বিশেষ সাক্ষাৎকার-বাড়তি জনসংখ্যার কারণেই আমাদের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা by এ কে এম নূর-উন-নবী
এ কে এম নূর-উন-নবীর জন্ম দিনাজপুরে, ১৯৫৩ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮১ সালে। ১৯৮৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেমোগ্রাফিতে স্নাতকোত্তর। ১৯৮৫ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
কমনওয়েলথ বৃত্তির অধীনে ১৯৯১ সালে কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেমোগ্রাফিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৮ সালে তাঁর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ খোলা হয় এবং তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন হিসেবে বদলি হন ২০০০ সালে। এখনো তিনি অধ্যাপক হিসেবে সেই বিভাগে কর্মরত। তিনি বাংলাদেশ পপুলেশন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং ন্যাশনাল পপুলেশন কাউন্সিলের একজন সদস্য।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো সম্প্রতি পরিচালিত আদমশুমারির ভিত্তিতে সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৪ কোটি ২৩ লাখ। কিন্তু আমরা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, এমনকি সরকারেরও বিভিন্ন উৎস থেকে জানতাম যে লোকসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। এই বিশাল তারতম্যকে ঘিরে দেশে বেশ একটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে; সেই বিতর্কে এমনকি সরকারের কৃষিমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীকেও জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। আপনি কি বলবেন এমন বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ কী করে তৈরি হলো?
এ কে এম নূর-উন-নবী আমাদের সবারই ধারণা ছিল, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই আদমশুমারির আগে সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রীসহ অন্য সবাই ১৬ কোটির কথাই বলতেন। এখন বলা হচ্ছে ১৪ কোটি ২৩ লাখ। জনসংখ্যা আসলে কত, এটা জানা যাবে কীভাবে? একটা হলো সরাসরি গণনা করে। পৃথিবীর কোনো দেশেই জনসংখ্যা গণনা করে প্রকৃত সংখ্যাটি জানা যায় না—আদমশুমারিতে কম গণনা, বেশি গণনা হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিচ্যুতির মাত্রাটা কী? গণনার বাইরে কি খুব বেশি মাত্রায় মানুষ রয়ে যাচ্ছে? নাকি বাস্তবতার মোটামুটি কাছাকাছি যাওয়া যাচ্ছে? সেটা পরিমাপ করা হয় একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, সেটাকে বলে পোস্ট-এনিউম্যারেশন চেক বা গণনা-পরবর্তী মূল্যায়ন। এই গণনা-পরবর্তী প্রক্রিয়ায় আমরা দেখতে পাই, কত শতাংশ মানুষ গণনার বাইরে থেকেছে। ১৯৭৪ সালে দেখা গেছে, প্রায় ৭ শতাংশ মানুষ গণনাভুক্ত হয়নি। ১৯৮১ সালের আদমশুমারিতে গণনাভুক্ত হয়নি ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ১৯৯১ সালে এটা ছিল ৫ শতাংশের কাছাকাছি, ২০০১ সালেও ৫ শতাংশের কাছাকাছি। এবার আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে-শুনতে পাচ্ছি, অনেকের বাসায় গণনাকারীরা যাননি। এটা যদি সাধারণ অবস্থা হয়, তাহলে এবার গণনার বাইরে রয়ে গেছেন এমন মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার কথা।
প্রথম আলো কত শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য?
এ কে এম নূর-উন-নবী: যেকোনো সামাজিক গবেষণায় ৫ শতাংশ হচ্ছে গ্রহণযোগ্য সীমা। অর্থাৎ ৫ শতাংশ যদি ভুল হয়, তাহলে এটা গ্রহণযোগ্য। এর বেশি হলে প্রশ্ন দেখা দেয়। ৭ শতাংশ, ৯ শতাংশ হলে আমরা বলতে পারি, এই গণনা সঠিক হয়নি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত—এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সূত্রে একটা করে সংখ্যা পেয়েছি, যেমন—জাতিসংঘ, সিআইএ, বিশ্বব্যাংক, পপুলেশন রেফারেন্স ব্যুরো ইত্যাদি। এদের দেওয়া সংখ্যাগুলো মোটামুটি কাছাকাছি—১৫ কোটি ৮০ লাখ থেকে ১৬ কোটি ৪৪ লাখ পর্যন্ত। কিন্তু আমরা আদমশুমারি থেকে পেলাম ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। এই সংখ্যা ওগুলোর থেকে অনেক কম।
প্রথম আলো আপনি এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না?
এ কে এম নূর-উন-নবী এটা গ্রহণযোগ্য না অগ্রহণযোগ্য, সে বিষয়ে মত দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। কারণ, এটি প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া সংখ্যা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো আদমশুমারির এই প্রাথমিক প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় বলেছে, ‘আমরা যা পেয়েছি, তা-ই দিয়েছি। এর মধ্যে আমরা কোনো ছলচাতুরী করিনি।’ সম্পূর্ণ সত্য কথা। কারণ, যাদের গণনার মধ্যে নেওয়া হয়নি, তারা তো এই সংখ্যার মধ্যে নেই। পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব বলেছেন, ‘আমরা যদি গণনা-পরবর্তী মূল্যায়নে দেখি যে ৭ শতাংশ ত্রুটি হয়েছে, তাহলে আমরা এটিও গ্রহণ করব।’ এটা শুনে আশা জাগে যে ত্রুটি শোধরাবার একটা পদ্ধতি তো আছেই এবং সেই পদ্ধতিটা তো অনুসরণ করা হচ্ছে। যতটা গণনার বাইরে থেকে গেছে, তা যদি সংযুক্ত করা হয়, তাহলে যে সংখ্যাটা পাওয়া যাবে, তা নিশ্চয়ই ১৪ কোটি ২৩ লাখের চেয়ে অনেক বেশি হবে।
প্রথম আলো শুমারি বা গণনা-পরবর্তী মূল্যায়ন কেমন হতে পারে?
এ কে এম নূর-উন-নবী পরিসংখ্যান ব্যুরো নিজে এবার এই কাজটা করছে না—এটা একটা ভালো উদ্যোগ। কাজটা করছে বিআইডিএস। আমরা চাই তারা যেন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রভাবমুক্তভাবে কাজটা করে। বিআইডিএসের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন আছে, যেমন—তারা গণনা-পরবর্তী মূল্যায়নের জন্য বেছে নিয়েছে মাত্র ২৮০টি পিএসইউ (প্রাইমারি স্যামপ্লিং ইউনিট)। আদমশুমারি হয়েছে যেখানে প্রায় তিন লাখ পিএসইউ দিয়ে, সেখানে গণনা-পরবর্তী মূল্যায়নের জন্য ২৮০টি পিএসইউ যথেষ্ট নয়। বলা হতে পারে, গরিব দেশ, অত অর্থ নেই। মানলাম, তবে বিআইডিএস তার যেটুকু সাধ্য আছে, তা দিয়েই যেন সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে এবং প্রভাবমুক্তভাবে কাজটা সম্পন্ন করে। এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোকে তারা যে হিসাবটা দেবে, ব্যুরো যেন সততার সঙ্গে সেটা সংযুক্ত করে নেয়, সেখানে যেন আবার কম-বেশি না করা হয়। ৫ শতাংশের ওপরে চলে গেলে তো তাদের শুমারির সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তাই তাঁরা ৫ শতাংশের নিচেই চেপে রাখার চেষ্টা করবেন—এ রকম যেন না করা হয়, এই সৎ সাহস পরিসংখ্যান ব্যুরোকে রাখতে হবে।
প্রথম আলো প্রাথমিক প্রতিবেদনেই যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করছে ৯৬৪ জন মানুষ। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে খুব সম্ভব এটা এক হাজারের বেশি হবে। এই জনঘনত্ব এবং সামনের দিনগুলোতে এর ক্রমাগত বৃদ্ধির পরিণাম কী হতে পারে?
এ কে এম নূর-উন-নবী জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার দেওয়া তথ্যে আমরা দেখেছি, কোথাও এই সংখ্যা ১১২৬, কোথাও ১১৪০, মোট কথা ১১০০-এর ওপর। এখন পরিসংখ্যান ব্যুরো মোট জনসংখ্যা বলছে ১৪ কোটি ২৩ লাখ, সেই হিসাবে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৬৪ জনের বাস—এই হিসাব ঠিক আছে। কিন্তু আবারও বলি, এই হিসাব চূড়ান্ত নয়। চূড়ান্ত হিসাবে এই সংখ্যা এক হাজারের ওপরে হবে। কিন্তু ৯৬৪ জনই অনেক বেশি। হংকং-সিঙ্গাপুরের মতো নগররাষ্ট্রগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশের জনঘনত্ব এখন বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ সারিতে। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন, সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১৪০ জন। ভারত দ্বিতীয় জনবহুল দেশ, সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৬২ জনের বাস। আর আমাদের দেশে ৯৬৪ জন। আমাদের তো শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা!
প্রথম আলো বেশি জনসংখ্যাকে কেউ কেউ সমস্যা মনে করেন না। তাঁরা বলেন, জনসংখ্যা হচ্ছে জনসম্পদ, এই জনসম্পদকে কাজে লাগানোই প্রকৃত ব্যাপার।
এ কে এম নূর-উন-নবী আয়তন ও সম্পদের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে আমাদের জনঘনত্ব ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে কত ক্ষেত্রে কতভাবে হয়, তা বলে শেষ করা যাবে না। আমরা সবাই দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, সেগুলোর অধিকাংশই অতিরিক্ত জনঘনত্বের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। একদিন কারওয়ান বাজার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে আমার এক ঘণ্টা সময় লাগল। ১০ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে কেন এক ঘণ্টা লাগবে? জনঘনত্ব বেশি হলে কী ঘটতে পারে, এটা তার একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত। আমরা পরিবেশ রক্ষার কথা বলছি; জনঘনত্ব এত বেশি হলে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাঁওড়-পুকুর-জলাশয় ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাচ্ছে, বেদখল হয়ে যাচ্ছে, বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে; প্রতিবছর কৃষিজমি কমে যাচ্ছে ১ শতাংশ হারে; জনস্বাস্থ্য রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ছে; মানুষের কর্মসংস্থানের সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে; অপরাধ বাড়ছে, মানুষে-মানুষে হিংসা হানাহানি বাড়ছে; দুর্নীতি বেড়ে চলেছে লাগামহীনভাবে—এসবই ঘটছে অতিরিক্ত জনঘনত্বের ফল। আমরা খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলি, এই ছোট্ট দেশে এত দ্রুত হারে যদি কৃষিজমির পরিমাণ কমে যেতে থাকে, তাহলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন হবে কীভাবে? কত দিন আমরা খাদ্য আমদানি করব? সারা বিশ্বেই খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে সংকট চলছে; বিশ্ববাজারের গতিপ্রকৃতি ভীষণ অনিশ্চিত। সংক্ষেপে, জনঘনত্বের ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা বলে শেষ করা যাবে না।
প্রথম আলো মার্কিন বিজ্ঞানী জন ক্যালহুনের লেখা একটি গবেষণা প্রবন্ধের শিরোনাম ‘পপুলেশন ডেনসিটি অ্যান্ড সোশ্যাল প্যাথলজি’। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, অতিরিক্ত জনঘনত্বের ফলে সামাজিকভাবে ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে আমরা কি প্যাথলজিক্যাল কন্ডিশনের মধ্যে আছি?
এ কে এম নূর-উন-নবী আমাদের সমাজে ভয়াবহ রকমের যেসব অন্যায়-অবিচার-অনাচার ঘটছে, রোমহর্ষক যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তাতে তো মনে হয় আমরা একটা প্যাথলজিক্যাল কন্ডিশনের মধ্য দিয়েই চলেছি। কোনো কিছুই এখানে সুস্থ, স্বাভাবিক নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধি যে একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছে, তা তো নয়। প্রতিবছর আমাদের লোকসংখ্যা বাড়ছে গড়ে ১৮ থেকে ২০ লাখ। ১০ বছর পরে আমাদের অবস্থা কী হবে, তা ভেবে ভীষণ উদ্বিগ্ন হতে হয়।
প্রথম আলো তাহলে আমাদের উপায় কী? এই সমস্যার সমাধান করা যাবে কীভাবে?
এ কে এম নূর-উন-নবী সমাধান বড় কঠিন। সমস্যাটা কিছুটা লাঘব হতে পারে, যদি আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগটাকে বেগবান করতে পারি।
প্রথম আলো কিন্তু মনে হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বোধ হয় থেমে গেছে। পরিবার পরিকল্পনার কথা তো এখন আর তেমন শোনা যায় না।
এ কে এম নূর-উন-নবী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ থেমে যায়নি, তবে এর গতি ও দৃশ্যমানতা কমে গেছে। পরিবার পরিকল্পনার উদ্যোগে আমরা বেশ সাফল্য অর্জন করেছি। ১৯৭৫ সালে একজন নারী সন্তান জন্ম দিতেন গড়ে ছয়টির বেশি। এখন এটা কমে হয়েছে ২ দশমিক ৫। কিন্তু এই জন্মহারও অনেক বেশি; কারণ, আমাদের মোট জনসংখ্যা ইতিমধ্যে বেড়ে অনেক হয়েছে। বড় জনসংখ্যা যদি অল্প হারেও বাড়ে, তবু মোট বৃদ্ধিটা হয় অনেক। ফলে আমাদের মোট জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে আবার শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, গড় আয়ু বেড়েছে, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে। তাই ২ দশমিক ৫ জন্মহারও অনেক বেশি। আরও একটা সমস্যা আছে, সেটাকে বলে পপুলেশন মোমেন্টাম। যদি জন্মহার ২ দশমিক ১ শতাংশেও নামিয়ে আনতে পারি, তবু কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি থেমে যাবে না। এটাকে আরও কমিয়ে ১ দশমিক ৬ বা ৭ শতাংশে নামাতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বেগবান করতে হবে, এটাকে অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে। লোকবল, বাজেট ইত্যাদি বাড়াতে হবে, নতুনভাবে কার্যক্রম পরিকল্পনা করতে হবে। ৬২ শতাংশ মা আর সন্তান নিতে চান না, কিন্তু গর্ভধারণ এড়ানোর জন্য যে দ্রব্যসামগ্রী প্রয়োজন, তা তাঁরা পাচ্ছেন না বলে আবার মা হচ্ছেন। এটি পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতার ছোট্ট একটি দৃষ্টান্ত। এ রকম আরও অনেক সমস্যা, সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি আছে, সেগুলো দূর করে পুরো কার্যক্রমে তীব্র গতিসঞ্চার করতে হবে।
প্রথম আলো পরিবার পরিকল্পনার সুফল পেতে তো দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। তার আগে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনে কী হবে? পাহাড়সমান সমস্যাগুলোর কী হবে?
এ কে এম নূর-উন-নবী জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। জনসংখ্যার সার্বিক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য বহু খাতভিত্তিক পরিকল্পনা ও কর্মোদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীকে মেধা ও পেশাভিত্তিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদক শক্তিতে পরিণত করতে হবে, যে কাজটি খুব সফলভাবে করতে পেরেছে চীন। জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার একটা অংশ হলো পরিবার পরিকল্পনা, আরেকটি হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন। এতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয় আছে। এই বহু খাতভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান মন্ত্রণালয়গুলোর কোনো একটির দ্বারা সম্ভব নয়, এ জন্য প্রয়োজন বহু খাতভিত্তিক আলাদা একটি মন্ত্রণালয়।
প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
এ কে এম নূর-উন-নবী: ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো সম্প্রতি পরিচালিত আদমশুমারির ভিত্তিতে সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৪ কোটি ২৩ লাখ। কিন্তু আমরা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, এমনকি সরকারেরও বিভিন্ন উৎস থেকে জানতাম যে লোকসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। এই বিশাল তারতম্যকে ঘিরে দেশে বেশ একটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে; সেই বিতর্কে এমনকি সরকারের কৃষিমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীকেও জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। আপনি কি বলবেন এমন বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ কী করে তৈরি হলো?
এ কে এম নূর-উন-নবী আমাদের সবারই ধারণা ছিল, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই আদমশুমারির আগে সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রীসহ অন্য সবাই ১৬ কোটির কথাই বলতেন। এখন বলা হচ্ছে ১৪ কোটি ২৩ লাখ। জনসংখ্যা আসলে কত, এটা জানা যাবে কীভাবে? একটা হলো সরাসরি গণনা করে। পৃথিবীর কোনো দেশেই জনসংখ্যা গণনা করে প্রকৃত সংখ্যাটি জানা যায় না—আদমশুমারিতে কম গণনা, বেশি গণনা হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিচ্যুতির মাত্রাটা কী? গণনার বাইরে কি খুব বেশি মাত্রায় মানুষ রয়ে যাচ্ছে? নাকি বাস্তবতার মোটামুটি কাছাকাছি যাওয়া যাচ্ছে? সেটা পরিমাপ করা হয় একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, সেটাকে বলে পোস্ট-এনিউম্যারেশন চেক বা গণনা-পরবর্তী মূল্যায়ন। এই গণনা-পরবর্তী প্রক্রিয়ায় আমরা দেখতে পাই, কত শতাংশ মানুষ গণনার বাইরে থেকেছে। ১৯৭৪ সালে দেখা গেছে, প্রায় ৭ শতাংশ মানুষ গণনাভুক্ত হয়নি। ১৯৮১ সালের আদমশুমারিতে গণনাভুক্ত হয়নি ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ১৯৯১ সালে এটা ছিল ৫ শতাংশের কাছাকাছি, ২০০১ সালেও ৫ শতাংশের কাছাকাছি। এবার আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে-শুনতে পাচ্ছি, অনেকের বাসায় গণনাকারীরা যাননি। এটা যদি সাধারণ অবস্থা হয়, তাহলে এবার গণনার বাইরে রয়ে গেছেন এমন মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার কথা।
প্রথম আলো কত শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য?
এ কে এম নূর-উন-নবী: যেকোনো সামাজিক গবেষণায় ৫ শতাংশ হচ্ছে গ্রহণযোগ্য সীমা। অর্থাৎ ৫ শতাংশ যদি ভুল হয়, তাহলে এটা গ্রহণযোগ্য। এর বেশি হলে প্রশ্ন দেখা দেয়। ৭ শতাংশ, ৯ শতাংশ হলে আমরা বলতে পারি, এই গণনা সঠিক হয়নি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত—এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সূত্রে একটা করে সংখ্যা পেয়েছি, যেমন—জাতিসংঘ, সিআইএ, বিশ্বব্যাংক, পপুলেশন রেফারেন্স ব্যুরো ইত্যাদি। এদের দেওয়া সংখ্যাগুলো মোটামুটি কাছাকাছি—১৫ কোটি ৮০ লাখ থেকে ১৬ কোটি ৪৪ লাখ পর্যন্ত। কিন্তু আমরা আদমশুমারি থেকে পেলাম ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। এই সংখ্যা ওগুলোর থেকে অনেক কম।
প্রথম আলো আপনি এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না?
এ কে এম নূর-উন-নবী এটা গ্রহণযোগ্য না অগ্রহণযোগ্য, সে বিষয়ে মত দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। কারণ, এটি প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া সংখ্যা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো আদমশুমারির এই প্রাথমিক প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় বলেছে, ‘আমরা যা পেয়েছি, তা-ই দিয়েছি। এর মধ্যে আমরা কোনো ছলচাতুরী করিনি।’ সম্পূর্ণ সত্য কথা। কারণ, যাদের গণনার মধ্যে নেওয়া হয়নি, তারা তো এই সংখ্যার মধ্যে নেই। পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব বলেছেন, ‘আমরা যদি গণনা-পরবর্তী মূল্যায়নে দেখি যে ৭ শতাংশ ত্রুটি হয়েছে, তাহলে আমরা এটিও গ্রহণ করব।’ এটা শুনে আশা জাগে যে ত্রুটি শোধরাবার একটা পদ্ধতি তো আছেই এবং সেই পদ্ধতিটা তো অনুসরণ করা হচ্ছে। যতটা গণনার বাইরে থেকে গেছে, তা যদি সংযুক্ত করা হয়, তাহলে যে সংখ্যাটা পাওয়া যাবে, তা নিশ্চয়ই ১৪ কোটি ২৩ লাখের চেয়ে অনেক বেশি হবে।
প্রথম আলো শুমারি বা গণনা-পরবর্তী মূল্যায়ন কেমন হতে পারে?
এ কে এম নূর-উন-নবী পরিসংখ্যান ব্যুরো নিজে এবার এই কাজটা করছে না—এটা একটা ভালো উদ্যোগ। কাজটা করছে বিআইডিএস। আমরা চাই তারা যেন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রভাবমুক্তভাবে কাজটা করে। বিআইডিএসের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন আছে, যেমন—তারা গণনা-পরবর্তী মূল্যায়নের জন্য বেছে নিয়েছে মাত্র ২৮০টি পিএসইউ (প্রাইমারি স্যামপ্লিং ইউনিট)। আদমশুমারি হয়েছে যেখানে প্রায় তিন লাখ পিএসইউ দিয়ে, সেখানে গণনা-পরবর্তী মূল্যায়নের জন্য ২৮০টি পিএসইউ যথেষ্ট নয়। বলা হতে পারে, গরিব দেশ, অত অর্থ নেই। মানলাম, তবে বিআইডিএস তার যেটুকু সাধ্য আছে, তা দিয়েই যেন সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে এবং প্রভাবমুক্তভাবে কাজটা সম্পন্ন করে। এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোকে তারা যে হিসাবটা দেবে, ব্যুরো যেন সততার সঙ্গে সেটা সংযুক্ত করে নেয়, সেখানে যেন আবার কম-বেশি না করা হয়। ৫ শতাংশের ওপরে চলে গেলে তো তাদের শুমারির সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তাই তাঁরা ৫ শতাংশের নিচেই চেপে রাখার চেষ্টা করবেন—এ রকম যেন না করা হয়, এই সৎ সাহস পরিসংখ্যান ব্যুরোকে রাখতে হবে।
প্রথম আলো প্রাথমিক প্রতিবেদনেই যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করছে ৯৬৪ জন মানুষ। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে খুব সম্ভব এটা এক হাজারের বেশি হবে। এই জনঘনত্ব এবং সামনের দিনগুলোতে এর ক্রমাগত বৃদ্ধির পরিণাম কী হতে পারে?
এ কে এম নূর-উন-নবী জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার দেওয়া তথ্যে আমরা দেখেছি, কোথাও এই সংখ্যা ১১২৬, কোথাও ১১৪০, মোট কথা ১১০০-এর ওপর। এখন পরিসংখ্যান ব্যুরো মোট জনসংখ্যা বলছে ১৪ কোটি ২৩ লাখ, সেই হিসাবে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৬৪ জনের বাস—এই হিসাব ঠিক আছে। কিন্তু আবারও বলি, এই হিসাব চূড়ান্ত নয়। চূড়ান্ত হিসাবে এই সংখ্যা এক হাজারের ওপরে হবে। কিন্তু ৯৬৪ জনই অনেক বেশি। হংকং-সিঙ্গাপুরের মতো নগররাষ্ট্রগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশের জনঘনত্ব এখন বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ সারিতে। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন, সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১৪০ জন। ভারত দ্বিতীয় জনবহুল দেশ, সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৬২ জনের বাস। আর আমাদের দেশে ৯৬৪ জন। আমাদের তো শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা!
প্রথম আলো বেশি জনসংখ্যাকে কেউ কেউ সমস্যা মনে করেন না। তাঁরা বলেন, জনসংখ্যা হচ্ছে জনসম্পদ, এই জনসম্পদকে কাজে লাগানোই প্রকৃত ব্যাপার।
এ কে এম নূর-উন-নবী আয়তন ও সম্পদের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে আমাদের জনঘনত্ব ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে কত ক্ষেত্রে কতভাবে হয়, তা বলে শেষ করা যাবে না। আমরা সবাই দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, সেগুলোর অধিকাংশই অতিরিক্ত জনঘনত্বের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। একদিন কারওয়ান বাজার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে আমার এক ঘণ্টা সময় লাগল। ১০ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে কেন এক ঘণ্টা লাগবে? জনঘনত্ব বেশি হলে কী ঘটতে পারে, এটা তার একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত। আমরা পরিবেশ রক্ষার কথা বলছি; জনঘনত্ব এত বেশি হলে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাঁওড়-পুকুর-জলাশয় ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাচ্ছে, বেদখল হয়ে যাচ্ছে, বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে; প্রতিবছর কৃষিজমি কমে যাচ্ছে ১ শতাংশ হারে; জনস্বাস্থ্য রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ছে; মানুষের কর্মসংস্থানের সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে; অপরাধ বাড়ছে, মানুষে-মানুষে হিংসা হানাহানি বাড়ছে; দুর্নীতি বেড়ে চলেছে লাগামহীনভাবে—এসবই ঘটছে অতিরিক্ত জনঘনত্বের ফল। আমরা খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলি, এই ছোট্ট দেশে এত দ্রুত হারে যদি কৃষিজমির পরিমাণ কমে যেতে থাকে, তাহলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন হবে কীভাবে? কত দিন আমরা খাদ্য আমদানি করব? সারা বিশ্বেই খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে সংকট চলছে; বিশ্ববাজারের গতিপ্রকৃতি ভীষণ অনিশ্চিত। সংক্ষেপে, জনঘনত্বের ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা বলে শেষ করা যাবে না।
প্রথম আলো মার্কিন বিজ্ঞানী জন ক্যালহুনের লেখা একটি গবেষণা প্রবন্ধের শিরোনাম ‘পপুলেশন ডেনসিটি অ্যান্ড সোশ্যাল প্যাথলজি’। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, অতিরিক্ত জনঘনত্বের ফলে সামাজিকভাবে ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে আমরা কি প্যাথলজিক্যাল কন্ডিশনের মধ্যে আছি?
এ কে এম নূর-উন-নবী আমাদের সমাজে ভয়াবহ রকমের যেসব অন্যায়-অবিচার-অনাচার ঘটছে, রোমহর্ষক যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তাতে তো মনে হয় আমরা একটা প্যাথলজিক্যাল কন্ডিশনের মধ্য দিয়েই চলেছি। কোনো কিছুই এখানে সুস্থ, স্বাভাবিক নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধি যে একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছে, তা তো নয়। প্রতিবছর আমাদের লোকসংখ্যা বাড়ছে গড়ে ১৮ থেকে ২০ লাখ। ১০ বছর পরে আমাদের অবস্থা কী হবে, তা ভেবে ভীষণ উদ্বিগ্ন হতে হয়।
প্রথম আলো তাহলে আমাদের উপায় কী? এই সমস্যার সমাধান করা যাবে কীভাবে?
এ কে এম নূর-উন-নবী সমাধান বড় কঠিন। সমস্যাটা কিছুটা লাঘব হতে পারে, যদি আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগটাকে বেগবান করতে পারি।
প্রথম আলো কিন্তু মনে হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বোধ হয় থেমে গেছে। পরিবার পরিকল্পনার কথা তো এখন আর তেমন শোনা যায় না।
এ কে এম নূর-উন-নবী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ থেমে যায়নি, তবে এর গতি ও দৃশ্যমানতা কমে গেছে। পরিবার পরিকল্পনার উদ্যোগে আমরা বেশ সাফল্য অর্জন করেছি। ১৯৭৫ সালে একজন নারী সন্তান জন্ম দিতেন গড়ে ছয়টির বেশি। এখন এটা কমে হয়েছে ২ দশমিক ৫। কিন্তু এই জন্মহারও অনেক বেশি; কারণ, আমাদের মোট জনসংখ্যা ইতিমধ্যে বেড়ে অনেক হয়েছে। বড় জনসংখ্যা যদি অল্প হারেও বাড়ে, তবু মোট বৃদ্ধিটা হয় অনেক। ফলে আমাদের মোট জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে আবার শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, গড় আয়ু বেড়েছে, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে। তাই ২ দশমিক ৫ জন্মহারও অনেক বেশি। আরও একটা সমস্যা আছে, সেটাকে বলে পপুলেশন মোমেন্টাম। যদি জন্মহার ২ দশমিক ১ শতাংশেও নামিয়ে আনতে পারি, তবু কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি থেমে যাবে না। এটাকে আরও কমিয়ে ১ দশমিক ৬ বা ৭ শতাংশে নামাতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বেগবান করতে হবে, এটাকে অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে। লোকবল, বাজেট ইত্যাদি বাড়াতে হবে, নতুনভাবে কার্যক্রম পরিকল্পনা করতে হবে। ৬২ শতাংশ মা আর সন্তান নিতে চান না, কিন্তু গর্ভধারণ এড়ানোর জন্য যে দ্রব্যসামগ্রী প্রয়োজন, তা তাঁরা পাচ্ছেন না বলে আবার মা হচ্ছেন। এটি পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতার ছোট্ট একটি দৃষ্টান্ত। এ রকম আরও অনেক সমস্যা, সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি আছে, সেগুলো দূর করে পুরো কার্যক্রমে তীব্র গতিসঞ্চার করতে হবে।
প্রথম আলো পরিবার পরিকল্পনার সুফল পেতে তো দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। তার আগে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনে কী হবে? পাহাড়সমান সমস্যাগুলোর কী হবে?
এ কে এম নূর-উন-নবী জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। জনসংখ্যার সার্বিক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য বহু খাতভিত্তিক পরিকল্পনা ও কর্মোদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীকে মেধা ও পেশাভিত্তিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদক শক্তিতে পরিণত করতে হবে, যে কাজটি খুব সফলভাবে করতে পেরেছে চীন। জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার একটা অংশ হলো পরিবার পরিকল্পনা, আরেকটি হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন। এতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয় আছে। এই বহু খাতভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান মন্ত্রণালয়গুলোর কোনো একটির দ্বারা সম্ভব নয়, এ জন্য প্রয়োজন বহু খাতভিত্তিক আলাদা একটি মন্ত্রণালয়।
প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
এ কে এম নূর-উন-নবী: ধন্যবাদ।
No comments