সদরে অন্দরে-বেত্রাঘাত, নাকি সভ্যতার মুখেই চপেটাঘাত by মোস্তফা কামাল
গরিব হওয়া কি অপরাধ? দারিদ্র্যের কারণে কিছু অর্জন করতে না পারার অপরাধে কি শাস্তি পেতে হবে? আর শাস্তিও যেমন-তেমন নয়, মারতে মারতে একেবারে হাসপাতালে পাঠানোর মতো অবস্থা তৈরি করতে হবে কি শিক্ষার্থীকে? প্রশ্নগুলো সহজেই চলে আসে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার ধুল্যা বিএম উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র মো.
জুলহাস মিয়ার শিক্ষকের হাতে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর। জুলহাসের অপরাধ, সে গরিব কৃষকের সন্তান। দারিদ্র্যের কারণে সে স্কুল ড্রেস কিনতে পারেনি। বাবা বলেছিলেন, বোরো ধান ঘরে এলে সন্তানকে স্কুল ড্রেস কিনে দেবেন। কিন্তু স্কুল তা মানবে কেন! তাই বুঝি অ্যাসেম্বলিতেই হয়ে গেল বিচার। শত শত শিক্ষার্থীর সামনে জুলহাসকে পেটাতে থাকেন গেম টিচার। বেতের পিটুনি খেয়ে একপর্যায়ে জুলহাস জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। হাঁটুর নিচে ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে তার। জুলহাসকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় এ ঘটনার পর।
জুলহাসসহ অন্য কয়েক শিক্ষার্থী স্কুল ড্রেস পরে না আসার কারণে শিক্ষকের কাছে আবেদন জানায় ওই দিনের জন্য মাফ করে দিতে। কিন্তু ক্রীড়া শিক্ষক মাফ না করে শাস্তি দেন। শুধু তা-ই নয়, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বক্তব্যকেও অবৈজ্ঞানিক ও অশিক্ষকসুলভ মনে হয়েছে। দেশে শিক্ষার্থীকে শারীরিক আঘাত করার জন্য যেখানে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করার বিধান আছে, সেখানে তিনি বলেছেন, তাদের পিটিয়েও নাকি ঠিক রাখা যায় না। তার মানে হচ্ছে, প্রধান শিক্ষকও এভাবে শারীরিক ও মানসিক শাস্তিদানকে সমর্থন করছেন।
প্রায়ই পত্রিকায় সংবাদ দেখা যায়, মক্তবের শিক্ষার্থীকে শাস্তি হিসেবে শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছে। কোথাও বা চুল কেটে দেওয়া হয়েছে- এমন খবরও আমাদের পড়তে হয়। এমন ছবিও দেখা যায়, কিশোরকে কপালে চাড়া দিয়ে সূর্যমুখী করে রাখা হয়েছে শাস্তি হিসেবে। যাঁরা পত্রিকা পড়েন, তাঁদের মনে থাকার কথা এসব সংবাদ গত বছরও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। আজকের বৈদ্যুতিক মাধ্যমে সরাসরি প্রচারের সুবিধা থাকার কারণে এ ধরনের লোমহর্ষক চিত্র প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা কমবেশি সবারই আছে।
মানিকগঞ্জের এ ঘটনা এসব থেকে একটু ভিন্ন। কারণ মক্তবের শিক্ষক আর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। স্কুলের শিক্ষকদের বেশির ভাগই বিএড ডিগ্রি অর্জনকারী। তাঁদের সবাই উচ্চশিক্ষিত। শিক্ষাদান পদ্ধতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষার্থীর আত্মিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে তাঁদের প্রশিক্ষণ রয়েছে, যা মক্তবের শিক্ষকের নেই। এ কারণে মক্তব কিংবা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের আধুনিক ব্যবস্থা এখনো অনুপস্থিত। আর থাকলেও সেসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতে গোনা। এমন পরিস্থিতিতে কোনো উচ্চ বিদ্যালয় কিংবা মহাবিদ্যালয়ে এমন চিত্র দেখা রীতিমতো অনাকাঙ্ক্ষিত।
যে প্রধান শিক্ষক এই শাস্তিকে সমর্থন করলেন, তিনি শিশুমনস্তত্ত্ব বিষয়ে নিজেও লেখাপড়া করে এসেছেন। তিনি জানেন, কোনো শিক্ষার্থী যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শত্রু মনে করে, যদি কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষক শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাচর্চা হতে পারে না। কারণ শিক্ষার্থী কখনো ওই প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করতে পারে না। আর শিক্ষককেও সে আপনজন মনে করতে পারে না। এমনকি ওই শিক্ষককে সে নিজের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। সংগত কারণেই শত্রুর সঙ্গে সেও শত্রুর আচরণ করতে চাইবে। তাহলে একজন কিংবা দুজনের জন্যও কোনো প্রতিষ্ঠানের গোটা শিক্ষা-পরিবেশই বিঘি্নত হতে পারে।
অথচ বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের শারীরিক কিংবা মানসিক আঘাত করার ব্যাপারে আদালত থেকে স্পষ্ট রায় ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে এ ধরনের শাস্তিদান সংবিধানবিরোধী এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আদালতের এই রায়ের পর সংগত কারণেই বাংলাদেশে চিরদিন চলে আসা গুরু প্রদত্ত শাস্তির রীতি বাতিল বলে গণ্য হলো। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারকে এ বিষয়ে নিশ্চিত করার ব্যাপারেও নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জাতীয়ভাবে একটি কমিশনও যেন সরকার গঠন করে, যার মাধ্যমে এই বিধান কার্যকর হচ্ছে কি না তা দেখা হবে।
শিক্ষার্থীদের এই শাস্তিদানের ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডা, জাপান, সাউথ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীদের শাস্তিদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৩০টি স্টেটের স্কুলে শাস্তিদান নিষিদ্ধ ঘোষিত। আজকে পশ্চিমা বিশ্বে এই শাস্তির বিধান নিষিদ্ধ হলেও এটি ব্রিটিশদের দ্বারাই সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তাদের কারণে বাংলা-ভারত এলাকায় এটি পাকাপোক্ত হয়। যদিও এখানে গুরুভক্তির ঐতিহ্য সেই পুরনোকাল থেকেই চলে এসেছে। বাংলাদেশে বেত্রাঘাত সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও ডেনমার্কে ১৯৬৭, জার্মানিতে ১৯৮৩, রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর থেকে নিষিদ্ধ। ২০০৪ সালে কানাডায় সুপ্রিম কোর্ট একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৯ সালে চীনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, ফ্রান্সের স্কুলগুলোতে সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই বেত্রাঘাত নিষিদ্ধ। গ্রিসের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেত্রাঘাত নিষিদ্ধ হয় ১৯৯৮ সাল থেকে। ইতালিতে নিষিদ্ধ হয় ১৯২৮ সালে। তবে কিছু এশীয় দেশে এখনো এই শাস্তিদানকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়নি। কোথাও কোথাও শিক্ষাদানের পদ্ধতি হিসেবে বইখাতার মতোই প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি গবেষণার ফলকে নিজেরা প্রয়োগ করতে চায় না? যেমনটি আমাদের এখানকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল একটি পরিপত্র জারি করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিতকরণসংক্রান্ত নীতিমালা শিরোনামে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীকে হাত-পা কিংবা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করা না হয়। শিক্ষার্থীর দিকে ডাস্টার বা এ-জাতীয় কিছু ছুড়ে মারা না হয়। এমনকি আছাড় দেওয়া কিংবা চিমটি কাটার মতো কোনো শাস্তিও দেওয়া যাবে না। শরীরের কোনো স্থানে কামড় ইত্যাদিও দেওয়া যাবে না। এমনকি শিক্ষার্থীর মানসিক আঘাত হতে পারে এমন কোনো তিরস্কারও করা যাবে না। সোজা কথা, শিক্ষার্থীর প্রতি নেতিবাচক কোনো আচরণই করা যাবে না। শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষা গ্রহণকে আনন্দদায়ক মনে করে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
মনস্তাত্তি্বক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর কথা বলা হলেও আমাদের শিক্ষাদান পদ্ধতিতে তার প্রয়োগ খুব দেখা দেয়নি। গবেষণায় দেখা গেছে, ইতিবাচক পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষাদান করা গেলে শিক্ষার্থীকে যেভাবে আকৃষ্ট করা যায়, শাস্তি দিয়ে তা সম্ভব নয়। শাস্তিদান করলে শিক্ষার্থী বদমেজাজি ও ঝগড়াটে মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে পড়ে। লেখাপড়ার প্রতি অনীহা আসে। মনোযোগ কমে যায়। হতাশা তৈরি হয়। আন্তসম্পর্ক বিনষ্ট হয়। শ্রেণীকক্ষে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। সংগত কারণেই শ্রেণী পাঠ সম্পন্ন করতে পারে না যথাসময়ে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাকে বিব্রত করে।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীকে যদি আনন্দদায়ক পরিবেশের মধ্যে ইতিবাচক প্রক্রিয়ায় শিক্ষাদান করা যায়, তা হলে সে লেখাপড়াকে খেলাধুলার মতো গ্রহণ করবে। আর সেই অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষককে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারীদের। শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে, শিশুমনস্তত্ত্ব শিক্ষাদানের দর্শনস্বরূপ। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষকই শিশুমনস্তত্ত্বের দিকটি মান্য করেন না। আমরা মো. জুলহাসের মতো আর কোনো শিক্ষার্থীর অবস্থা হোক তা দেখতে চাই না। একই সঙ্গে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দিকেও তাকাতে হবে। যেখানে আর্থিক অসংগতি স্পষ্ট, সেখানে স্কুল ড্রেসের মতো বিষয়গুলো সম্পন্ন করার জন্য একটু সময় কি দেওয়া যায় না?
লেখক : সাংবাদিক
mhussain_71@yahoo.com
জুলহাসসহ অন্য কয়েক শিক্ষার্থী স্কুল ড্রেস পরে না আসার কারণে শিক্ষকের কাছে আবেদন জানায় ওই দিনের জন্য মাফ করে দিতে। কিন্তু ক্রীড়া শিক্ষক মাফ না করে শাস্তি দেন। শুধু তা-ই নয়, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বক্তব্যকেও অবৈজ্ঞানিক ও অশিক্ষকসুলভ মনে হয়েছে। দেশে শিক্ষার্থীকে শারীরিক আঘাত করার জন্য যেখানে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করার বিধান আছে, সেখানে তিনি বলেছেন, তাদের পিটিয়েও নাকি ঠিক রাখা যায় না। তার মানে হচ্ছে, প্রধান শিক্ষকও এভাবে শারীরিক ও মানসিক শাস্তিদানকে সমর্থন করছেন।
প্রায়ই পত্রিকায় সংবাদ দেখা যায়, মক্তবের শিক্ষার্থীকে শাস্তি হিসেবে শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছে। কোথাও বা চুল কেটে দেওয়া হয়েছে- এমন খবরও আমাদের পড়তে হয়। এমন ছবিও দেখা যায়, কিশোরকে কপালে চাড়া দিয়ে সূর্যমুখী করে রাখা হয়েছে শাস্তি হিসেবে। যাঁরা পত্রিকা পড়েন, তাঁদের মনে থাকার কথা এসব সংবাদ গত বছরও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। আজকের বৈদ্যুতিক মাধ্যমে সরাসরি প্রচারের সুবিধা থাকার কারণে এ ধরনের লোমহর্ষক চিত্র প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা কমবেশি সবারই আছে।
মানিকগঞ্জের এ ঘটনা এসব থেকে একটু ভিন্ন। কারণ মক্তবের শিক্ষক আর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। স্কুলের শিক্ষকদের বেশির ভাগই বিএড ডিগ্রি অর্জনকারী। তাঁদের সবাই উচ্চশিক্ষিত। শিক্ষাদান পদ্ধতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষার্থীর আত্মিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে তাঁদের প্রশিক্ষণ রয়েছে, যা মক্তবের শিক্ষকের নেই। এ কারণে মক্তব কিংবা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের আধুনিক ব্যবস্থা এখনো অনুপস্থিত। আর থাকলেও সেসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতে গোনা। এমন পরিস্থিতিতে কোনো উচ্চ বিদ্যালয় কিংবা মহাবিদ্যালয়ে এমন চিত্র দেখা রীতিমতো অনাকাঙ্ক্ষিত।
যে প্রধান শিক্ষক এই শাস্তিকে সমর্থন করলেন, তিনি শিশুমনস্তত্ত্ব বিষয়ে নিজেও লেখাপড়া করে এসেছেন। তিনি জানেন, কোনো শিক্ষার্থী যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শত্রু মনে করে, যদি কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষক শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাচর্চা হতে পারে না। কারণ শিক্ষার্থী কখনো ওই প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করতে পারে না। আর শিক্ষককেও সে আপনজন মনে করতে পারে না। এমনকি ওই শিক্ষককে সে নিজের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। সংগত কারণেই শত্রুর সঙ্গে সেও শত্রুর আচরণ করতে চাইবে। তাহলে একজন কিংবা দুজনের জন্যও কোনো প্রতিষ্ঠানের গোটা শিক্ষা-পরিবেশই বিঘি্নত হতে পারে।
অথচ বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের শারীরিক কিংবা মানসিক আঘাত করার ব্যাপারে আদালত থেকে স্পষ্ট রায় ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে এ ধরনের শাস্তিদান সংবিধানবিরোধী এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আদালতের এই রায়ের পর সংগত কারণেই বাংলাদেশে চিরদিন চলে আসা গুরু প্রদত্ত শাস্তির রীতি বাতিল বলে গণ্য হলো। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারকে এ বিষয়ে নিশ্চিত করার ব্যাপারেও নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জাতীয়ভাবে একটি কমিশনও যেন সরকার গঠন করে, যার মাধ্যমে এই বিধান কার্যকর হচ্ছে কি না তা দেখা হবে।
শিক্ষার্থীদের এই শাস্তিদানের ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডা, জাপান, সাউথ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীদের শাস্তিদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৩০টি স্টেটের স্কুলে শাস্তিদান নিষিদ্ধ ঘোষিত। আজকে পশ্চিমা বিশ্বে এই শাস্তির বিধান নিষিদ্ধ হলেও এটি ব্রিটিশদের দ্বারাই সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তাদের কারণে বাংলা-ভারত এলাকায় এটি পাকাপোক্ত হয়। যদিও এখানে গুরুভক্তির ঐতিহ্য সেই পুরনোকাল থেকেই চলে এসেছে। বাংলাদেশে বেত্রাঘাত সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও ডেনমার্কে ১৯৬৭, জার্মানিতে ১৯৮৩, রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর থেকে নিষিদ্ধ। ২০০৪ সালে কানাডায় সুপ্রিম কোর্ট একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৯ সালে চীনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, ফ্রান্সের স্কুলগুলোতে সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই বেত্রাঘাত নিষিদ্ধ। গ্রিসের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেত্রাঘাত নিষিদ্ধ হয় ১৯৯৮ সাল থেকে। ইতালিতে নিষিদ্ধ হয় ১৯২৮ সালে। তবে কিছু এশীয় দেশে এখনো এই শাস্তিদানকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়নি। কোথাও কোথাও শিক্ষাদানের পদ্ধতি হিসেবে বইখাতার মতোই প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি গবেষণার ফলকে নিজেরা প্রয়োগ করতে চায় না? যেমনটি আমাদের এখানকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল একটি পরিপত্র জারি করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিতকরণসংক্রান্ত নীতিমালা শিরোনামে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীকে হাত-পা কিংবা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করা না হয়। শিক্ষার্থীর দিকে ডাস্টার বা এ-জাতীয় কিছু ছুড়ে মারা না হয়। এমনকি আছাড় দেওয়া কিংবা চিমটি কাটার মতো কোনো শাস্তিও দেওয়া যাবে না। শরীরের কোনো স্থানে কামড় ইত্যাদিও দেওয়া যাবে না। এমনকি শিক্ষার্থীর মানসিক আঘাত হতে পারে এমন কোনো তিরস্কারও করা যাবে না। সোজা কথা, শিক্ষার্থীর প্রতি নেতিবাচক কোনো আচরণই করা যাবে না। শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষা গ্রহণকে আনন্দদায়ক মনে করে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
মনস্তাত্তি্বক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর কথা বলা হলেও আমাদের শিক্ষাদান পদ্ধতিতে তার প্রয়োগ খুব দেখা দেয়নি। গবেষণায় দেখা গেছে, ইতিবাচক পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষাদান করা গেলে শিক্ষার্থীকে যেভাবে আকৃষ্ট করা যায়, শাস্তি দিয়ে তা সম্ভব নয়। শাস্তিদান করলে শিক্ষার্থী বদমেজাজি ও ঝগড়াটে মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে পড়ে। লেখাপড়ার প্রতি অনীহা আসে। মনোযোগ কমে যায়। হতাশা তৈরি হয়। আন্তসম্পর্ক বিনষ্ট হয়। শ্রেণীকক্ষে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। সংগত কারণেই শ্রেণী পাঠ সম্পন্ন করতে পারে না যথাসময়ে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাকে বিব্রত করে।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীকে যদি আনন্দদায়ক পরিবেশের মধ্যে ইতিবাচক প্রক্রিয়ায় শিক্ষাদান করা যায়, তা হলে সে লেখাপড়াকে খেলাধুলার মতো গ্রহণ করবে। আর সেই অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষককে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারীদের। শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে, শিশুমনস্তত্ত্ব শিক্ষাদানের দর্শনস্বরূপ। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষকই শিশুমনস্তত্ত্বের দিকটি মান্য করেন না। আমরা মো. জুলহাসের মতো আর কোনো শিক্ষার্থীর অবস্থা হোক তা দেখতে চাই না। একই সঙ্গে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দিকেও তাকাতে হবে। যেখানে আর্থিক অসংগতি স্পষ্ট, সেখানে স্কুল ড্রেসের মতো বিষয়গুলো সম্পন্ন করার জন্য একটু সময় কি দেওয়া যায় না?
লেখক : সাংবাদিক
mhussain_71@yahoo.com
No comments