শ্রদ্ধাঞ্জলি-‘বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় স্বদেশ’ by অমর সাহা
চলে গেলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। নীরবে। বৃহস্পতিবার রাত সোয়া নয়টায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দক্ষিণ কলকাতার তাঁর নিজস্ব বাসভবনে। এ দিনই রাত ১২টায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় দক্ষিণ কলকাতারই কেওড়াতলা মহাশ্মশানে।
তাঁর একমাত্র ছেলে দেবরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার সকালে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলার সময় জানালেন, ‘অনেকটা অভিমান নিয়েই বাবা চলে গেলেন। বাবার অভিমান ছিল, দীর্ঘদিন ধরে রোগশয্যায় থাকলেও তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরাও তেমন খোঁজ নেননি। খোঁজ নেওয়া হয়নি সরকারি পর্যায়েও। তাই বাবা মৃত্যুর আগেই বলে গিয়েছেন, “মৃত্যুর পর আমাকে আর প্রচারের আলোতে নিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। যত তাড়াতাড়ি পারো, শেষকৃত্য সম্পন্ন করে নিয়ো। মরদেহ নিয়ে শোক জ্ঞাপন অনুষ্ঠানের আর প্রয়োজন নেই।” তাই বৃহস্পতিবার মৃত্যুর তিন ঘণ্টার মধ্যেই এই কণ্ঠসৈনিকের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। তবু বাবার মৃত্যুসংবাদ শুনে ছুটে এসেছিলেন কলকাতার মেয়র শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, সিপিএম নেতা রবীনদেবসহ ঘনিষ্ঠজনেরা। কিন্তু সাধারণ মানুষ আর তাঁকে দেখতে পারলেন না।’
এই দেবদুলাল ছিলেন একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্য অনুপ্রেরণা। গোটা বাংলাদেশেই তিনি কোটি মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন একজন কণ্ঠসৈনিক হিসেবে। সবার প্রিয় ছিল তাঁর সুমধুর কণ্ঠ।
মৃত্যুর আগে তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থতা নিয়ে কাটিয়েছেন কলকাতার সাদার্ন এভিনিউর তাঁর নিজ বাসভবনের একটি ছোট্ট খাটে।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গত বছরের বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের আগে সর্বশেষ তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল।
দিনটা ছিল রোববার। তখন বিকেল পাঁচটা। আমি এবং আমাদের চিত্রগ্রাহক ভাস্কর মুখোপাধ্যায় পৌঁছে গিয়েছিলাম তাঁর বাসভবনে। চারতলায় থাকেন তিনি। আমরা পরিচয় দিলাম। তিনি হাত তুলে প্রত্যুত্তর দিলেন। বললাম, ঢাকার কাগজের লোক আমরা। শুনেই উঠে বসতে চাইলেন। মেয়ে দেবারতী এসে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে শুইয়ে দিলেন। দেবারতী বললেন, ‘বাবা দুরারোগ্য পিএসপি বা প্রোগ্রেসিভ সুপ্রা নিউক্লিয়ার পলসি রোগে আক্রান্ত। ধীরে ধীরে তাঁর মস্তিষ্কের কোষগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন তেমন একটা কথা বলতে পারেন না। তবে সব বোঝেন। একটু হাঁটাচলা করতে পারেন। খেতেও পারেন সামান্য। দেবারতী আরও বললেন, ২০০৮ সালে মা মারা যাওয়ার পর বাবা একটু বেশি ভেঙে পড়েছেন। এখন আমরা দেখভাল করছি বাবার। আমরা দুই ভাইবোন। দাদা দেবরাজ কলকাতা ২৪ ঘণ্টা সংবাদ চ্যানেলে কর্মরত। আর আমি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করি।’
আমরা এগিয়ে গেলাম কণ্ঠসৈনিকের খাটের কাছে। বললাম, মনে পড়ে সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন দেবদুলাল। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব মনে আছে। ভুলব কেমন করে। বাংলাদেশ তো আমার দ্বিতীয় স্বদেশ। তাকে কি ভোলা যায়?’ ১৯৬৩ সাল থেকে আকাশবাণী রেডিও কেন্দ্রে চাকরি করেছেন দেবদুলাল। আর সেখান থেকেই অবসর নিয়েছেন ১৯৯৪ সালে।
দেবদুলাল বললেন, ‘সেদিন আমি প্রাণভরে আমার যৌবন উজাড় করে দিয়েছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। এমন ঘটনা তো সবার ভাগ্যে ঘটে না? আমি তো সেই ঘটনার ভাগ্যবান ব্যক্তি। পেয়েছি কোটি বাঙালির ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে আমি মরতে চাই।’
তিনি বললেন, ‘আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে নিজেকে মাঝেমধ্যে আর সংবরণ করতে পারিনি। ভাবিনি, আমি একজন খবর পাঠক। মনে হয়েছিল, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ পরিক্রমা বা সংবাদ সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন নিজেকে মনে করতাম, আমিও সেই রণাঙ্গনের একজন সৈনিক, যখন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা পড়তাম, তখন আমার মনের সমস্ত উল্লাস, উচ্ছ্বাস নেমে আসত আমার কণ্ঠজুড়ে। যখন করুণ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পড়তাম, তখন কান্নায় জড়িয়ে আসত গলা।’ বললেন, ‘মুত্তিযুদ্ধের শেষ দিকটায় যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। উত্তেজনা আর প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন পড়ব বাংলাদেশের খবর।’
এই কণ্ঠসৈনিক কথায় কথায় আরও বললেন, ‘একাত্তর কেন, সেই ১৯৬৮-৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতেও পড়েছি বাংলাদেশের খবর। তখন কে জানত এই অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে বাংলাদেশ হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালিদের রাষ্ট্র। পৃথিবীর বুকে বাঙালিদের জন্য তৈরি হবে একটি স্বাধীন আবাসভূমি।’ বললেন, ‘অদেখা পূর্ববঙ্গের অচেনা বঙ্গভাষীর প্রতি নৈকট্য বোধে মন আপ্লুত হয়েছে আমার বারবার। আর কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশ নামের একটি মানসী মূর্তিকে।’
বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা বলতে গিয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে দেবদুলাল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এসেছেন স্বাধীন স্বদেশভূমি বাংলাদেশে। ওই সময় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম আমরা। উঠেছিলাম হোটেল পূর্বাণীতে। বঙ্গবন্ধু যখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তিনি হঠাৎ বলে ওঠেন, “কোথায় আমাদের সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়?” আমি তখন উঠে এগিয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন। বলেন, “আমি আপনার কণ্ঠ শুনেছি”।’
দেবদুলালের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরে, সেই ১৯৩৪ সালে। ১৯৭২ সালে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া হয়েছিল ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি তুলে দিয়েছিলেন দেবদুলালের হাতে সেই পদ্মশ্রী সম্মান।
অমর সাহা
এই দেবদুলাল ছিলেন একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিত্য অনুপ্রেরণা। গোটা বাংলাদেশেই তিনি কোটি মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন একজন কণ্ঠসৈনিক হিসেবে। সবার প্রিয় ছিল তাঁর সুমধুর কণ্ঠ।
মৃত্যুর আগে তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থতা নিয়ে কাটিয়েছেন কলকাতার সাদার্ন এভিনিউর তাঁর নিজ বাসভবনের একটি ছোট্ট খাটে।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গত বছরের বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের আগে সর্বশেষ তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল।
দিনটা ছিল রোববার। তখন বিকেল পাঁচটা। আমি এবং আমাদের চিত্রগ্রাহক ভাস্কর মুখোপাধ্যায় পৌঁছে গিয়েছিলাম তাঁর বাসভবনে। চারতলায় থাকেন তিনি। আমরা পরিচয় দিলাম। তিনি হাত তুলে প্রত্যুত্তর দিলেন। বললাম, ঢাকার কাগজের লোক আমরা। শুনেই উঠে বসতে চাইলেন। মেয়ে দেবারতী এসে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে শুইয়ে দিলেন। দেবারতী বললেন, ‘বাবা দুরারোগ্য পিএসপি বা প্রোগ্রেসিভ সুপ্রা নিউক্লিয়ার পলসি রোগে আক্রান্ত। ধীরে ধীরে তাঁর মস্তিষ্কের কোষগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন তেমন একটা কথা বলতে পারেন না। তবে সব বোঝেন। একটু হাঁটাচলা করতে পারেন। খেতেও পারেন সামান্য। দেবারতী আরও বললেন, ২০০৮ সালে মা মারা যাওয়ার পর বাবা একটু বেশি ভেঙে পড়েছেন। এখন আমরা দেখভাল করছি বাবার। আমরা দুই ভাইবোন। দাদা দেবরাজ কলকাতা ২৪ ঘণ্টা সংবাদ চ্যানেলে কর্মরত। আর আমি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করি।’
আমরা এগিয়ে গেলাম কণ্ঠসৈনিকের খাটের কাছে। বললাম, মনে পড়ে সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন দেবদুলাল। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব মনে আছে। ভুলব কেমন করে। বাংলাদেশ তো আমার দ্বিতীয় স্বদেশ। তাকে কি ভোলা যায়?’ ১৯৬৩ সাল থেকে আকাশবাণী রেডিও কেন্দ্রে চাকরি করেছেন দেবদুলাল। আর সেখান থেকেই অবসর নিয়েছেন ১৯৯৪ সালে।
দেবদুলাল বললেন, ‘সেদিন আমি প্রাণভরে আমার যৌবন উজাড় করে দিয়েছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। এমন ঘটনা তো সবার ভাগ্যে ঘটে না? আমি তো সেই ঘটনার ভাগ্যবান ব্যক্তি। পেয়েছি কোটি বাঙালির ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে আমি মরতে চাই।’
তিনি বললেন, ‘আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে নিজেকে মাঝেমধ্যে আর সংবরণ করতে পারিনি। ভাবিনি, আমি একজন খবর পাঠক। মনে হয়েছিল, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ পরিক্রমা বা সংবাদ সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন নিজেকে মনে করতাম, আমিও সেই রণাঙ্গনের একজন সৈনিক, যখন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা পড়তাম, তখন আমার মনের সমস্ত উল্লাস, উচ্ছ্বাস নেমে আসত আমার কণ্ঠজুড়ে। যখন করুণ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পড়তাম, তখন কান্নায় জড়িয়ে আসত গলা।’ বললেন, ‘মুত্তিযুদ্ধের শেষ দিকটায় যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। উত্তেজনা আর প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন পড়ব বাংলাদেশের খবর।’
এই কণ্ঠসৈনিক কথায় কথায় আরও বললেন, ‘একাত্তর কেন, সেই ১৯৬৮-৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতেও পড়েছি বাংলাদেশের খবর। তখন কে জানত এই অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে বাংলাদেশ হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালিদের রাষ্ট্র। পৃথিবীর বুকে বাঙালিদের জন্য তৈরি হবে একটি স্বাধীন আবাসভূমি।’ বললেন, ‘অদেখা পূর্ববঙ্গের অচেনা বঙ্গভাষীর প্রতি নৈকট্য বোধে মন আপ্লুত হয়েছে আমার বারবার। আর কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশ নামের একটি মানসী মূর্তিকে।’
বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা বলতে গিয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে দেবদুলাল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এসেছেন স্বাধীন স্বদেশভূমি বাংলাদেশে। ওই সময় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম আমরা। উঠেছিলাম হোটেল পূর্বাণীতে। বঙ্গবন্ধু যখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তিনি হঠাৎ বলে ওঠেন, “কোথায় আমাদের সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়?” আমি তখন উঠে এগিয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন। বলেন, “আমি আপনার কণ্ঠ শুনেছি”।’
দেবদুলালের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরে, সেই ১৯৩৪ সালে। ১৯৭২ সালে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া হয়েছিল ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি তুলে দিয়েছিলেন দেবদুলালের হাতে সেই পদ্মশ্রী সম্মান।
অমর সাহা
No comments