নির্বাচন-চাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন by বদিউল আলম মজুমদার
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, সরকার একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কথা ভাবছে।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নিয়ে এ কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে উত্থাপন করবে। আর রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা থেকে নিয়োগ দেবেন (প্রথম আলো, ২৮ জুলাই ২০১১)। সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের মতো বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে সরকারকে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করব।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের প্রেক্ষাপটে সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলে আসছে। কিন্তু সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করলেই কি কমিশন শক্তিশালী হয়ে যাবে? আর শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এককভাবেই কি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে?
সার্চ কমিটির মাধ্যমে বাছাই করা হলে নিঃসন্দেহে সৎ, যোগ্য, দলনিরপেক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পথ সুগম হবে। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এটাই একমাত্র করণীয় নয়। এর জন্য কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে কমিশনের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার জন্য একটি যথার্থ আইনি কাঠামো। নির্বাচনী আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য কমিশনকে সহায়তা প্রদান এবং কমিশনের ক্ষমতার প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার শ্রদ্ধাশীলতা প্রদর্শনও এ লক্ষ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন-সংক্রান্ত অনেকগুলো আইনের ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ১১ দলের পক্ষ থেকে ১৫ জুলাই ২০০৫ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত সংস্কারের রূপরেখা এসব আইনে বহুলাংশে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিফলিত হয়েছে ‘সুজন’সহ কয়েকটি নাগরিক সংগঠনের অনেক প্রস্তাব। আর এসব আইনি সংস্কার গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সৌভাগ্যবশত নবম সংসদ ২০০৭-০৮ সালে জারি করা নির্বাচন-সংক্রান্ত সব অধ্যাদেশই অনুমোদন করেছে, যদিও কিছু পরিবর্তনসহ।
জাতীয় নির্বাচন-সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলো হলো: গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও); ভোটার তালিকা আইন, ২০১০; নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন, ২০১০; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন, ১৯৯১; জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন আইন, ২০০৪; নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন বিধিমালা। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করতে হলে এসব আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আবশ্যক। সংস্কারের একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে কমিশন এরই মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছে। কমিশনের আলোচ্যসূচিতে আরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কিছু নতুন আইনের খসড়া।
প্রসঙ্গত, বৈঠকের তারিখ একাধিকবার পরিবর্তন করলেও আওয়ামী লীগ শিগগির কমিশনের সঙ্গে বসবে বলে জানানো হয়েছে। তবে কয়েকবার আমন্ত্রণ জানানোর পরও বিএনপি কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে নারাজ। কমিশনের আমন্ত্রণে সাড়া না দেওয়ার বিএনপির বর্তমান সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, এমনকি তা দায়িত্বহীনতার পর্যায়ে পড়ে। আমরা বিএনপিকে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বান জানাই।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথাযথ আইনি কাঠামো সৃষ্টি করলেই হবে না, নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন করতে হবে। তাদের আর্থিক স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে ক্ষমতাসীনরা কমিশনকে, গ্রামবাংলার ভাষায়, ‘হাতে না মারতে পারলেও, ভাতে না পারতে পারে’। অনেকেরই স্মরণ আছে যে গত চারদলীয় সরকারের আমলে কমিশনারদের বেতনভাতার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। আর বর্তমান সরকার সব প্রস্তুতি নেওয়ার পরও কমিশনকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজন থেকে বিরত রেখেছে। এ ছাড়া নাগরিক সমাজের দাবি সত্ত্বেও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনকে সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
যথাযথ আইনি কাঠামো সৃষ্টিই যথেষ্ট নয়, এগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কমিশনকে সহযোগিতা এবং আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাশীলতাও প্রদর্শন করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, এ ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত ভূমিকা কালিমালিপ্ত। উদাহরণস্বরূপ, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিলুপ্তি, বিদেশি শাখার অবসান, দলের তৃণমূলের সদস্যদের সুপারিশের আলোকে তৈরি প্যানেলের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদান প্রভৃতি হলো নির্বাচন কমিশনের অধীন রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এসব শর্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি সংসদে অনুমোদনের সময় আইনগুলোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও এনেছে। যেমন: দলের নেতা-কর্মীদের সুপারিশের ভিত্তিতে তৈরি প্যানেল থেকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা আইন অনুমোদনের সময় রহিত করা হয়েছে, ফলে এখন দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডকে এসব সুপারিশ শুধু বিবেচনায় নিতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, এ ধরনের ক্ষমতাহরণ সত্ত্বেও দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্যই নেই।
নবম সংসদে পাস করা আইনগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শুধু সহযোগিতার অভাবই নয়, অনেক ক্ষেত্রে দলের পক্ষ থেকে রীতিমতো বাধাও দেওয়া হচ্ছে। যেমন: নিবন্ধনের শর্ত পূরণের জন্য দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন বিলুপ্ত করার প্রশ্ন তুললে নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হতে হয়। কমিশনের বিরুদ্ধে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ তোলা হয়।
তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা অবশ্যই ‘নেসেসারি’ বা প্রয়োজনীয়, কিন্তু ‘সাফিসিয়েন্ট’ বা যথেষ্ট নয়। কারণ, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিশন একটি পক্ষ মাত্র। অন্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলো হলো—প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও তাদের মনোনীত প্রার্থী। এদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ১০ লক্ষাধিক সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তার সরাসরি সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রয়োজন হাজার হাজার আনসার, পুলিশ, বিজিবি, এমনকি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতা। দুর্ভাগ্যবশত, দলতন্ত্রের যে সর্বগ্রাসী উন্মত্ততায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো লিপ্ত, তাতে এসব ব্যক্তির কাছ থেকেই নিরপেক্ষ আচরণ আশা করা যায় না।
এ কথা কারও অজানা নয় যে নির্বাচনী অসদাচরণের মূল হোতা রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা। তারাই মনোনয়ন-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়, দল কেনাবেচায় জড়িত হয়, টাকা দিয়ে ভোট কেনে, দুর্বল প্রতিপক্ষকে হুমকি দেয় এবং অনেক সময় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত রাখে, ভোটারদের নির্বাচনকেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে, সহিংসতায় লিপ্ত হয়, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করে ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসব অপকর্ম বন্ধ করলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথের অধিকাংশ বাধাই দূর হয়ে যাবে। যেসব দেশে নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটেছে, সেসব দেশে রাজনৈতিক দলের সদাচরণ বহুলাংশে নিশ্চিত হয়েছে এবং তারা নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশেও নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখায় একটি আচরণবিধি অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার ফলে দলগুলো সংযত আচরণ করেছিল। তাই একানব্বইয়ের নির্বাচন ছিল সবচেয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। তখন অবশ্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দলবাজি ও ফায়দাবাজিতে লিপ্ত ছিল না।
তাই এটি সুস্পষ্ট যে সুষ্ঠুও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের মনোনীত প্রার্থীরা এবং দল ও প্রার্থীদের যেকোনো মূল্যে ও বৈধ-অবৈধ যেকোনো পন্থায় নির্বাচনে জেতার মানসিকতা। দলতন্ত্রের লাগামহীন বিস্তারের ফলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা হতে হবে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। একইভাবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য অবশ্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার নাগরিকদের প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকিরও অবসান ঘটাতে হবে।
আমাদের জন্য একটি অপূর্ব সুযোগ এসেছিল বহু আলোচিত মাগুরার উপনির্বাচনের পর। সেই উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল কারচুপির আশ্রয় নিয়েছিল, নির্বাচন কমিশন তা ঠেকাতে পারেনি। তাই তখন সর্বাধিক প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক দলের সংস্কার ও রাজনীতিকে ‘ঠিক’ করা এবং কমিশনের সংস্কার। কিন্তু মূল সমস্যাগুলো কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রেখে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জিকির তোলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের, যার দায়িত্ব মূলত নির্বাচনের সময়ে ‘পাহারাদারের’ ভূমিকা পালন করা। সমস্যা এড়িয়ে গেলে সমস্যা দূর হয় না, তাই ঘর পোড়া গরুর মতো এ স্লোগানটির পরিণতি সম্পর্কেও আমরা সন্দিহান।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন সবকিছুর দায়িত্বে থাকবে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করবে। কিন্তু কমিশনের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। কারণ, নির্বাচন-সংক্রান্ত যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, তা পরিচালনা করতেই কমিশনকে হিমশিম খেতে হয়। তাদের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার সময় কোথায়? এ ছাড়া নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সঙ্গে ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস’ বা বিড়াল-ইঁদুরের খেলায় কমিশনকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতে হয়। উপরন্তু এটি তাদের সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্বের অংশও নয়। তবে আমরা চিন্তিত হয়েছি প্রথম আলোর (২০ জুলাই ২০১১) একটি সাম্প্রতিক হেডলাইন দেখে: ‘চার মন্ত্রণালয় নিজের দায়িত্বে রাখতে চায় নির্বাচন কমিশন’।
পরিশেষে এটি সুস্পষ্ট যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে বাছাই কমিটির মাধ্যমে এবং সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কমিশনার নিয়োগের পাশাপাশি আরও অনেকগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। আর নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হলে জাতিকে ভবিষ্যতে আরও অনেক লীলাখেলা দেখতে হবে বলে আমাদের আশঙ্কা, যার পরিণতি অমঙ্গলকর হতে বাধ্য। তাই আজ জরুরি ভিত্তিতে আমাদের প্রধান দলগুলোকে আলোচনায় বসতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের প্রেক্ষাপটে সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলে আসছে। কিন্তু সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করলেই কি কমিশন শক্তিশালী হয়ে যাবে? আর শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এককভাবেই কি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে?
সার্চ কমিটির মাধ্যমে বাছাই করা হলে নিঃসন্দেহে সৎ, যোগ্য, দলনিরপেক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পথ সুগম হবে। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এটাই একমাত্র করণীয় নয়। এর জন্য কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে কমিশনের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার জন্য একটি যথার্থ আইনি কাঠামো। নির্বাচনী আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য কমিশনকে সহায়তা প্রদান এবং কমিশনের ক্ষমতার প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার শ্রদ্ধাশীলতা প্রদর্শনও এ লক্ষ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন-সংক্রান্ত অনেকগুলো আইনের ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ১১ দলের পক্ষ থেকে ১৫ জুলাই ২০০৫ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত সংস্কারের রূপরেখা এসব আইনে বহুলাংশে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিফলিত হয়েছে ‘সুজন’সহ কয়েকটি নাগরিক সংগঠনের অনেক প্রস্তাব। আর এসব আইনি সংস্কার গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সৌভাগ্যবশত নবম সংসদ ২০০৭-০৮ সালে জারি করা নির্বাচন-সংক্রান্ত সব অধ্যাদেশই অনুমোদন করেছে, যদিও কিছু পরিবর্তনসহ।
জাতীয় নির্বাচন-সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলো হলো: গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও); ভোটার তালিকা আইন, ২০১০; নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন, ২০১০; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন, ১৯৯১; জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন আইন, ২০০৪; নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন বিধিমালা। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করতে হলে এসব আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আবশ্যক। সংস্কারের একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে কমিশন এরই মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছে। কমিশনের আলোচ্যসূচিতে আরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কিছু নতুন আইনের খসড়া।
প্রসঙ্গত, বৈঠকের তারিখ একাধিকবার পরিবর্তন করলেও আওয়ামী লীগ শিগগির কমিশনের সঙ্গে বসবে বলে জানানো হয়েছে। তবে কয়েকবার আমন্ত্রণ জানানোর পরও বিএনপি কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে নারাজ। কমিশনের আমন্ত্রণে সাড়া না দেওয়ার বিএনপির বর্তমান সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, এমনকি তা দায়িত্বহীনতার পর্যায়ে পড়ে। আমরা বিএনপিকে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহ্বান জানাই।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথাযথ আইনি কাঠামো সৃষ্টি করলেই হবে না, নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন করতে হবে। তাদের আর্থিক স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে ক্ষমতাসীনরা কমিশনকে, গ্রামবাংলার ভাষায়, ‘হাতে না মারতে পারলেও, ভাতে না পারতে পারে’। অনেকেরই স্মরণ আছে যে গত চারদলীয় সরকারের আমলে কমিশনারদের বেতনভাতার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। আর বর্তমান সরকার সব প্রস্তুতি নেওয়ার পরও কমিশনকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজন থেকে বিরত রেখেছে। এ ছাড়া নাগরিক সমাজের দাবি সত্ত্বেও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনকে সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
যথাযথ আইনি কাঠামো সৃষ্টিই যথেষ্ট নয়, এগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কমিশনকে সহযোগিতা এবং আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাশীলতাও প্রদর্শন করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, এ ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত ভূমিকা কালিমালিপ্ত। উদাহরণস্বরূপ, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিলুপ্তি, বিদেশি শাখার অবসান, দলের তৃণমূলের সদস্যদের সুপারিশের আলোকে তৈরি প্যানেলের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদান প্রভৃতি হলো নির্বাচন কমিশনের অধীন রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এসব শর্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি সংসদে অনুমোদনের সময় আইনগুলোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও এনেছে। যেমন: দলের নেতা-কর্মীদের সুপারিশের ভিত্তিতে তৈরি প্যানেল থেকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা আইন অনুমোদনের সময় রহিত করা হয়েছে, ফলে এখন দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডকে এসব সুপারিশ শুধু বিবেচনায় নিতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, এ ধরনের ক্ষমতাহরণ সত্ত্বেও দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্যই নেই।
নবম সংসদে পাস করা আইনগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শুধু সহযোগিতার অভাবই নয়, অনেক ক্ষেত্রে দলের পক্ষ থেকে রীতিমতো বাধাও দেওয়া হচ্ছে। যেমন: নিবন্ধনের শর্ত পূরণের জন্য দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন বিলুপ্ত করার প্রশ্ন তুললে নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হতে হয়। কমিশনের বিরুদ্ধে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ তোলা হয়।
তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা অবশ্যই ‘নেসেসারি’ বা প্রয়োজনীয়, কিন্তু ‘সাফিসিয়েন্ট’ বা যথেষ্ট নয়। কারণ, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিশন একটি পক্ষ মাত্র। অন্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলো হলো—প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও তাদের মনোনীত প্রার্থী। এদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ১০ লক্ষাধিক সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তার সরাসরি সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রয়োজন হাজার হাজার আনসার, পুলিশ, বিজিবি, এমনকি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতা। দুর্ভাগ্যবশত, দলতন্ত্রের যে সর্বগ্রাসী উন্মত্ততায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো লিপ্ত, তাতে এসব ব্যক্তির কাছ থেকেই নিরপেক্ষ আচরণ আশা করা যায় না।
এ কথা কারও অজানা নয় যে নির্বাচনী অসদাচরণের মূল হোতা রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা। তারাই মনোনয়ন-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়, দল কেনাবেচায় জড়িত হয়, টাকা দিয়ে ভোট কেনে, দুর্বল প্রতিপক্ষকে হুমকি দেয় এবং অনেক সময় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত রাখে, ভোটারদের নির্বাচনকেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে, সহিংসতায় লিপ্ত হয়, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করে ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসব অপকর্ম বন্ধ করলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথের অধিকাংশ বাধাই দূর হয়ে যাবে। যেসব দেশে নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটেছে, সেসব দেশে রাজনৈতিক দলের সদাচরণ বহুলাংশে নিশ্চিত হয়েছে এবং তারা নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশেও নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখায় একটি আচরণবিধি অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার ফলে দলগুলো সংযত আচরণ করেছিল। তাই একানব্বইয়ের নির্বাচন ছিল সবচেয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। তখন অবশ্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দলবাজি ও ফায়দাবাজিতে লিপ্ত ছিল না।
তাই এটি সুস্পষ্ট যে সুষ্ঠুও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের মনোনীত প্রার্থীরা এবং দল ও প্রার্থীদের যেকোনো মূল্যে ও বৈধ-অবৈধ যেকোনো পন্থায় নির্বাচনে জেতার মানসিকতা। দলতন্ত্রের লাগামহীন বিস্তারের ফলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা হতে হবে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। একইভাবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য অবশ্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার নাগরিকদের প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকিরও অবসান ঘটাতে হবে।
আমাদের জন্য একটি অপূর্ব সুযোগ এসেছিল বহু আলোচিত মাগুরার উপনির্বাচনের পর। সেই উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল কারচুপির আশ্রয় নিয়েছিল, নির্বাচন কমিশন তা ঠেকাতে পারেনি। তাই তখন সর্বাধিক প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক দলের সংস্কার ও রাজনীতিকে ‘ঠিক’ করা এবং কমিশনের সংস্কার। কিন্তু মূল সমস্যাগুলো কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রেখে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জিকির তোলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের, যার দায়িত্ব মূলত নির্বাচনের সময়ে ‘পাহারাদারের’ ভূমিকা পালন করা। সমস্যা এড়িয়ে গেলে সমস্যা দূর হয় না, তাই ঘর পোড়া গরুর মতো এ স্লোগানটির পরিণতি সম্পর্কেও আমরা সন্দিহান।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন সবকিছুর দায়িত্বে থাকবে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করবে। কিন্তু কমিশনের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। কারণ, নির্বাচন-সংক্রান্ত যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, তা পরিচালনা করতেই কমিশনকে হিমশিম খেতে হয়। তাদের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার সময় কোথায়? এ ছাড়া নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সঙ্গে ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস’ বা বিড়াল-ইঁদুরের খেলায় কমিশনকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতে হয়। উপরন্তু এটি তাদের সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্বের অংশও নয়। তবে আমরা চিন্তিত হয়েছি প্রথম আলোর (২০ জুলাই ২০১১) একটি সাম্প্রতিক হেডলাইন দেখে: ‘চার মন্ত্রণালয় নিজের দায়িত্বে রাখতে চায় নির্বাচন কমিশন’।
পরিশেষে এটি সুস্পষ্ট যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে বাছাই কমিটির মাধ্যমে এবং সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কমিশনার নিয়োগের পাশাপাশি আরও অনেকগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। আর নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হলে জাতিকে ভবিষ্যতে আরও অনেক লীলাখেলা দেখতে হবে বলে আমাদের আশঙ্কা, যার পরিণতি অমঙ্গলকর হতে বাধ্য। তাই আজ জরুরি ভিত্তিতে আমাদের প্রধান দলগুলোকে আলোচনায় বসতে হবে।
No comments