সীমান্তে হত্যা-ফেলানী, তাহলে তুমি কার? by ফারুক ওয়াসিফ
খবরটা পড়ে থমকে যেতে হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, ‘বিএসএফের হাতে নিহত ফেলানী বাংলাদেশি নয়। তারা ভারতীয়।’ গত সোমবারের প্রথম আলোয় তাঁর উক্তিটি পড়ার পর ফেলানীর মৃত্যুদৃশ্যটাই মনে ভাসছে। লাল কার্ডিগান পরা এক কিশোরী মাথা নিচু করে ঝুলছে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায়।
তার নিথর দুটি হাতও মাটির দিকে বাড়ানো। মনে পড়ছে আর উথলে উঠছে পুরোনো শোক। জাগছে অমোঘ একটি প্রশ্ন: ফেলানী, তুমি কি তাহলে বেওয়ারিশ? তোমার দায় নেবার নেই কেউ?
প্রকৃতির বিচারে সব মৃত্যুই সমান। কে কীভাবে মরল, কাদের হাতে মরল, স্বাভাবিক মৃত্যু হলো নাকি হলো অপঘাতে, তার মূল্যায়ন প্রকৃতি করে না। কিন্তু মানুষের কাছে, মানুষের আইন, যুক্তি ও নৈতিকতার কাছে সব মৃত্যু নয় সমান। কোনো কোনো মৃত্যুর কারণ ব্যক্তি, কোনো মৃত্যুর কারণ রাষ্ট্র। ফেলানী রাষ্ট্রীয় হত্যার শিকার। তার বয়স এবং মৃত্যুর পরিস্থিতি পাথরের মতো ভারী হয়ে চেপে বসে আমাদের মনে। তাই সেই মৃত্যুতে ক্ষোভের হুতাশন জ্বলে উঠেছিল। শোকতপ্ত হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। সেই শোকের আগুন যখন ছাইচাপা যেতে বসেছে, তখনই আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং শুকিয়ে আসা ক্ষতে আঘাত করলেন। তিনি কিশোরী ফেলানীকে অস্বীকার করলেন। বঞ্চিত করলেন মেয়েটির বাংলাদেশি নাগরিকত্ব এবং জীবিত বা মৃত অবস্থায় তার আইনি অধিকার। জীবিত অবস্থায় তার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারেনি। মৃত্যুর পর দেখিয়েছিল গড়িমসিপনা। প্রতিক্রিয়া জানাতে লম্বা সময় নিয়েছিল। সে সময়টায় ফেলানী লাশ হয়ে ঝুলছিল, পড়ে ছিল ভিনদেশে। কেন? তার মায়ের ভাষায় ‘হামরা গরিব মানুষ, প্যাটের ভখোত ভারত গেছিলাম।’ পরের কাহিনি সবার জানা। জীবিত ফেলানী দেশহারা হলেও মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের খাঁটি শোক ও সহানুভূতির জোয়ারে সে ফিরে পেয়েছিল দেশের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার অধিকারে সে হয়ে উঠেছিল সবার কন্যা। ফেলে দেওয়া ফেলানী মৃত্যুর মূল্যে অবশেষে ফিরেছিল দেশে। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফেলানীর সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং তার শোকে আপ্লুত কোটি মানুষের ভালোবাসাকে একটি বাক্যের বাণে তুচ্ছ করে দিলেন?
আমরা কথা বলে চলি। সেসব কথা কেউ শোনে, কেউ শোনে না। কিন্তু মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীরা যখন কথা বলেন, তখন সবাইকেই তা শুনতে হয়। তাঁদের কথা বাণীর মতো, বারবার মনে আসে। বারবার শুনতে শুনতে তা একসময় ‘সত্য’ হয়ে যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাহলে ফেলানী বিষয়ে আমাদের জানা সত্য বাতিল করে বিদেশের মাটিতে কোন ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন? কী দরকারে? চাইলেন যদি, তাহলে প্রমাণ দিলেন না কেন? আর ফেলানীর পরিচয় যা-ই হোক, তাতে তার মৃত্যুর বেদনার কোনো হেরফের হয় না।
গত রোববার নিউইয়র্কের এক সভায় ফেলানী বিষয়ে তাঁর বলা চারটি বাক্য প্রকাশিত হয়েছে পরের দিনের প্রথম আলোয়। তিনি বলেছেন, ‘বিএসএফের হাতে নিহত ফেলানী বাংলাদেশি নয়। তারা ভারতীয়। তার পরও সরকার পরিবারটির জন্য অনেক কিছু করেছে। আমি নিজে তাদের বাড়িতে গিয়েছি।’
এই চারটি বাক্যের প্রথম দুটির সত্যতা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই তো দেশের সব নাগরিকের জানমালের জিম্মাদার। তিনি নিশ্চয়ই মিথ্যা বলতে পারেন না। তাহলে ফেলানী ‘বাংলাদেশি’ এই সত্য জ্ঞান করে যারা দুঃখ পেয়েছিল, তারাই নির্ঘাত ‘মিথ্যাবাদী’। মিথ্যাবাদী ফেলানীর বাবা-মাসহ তার গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। মিথ্যাবাদী দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম, মিথ্যাবাদী গোটা বাংলাদেশ। সাহারা খাতুন আইনের লোক, অ্যাডভোকেট মানুষ। তাই তাঁকে একটা আইনি প্রশ্নই করা যায়: তাঁর দাবির ভিত্তি কী, তা প্রকাশ করা হোক। ফেলানী যদি ভারতীয়ই হবে, কেন তাহলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেরি করে হলেও ভারতের কাছে প্রতিবাদ করেছিল? যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা গত এক দশকে ১০০০ (হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন) বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে ছাড় পেয়েছে, তারাই বা কেন ফেলানী হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল? কেন তাদের কয়েকজনকে এ ঘটনার জন্য ‘ভর্ৎসনা’ শুনতে হলো? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তৃতীয় বাক্যটি অর্থাৎ ‘তার পরও সরকার পরিবারটির জন্য অনেক কিছু করেছে’ এই কথাটিও বিতর্কিত। কিছু অর্থ সাহায্য নিশ্চয়ই তারা পেয়েছে। কিন্তু সরকারের প্রধান কাজ জনগণকে রক্ষা করা, তাদের যে কারও ওপর করা অন্যায়ের বিচার করা। সেটি কি তাঁরা করতে পেরেছিলেন? তাঁর চতুর্থ বাক্যটি ছিল, ‘আমি নিজে তাদের বাড়িতে গিয়েছি।’ কথাটা স্ববিরোধী হয়ে গেল না? ফেলানী যদি ভারতীয় নাগরিকই হবে, তাহলে তিনি তার বাড়িতে কীভাবে যাবেন, কেনই বা যাবেন? ভারতীয় নাগরিকের বাড়ি তো ভারতীয় ভূখণ্ডেই হওয়ার কথা। যে ফেলানী বাংলাদেশি নয়, সেই ফেলানীর পরিবার কীভাবে বাংলাদেশে বাস করছিল? কেন বাবা-মেয়ে ভারত থেকে মরতে আসছিল বাংলাদেশে? প্রথমে বিএসএফের গুলি, পরে সাহারা খাতুনের এই অবিস্মরণীয় উক্তি, দুটো ঘটনাই ফেলানীর নামকরণকে ‘সার্থক’ করল অর্থাৎ তাকে পরিত্যক্তা হিসেবেই রেখে দিল।
কিন্তু সীমান্তের দুই পারের গ্রামের মানুষ এতটা নির্বিকার থাকতে পারেনি। ফেলানী যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছিল, তখন তারা বেড়ার দুই পারে মিছিল করে প্রতিবাদ করছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হত্যাকর্মের নিন্দা করতে বাধেনি অনেক ভারতীয় নাগরিকেরও। অথচ আমাদের মন্ত্রীর সেটা বাধছে! তাঁর কথা মানলে বিএসএফ বাংলাদেশের দিক থেকে দায়মুক্ত। তাহলে একে এখন ভারতীয় বাহিনীর হাতে ভারতীয় নাগরিক হত্যার মামলা বলে ভাবতে হবে আমাদের!
দুই.
সীমান্ত মানে মাটি ও মানুষের ভাগাভাগি। মাটিতে দাগ ছাড়া সীমান্ত হয় না, মানচিত্র হয় না। জীবিত ফেলানীর সীমান্ত ছিল, কিন্তু মৃত ফেলানী কোনো পার্থিব সীমান্তে ছিল না ওই কয়েক ঘণ্টা। সে ঝুলে ছিল শূন্যে। কাঁটাতারের আগের জীবনেও তার দেশ ছিল না, কাঁটাতারে লটকে থাকার ওই সময়টাতেও সে দেশহীন। সে তখন দেশ ও মাটির ঊর্ধ্বে।
মানুষের মনের ঘৃণা ও ভালোবাসার সীমান্তে শহীদ হয়েছিলেন যিশু। মানবতার জন্য ক্রুশবিদ্ধ হয়ে শরীরের সব রক্ত ঝরিয়ে প্রাণদান করতে হয়েছিল তাঁকে। আর ফেলানী ইতিহাসের দুই সীমান্তের শহীদ। যিশুর মতোই কাঁটাবিদ্ধ, নৃশংসতার ফলকবিদ্ধ। যিশুর মতোই সে উঠে গিয়েছিল সমাজ-সংসারের ওপর, সব ভেদাভেদের বাইরে। তার মৃত্যু তখন নিষ্পাপ মানবতার মৃত্যু। যিশুর মতো তারও দুই হাত বাড়ানো ছিল মানুষের দিকে, মাটির দিকে। কিন্তু কেউ ধরেনি সেই হাত। আধা ঘণ্টা ধরে ‘পানি’ ‘পানি’ বলে চিৎকার করলেও তাঁর হতভাগ্য পিতা ছাড়া আর কারও কানে যায়নি সেই ডাক। এভাবে মাসুমের রক্তে ভিজল দুই দেশের সীমান্ত, ভারত বাংলাদেশের ভালোবাসার সংসার।
১৯৪৭ সালে রক্ত দিয়ে এই সংসার ভাগ হয়েছিল, রক্ত দিয়েই সেই ভাগ রক্ষিত হচ্ছে। মাঝখানে পথ নেই, পরিখা আছে, কাঁটাতার আছে। মানবিকতাটাই শুধু নেই।
তিন.
বাংলার কবি, বরিশালের সন্তান জীবনানন্দ দাশ সম্ভবত ছেচল্লিশের দাঙ্গায় নিহতদের মনে রেখে লিখেছিলেন, ‘মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ/ উড়ুক উড়ুক তারা পৌষের জোছনায় নীরবে উড়ুক’। এখনো বাংলার আকাশজুড়ে ছেচল্লিশের, একাত্তরের, তার আগের আর তার পরের সব বেওয়ারিশ আত্মারা উড়ছে। আকাশ ঢেকে আসছে রাষ্ট্রীয় অপঘাতের শিকারেরা। বাতাস ফাঁপছে তাদের শ্বাসাঘাতে। বিজলির ফলায় কাঁটাতার ছিঁড়ে ছিঁড়ে তারা উড়ছে আর পাক খাচ্ছে—এ সীমান্ত থেকে সেই সীমান্ত অবধি।
আমাদের সীমান্তে কোনো সংঘাত নেই, যুদ্ধ নেই, তবু এত অপঘাত কেন?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
প্রকৃতির বিচারে সব মৃত্যুই সমান। কে কীভাবে মরল, কাদের হাতে মরল, স্বাভাবিক মৃত্যু হলো নাকি হলো অপঘাতে, তার মূল্যায়ন প্রকৃতি করে না। কিন্তু মানুষের কাছে, মানুষের আইন, যুক্তি ও নৈতিকতার কাছে সব মৃত্যু নয় সমান। কোনো কোনো মৃত্যুর কারণ ব্যক্তি, কোনো মৃত্যুর কারণ রাষ্ট্র। ফেলানী রাষ্ট্রীয় হত্যার শিকার। তার বয়স এবং মৃত্যুর পরিস্থিতি পাথরের মতো ভারী হয়ে চেপে বসে আমাদের মনে। তাই সেই মৃত্যুতে ক্ষোভের হুতাশন জ্বলে উঠেছিল। শোকতপ্ত হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। সেই শোকের আগুন যখন ছাইচাপা যেতে বসেছে, তখনই আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং শুকিয়ে আসা ক্ষতে আঘাত করলেন। তিনি কিশোরী ফেলানীকে অস্বীকার করলেন। বঞ্চিত করলেন মেয়েটির বাংলাদেশি নাগরিকত্ব এবং জীবিত বা মৃত অবস্থায় তার আইনি অধিকার। জীবিত অবস্থায় তার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারেনি। মৃত্যুর পর দেখিয়েছিল গড়িমসিপনা। প্রতিক্রিয়া জানাতে লম্বা সময় নিয়েছিল। সে সময়টায় ফেলানী লাশ হয়ে ঝুলছিল, পড়ে ছিল ভিনদেশে। কেন? তার মায়ের ভাষায় ‘হামরা গরিব মানুষ, প্যাটের ভখোত ভারত গেছিলাম।’ পরের কাহিনি সবার জানা। জীবিত ফেলানী দেশহারা হলেও মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের খাঁটি শোক ও সহানুভূতির জোয়ারে সে ফিরে পেয়েছিল দেশের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার অধিকারে সে হয়ে উঠেছিল সবার কন্যা। ফেলে দেওয়া ফেলানী মৃত্যুর মূল্যে অবশেষে ফিরেছিল দেশে। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফেলানীর সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং তার শোকে আপ্লুত কোটি মানুষের ভালোবাসাকে একটি বাক্যের বাণে তুচ্ছ করে দিলেন?
আমরা কথা বলে চলি। সেসব কথা কেউ শোনে, কেউ শোনে না। কিন্তু মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীরা যখন কথা বলেন, তখন সবাইকেই তা শুনতে হয়। তাঁদের কথা বাণীর মতো, বারবার মনে আসে। বারবার শুনতে শুনতে তা একসময় ‘সত্য’ হয়ে যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাহলে ফেলানী বিষয়ে আমাদের জানা সত্য বাতিল করে বিদেশের মাটিতে কোন ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন? কী দরকারে? চাইলেন যদি, তাহলে প্রমাণ দিলেন না কেন? আর ফেলানীর পরিচয় যা-ই হোক, তাতে তার মৃত্যুর বেদনার কোনো হেরফের হয় না।
গত রোববার নিউইয়র্কের এক সভায় ফেলানী বিষয়ে তাঁর বলা চারটি বাক্য প্রকাশিত হয়েছে পরের দিনের প্রথম আলোয়। তিনি বলেছেন, ‘বিএসএফের হাতে নিহত ফেলানী বাংলাদেশি নয়। তারা ভারতীয়। তার পরও সরকার পরিবারটির জন্য অনেক কিছু করেছে। আমি নিজে তাদের বাড়িতে গিয়েছি।’
এই চারটি বাক্যের প্রথম দুটির সত্যতা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই তো দেশের সব নাগরিকের জানমালের জিম্মাদার। তিনি নিশ্চয়ই মিথ্যা বলতে পারেন না। তাহলে ফেলানী ‘বাংলাদেশি’ এই সত্য জ্ঞান করে যারা দুঃখ পেয়েছিল, তারাই নির্ঘাত ‘মিথ্যাবাদী’। মিথ্যাবাদী ফেলানীর বাবা-মাসহ তার গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। মিথ্যাবাদী দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম, মিথ্যাবাদী গোটা বাংলাদেশ। সাহারা খাতুন আইনের লোক, অ্যাডভোকেট মানুষ। তাই তাঁকে একটা আইনি প্রশ্নই করা যায়: তাঁর দাবির ভিত্তি কী, তা প্রকাশ করা হোক। ফেলানী যদি ভারতীয়ই হবে, কেন তাহলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেরি করে হলেও ভারতের কাছে প্রতিবাদ করেছিল? যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা গত এক দশকে ১০০০ (হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন) বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে ছাড় পেয়েছে, তারাই বা কেন ফেলানী হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল? কেন তাদের কয়েকজনকে এ ঘটনার জন্য ‘ভর্ৎসনা’ শুনতে হলো? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তৃতীয় বাক্যটি অর্থাৎ ‘তার পরও সরকার পরিবারটির জন্য অনেক কিছু করেছে’ এই কথাটিও বিতর্কিত। কিছু অর্থ সাহায্য নিশ্চয়ই তারা পেয়েছে। কিন্তু সরকারের প্রধান কাজ জনগণকে রক্ষা করা, তাদের যে কারও ওপর করা অন্যায়ের বিচার করা। সেটি কি তাঁরা করতে পেরেছিলেন? তাঁর চতুর্থ বাক্যটি ছিল, ‘আমি নিজে তাদের বাড়িতে গিয়েছি।’ কথাটা স্ববিরোধী হয়ে গেল না? ফেলানী যদি ভারতীয় নাগরিকই হবে, তাহলে তিনি তার বাড়িতে কীভাবে যাবেন, কেনই বা যাবেন? ভারতীয় নাগরিকের বাড়ি তো ভারতীয় ভূখণ্ডেই হওয়ার কথা। যে ফেলানী বাংলাদেশি নয়, সেই ফেলানীর পরিবার কীভাবে বাংলাদেশে বাস করছিল? কেন বাবা-মেয়ে ভারত থেকে মরতে আসছিল বাংলাদেশে? প্রথমে বিএসএফের গুলি, পরে সাহারা খাতুনের এই অবিস্মরণীয় উক্তি, দুটো ঘটনাই ফেলানীর নামকরণকে ‘সার্থক’ করল অর্থাৎ তাকে পরিত্যক্তা হিসেবেই রেখে দিল।
কিন্তু সীমান্তের দুই পারের গ্রামের মানুষ এতটা নির্বিকার থাকতে পারেনি। ফেলানী যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছিল, তখন তারা বেড়ার দুই পারে মিছিল করে প্রতিবাদ করছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হত্যাকর্মের নিন্দা করতে বাধেনি অনেক ভারতীয় নাগরিকেরও। অথচ আমাদের মন্ত্রীর সেটা বাধছে! তাঁর কথা মানলে বিএসএফ বাংলাদেশের দিক থেকে দায়মুক্ত। তাহলে একে এখন ভারতীয় বাহিনীর হাতে ভারতীয় নাগরিক হত্যার মামলা বলে ভাবতে হবে আমাদের!
দুই.
সীমান্ত মানে মাটি ও মানুষের ভাগাভাগি। মাটিতে দাগ ছাড়া সীমান্ত হয় না, মানচিত্র হয় না। জীবিত ফেলানীর সীমান্ত ছিল, কিন্তু মৃত ফেলানী কোনো পার্থিব সীমান্তে ছিল না ওই কয়েক ঘণ্টা। সে ঝুলে ছিল শূন্যে। কাঁটাতারের আগের জীবনেও তার দেশ ছিল না, কাঁটাতারে লটকে থাকার ওই সময়টাতেও সে দেশহীন। সে তখন দেশ ও মাটির ঊর্ধ্বে।
মানুষের মনের ঘৃণা ও ভালোবাসার সীমান্তে শহীদ হয়েছিলেন যিশু। মানবতার জন্য ক্রুশবিদ্ধ হয়ে শরীরের সব রক্ত ঝরিয়ে প্রাণদান করতে হয়েছিল তাঁকে। আর ফেলানী ইতিহাসের দুই সীমান্তের শহীদ। যিশুর মতোই কাঁটাবিদ্ধ, নৃশংসতার ফলকবিদ্ধ। যিশুর মতোই সে উঠে গিয়েছিল সমাজ-সংসারের ওপর, সব ভেদাভেদের বাইরে। তার মৃত্যু তখন নিষ্পাপ মানবতার মৃত্যু। যিশুর মতো তারও দুই হাত বাড়ানো ছিল মানুষের দিকে, মাটির দিকে। কিন্তু কেউ ধরেনি সেই হাত। আধা ঘণ্টা ধরে ‘পানি’ ‘পানি’ বলে চিৎকার করলেও তাঁর হতভাগ্য পিতা ছাড়া আর কারও কানে যায়নি সেই ডাক। এভাবে মাসুমের রক্তে ভিজল দুই দেশের সীমান্ত, ভারত বাংলাদেশের ভালোবাসার সংসার।
১৯৪৭ সালে রক্ত দিয়ে এই সংসার ভাগ হয়েছিল, রক্ত দিয়েই সেই ভাগ রক্ষিত হচ্ছে। মাঝখানে পথ নেই, পরিখা আছে, কাঁটাতার আছে। মানবিকতাটাই শুধু নেই।
তিন.
বাংলার কবি, বরিশালের সন্তান জীবনানন্দ দাশ সম্ভবত ছেচল্লিশের দাঙ্গায় নিহতদের মনে রেখে লিখেছিলেন, ‘মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ/ উড়ুক উড়ুক তারা পৌষের জোছনায় নীরবে উড়ুক’। এখনো বাংলার আকাশজুড়ে ছেচল্লিশের, একাত্তরের, তার আগের আর তার পরের সব বেওয়ারিশ আত্মারা উড়ছে। আকাশ ঢেকে আসছে রাষ্ট্রীয় অপঘাতের শিকারেরা। বাতাস ফাঁপছে তাদের শ্বাসাঘাতে। বিজলির ফলায় কাঁটাতার ছিঁড়ে ছিঁড়ে তারা উড়ছে আর পাক খাচ্ছে—এ সীমান্ত থেকে সেই সীমান্ত অবধি।
আমাদের সীমান্তে কোনো সংঘাত নেই, যুদ্ধ নেই, তবু এত অপঘাত কেন?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments