দাহকালের কথা-ফরমালিন by মাহমুদুজ্জামান বাবু

রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল। কেবিন নম্বর ১৩০৭। ২৪ মে সকাল-দুপুরের মাঝামাঝি সময়ে আড়ষ্ট পায়ে গিয়ে ওই কেবিনের সামনে দাঁড়াই। হাসপাতালের তথ্যকেন্দ্র আমাকে জানিয়েছে, এখানেই আছেন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী আজম খান। ভেজানো দরজায় টোকা দিই।

সাড়া মেলে না। হাতের তালু দিয়ে ঠেললে দরজা খুলে যায় অনেকটা; ভেতরে আমি ঢুকে যাই কিন্তু কেবিনে কাউকে দেখি না। বেরিয়ে এসে দরজায় লেখা নম্বর মেলাই। হ্যাঁ, ১৩০৭। ঠিকই তো আছে। করিডরের মাথায় দায়িত্ব পালনরত চিকিৎসা সহযোগী জানালেন, আজম খানকে সিটি স্ক্যান করতে নেওয়া হয়েছে অন্য ফ্লোরে এবং তিনি এই কেবিনেই ফিরবেন। হাসপাতালে আসার আগে ভেবেছিলাম, আরও অনেক পরিচিত মুখ এখানে দেখতে পাব। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। নিঃসঙ্গ ১৩০৭ নম্বর কেবিনের সামনের করিডরে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। একা।
২০০৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকার গুলশানের ওয়ান্ডারল্যান্ডে গান গাইতে গেছি। বিকেলের সূর্য তখন সন্ধ্যার হাত ধরে হাঁটছে। অগ্রজ শিল্পী আছেন আরও তিনজন। তাঁদেরই একজন আজম খান। আয়োজকদের একজন এসে জানালেন, নিয়ম ভেঙে দুজন অগ্রজ শিল্পী আমার আগেই গাইতে চান, কারণ তাঁদের আরও দুই জায়গায় বায়না করা আছে। তাঁরা চলে যাবেন। নিয়ম ভাঙার কথা বললাম। কারণ নিয়ম হলো অনুজ শিল্পী বা গায়কেরাই আগে মঞ্চে ওঠেন, যদি কোথাও অনুজ-অগ্রজ মিশেল থাকে। তো, আমি বিজয় দিবসের ঔদার্যে সম্মতি দিলাম। তিনজনের বাকি একজনের নাম আজম খান। এর আগে আমি এমন কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি, যেখানে আজম খানও গাইবেন, আমিও গাইব। আজ আমাদের দেখা হবে। আজ মহান বিজয় দিবস। আজম খান মুক্তিযোদ্ধা। চাইলে আজম খানও আমার আগে গাইবেন আজ। কিন্তু তাঁর আগে আমি তাঁকে কাছ থেকে দেখতে চাই।
অতিথিকক্ষের পাশে আর একটি ছোট্ট পরিসরে একা বসে ছিলেন তিনি। বাইরের মঞ্চে অগ্রজ শিল্পীদের একজন তখন দেশাত্মবোধক গান গাইছেন। আমি আজম খানের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তিনি চেয়ারে বসে ছিলেন। হাসি চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘বসো।’ তাঁর উল্টো দিকে বসে আমি তাঁকে দেখি। আমার মনে পড়তে থাকে তাঁর গাওয়া অসংখ্য গানের লাইন, সুর ও সংগীত। আমি বলি, ‘আজম ভাই, আপনি কি আমার আগে গাইতে চান?’ আজম খান হাসেন, বলেন, ‘একই কথা। তুমি কী চাও?’ আমি বলি, ‘আগে গাইতে চাই। আপনি গেয়ে ফেললে তো আমার গান শোনার জন্য কেউ থাকবে না।’ আবার সেই ঝকঝকে দাঁতের হাসি। ‘শোনো মিয়া, তুমি হইলা ফাইটার। আমি তোমারে খেয়াল করি। আমিও ফাইটার। যুদ্ধে গেছিলাম। এই দেখো, হাতে গুলির দাগ।’ আজম খান ডান করতল কনুই পর্যন্ত মেলে দেন টেবিলের ওপর। আলো-আঁধারিতে আমি তাঁর হাতে গুলির দাগ খুঁজি। প্রায় ফিসফিস স্বরে কথা বলেন পপসম্রাট, ‘আপস কইরো না। আমিও করি নাই। করব না।’
করিডরের বাঁকে একটা হুইলচেয়ার উঁকি দিলে আমি এগোই। হ্যাঁ, আজম খান। আমাকে দেখে চেনার ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন। ক্যানসারের ছোবলে আরও শীর্ণ হয়ে যাওয়া একজন যোদ্ধার পেছনে পেছনে কেবিনে ঢুকে পড়ি। তাঁর ছোট মেয়ে ইমা আর সুহূদ মতিন সকালের নাশতার আয়োজন সাজাতে থাকে। টলমল পায়ে আজম খান উঠে দাঁড়ান কেবিনের উত্তরমুখী কাচের বিশাল জানালার পাশে। আকাশে জ্যৈষ্ঠের মেঘ। জানালা দিয়ে বহুদূর দেখা যায়। মেঘলা মেঘলা গাছপালা। নাশতা শেষে বিছানায় আধশোয়া আজম খানকে দেখতে আসেন বড় ভাই ও বরেণ্য সুরকার-সংগীত পরিচালক আলম খানের স্ত্রী, আজম খানের ভাবি। তাঁর অনুযোগ, তিনি ফলমূল আনতে পারলেন না, এই হাসপাতালে ওসব আনা যায় না। শুনে আজম খান অস্বস্তিতে মাথা নাড়েন। বলেন, ‘ভালো করেছেন, আনেন নাই। সব তো ফরমালিন দেওয়া। ফরমালিন খাইয়াই তো এই সব কঠিন অসুখ হইতেছে মানুষের। দেশটারে ফরমালিনই খাইলো।’ এতক্ষণে আজম খানকে ক্লান্ত দেখায়। যোদ্ধারাও কখনো কখনো ক্লান্ত হয়।
২৯ মে ঢাকায় ‘বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং র্যাব বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টাসহ বেশ কজন সুশিক্ষিত মানুষ র্যাবের পক্ষে ইতিবাচক কথা বলেছেন। বসুন্ধরা গ্রুপের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান-এর সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েও লিমনের বেঁচে থাকা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আর র্যাব বিলুপ্তির বিরোধিতা করেছেন। মনে পড়ে, মিলন গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হওয়ার পরপরই র্যাবের কমান্ডার মেজর সোহায়েল বলেছিলেন, আল্লাহর রহমতে এবার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। পায়ের ওপর দিয়ে গেছে।
বিতর্কটা ছিল মানবাধিকার নিয়ে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে। নীরব থাকলেন আমাদের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী। কারণ, পাছে সরকার অসন্তুষ্ট হয়। চিকিৎসক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, ফরমালিন পচনশীল ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। তাই ফরমালিনযুক্ত কোনো কিছু পচে না। পচলেও গন্ধ ছড়ায় না।
আজম ভাই, আমরা ঠিক আছি। আমাদের কিছুই পচে নাই।
মাহমুদুজ্জামান বাবু : গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.