স্মরণ-শওকত জামিল আমাদের ক্ষমা করবেন by মনজুরুল আহসান বুলবুল
সাংবাদিকদের মৃত্যুসংবাদ নিয়েই অতিবাহিত করছি প্রতিদিন প্রতি রাত। সাগর-রুনির রেশ তো কাটছেই না—সবশেষ মেঘনায় লঞ্চডুবিতে হারালাম বাংলাভিশনের ফটোসাংবাদিককে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাসুদের এই অসহায় মৃত্যু-কাতরতার সঙ্গে যোগ দিলেন শওকত জামিল।
দেশে-বিদেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রকেই গণ্য করি নিজের আসল পরিবার হিসেবে। এই অঙ্গনের ভালো-মন্দ তাড়িত করে খুব দ্রুত। এ কারণেই তুরস্কের সাংবাদিক নাদিম সেনরের কারামুক্তিতে যেমন উজ্জীবিত হই, তেমনই মংলায় সাংবাদিক মনিরের স্ত্রীর আগুনে পুড়ে করুণ মৃত্যু বা চট্টগ্রামের জসিম চৌধুরীর উচ্ছল কিশোর পুত্রের পানিতে ডুবে হারিয়ে যাওয়াকে নিজের পরিবারের বেদনা বলেই গণ্য করি। কিন্তু, না, আমি স্মৃতিকাতরতা থেকে কলম ধরিনি। এই মুহূর্তে আমি ক্ষুব্ধ এবং দুঃখিত। আমার এই ক্ষোভ সংবাদপত্রগুলোর প্রতি, আমার দুঃখ আমার পেশাকে নিয়েই।
ফটোসাংবাদিক শওকত জামিল আমার সহকর্মী ছিলেন। দীর্ঘসময় আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। জামিলের অসংখ্য চোখ-ঝলসানো ছবি দিয়ে সংবাদপত্রের প্রথম পাতা সাজিয়েছি দীর্ঘদিন, আবার অনেক ছবি ফেলে দিয়ে তর্কে কাটিয়েছি অনেক সন্ধ্যা-সকাল। সেই জামিল আজ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। জানি, তাঁকে নিয়ে অনেক শোকসভা হবে, স্মৃতিচারণার নহর বইবে, জামিল কত ভালো ছিলেন, সে কথা বলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখব আমরা। কিন্তু তাঁর প্রতি কী আচরণ করেছে আমাদের সংবাদপত্রগুলো? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে দেখি সংবাদপত্রগুলোই জামিল সম্পর্কে কী লিখেছে:
১. তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে রেখে গেছেন।
২. ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী ও সদালাপী ছিলেন শওকত জামিল।
৩. গতকাল সকাল ১০টায় এলিফ্যান্ট রোডে অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে ঘটনাস্থলে ছোটেন ছবি তুলতে। হঠার্যা বুকে ব্যথা অনুভব করলে তিনি প্রথমে জাতীয় প্রেসক্লাবে গিয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নেন। ব্যথা আরও বাড়তে থাকলে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেগুনবাগিচায় নিজ বাসায় যান। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে দ্রুত বারডেম হাসপাতালের কার্ডিয়াক সেন্টারে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকির্যাসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
৪। ১৯৫৬ সালের ২২ জুন বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন শওকত জামিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) পাস করেন।
৫। তাঁর পিতা আবদুল লতিফ খান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
৬। জামিল ১৯৮২ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর ফটোসাংবাদিক হিসেবে দৈনিক খবর, সর্বশেষ ২০০৫ সাল থেকে ডেইলি স্টার পত্রিকার জ্যেষ্ঠ ফটোসাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সারাংশ হচ্ছে: শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান জামিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে পেশা হিসেবে বেছে নেন ফটোসাংবাদিকতা। ভালো মানুষ, দায়িত্বশীল সাংবাদিক শওকত জামিল মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও পেশাগত দায়িত্বই পালন করেছেন। দেশের স্বনামধন্য দুটো পত্রিকায় সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবেই কাজ করেছেন তিনি। এর বাইরে জামিল ছিলেন উচ্চাঙ্গসংগীতের সমঝদার, নিজে সেতার বাজাতেন। ছেলের নাম রেখেছেন বেহাগ জামিল। সে-ও সম্ভবত গানের জগতে ঢুকেছে বাবার আগ্রহেই।
সেই জামিলের আকস্মিক মৃত্যুর ধাক্কা বুকে নিয়েই প্রশ্ন করি, শওকত জামিলের মৃত্যুসংবাদটি ছাপতে গিয়ে তাঁর প্রতি যোগ্য সম্মান কি দেখিয়েছে আমাদের গণমাধ্যমগুলো? ১৪ মার্চ শওকত জামিলের মৃত্যুর পরদিন তাঁর মৃত্যুসংবাদটি দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, সমকাল, জনকণ্ঠ, যুগান্তর, আমার দেশ ছেপেছে শেষ পৃষ্ঠায়। জামিলের শেষ কর্মস্থল ডেইলি স্টার জামিল সম্পর্কে চমর্যাকার রিপোর্ট ছেপেছে, কিন্তু প্রথম পাতায় ঠাঁই হয়নি তাঁর। তাঁর আগের কর্মস্থল সংবাদ-এ জামিলের জায়গা হয়েছে শেষ পৃষ্ঠায় শেষ কলামে ভাঁজের নিচে। ‘নামকরা’ আরও কিছু পত্রিকায় জামিল ঢুকে গেছে ভেতরের পাতায়! এর মাধ্যমে আমরা কি শওকত জামিলের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখালাম? কেন শওকত জামিলের মৃত্যুর খবরটি আমরা প্রধান দৈনিকগুলোর প্রথম পাতায় ছাপতে পারলাম না? জামিল যদি খুন হতেন, যদি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যেতেন—কেবল তাহলেই কি তিনি প্রথম পাতায় ঠাঁই করে নেওয়ার যোগ্য হতেন? প্রায় তিন দশক ধরে সফলভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেও কি মৃত্যুর পর প্রথম পাতার খবর হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারলেন না তিনি? সংবাদপত্রের সাধারণ পাঠক যদি প্রশ্ন তোলেন, কী জবাব আমাদের?
অন্য অনেক পেশার মতো সাংবাদিকতা পেশাও যখন ক্রমাগত কলঙ্কিত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত এই পেশার প্রবীণ-নবীন উজ্জ্বল অনুকরণীয় মানুষদের হারিয়ে আমার যখন নিঃস্ব হচ্ছি, কালোটাকা ও ক্ষমতায় মত্ত ব্যক্তিরা যখন হয় গণমাধ্যম দখল, না-হয় তাকে কলুষিত করার মিশন নিয়ে মাঠে, তখন এই পেশায় ভালো মানুষ ও পেশাদার বলে কি কেউ থাকবে না? যোগ্য সম্মান কি তাঁরা পাবেন না? এমনকি মৃত্যুর পরও না? জানি, জামিলের মৃত্যুর এক বছর পর আমরা কেউ এই দিনটির কথা হয়তো স্মরণেও রাখব না; দিবসটি হয়ে যাবে কেবল তাঁর স্ত্রী-সন্তানের।
আমি ক্ষুব্ধ, কারণ, আমি নিশ্চিতভাবেই মনে করি, শওকত জামিলের মৃত্যুর খবরটি প্রথম পাতায় প্রকাশ না করে তাঁর প্রতি আমাদের সংবাদপত্রগুলো অন্যায় আচরণ করেছে। ফটোসাংবাদিক বলেই কি জামিলের প্রতি এমন অবহেলা—এমন একটি সস্তা প্রশ্ন না তুলেও বলি, আমার আশঙ্কা, শওকত জামিলের মৃত্যুসংবাদটি প্রথম পাতায় প্রকাশ না করে আমাদের গণমাধ্যম একটি ভুল বার্তা দিল। বার্তাটি হলো, ভালো মানুষ, এমনকি ভালো সাংবাদিক হলেও তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রথম পাতায় ছাপার মতো গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়! প্রথম পাতা থাকবে সব নেতা-নেত্রীর দখলে! তবে ব্যতিক্রম যে একবারে নেই তা নয়। কারও সঙ্গে তুলনা নয়, জামিল তাঁর নিজের যোগ্যতা দিয়েই প্রথম পাতার খবর হতে পারতেন, সেকথাটিই শুধু আমার বলার।
আমি ব্যথিত এ কারণে: ভালো মানুষ হতে, ভালো হয়ে থাকতে যে সমাজে প্রতিনিয়ত প্রাণান্ত লড়াই করতে হয়, ভালো সাংবাদিক হিসেবে টিকে থাকতে পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি ভয় ও লোভকে জয় করতে হয়। সেখানে মৃত্যুর পরও যদি একজন ভালো মানুষ ও ভালো সাংবাদিকের ন্যূনতম মর্যাদা আমরা নিশ্চিত করতে না পারি, তা হলে এই শিল্পের দুর্ভোগের জন্য বাইরের কাউকে দায়ী করা যাবে না। পেশায় ভালো কাজের স্বীকৃতির জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, বেতন-ভাতার পাশাপাশি পেশার মর্যাদার জন্য নিরন্তর লড়াই করি। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, মৃত্যুর পর নিজের শোক সংবাদটি যাতে মর্যাদার সঙ্গে ছাপা হয়, সে জন্যও বেঁচে থাকতেই লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে!
আমরা বলি, যে জাতি বীরের সম্মান দিতে পারে না, সেখানে নাকি বীরের জন্ম হয় না। গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ বলি, মৃত্যুর পরও যে শিল্প যোগ্য, ভদ্র, মার্জিত ও দক্ষ কর্মীদের মর্যাদা দেয় না, সেই শিল্পের ধ্বংস কি আমরাই ডেকে আনছি না?
একটিই প্রার্থনা: জামিলের প্রতি যে অন্যায় আমরা করলাম, তা ভবিষ্যতের জন্য আমাদের সতর্ক করুক।
শওকত জামিল, আমাদের ক্ষমা করবেন।
মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক।
bulbulahsan@gmail.com
ফটোসাংবাদিক শওকত জামিল আমার সহকর্মী ছিলেন। দীর্ঘসময় আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। জামিলের অসংখ্য চোখ-ঝলসানো ছবি দিয়ে সংবাদপত্রের প্রথম পাতা সাজিয়েছি দীর্ঘদিন, আবার অনেক ছবি ফেলে দিয়ে তর্কে কাটিয়েছি অনেক সন্ধ্যা-সকাল। সেই জামিল আজ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। জানি, তাঁকে নিয়ে অনেক শোকসভা হবে, স্মৃতিচারণার নহর বইবে, জামিল কত ভালো ছিলেন, সে কথা বলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখব আমরা। কিন্তু তাঁর প্রতি কী আচরণ করেছে আমাদের সংবাদপত্রগুলো? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে দেখি সংবাদপত্রগুলোই জামিল সম্পর্কে কী লিখেছে:
১. তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে রেখে গেছেন।
২. ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী ও সদালাপী ছিলেন শওকত জামিল।
৩. গতকাল সকাল ১০টায় এলিফ্যান্ট রোডে অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে ঘটনাস্থলে ছোটেন ছবি তুলতে। হঠার্যা বুকে ব্যথা অনুভব করলে তিনি প্রথমে জাতীয় প্রেসক্লাবে গিয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নেন। ব্যথা আরও বাড়তে থাকলে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেগুনবাগিচায় নিজ বাসায় যান। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে দ্রুত বারডেম হাসপাতালের কার্ডিয়াক সেন্টারে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকির্যাসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
৪। ১৯৫৬ সালের ২২ জুন বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন শওকত জামিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) পাস করেন।
৫। তাঁর পিতা আবদুল লতিফ খান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
৬। জামিল ১৯৮২ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর ফটোসাংবাদিক হিসেবে দৈনিক খবর, সর্বশেষ ২০০৫ সাল থেকে ডেইলি স্টার পত্রিকার জ্যেষ্ঠ ফটোসাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সারাংশ হচ্ছে: শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান জামিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে পেশা হিসেবে বেছে নেন ফটোসাংবাদিকতা। ভালো মানুষ, দায়িত্বশীল সাংবাদিক শওকত জামিল মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও পেশাগত দায়িত্বই পালন করেছেন। দেশের স্বনামধন্য দুটো পত্রিকায় সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবেই কাজ করেছেন তিনি। এর বাইরে জামিল ছিলেন উচ্চাঙ্গসংগীতের সমঝদার, নিজে সেতার বাজাতেন। ছেলের নাম রেখেছেন বেহাগ জামিল। সে-ও সম্ভবত গানের জগতে ঢুকেছে বাবার আগ্রহেই।
সেই জামিলের আকস্মিক মৃত্যুর ধাক্কা বুকে নিয়েই প্রশ্ন করি, শওকত জামিলের মৃত্যুসংবাদটি ছাপতে গিয়ে তাঁর প্রতি যোগ্য সম্মান কি দেখিয়েছে আমাদের গণমাধ্যমগুলো? ১৪ মার্চ শওকত জামিলের মৃত্যুর পরদিন তাঁর মৃত্যুসংবাদটি দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, সমকাল, জনকণ্ঠ, যুগান্তর, আমার দেশ ছেপেছে শেষ পৃষ্ঠায়। জামিলের শেষ কর্মস্থল ডেইলি স্টার জামিল সম্পর্কে চমর্যাকার রিপোর্ট ছেপেছে, কিন্তু প্রথম পাতায় ঠাঁই হয়নি তাঁর। তাঁর আগের কর্মস্থল সংবাদ-এ জামিলের জায়গা হয়েছে শেষ পৃষ্ঠায় শেষ কলামে ভাঁজের নিচে। ‘নামকরা’ আরও কিছু পত্রিকায় জামিল ঢুকে গেছে ভেতরের পাতায়! এর মাধ্যমে আমরা কি শওকত জামিলের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখালাম? কেন শওকত জামিলের মৃত্যুর খবরটি আমরা প্রধান দৈনিকগুলোর প্রথম পাতায় ছাপতে পারলাম না? জামিল যদি খুন হতেন, যদি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যেতেন—কেবল তাহলেই কি তিনি প্রথম পাতায় ঠাঁই করে নেওয়ার যোগ্য হতেন? প্রায় তিন দশক ধরে সফলভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেও কি মৃত্যুর পর প্রথম পাতার খবর হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারলেন না তিনি? সংবাদপত্রের সাধারণ পাঠক যদি প্রশ্ন তোলেন, কী জবাব আমাদের?
অন্য অনেক পেশার মতো সাংবাদিকতা পেশাও যখন ক্রমাগত কলঙ্কিত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত এই পেশার প্রবীণ-নবীন উজ্জ্বল অনুকরণীয় মানুষদের হারিয়ে আমার যখন নিঃস্ব হচ্ছি, কালোটাকা ও ক্ষমতায় মত্ত ব্যক্তিরা যখন হয় গণমাধ্যম দখল, না-হয় তাকে কলুষিত করার মিশন নিয়ে মাঠে, তখন এই পেশায় ভালো মানুষ ও পেশাদার বলে কি কেউ থাকবে না? যোগ্য সম্মান কি তাঁরা পাবেন না? এমনকি মৃত্যুর পরও না? জানি, জামিলের মৃত্যুর এক বছর পর আমরা কেউ এই দিনটির কথা হয়তো স্মরণেও রাখব না; দিবসটি হয়ে যাবে কেবল তাঁর স্ত্রী-সন্তানের।
আমি ক্ষুব্ধ, কারণ, আমি নিশ্চিতভাবেই মনে করি, শওকত জামিলের মৃত্যুর খবরটি প্রথম পাতায় প্রকাশ না করে তাঁর প্রতি আমাদের সংবাদপত্রগুলো অন্যায় আচরণ করেছে। ফটোসাংবাদিক বলেই কি জামিলের প্রতি এমন অবহেলা—এমন একটি সস্তা প্রশ্ন না তুলেও বলি, আমার আশঙ্কা, শওকত জামিলের মৃত্যুসংবাদটি প্রথম পাতায় প্রকাশ না করে আমাদের গণমাধ্যম একটি ভুল বার্তা দিল। বার্তাটি হলো, ভালো মানুষ, এমনকি ভালো সাংবাদিক হলেও তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রথম পাতায় ছাপার মতো গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়! প্রথম পাতা থাকবে সব নেতা-নেত্রীর দখলে! তবে ব্যতিক্রম যে একবারে নেই তা নয়। কারও সঙ্গে তুলনা নয়, জামিল তাঁর নিজের যোগ্যতা দিয়েই প্রথম পাতার খবর হতে পারতেন, সেকথাটিই শুধু আমার বলার।
আমি ব্যথিত এ কারণে: ভালো মানুষ হতে, ভালো হয়ে থাকতে যে সমাজে প্রতিনিয়ত প্রাণান্ত লড়াই করতে হয়, ভালো সাংবাদিক হিসেবে টিকে থাকতে পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি ভয় ও লোভকে জয় করতে হয়। সেখানে মৃত্যুর পরও যদি একজন ভালো মানুষ ও ভালো সাংবাদিকের ন্যূনতম মর্যাদা আমরা নিশ্চিত করতে না পারি, তা হলে এই শিল্পের দুর্ভোগের জন্য বাইরের কাউকে দায়ী করা যাবে না। পেশায় ভালো কাজের স্বীকৃতির জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, বেতন-ভাতার পাশাপাশি পেশার মর্যাদার জন্য নিরন্তর লড়াই করি। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, মৃত্যুর পর নিজের শোক সংবাদটি যাতে মর্যাদার সঙ্গে ছাপা হয়, সে জন্যও বেঁচে থাকতেই লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে!
আমরা বলি, যে জাতি বীরের সম্মান দিতে পারে না, সেখানে নাকি বীরের জন্ম হয় না। গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ বলি, মৃত্যুর পরও যে শিল্প যোগ্য, ভদ্র, মার্জিত ও দক্ষ কর্মীদের মর্যাদা দেয় না, সেই শিল্পের ধ্বংস কি আমরাই ডেকে আনছি না?
একটিই প্রার্থনা: জামিলের প্রতি যে অন্যায় আমরা করলাম, তা ভবিষ্যতের জন্য আমাদের সতর্ক করুক।
শওকত জামিল, আমাদের ক্ষমা করবেন।
মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক।
bulbulahsan@gmail.com
No comments