বিশেষ সাক্ষাৎকার-সমঝোতার বিষয়ে তাঁদের নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে হবে by শফিক আহমেদ
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী শফিক আহমেদের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৬ জুলাই কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামে। তিনি ১৯৫৩ সালে কুমিল্লা সরকারি জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে লন্ডনের লিঙ্কন’স ইন থেকে বার-অ্যাট-ল করার পর তিনি হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৯৯-২০০০ ও ২০০৮-২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের প্রেক্ষাপটে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মহিউদ্দিন ফারুক
প্রথম আলো ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলেও আগামী দুই মেয়াদে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে অভিমত দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তো আদালত রাজনৈতিক বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
শফিক আহমেদ ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় আপিল বিভাগ তা বাতিল করেছেন। অসাংবিধানিক এই বিধানটি সংবিধানে আর রাখার কোনো সাংবিধানিক সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী এ কথাটিই বলেছেন। যে কারণে এটা বাতিল হয়েছে, সেই কারণ বিদ্যমান। তাই পুনরায় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযুক্ত করার সুযোগ নেই।
গণতন্ত্র রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভ। কাজেই অনির্বাচিত সরকার কখনো নব্বই দিন, কখনো দুই বছরের জন্য দেশ চালাবে—এটা হতে পারে না। তাই প্রসপেক্টটিভভাবে (ভবিষ্যতে) তা বাতিল করা হয়েছে। তাই দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা সংবিধানে স্থান পাবে না। যেমন—আদালত পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন। এই সংশোধনীর বলে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। কথা হলো, যে জিনিসটা একবার সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়েছে অসাংবিধানিক বলে, সেই জিনিসটা কীভাবে আবার সংবিধানে স্থান পাবে?
প্রথম আলো পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার আগেই সরকার এই অবস্থান কেন নিল? প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে সংসদে এসে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার সুযোগই যদি না থাকে, তাহলে প্রস্তাব দিয়ে কী লাভ হবে?
শফিক আহমেদ রায়ের অপারেটিভ (কার্যকর) অংশ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে করেই পরিষ্কার ধারণা হবে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর সংবিধানের অংশ হিসেবে নেই। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি কী চায়, সেটা স্পষ্টভাবে বলতে হবে। কিন্তু যেটা অসাংবিধানিক, সেটা সংবিধানে কখনোই ঢুকতে পারে না—এটা মাথায় রাখতে হবে। এই আইনি ও সাংবিধানিক বিধিবিধানটি সামনে রেখেই বিএনপিকে পরিষ্কারভাবে তাদের প্রস্তাব দিতে হবে।
প্রথম আলো নব্বইয়ের দশকে যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন, আজ তাঁরা সেই ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে। আবার যাঁরা সেদিন তত্ত্বাবধায়কের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরাই এখন তা রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন। এটা কি আমাদের রাজনীতির পরিহাস নয়?
শফিক আহমেদ এটা সরকার বাতিল করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে আনা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করেছেন। এ নিয়ে আর কোনো বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই।
প্রথম আলো সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে রায়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। রায় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে। তাঁর এ বক্তব্যকে একজন আইনজীবী হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শফিক আহমেদ সভাপতির বক্তব্যটি একেবারেই বিভ্রান্তিমূলক ও ভিত্তিহীন। প্রধানমন্ত্রী রায় সম্পর্কে ভুল বলেননি। সংবাদ সম্মেলনে তিনি রায়ের মর্মার্থই উপস্থাপন করেছেন।
প্রথম আলো ২ জুন প্রথম আলোতে বিশিষ্ট নাগরিকেরা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিসের ভিত্তিতে সমঝোতা হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
শফিক আহমেদ বিশিষ্ট নাগরিকেরাই তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। এ জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। তবে সমঝোতাটা কীভাবে হতে পারে, সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট প্রস্তাবও তাঁদের কাছ থেকে আসা উচিত। সমঝোতার প্রস্তাবটি হওয়া উচিত সুনির্দিষ্ট, গ্রহণযোগ্য ও গঠনমূলক। তবে তা কোনোভাবেই যেন সংবিধান, আইন ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার রীতিনীতির পরিপন্থী না হয়।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টির যেমন আইনগত দিক আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক দিকও। নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান দুটি দলের মধ্যে মতৈক্য না হলে নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে?
শফিক আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ব্যাপারে এখন আইনসংগতভাবেই একটি সিদ্ধান্ত এসে গেছে। গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রশ্নে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পন্থা—নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হওয়া, স্বাধীনভাবে কাজ করা। নির্বাচনকালে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য-সহযোগিতা করবে; যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বহু গণতান্ত্রিক দেশই সেই দৃষ্টান্ত রেখেছে। সেসব দেশে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান না থাকা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে ও ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজনে আইনে রদবদল করা যেতে পারে। নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড শক্তিশালী হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। এখন যাঁরা কমিশনে আছেন, তাঁরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ হলে দলীয় সরকারের অধীনেও যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করা সম্ভব, তার বড় প্রমাণ বিগত পৌর নির্বাচন, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন, সংসদের উপনির্বাচন ও সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন।
প্রথম আলো সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় মানার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি কী মনে করেন?
শফিক আহমেদ না, এটা ঠিক নয়। সর্বোচ্চ আদালত যখন কোনো রায় দেন, তখন সেটা আইন। আর এটা মানতে সবাই বাধ্য। তা না হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা, দেশে নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টি হবে। মওদুদ আহমদ সঠিক বলেননি। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলতে চাই, যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য রায় প্রত্যাখ্যান করার কথা বলেছেন, তাঁরা আদালত অবমাননা করেছেন।
প্রথম আলো সম্প্রতি সংসদের স্থায়ী কমিটির ক্ষমতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রিসভার বৈঠকে নাকচ হয়ে গেছে। প্রস্তাবে বড় কোনো অসংগতি ছিল বলে মনে করেন?
শফিক আহমেদ প্রস্তাবটি নাকচ করা হয়নি। আরও অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য এটা ফেরত পাঠানো হয়েছে। এটাতে ছিল, সংসদীয় কমিটি যদি কাউকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকে, হাজির না হলে সমন জারি করার বিষয়ে। অর্থাৎ তাদের দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। অন্যান্য দেশের কী নজির আছে, তা-ও দেখার জন্য তা ফেরত পাঠানো হয়েছে।
প্রথম আলো বিরোধী দলের অভিযোগ, পঞ্চম সংশোধনীর ব্যাপারে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান পুনর্মুদ্রণে কারচুপি করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতাও পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি চেয়ে পাননি বলে তাঁরা নালিশ করেছেন। এই অভিযোগ কতটা সত্য?
শফিক আহমেদ এটা একেবারেই বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ের আলোকেই সংবিধান ছাপানো হয়েছে। এটা ঠিক নয় যে দলীয় নেত্রী কপি চেয়ে পাননি। বিরোধীদলীয় নেতাসহ সব সাংসদকে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আছে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগও একই অভিযোগ করত। এতে কি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না?
শফিক আহমেদ আমি সব সময়ই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। কোনো অবস্থাতেই বিচার না করে কাউকে হত্যা করা আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। এ ধরনের যেকোনো বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্তের জন্য প্রতিটি থানায় আলাদা তদন্ত সেল করা হয়েছে, যাতে করে তদন্ত দ্রুত শেষ হয় এবং বিনা কারণে ফৌজদারি মামলা দীর্ঘায়িত না হয়।
প্রথম আলো বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এক সভায় আপনার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও তাঁদের হাত-পা বাঁধা। অন্যদিকে বিরোধী দলের অভিযোগ, সরকার বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করছে।
শফিক আহমেদ এই অভিযোগ সঠিক নয়। এর আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল, দেশে ২০ লাখ মামলা বিচারাধীন। আমার বক্তব্যটি ছিল সেই প্রসঙ্গে। বিচারকেরা বিচারিক মনোভাব নিয়ে বিচারকাজ করলে এ পরিস্থিতি হওয়ার কথা নয়। আমি অধস্তন আদালতের দৈনন্দিন কাজ তদারকির জন্য একটা স্বাধীন সচিবালয় সুপ্রিম কোর্টের অধীনে গঠনের প্রস্তাব করেছিলাম। এ নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ নেই।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে বিরোধী দল রোববার হরতাল ডেকেছে। এতে কি পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হবে না?
শফিক আহমেদ বিরোধী দলের হরতাল আহ্বানের কোনো যুক্তি নেই। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধানটি সরকার বাতিল করেনি। তারা নিশ্চয়ই অবগত আছে, অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষেই বক্তব্য দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা। তিনি সরকারের পক্ষে মতামতটা তুলে ধরেছেন। কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেননি। আদালত তাঁর প্রজ্ঞা অনুসারে যেটা সাংবিধানিক ও আইনসংগত মনে করেছেন, তার আলোকে রায় দিয়েছেন।
সরকারকে দোষারোপ করে এই হরতাল অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত মনে করি। এর যুক্তিসংগত কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। এখানে সরকারের কী দোষ? সরকার যেখানে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের অংশীদার নয়, সেখানে এই হরতাল জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য। আমি মনে করি, বিরোধী দলের এ হরতাল আদালত ও জনগণের বিরুদ্ধে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
শফিক আহমেদ ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মহিউদ্দিন ফারুক
প্রথম আলো ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলেও আগামী দুই মেয়াদে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে অভিমত দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তো আদালত রাজনৈতিক বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
শফিক আহমেদ ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় আপিল বিভাগ তা বাতিল করেছেন। অসাংবিধানিক এই বিধানটি সংবিধানে আর রাখার কোনো সাংবিধানিক সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী এ কথাটিই বলেছেন। যে কারণে এটা বাতিল হয়েছে, সেই কারণ বিদ্যমান। তাই পুনরায় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযুক্ত করার সুযোগ নেই।
গণতন্ত্র রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভ। কাজেই অনির্বাচিত সরকার কখনো নব্বই দিন, কখনো দুই বছরের জন্য দেশ চালাবে—এটা হতে পারে না। তাই প্রসপেক্টটিভভাবে (ভবিষ্যতে) তা বাতিল করা হয়েছে। তাই দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা সংবিধানে স্থান পাবে না। যেমন—আদালত পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন। এই সংশোধনীর বলে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। কথা হলো, যে জিনিসটা একবার সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়েছে অসাংবিধানিক বলে, সেই জিনিসটা কীভাবে আবার সংবিধানে স্থান পাবে?
প্রথম আলো পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার আগেই সরকার এই অবস্থান কেন নিল? প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে সংসদে এসে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার সুযোগই যদি না থাকে, তাহলে প্রস্তাব দিয়ে কী লাভ হবে?
শফিক আহমেদ রায়ের অপারেটিভ (কার্যকর) অংশ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে করেই পরিষ্কার ধারণা হবে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর সংবিধানের অংশ হিসেবে নেই। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি কী চায়, সেটা স্পষ্টভাবে বলতে হবে। কিন্তু যেটা অসাংবিধানিক, সেটা সংবিধানে কখনোই ঢুকতে পারে না—এটা মাথায় রাখতে হবে। এই আইনি ও সাংবিধানিক বিধিবিধানটি সামনে রেখেই বিএনপিকে পরিষ্কারভাবে তাদের প্রস্তাব দিতে হবে।
প্রথম আলো নব্বইয়ের দশকে যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন, আজ তাঁরা সেই ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে। আবার যাঁরা সেদিন তত্ত্বাবধায়কের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরাই এখন তা রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন। এটা কি আমাদের রাজনীতির পরিহাস নয়?
শফিক আহমেদ এটা সরকার বাতিল করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে আনা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করেছেন। এ নিয়ে আর কোনো বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই।
প্রথম আলো সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে রায়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। রায় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে। তাঁর এ বক্তব্যকে একজন আইনজীবী হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শফিক আহমেদ সভাপতির বক্তব্যটি একেবারেই বিভ্রান্তিমূলক ও ভিত্তিহীন। প্রধানমন্ত্রী রায় সম্পর্কে ভুল বলেননি। সংবাদ সম্মেলনে তিনি রায়ের মর্মার্থই উপস্থাপন করেছেন।
প্রথম আলো ২ জুন প্রথম আলোতে বিশিষ্ট নাগরিকেরা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিসের ভিত্তিতে সমঝোতা হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
শফিক আহমেদ বিশিষ্ট নাগরিকেরাই তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। এ জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। তবে সমঝোতাটা কীভাবে হতে পারে, সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট প্রস্তাবও তাঁদের কাছ থেকে আসা উচিত। সমঝোতার প্রস্তাবটি হওয়া উচিত সুনির্দিষ্ট, গ্রহণযোগ্য ও গঠনমূলক। তবে তা কোনোভাবেই যেন সংবিধান, আইন ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার রীতিনীতির পরিপন্থী না হয়।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টির যেমন আইনগত দিক আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক দিকও। নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান দুটি দলের মধ্যে মতৈক্য না হলে নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে?
শফিক আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ব্যাপারে এখন আইনসংগতভাবেই একটি সিদ্ধান্ত এসে গেছে। গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রশ্নে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পন্থা—নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হওয়া, স্বাধীনভাবে কাজ করা। নির্বাচনকালে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য-সহযোগিতা করবে; যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বহু গণতান্ত্রিক দেশই সেই দৃষ্টান্ত রেখেছে। সেসব দেশে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান না থাকা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে ও ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজনে আইনে রদবদল করা যেতে পারে। নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড শক্তিশালী হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। এখন যাঁরা কমিশনে আছেন, তাঁরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ হলে দলীয় সরকারের অধীনেও যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করা সম্ভব, তার বড় প্রমাণ বিগত পৌর নির্বাচন, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন, সংসদের উপনির্বাচন ও সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন।
প্রথম আলো সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় মানার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি কী মনে করেন?
শফিক আহমেদ না, এটা ঠিক নয়। সর্বোচ্চ আদালত যখন কোনো রায় দেন, তখন সেটা আইন। আর এটা মানতে সবাই বাধ্য। তা না হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা, দেশে নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টি হবে। মওদুদ আহমদ সঠিক বলেননি। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলতে চাই, যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য রায় প্রত্যাখ্যান করার কথা বলেছেন, তাঁরা আদালত অবমাননা করেছেন।
প্রথম আলো সম্প্রতি সংসদের স্থায়ী কমিটির ক্ষমতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রিসভার বৈঠকে নাকচ হয়ে গেছে। প্রস্তাবে বড় কোনো অসংগতি ছিল বলে মনে করেন?
শফিক আহমেদ প্রস্তাবটি নাকচ করা হয়নি। আরও অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য এটা ফেরত পাঠানো হয়েছে। এটাতে ছিল, সংসদীয় কমিটি যদি কাউকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকে, হাজির না হলে সমন জারি করার বিষয়ে। অর্থাৎ তাদের দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। অন্যান্য দেশের কী নজির আছে, তা-ও দেখার জন্য তা ফেরত পাঠানো হয়েছে।
প্রথম আলো বিরোধী দলের অভিযোগ, পঞ্চম সংশোধনীর ব্যাপারে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান পুনর্মুদ্রণে কারচুপি করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতাও পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি চেয়ে পাননি বলে তাঁরা নালিশ করেছেন। এই অভিযোগ কতটা সত্য?
শফিক আহমেদ এটা একেবারেই বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ের আলোকেই সংবিধান ছাপানো হয়েছে। এটা ঠিক নয় যে দলীয় নেত্রী কপি চেয়ে পাননি। বিরোধীদলীয় নেতাসহ সব সাংসদকে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কপি দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আছে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগও একই অভিযোগ করত। এতে কি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না?
শফিক আহমেদ আমি সব সময়ই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। কোনো অবস্থাতেই বিচার না করে কাউকে হত্যা করা আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। এ ধরনের যেকোনো বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্তের জন্য প্রতিটি থানায় আলাদা তদন্ত সেল করা হয়েছে, যাতে করে তদন্ত দ্রুত শেষ হয় এবং বিনা কারণে ফৌজদারি মামলা দীর্ঘায়িত না হয়।
প্রথম আলো বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এক সভায় আপনার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও তাঁদের হাত-পা বাঁধা। অন্যদিকে বিরোধী দলের অভিযোগ, সরকার বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করছে।
শফিক আহমেদ এই অভিযোগ সঠিক নয়। এর আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল, দেশে ২০ লাখ মামলা বিচারাধীন। আমার বক্তব্যটি ছিল সেই প্রসঙ্গে। বিচারকেরা বিচারিক মনোভাব নিয়ে বিচারকাজ করলে এ পরিস্থিতি হওয়ার কথা নয়। আমি অধস্তন আদালতের দৈনন্দিন কাজ তদারকির জন্য একটা স্বাধীন সচিবালয় সুপ্রিম কোর্টের অধীনে গঠনের প্রস্তাব করেছিলাম। এ নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ নেই।
প্রথম আলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে বিরোধী দল রোববার হরতাল ডেকেছে। এতে কি পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হবে না?
শফিক আহমেদ বিরোধী দলের হরতাল আহ্বানের কোনো যুক্তি নেই। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধানটি সরকার বাতিল করেনি। তারা নিশ্চয়ই অবগত আছে, অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষেই বক্তব্য দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা। তিনি সরকারের পক্ষে মতামতটা তুলে ধরেছেন। কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেননি। আদালত তাঁর প্রজ্ঞা অনুসারে যেটা সাংবিধানিক ও আইনসংগত মনে করেছেন, তার আলোকে রায় দিয়েছেন।
সরকারকে দোষারোপ করে এই হরতাল অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত মনে করি। এর যুক্তিসংগত কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। এখানে সরকারের কী দোষ? সরকার যেখানে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের অংশীদার নয়, সেখানে এই হরতাল জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য। আমি মনে করি, বিরোধী দলের এ হরতাল আদালত ও জনগণের বিরুদ্ধে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
শফিক আহমেদ ধন্যবাদ।
No comments