চাক্কা জ্যাম by অমিত বসু
স্টার্ট দিয়ে গিয়ার নিউট্রালে রেখে সামনে অ্যাকসেলে চাপ দিচ্ছেন মমতা। লোককে গতির শব্দ শোনাবেন বলে সাইলেন্সারটা ভেঙে রেখেছেন। তাতে চলুক না চলুক গর্জন তীব্র। অটো এমিশন চেক না করানোয় ধূম্রজাল। ধোঁয়া এবং শব্দ নিখরচায় নয়। যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। আহ্লাদে নটরাজের ডমরু বাজাচ্ছে মিডিয়া। কটাকট টকাটক।
অনেকটা ঘড়ির টিকটিকের মতো। সময়ের সতর্কতা। প্রতি পল মাপছে। সরকার চলুক না চলুক দু'দণ্ড বিশ্রাম নিচ্ছেন মমতা। পাহাড় থেকে জঙ্গল, কংক্রিটের অরণ্য থেকে সাগর, চল চপলার চকিত চমকে চরণ-বিচরণ।
পিসিমার দুরবস্থা দেখে চুপ না থাকতে পারেননি ভ্রাতুষ্পুত্র আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের গাড়ি ছুটিয়েছেন বেপরোয়াভাবে। ধাক্কা লাগুক, শকট সংকটে পড়ূক, স্পিডোমিটার উড়ে যাক, পরোয়া নেই। যাত্রীর উত্তাপে সব বাধা বরফের মতো গলতে বাধ্য। বাদ সেধেছেন পুলিশ কনস্টেবল। রুখতে চেয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে সপাটে চড় কষিয়ে আকাশ তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পিসিমার কথা। যার কাছে প্রতি পল অমূল্য। আইন যাই বলুক, গাড়ি থামাতে যারা লাল সিগন্যাল দেখায়, তারা সিপিএমের লোক। রক্তিম যে সিপিএমের নিশান, একটা শিশুও জানে। পুলিশ জানে না। এ সরকার লাল হলুদ মানে না। তাদের চোখে সবাই সজীব, সবই সবুজ।
মহাকরণের মন্ত্রীরা এসবের তাৎপর্য আকাশকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। মিডিয়ার চিৎকারে গোলমাল করে ফেলল পুলিশ। সেকেলে আইনে জেলে ভরে দিল আকাশকে। এমন ব্যাকডেটেড রাজ্য ভূভারতে নেই। সবেতে পিছিয়ে থাকা। এগিয়ে যাওয়ার নামগন্ধ কর্পূরের মতো উধাও। কপালে শেষ পর্যন্ত কী আছে কে জানে।
না, এভাবে হবে না। মানুষের চোখে নতুন রঙ লাগাতে হবে। সবকিছু সহজে ঢাকলে কথা উঠবে, তার চেয়ে নীল-সাদা ভালো। অসীম প্রেম আর পবিত্রতার প্রতীক। এই বসন্তে স্বর্গীয় উদ্ভাসে রঙে রঙে বিভোর শহুরেরা। রেলিং থেকে পার্কের বেঞ্চ, গাছের গুঁড়ি থেকে এয়ারপোর্ট টার্মিনাল, রঙের প্রলেপে ললিত সুন্দর। রাস্তার ফুটপাতে অতিরিক্ত ল্যাম্পপোস্ট। এক একটায় তিনটা আলো। উজ্জ্বলতায় লজ্জা পাবে লন্ডন। ভালো করে দেখুক সবাই, সরকার কতটা অন্ধকারের শত্রু।
আশ্চর্য, বর্ণময়তায় কলঙ্কের খোঁজ। অভিযোগ, রঙ করার নামে স্বজন পোষণ। উপকৃত মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার। যদি সত্যিই তাই হয়, ক্ষতি কী? চ্যারিটি বিগিনস অ্যাক্ট হোম। ঘর কাঁদবে, বাইরেটা হাসবে, সে তো হতে পারে না। তবে রঙ কোম্পানিগুলো কাঁদতে শুরু করেছে। ক্রেডিটে রঙ সাপ্লাইয়ের বাধ্যবাধকতা। চুন-বালি-সিমেন্ট বাকিতে দিলে চলে, রঙের বেলায় সেটা খাটে না। প্রমোটররা সে কথা জানে। যারা শহর রাঙাতে চায়, তারা বুঝেও বোঝে না। তাদের ধার এতটাই, কোনো রাজনীতির ধার ধারার দরকার পড়ে না।
সমস্যাটা অন্য জায়গায়। যারা টেন্ডার পাচ্ছে, ট্রাফিক রুলস ভেঙে জেলে যাচ্ছে, উৎসবে, দাঙ্গায়, ফ্যাসাদে জড়িয়ে থাকায় আটক হচ্ছে, সবার ঠিকানা একটাই, ৩০ বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। মুখ্যমন্ত্রীও ঠিক এক ঠিকানাতেই থাকেন। একান্নবর্তী পরিবার টুকরো টুকরো হয়ে এবার এধার-ওধার ছিটকাচ্ছে। সেখানে সপরিবার থাকাটা নিঃসন্দেহে আনন্দের।
যৌথ পরিবারের নিয়ম, বিপদে-আপদে সবাই একসঙ্গে থাকবে। স্বার্থপরের মতো অতিরিক্ত সুখের আশায় কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। মুখ্যমন্ত্রী সেই নীতিতে বিশ্বাসী। নভেম্বরে লজ্জার মাথা খেয়ে দুই ভাইকে ভবানীপুর থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। জাতীয় টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকারে কৈফিয়ত হিসেবে বলেছেন, না ছাড়ালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। তার মানে কি এই, তার ভাইয়েদের জন্য শহরে দাঙ্গা লাগতে পারে!
ভয়ের কারণটা অনেক সময় রাজনীতির সব রঙ ছাপিয়ে ওঠে। কিছুতেই চাপা দেওয়া যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, সাংবাদিকরা ঘরপোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়। মমতার মতো বিজেপির পপুলার রাজনীতিক প্রমোদ মহাজনের করুণ পরিণতির কথা ভুলে যাওয়াটা কঠিন। তাকে ভাইয়ের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সাধারণত দেখা যায়, পরিবারে একজন বড় হলে তার কাঁধে ভর দিয়ে অন্যরা উঠতে চায়। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফেলতে গেলে পরিস্থিতি মর্মান্তিক হয়। পরিবারে মমতার একমাত্র আশ্রয় ছিলেন মা গায়েত্রী দেবী। তিনি চলে যাওয়ার পর বাড়িতে অনেকের সঙ্গে থেকেও মমতা একা। বোঝা কিন্তু অনেক। এক ছাদের নিচে থাকার দরুন দাবি-দাওয়া ঊর্ধ্বমুখী। সহযোগ কম, চাহিদা বেশি। দুর্যোগ সে কারণেই। মমতার ঠিকানা বদলানোর সময় এসেছে। পেশাদার রাজনীতিক হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই জানেন, রাজ্যের রাজনীতির ঢেউ সামলানোর চেয়ে ফ্যামিলি পলিটিক্সের মোকাবেলা করা অনেক কঠিন।
অমিত বসু :পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক
পিসিমার দুরবস্থা দেখে চুপ না থাকতে পারেননি ভ্রাতুষ্পুত্র আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের গাড়ি ছুটিয়েছেন বেপরোয়াভাবে। ধাক্কা লাগুক, শকট সংকটে পড়ূক, স্পিডোমিটার উড়ে যাক, পরোয়া নেই। যাত্রীর উত্তাপে সব বাধা বরফের মতো গলতে বাধ্য। বাদ সেধেছেন পুলিশ কনস্টেবল। রুখতে চেয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে সপাটে চড় কষিয়ে আকাশ তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পিসিমার কথা। যার কাছে প্রতি পল অমূল্য। আইন যাই বলুক, গাড়ি থামাতে যারা লাল সিগন্যাল দেখায়, তারা সিপিএমের লোক। রক্তিম যে সিপিএমের নিশান, একটা শিশুও জানে। পুলিশ জানে না। এ সরকার লাল হলুদ মানে না। তাদের চোখে সবাই সজীব, সবই সবুজ।
মহাকরণের মন্ত্রীরা এসবের তাৎপর্য আকাশকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। মিডিয়ার চিৎকারে গোলমাল করে ফেলল পুলিশ। সেকেলে আইনে জেলে ভরে দিল আকাশকে। এমন ব্যাকডেটেড রাজ্য ভূভারতে নেই। সবেতে পিছিয়ে থাকা। এগিয়ে যাওয়ার নামগন্ধ কর্পূরের মতো উধাও। কপালে শেষ পর্যন্ত কী আছে কে জানে।
না, এভাবে হবে না। মানুষের চোখে নতুন রঙ লাগাতে হবে। সবকিছু সহজে ঢাকলে কথা উঠবে, তার চেয়ে নীল-সাদা ভালো। অসীম প্রেম আর পবিত্রতার প্রতীক। এই বসন্তে স্বর্গীয় উদ্ভাসে রঙে রঙে বিভোর শহুরেরা। রেলিং থেকে পার্কের বেঞ্চ, গাছের গুঁড়ি থেকে এয়ারপোর্ট টার্মিনাল, রঙের প্রলেপে ললিত সুন্দর। রাস্তার ফুটপাতে অতিরিক্ত ল্যাম্পপোস্ট। এক একটায় তিনটা আলো। উজ্জ্বলতায় লজ্জা পাবে লন্ডন। ভালো করে দেখুক সবাই, সরকার কতটা অন্ধকারের শত্রু।
আশ্চর্য, বর্ণময়তায় কলঙ্কের খোঁজ। অভিযোগ, রঙ করার নামে স্বজন পোষণ। উপকৃত মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার। যদি সত্যিই তাই হয়, ক্ষতি কী? চ্যারিটি বিগিনস অ্যাক্ট হোম। ঘর কাঁদবে, বাইরেটা হাসবে, সে তো হতে পারে না। তবে রঙ কোম্পানিগুলো কাঁদতে শুরু করেছে। ক্রেডিটে রঙ সাপ্লাইয়ের বাধ্যবাধকতা। চুন-বালি-সিমেন্ট বাকিতে দিলে চলে, রঙের বেলায় সেটা খাটে না। প্রমোটররা সে কথা জানে। যারা শহর রাঙাতে চায়, তারা বুঝেও বোঝে না। তাদের ধার এতটাই, কোনো রাজনীতির ধার ধারার দরকার পড়ে না।
সমস্যাটা অন্য জায়গায়। যারা টেন্ডার পাচ্ছে, ট্রাফিক রুলস ভেঙে জেলে যাচ্ছে, উৎসবে, দাঙ্গায়, ফ্যাসাদে জড়িয়ে থাকায় আটক হচ্ছে, সবার ঠিকানা একটাই, ৩০ বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। মুখ্যমন্ত্রীও ঠিক এক ঠিকানাতেই থাকেন। একান্নবর্তী পরিবার টুকরো টুকরো হয়ে এবার এধার-ওধার ছিটকাচ্ছে। সেখানে সপরিবার থাকাটা নিঃসন্দেহে আনন্দের।
যৌথ পরিবারের নিয়ম, বিপদে-আপদে সবাই একসঙ্গে থাকবে। স্বার্থপরের মতো অতিরিক্ত সুখের আশায় কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। মুখ্যমন্ত্রী সেই নীতিতে বিশ্বাসী। নভেম্বরে লজ্জার মাথা খেয়ে দুই ভাইকে ভবানীপুর থানা থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। জাতীয় টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকারে কৈফিয়ত হিসেবে বলেছেন, না ছাড়ালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। তার মানে কি এই, তার ভাইয়েদের জন্য শহরে দাঙ্গা লাগতে পারে!
ভয়ের কারণটা অনেক সময় রাজনীতির সব রঙ ছাপিয়ে ওঠে। কিছুতেই চাপা দেওয়া যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, সাংবাদিকরা ঘরপোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়। মমতার মতো বিজেপির পপুলার রাজনীতিক প্রমোদ মহাজনের করুণ পরিণতির কথা ভুলে যাওয়াটা কঠিন। তাকে ভাইয়ের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সাধারণত দেখা যায়, পরিবারে একজন বড় হলে তার কাঁধে ভর দিয়ে অন্যরা উঠতে চায়। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফেলতে গেলে পরিস্থিতি মর্মান্তিক হয়। পরিবারে মমতার একমাত্র আশ্রয় ছিলেন মা গায়েত্রী দেবী। তিনি চলে যাওয়ার পর বাড়িতে অনেকের সঙ্গে থেকেও মমতা একা। বোঝা কিন্তু অনেক। এক ছাদের নিচে থাকার দরুন দাবি-দাওয়া ঊর্ধ্বমুখী। সহযোগ কম, চাহিদা বেশি। দুর্যোগ সে কারণেই। মমতার ঠিকানা বদলানোর সময় এসেছে। পেশাদার রাজনীতিক হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই জানেন, রাজ্যের রাজনীতির ঢেউ সামলানোর চেয়ে ফ্যামিলি পলিটিক্সের মোকাবেলা করা অনেক কঠিন।
অমিত বসু :পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক
No comments