শ্রদ্ধাঞ্জলি-তাঁকে ভোলা যাবে না by সকিনা হোসেন
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ২০টি পাকিস্তানি ট্যাংক বিকল করে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন এ কে এম নুরুল আবসার। এমনভাবেই বিকল করলেন যে কোনোদিনই সেগুলো আর ব্যবহার করা যাবে না। কাজটি করে তৃপ্তি পেয়েছিলেন তিনি।লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রমের লেখা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে নুরুল আবসার
প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন কোয়ার্টার ইনফেন্ট্রি স্কুলে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বিবিসি শুনেই বাংলার বুকে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারেন তিনি। তবে সে সময় স্বাধিকারের যে জোয়ার এসেছিল, তা অন্য সবার মতো তিনিও ধারণ করেছিলেন নিজের মধ্যে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকেই তিনি সন্দেহ করছিলেন, পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব বাংলায় কোনো ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। তিনি ট্যাংক রেজিমেন্টে কাজ করতেন বলে সন্দেহটা আরও বেশি দানা বাঁধে মনে। ২১ ক্যাভেলরি রেজিমেন্টের ট্যাংক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। ফলে ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ট্যাংক আনার কথা শুনেই তিনি বুঝতে পারলেন, কী ঘটতে যাচ্ছে। মার্চ মাসেই ট্যাংকগুলো বিকল করে দিয়েছিলেন তিনি।
২৬ মার্চ অন্য অনেকের মতোই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবেন। যেকোনো মূল্যে পশ্চিম পাকিস্তান ছাড়তে হবে। তখন একজন বাঙালি সুবেদারের সহযোগিতায় কমান্ডো অপারেশনে অংশ নিতে ঢাকায় আসার সুযোগ পেলেন তিনি। ক্যাপ্টেন সায়গল ছিলেন টিক্কা খানের এডিসি। কর্নেল নূরুন্নবী, ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার ও ক্যাপ্টেন সায়গল একটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আসেন ২৮ মার্চ। কর্নেল নূরুন্নবীর সঙ্গে পরিকল্পনা করেন, ২৯ মার্চেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নেবেন।
কিন্তু ২৯ মার্চ কর্নেল নূরুন্নবীর সঙ্গে তিনি সেনানিবাস ছাড়তে পারেননি। তিনি যদি পালিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতেন, তাহলে নুরুল আবসারের এক ভাইকে পরিবারসমেত হত্যা করা হতো। ভাই রাব্বানী ও তাঁর পরিবারকে ঘিরে রেখেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ফলে ভাইয়ের জীবন বাঁচাতে তিনি বেছে নিলেন নিজের মৃত্যুর পথটি। ফিরে গেলেন সেনানিবাসে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নুরুল আবসারকে নিয়ে যায় সৈয়দপুর সেনানিবাসে। আরও কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে তাঁকেও রাখা হয় কড়া নজরদারিতে। সেখানে তাঁর সঙ্গে নজরবন্দী অবস্থায় আরও ছিলেন মেজর নাসিরউদ্দিন, লে. হাশেম, লে. বদিউজ্জামান, লে. সালাম ও লে. আবুল হোসেন। তাঁরা সবাই মিলে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সে সময় পাকিস্তানি নজরদারি উপেক্ষা করে পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। নুরুল আবসার সতীর্থদের বললেন, বর্ষা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মুষলধারে বৃষ্টি হবে যখন, তখন পালানো সহজ হবে।
কিন্তু বর্ষা আসার আগেই মে মাসের ৫ বা ৬ তারিখে মেজর নাসিরউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন নুরুল আবসারকে পাকিস্তানি সেনারা রংপুর শহরের বাইরে বগুড়া মহাসড়কের পাশে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। বৈদ্যুতিক তার দিয়ে তাঁদের সারা শরীরে আঘাত করা হয়।
এরপর ২৮ মে ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার ও লে. হাশেমকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার নাম করে একটি জিপে তোলা হয়। বিকেল চারটার দিকে দুটি ট্রাক ও দুটি জিপ বগুড়া মহাসড়কের পলাশবাড়ীতে পৌঁছায়। এর একটিতেই ছিলেন ক্যাপ্টেন আবসার ও লে. হাশেম। তাঁদের টেনেহিঁচড়ে নামানো হয় রাস্তায়, এবং এরপর গুলি করা হয়। ২৮ মে শহীদ হলেন তাঁরা।
সরকার ক্যাপ্টেন নুরুল আবসারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসের প্যারেড গ্রাউন্ডের নামকরণ করেছে ‘শহীদ ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার প্যারেড গ্রাউন্ড’। সৈয়দপুর সেনানিবাসের একটি সড়কের নাম রাখা হয়েছে ‘শহীদ ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার সড়ক’। নুরুল আবসারের দেহাবশেষ বগুড়ার পলাশবাড়ী থেকে সংগ্রহ করে সৈয়দপুর সেনানিবাসের গণকবরে রাখা হয়েছে। ২০০০ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট নবম পর্যায়ে বেরিয়েছে। সেখানে ক্যাপ্টেন নুরুল আবসারের নামে একটি ডাকটিকিটও আছে।
গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস উপজেলার কড়িকান্দি থেকে মোহনপুর পর্যন্ত সড়কটিও ‘শহীদ ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার’ নামে করা হয়েছে।
ছাত্রজীবনে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি পরিচিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার আসরের নারায়ণগঞ্জ শাখার সদস্য ছিলেন তিনি। কবিতা লিখতেন, গিটার বাজাতেন, গান শুনতেন।
আজ ৩ জুন বিকেল তিনটায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শহীদ বুদ্ধিজীবী ক্যাপ্টেন এ কে এম নুরুল আবসারের ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকীতে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হবে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণ অনুষ্ঠানে আপনিও শরিক হতে পারেন।
সকিনা হোসেন
২৬ মার্চ অন্য অনেকের মতোই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবেন। যেকোনো মূল্যে পশ্চিম পাকিস্তান ছাড়তে হবে। তখন একজন বাঙালি সুবেদারের সহযোগিতায় কমান্ডো অপারেশনে অংশ নিতে ঢাকায় আসার সুযোগ পেলেন তিনি। ক্যাপ্টেন সায়গল ছিলেন টিক্কা খানের এডিসি। কর্নেল নূরুন্নবী, ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার ও ক্যাপ্টেন সায়গল একটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আসেন ২৮ মার্চ। কর্নেল নূরুন্নবীর সঙ্গে পরিকল্পনা করেন, ২৯ মার্চেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নেবেন।
কিন্তু ২৯ মার্চ কর্নেল নূরুন্নবীর সঙ্গে তিনি সেনানিবাস ছাড়তে পারেননি। তিনি যদি পালিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতেন, তাহলে নুরুল আবসারের এক ভাইকে পরিবারসমেত হত্যা করা হতো। ভাই রাব্বানী ও তাঁর পরিবারকে ঘিরে রেখেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ফলে ভাইয়ের জীবন বাঁচাতে তিনি বেছে নিলেন নিজের মৃত্যুর পথটি। ফিরে গেলেন সেনানিবাসে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নুরুল আবসারকে নিয়ে যায় সৈয়দপুর সেনানিবাসে। আরও কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে তাঁকেও রাখা হয় কড়া নজরদারিতে। সেখানে তাঁর সঙ্গে নজরবন্দী অবস্থায় আরও ছিলেন মেজর নাসিরউদ্দিন, লে. হাশেম, লে. বদিউজ্জামান, লে. সালাম ও লে. আবুল হোসেন। তাঁরা সবাই মিলে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সে সময় পাকিস্তানি নজরদারি উপেক্ষা করে পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। নুরুল আবসার সতীর্থদের বললেন, বর্ষা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মুষলধারে বৃষ্টি হবে যখন, তখন পালানো সহজ হবে।
কিন্তু বর্ষা আসার আগেই মে মাসের ৫ বা ৬ তারিখে মেজর নাসিরউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন নুরুল আবসারকে পাকিস্তানি সেনারা রংপুর শহরের বাইরে বগুড়া মহাসড়কের পাশে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। বৈদ্যুতিক তার দিয়ে তাঁদের সারা শরীরে আঘাত করা হয়।
এরপর ২৮ মে ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার ও লে. হাশেমকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার নাম করে একটি জিপে তোলা হয়। বিকেল চারটার দিকে দুটি ট্রাক ও দুটি জিপ বগুড়া মহাসড়কের পলাশবাড়ীতে পৌঁছায়। এর একটিতেই ছিলেন ক্যাপ্টেন আবসার ও লে. হাশেম। তাঁদের টেনেহিঁচড়ে নামানো হয় রাস্তায়, এবং এরপর গুলি করা হয়। ২৮ মে শহীদ হলেন তাঁরা।
সরকার ক্যাপ্টেন নুরুল আবসারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসের প্যারেড গ্রাউন্ডের নামকরণ করেছে ‘শহীদ ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার প্যারেড গ্রাউন্ড’। সৈয়দপুর সেনানিবাসের একটি সড়কের নাম রাখা হয়েছে ‘শহীদ ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার সড়ক’। নুরুল আবসারের দেহাবশেষ বগুড়ার পলাশবাড়ী থেকে সংগ্রহ করে সৈয়দপুর সেনানিবাসের গণকবরে রাখা হয়েছে। ২০০০ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট নবম পর্যায়ে বেরিয়েছে। সেখানে ক্যাপ্টেন নুরুল আবসারের নামে একটি ডাকটিকিটও আছে।
গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস উপজেলার কড়িকান্দি থেকে মোহনপুর পর্যন্ত সড়কটিও ‘শহীদ ক্যাপ্টেন নুরুল আবসার’ নামে করা হয়েছে।
ছাত্রজীবনে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি পরিচিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার আসরের নারায়ণগঞ্জ শাখার সদস্য ছিলেন তিনি। কবিতা লিখতেন, গিটার বাজাতেন, গান শুনতেন।
আজ ৩ জুন বিকেল তিনটায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শহীদ বুদ্ধিজীবী ক্যাপ্টেন এ কে এম নুরুল আবসারের ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকীতে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হবে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণ অনুষ্ঠানে আপনিও শরিক হতে পারেন।
সকিনা হোসেন
No comments