোধের পরিচয় দিতে পারে। বিএনপি তা মানবে কি না, সে ঝুঁকি নিশ্চয়ই থাকবে, কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলা দিতে পারে, তবে অযৌক্তিক কোনো দাবি করে বিএনপি তখন খুব সুবিধা আদায় করতে পারবে না। জনগণের বিচার-বিবেচনা বোধের প্রতি আস্থা রেখে এই কাজটি করলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের লাভবান হওয়ারই কথা।
নির্বাচনের সময় কিন্তু জনগণের বিচারটাকেই রাজনৈতিক দলগুলোকে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে হয়। আগামী নির্বাচনের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে জনগণের ওপর আস্থা রাখার কাজটি কি আওয়ামী লীগ করবে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য বিএনপিকে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে, হরতালের ডাক দিতে হলো—এর চেয়ে পরিহাস আর কী হতে পারে! কার হরতাল কে ডাকে! কিন্তু বাস্তবতা এমনই। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বিএনপি আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রক্ষার জন্য জনগণকে হরতালে শামিল করতে চাইছে, তা কেউ জানে না। বর্তমানে সংবিধানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রয়েছে, সেটাই টিকিয়ে রাখতে চাইছে? বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিষয়টি তো তাহলে মেনে নিতে হবে। যদি আদালতের পরামর্শ অনুযায়ী বিচার বিভাগকে জড়িত না করার বিষয়টি যৌক্তিক মনে করা হয়, সে ক্ষেত্রে নতুন একটি ফর্মুলা তো জনগণের সামনে হাজির করতে হবে। এর আগেই হরতালের ডাক দেওয়াটা কি যৌক্তিক হলো? সংসদে গিয়ে প্রস্তাব দিলে সবচেয়ে ভালো, এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর একটি সিদ্ধান্তে নিশ্চয়ই আসা যাবে। সংসদে না গেলে গণমাধ্যমের সামনেও একটি ফর্মুলা হাজির করতে পারে বিএনপি। আওয়ামী লীগ বিএনপির প্রস্তাব মানবে কি মানবে না, সেই আশঙ্কাও নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য একটি প্রস্তাব দিয়ে জনগণের বিচার-বিবেচনার ওপর ভরসা করতে সমস্যা কোথায়?
জনগণের বিচার-বিবেচনার ওপর যদি সরকারি দল ও বিরোধী দলের আস্থা না থাকে, তবে তারা জনগণের সমর্থন আশা করে কোন মুখে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যেমন অসাংবিধানিক বলা হয়েছে, তেমনি বাস্তবতার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আদালত আগামী দুটি নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন। আর এই সরকারব্যবস্থা থেকে বিচার বিভাগকে মুক্তি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই বিষয়টি সংসদের মাধ্যমে ঠিক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমেই এর নিষ্পত্তি হতে হবে। বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত, এই অবস্থায় সংসদে বসে আলাপ-আলোচনা করে এর কতটুকু নিষ্পত্তি করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক।
এই বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী আদালতের রায় মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগামী নির্বাচনে থাকবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। আগামী দুটি নির্বাচন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে, আদালতের সেই পর্যবেক্ষণের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে বলা হয়েছে, সংসদ মনে করলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে বিচার বিভাগকে জড়িত করা যাবে না। এখানে আমি একটি ফর্মুলা চাই। বিরোধী দল সংসদে এসে এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য দিতে পারে। কোনো বিল সংসদে উত্থাপন করা হলে তার ওপর মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকে।’ প্রধানমন্ত্রী একদিকে যেমন বলেছেন, ‘সংসদীয় সরকার-পদ্ধতিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, সেভাবেই আগামী নির্বাচন হবে’; আবার আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হলে সে ফর্মুলা যে বিরোধী দলকেই দিতে হবে, তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থানকে কেউ বুদ্ধিদীপ্ত হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন শুরু করে, তখন বিএনপি এর বিরোধিতা করেই এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী গত মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়ার সেই উক্তি। ‘তিনি তো (খালেদা জিয়া) বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন, এখন উনি কোন পাগলের অধীনে নির্বাচন চান?’ তবে একই সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিএনপিই সংবিধানে যুক্ত করেছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন করতে গেলে যিনি প্রধান উপদেষ্টা হবেন, সেই সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অধীনে নির্বাচন না করার কথা আগেই ঘোষণা করে বসে আছে বিএনপি। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে চাইলে সে প্রস্তাব বিএনপিই দিক, এমনটিই চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। আর বিএনপি যদি সে ধরনের কিছু না করে, তবে আদালতের রায় মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচনের পথে যেতে চায় সরকার। রাজনৈতিকভাবে সরকার হয়তো এখন সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বা বিরোধী দলকে বেকায়দায় ফেলা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিলে, সরকারি দল বা প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কাকেই বাড়িয়ে তুলেছে।
বিরোধী দল বিএনপি হাইকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়ে হরতালও ডাকা হয়ে গেছে। জামায়াতে ইসলামীও একই ইস্যুতে একই দিন হরতাল ডেকেছে। একসময় যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য দিনের পর দিন হরতাল পালন করেছে আওয়ামী লীগ, এখন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে একই পথ ধরে এগোচ্ছে বিএনপি। ১৯৯৪ সালের মাগুরা নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল, তখন থেকে ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত হওয়ার আগে বছর দুয়েক সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংঘাত-সহিংসতায় কতজন প্রাণ হারিয়েছিল, তার হিসাব অন্তত আওয়ামী লীগের কাছে থাকা উচিত। আবার ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানের অধীনে নির্বাচন না করার দাবিতে আওয়ামী লীগ যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল, রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার পর এর পরিণতি হচ্ছে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির ঘটনা। আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত একই ধরনের ইস্যুতে একই ধরনের আন্দোলনের পুনরাবৃত্তিই কি ঘটতে যাচ্ছে দেশে? আগে যা করেছিল আওয়ামী লীগ, এখন তা করবে বিএনপি!
বিএনপি যে আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া মানবে না, তা আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে। আবার আওয়ামী লীগ এ নিয়ে ভালো-খারাপ যে উদ্যোগই নিক না কেন, বিএনপি যে তা মেনে নেবে না, সেটাও আওয়ামী লীগের জানা। বুঝেশুনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বলটি বিএনপির কোর্টে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করার কৌশল নিয়েছেন। কিন্তু কৌশল যত কৌশলেরই হোক, সরকারের এই অবস্থান রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই উসকে দেবে। আওয়ামী লীগ তবে কী করতে পারত?
সাধারণভাবে বললে বিএনটির অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে আগামী নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। আদালত যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বিচার বিভাগকে জড়িত না করার কথা বলেছেন, আবার বিএনপিও যেহেতু বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে, তাই নতুন একটি পথ খুঁজে বের করার কোনো বিকল্প নেই। বিএনপির কাছ থেকে এই প্রস্তাবের অপেক্ষা না করে তাই আওয়ামী লীগেরই উচিত ছিল একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ফর্মুলা জাতির সামনে তুলে ধরা। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এই কাজটি করে শুভ বোধের পরিচয় দিতে পারে। বিএনপি তা মানবে কি না, সে ঝুঁকি নিশ্চয়ই থাকবে, কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলা দিতে পারে, তবে অযৌক্তিক কোনো দাবি করে বিএনপি তখন খুব সুবিধা আদায় করতে পারবে না। জনগণের বিচার-বিবেচনা বোধের প্রতি আস্থা রেখে এই কাজটি করলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের লাভবান হওয়ারই কথা।
নির্বাচনের সময় কিন্তু জনগণের বিচারটাকেই রাজনৈতিক দলগুলোকে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে হয়। আগামী নির্বাচনের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে জনগণের ওপর আস্থা রাখার কাজটি কি আওয়ামী লীগ করবে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য বিএনপিকে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে, হরতালের ডাক দিতে হলো—এর চেয়ে পরিহাস আর কী হতে পারে! কার হরতাল কে ডাকে! কিন্তু বাস্তবতা এমনই। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বিএনপি আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রক্ষার জন্য জনগণকে হরতালে শামিল করতে চাইছে, তা কেউ জানে না। বর্তমানে সংবিধানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রয়েছে, সেটাই টিকিয়ে রাখতে চাইছে? বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিষয়টি তো তাহলে মেনে নিতে হবে। যদি আদালতের পরামর্শ অনুযায়ী বিচার বিভাগকে জড়িত না করার বিষয়টি যৌক্তিক মনে করা হয়, সে ক্ষেত্রে নতুন একটি ফর্মুলা তো জনগণের সামনে হাজির করতে হবে। এর আগেই হরতালের ডাক দেওয়াটা কি যৌক্তিক হলো? সংসদে গিয়ে প্রস্তাব দিলে সবচেয়ে ভালো, এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর একটি সিদ্ধান্তে নিশ্চয়ই আসা যাবে। সংসদে না গেলে গণমাধ্যমের সামনেও একটি ফর্মুলা হাজির করতে পারে বিএনপি। আওয়ামী লীগ বিএনপির প্রস্তাব মানবে কি মানবে না, সেই আশঙ্কাও নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য একটি প্রস্তাব দিয়ে জনগণের বিচার-বিবেচনার ওপর ভরসা করতে সমস্যা কোথায়?
জনগণের বিচার-বিবেচনার ওপর যদি সরকারি দল ও বিরোধী দলের আস্থা না থাকে, তবে তারা জনগণের সমর্থন আশা করে কোন মুখে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments