প্রতিরোধের মার্চ-সবার অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যার সঙ্গে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে গোটা জাতির ভাগ্য জড়িত, তা আকস্মিকভাবে রাতারাতি ঘটতে পারে না। তার প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য একটি প্রস্তুতিপর্ব থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। ২৬ মার্চ থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের দিনগুলো ছিল প্রস্তুতির।
একটি হিংস্র শক্তিকে প্রতিহত করার প্রয়োজন হতে পারে, ওই সময় তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল বাংলাদেশের জনগণ।
১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের অধ্যায়টি শেষ হয়ে যায়। ’৭০-এর ডিসেম্বর ও ’৭১-এর জানুয়ারি থেকেই শুরু হয় স্বাধিকারের আপসহীন সংগ্রাম। তবে সাংবিধানিক উপায়েই তা অর্জনের চেষ্টা করা হয়। অবিলম্বে সে সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কারণে। মার্চের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় প্রত্যক্ষ স্বাধীনতাসংগ্রাম। স্বৈরশাসন ও নিপীড়নের প্রতিবাদে জনগণ এতটা এগিয়ে যায় যে সে সংগ্রামে নেতাদের আপস করার কোনো সুযোগ ছিল না। ২৬ মার্চ থেকে জীবন-মরণ প্রতিরোধ বা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
৪২ বছর আগের কথা। সব ঘটনা মনে রাখা সম্ভব নয়। তবে এমন কিছু ঘটনাও মানুষের জীবনে ঘটে, যা ভুলে যাওয়াও অসম্ভব। ইতিহাস সৃষ্টির সময়টির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া এক পরম সৌভাগ্যের বিষয়। জাতির ইতিহাস দশকে দশকে সৃষ্টি হয় না। তবে বাংলাদেশে দশকে দশকে রচিত হয় নতুন নতুন ইতিহাস। নিজের চোখে দেখা ইতিহাসের সঙ্গে রচিত ইতিহাসের গরমিল দেখলে কেমন কষ্ট হয়। একদিকে মেলাতে পারি না, অন্যদিকে প্রতিবাদ করারও উপায় নেই। এবং করেও কোনো লাভ নেই।
বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা প্রয়োজন—এ কথা একাত্তরের আগে প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়নি। ’৭০ থেকে প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রযুবসমাজের মধ্যে এই ভূখণ্ডে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটি ছোট অংশের ঘরোয়া কথাবার্তার মধ্যেও বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে।
জহির রায়হান ছিলেন কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক। অসামান্য মেধাবী শিল্পী। রাজনীতিতে কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাঁদের পরিবারের প্রায় সবাই ছিলেন প্রগতিশীল বাম রাজনীতির মানুষ। জহির রায়হান আমূল সমাজ রূপান্তরে বিশ্বাস করতেন। অবিচল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। তিনি বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানি কাঠামোর মধ্যে থেকে তা সম্ভব নয়। ষাটের দশকের শেষদিকে আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব তাঁর সঙ্গে ঘোরাফেরা করতাম। জীবন থেকে নেয়া তৈরির দেড়-দুই বছর আগে একদিন তাঁদের কায়েতটুলীর বাড়িতে কি কথা প্রসঙ্গে বললেন: থাকা যাবে না। আমাদের একজন বললেন: কোথায় থাকা যাবে না? তিনি বললেন: পশ্চিমাদের সঙ্গে। সম্ভব নয়।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে যে থাকা যাবে না, সে কথা আমি তার আগে অত পরিষ্কারভাবে কারও কাছে শুনিনি। এর মধ্যে ঘটে গেল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। যাঁরা জীবন থেকে নেয়া দেখেছেন, তাঁরা লক্ষ করবেন, ওতে একটি গানের কথা এ রকম: ‘এ খাঁচা ভাঙব বলে...’ খাঁচা কী? খাঁচা হলো পূর্ববাংলা। বাঙালিরা যে খাঁচায় পাঞ্জাবিদের হাতে বন্দী। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের অধীনে শৃঙ্খলিত থাকা। তা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। আরেকটি সংলাপ আছে:
‘একেবারে মিলিটারি মেজাজ!’
তখন দেশে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন বাংলার মানুষ আর সামরিক শাসনে থাকতে চাইছিল না। পাকিস্তানিদের সঙ্গেও নয়। জীবন থেকে নেয়ার স্ক্রিপ্ট যখন তিনি লেখেন এবং শুটিং করেন, তখন তাঁর সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল। আমরা অনিয়মিত পত্রিকা ও সংকলন বের করতাম। জহির ভাইয়ের কাছে লেখা চাইলে দিতে পারতেন না। ওই চিত্রনাট্যেরই কিছু অংশ দিয়ে দিতেন। আমরা সংকলনে ছাপতাম।
তেমন একটি সংকলনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তখন আমি রামকৃষ্ণ মিশন রোডে থাকতাম। পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্র ইউনিয়নের গোপীবাগ আঞ্চলিক শাখাটি ছিল খুবই মিলিট্যান্ট। তখন তার নেতৃত্বে ছিলেন আরশাদুল সামাদ, সাদেক হোসেন খোকা (অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র), নাজির হোসেন, জাকির হোসেন, আহসামুল বাসার, শাহ আলম, দুলাল প্রমুখ। অঙ্গীকার নামে একুশের সংকলন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৯৭০-এ। তার উদ্দেশ্য ‘মেহনতি কৃষক, সর্বহারা শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীদের শোষণ-মুক্তির জন্য জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদ এবং নয়া সংশোধনবাদবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলা।’ জহির রায়হান লেখা দিয়েছিলেন। চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে ঘুরে ব্যর্থ হই। হাশেম খান প্রচ্ছদ এঁকে দিয়ে আমাদের উদ্ধার করেন। লাল ও সবুজের প্রচ্ছদটি ছিল চমৎকার।
একদিকে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, অন্যদিকে বামদের ‘জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। একপর্যায়ে বিশেষ করে সত্তরের নির্বাচনের পরে, দুটি ধারা মতাদর্শে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একসঙ্গে মিশে যায়। মানুষের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা: একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে নেয় বাংলার মুক্তিকামী মানুষ। এর মধ্যে সত্তরের ১২ নভেম্বরের গোর্কির পর মানুষ আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়। স্বাধীনতা বিষয়ে প্রথম কবিতা শামসুর রাহমানের ‘সফেদ পাঞ্জাবী’। তাঁর ভাষায়: ‘হায়, আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী!’ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মন্ত্র বড় কঠিন মন্ত্র। তা একবার জপা শুরু হলে তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থামে না।
একাত্তরের জানুয়ারির শেষ দিকে মোজাম্মেল হোসেন মন্টু (সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক) ও বাবুল আকতার (রেডিও-টিভি সংবাদ পাঠক) আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে মুন্সিগঞ্জে যান এক অনুষ্ঠানে। খালের পাড়ে তাঁর বাড়িতে রাত যাপন করি। প্রচণ্ড শীত। সারা শহর ঘুরে বেড়াই। দেখতে পাই বহু বাড়িতে এবং গাছের মাথায় এক নতুন পতাকা উড়ছে। সবুজ জমিনে লাল সূর্য—যেমনটি বর্তমান পতাকা।
বাংলাদেশের পতাকা বিষয়ে আজকাল নানা রকম কথা শোনা যায়। পতাকা বিষয়ে প্রথম খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক পূর্বদেশ-এ। একাত্তরের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। তাতে বলা হয়েছিল: ‘সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জ শহর ও মহকুমার বিভিন্ন স্থানে সবুজের মাঝে গোলাকার লাল সূর্য আঁকা কয়েকটি বড় আকারের পতাকা উড়তে দেখা যায়। মুন্সিগঞ্জ শহরের প্রবেশ তোরণ, হরগঙ্গা মহাবিদ্যালয়ের ভবন ও শহর কমিটির নির্মীয়মাণ ভবনের উপর এ পতাকা উড়তে দেখা যায়। এ ছাড়াও কাঠপট্টি, কমলাঘাট, তালতলা, লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী ও বাহের-কামরাখাড়া ইউনিয়নের কমিউনিটি ভবনের উপরেও এ পতাকা উড়তে দেখা যায় বলে এখানে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে। এ সমস্ত পতাকার নিকটস্থ বিভিন্ন প্রাচীরগাত্রে “স্বাধীন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা” লেখা ছিল। এবং এর পাশে লেখা ছিল—পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকার প্রতি প্রতিটি বাঙালীর সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। কে বা কারা রাতের অন্ধকারে এ পতাকা উত্তোলন করে তা জানা যায়নি।’
স্বাধীনতাকামী মানুষ যেদিকে পারছিল তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটাচ্ছিল। পতাকার লাল সূর্যের মধ্যে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র যোগ করে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ২ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তোলন করেন। ২৩ মার্চ সেনানিবাস ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো হয়নি।
ফেব্রুয়ারিও উত্তাল ছিল। প্রতিদিন সভা-সমাবেশ। মার্চের ১ তারিখ থেকে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছু দেশের মানুষ, অল্পসংখ্যক পাকিস্তানবাদী ছাড়া মেনে নিতে সম্মত ছিল না। মিছিল আর স্লোগান। স্লোগান আর মিছিল। সেদিন দল আর মত বলে কিছু ছিল না। দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষের গন্তব্য ছিল ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন। কোনো না কোনো সংগঠনের সঙ্গে আমরা প্রতিদিন হাঁটতে হাঁটতে ৩২ নম্বরে আসতাম। নেতা নতুন কী নির্দেশ দেন তা পরদিন কাগজে না পড়ে তাঁর নিজের মুখে শোনার আগ্রহ সবার।
কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে সুবিধাবাদী কেউ কেউ এদিকেও ছিলেন ওদিকেও ছিলেন। তাঁরা একপর্যায়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। সামনে চলে আসেন তরুণ কবি-লেখক-শিল্পীরা। গঠিত হয় ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’। প্রতিদিন প্রতিরাতে চলত পল্টন ময়দানে, বাহাদুর শাহ পার্কে, শহীদ মিনারে, বাংলা একাডেমীসহ নানা জায়গায় গণসংগীত, পথসভা, কবিতাপাঠ, মশাল মিছিল, সংগীত মিছিল প্রভৃতি। লেখক সংগ্রাম শিবির গড়ে তুলতে আমার দুই বন্ধু আহমদ ছফা ও হুমায়ুন কবির অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। কবি ও সমালোচক হুমায়ুন কবির, বাম রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী, স্বাধীনতার কয়েক মাস পরে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
প্রবীণদের মধ্যে আহমদ শরীফ ছিলেন আপসহীন। তরুণদের নিয়ে কাজ করতে পারতেন। আমাদের অগ্রজতুল্য বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ছিলেন খুবই তৎপর। ২৪ মার্চ বাংলা একাডেমীতে লেখকদের একটি সমাবেশ করার কথা ছিল। আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার, বোরহান ভাই সাংগঠনিক কাজ করছিলেন। আমরা স্বাধীনতাসংক্রান্ত লিফলেট ছেপেছিলাম রাত জেগে। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় সভাটি হয়নি। পঁচিশে মার্চ থেকে পরিস্থিতি অকল্পনীয় আকার ধারণ করে।
নারী কবি-শিল্পী-লেখকও সেদিন রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁরা গান গাইতেন, কবিতা পাঠ করতেন, বক্তব্যও দিতেন। তাঁদের একজনের কথা আজও মনে পড়ে। ষোলোই ডিসেম্বরের পরে ঢাকায় এসে তাঁকে আর পাইনি। কবি মেহেরুন্নেসা। ভালো কবিতা লিখতেন। ষাটের দশকে বাংলা একাডেমীর কবিতা পাঠের আসরে তাঁর উপস্থিতি ছিল অবধারিত। একাত্তরের মার্চেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। মিছিলে আমাদের সঙ্গে হাঁটতেন। আমার চেয়ে বছর খানেকের বড়। এক কোম্পানিতে ছোট চাকরি করতেন। শ্যামবর্ণ। হালকা-পাতলা। বাংলা একাডেমী থেকে তাঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসির দিকে আসতে সেই মার্চে আমার মনে হতো পলাশ, শিমুল ও কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো আরও সুন্দর। আকাশের নীলকে মনে হতো আরও বেশি নীল। রমনার উচ্ছৃঙ্খল ঘাসগুলোকে মনে হতো আরও বেশি সবুজ। মধুদার কেনটিন বা শরিফ মিয়ার দোকানে বসতাম। খাঁটি মাখনের পোচ দেওয়া দুটো টোস্ট বিস্কুট ও চা খেতাম। একাত্তরের ঘাতকেরা ওর মতো নিরপরাধ মানুষকেও বাঁচতে দেয়নি। মেহেরুন্নেসাকে যারা হত্যা করেছে, জহির রায়হানকেও ওই গোত্রই হত্যা করে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা আজ সবাই জানে। প্রস্তুতিপর্বটির কথা প্রায় হারিয়েই গেছে। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। দেশেরও উন্নতি হয়েছে বটে। স্বাধীনতা অর্জনে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ যে কত বেশি তা জানার পথগুলো যতই দিন যাচ্ছে ততই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কষ্ট হয়। মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে। ছাদে গিয়ে দাঁড়াই। মধ্যরাতেও হাজার হাজার গাড়ি ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে। বাইশ পরিবার নয়, ২২ হাজার পরিবার আজ শতকোটি টাকার মালিক। তাদের সৌভাগ্যের মূলে কারা, তারা তা জানে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের অধ্যায়টি শেষ হয়ে যায়। ’৭০-এর ডিসেম্বর ও ’৭১-এর জানুয়ারি থেকেই শুরু হয় স্বাধিকারের আপসহীন সংগ্রাম। তবে সাংবিধানিক উপায়েই তা অর্জনের চেষ্টা করা হয়। অবিলম্বে সে সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কারণে। মার্চের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় প্রত্যক্ষ স্বাধীনতাসংগ্রাম। স্বৈরশাসন ও নিপীড়নের প্রতিবাদে জনগণ এতটা এগিয়ে যায় যে সে সংগ্রামে নেতাদের আপস করার কোনো সুযোগ ছিল না। ২৬ মার্চ থেকে জীবন-মরণ প্রতিরোধ বা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
৪২ বছর আগের কথা। সব ঘটনা মনে রাখা সম্ভব নয়। তবে এমন কিছু ঘটনাও মানুষের জীবনে ঘটে, যা ভুলে যাওয়াও অসম্ভব। ইতিহাস সৃষ্টির সময়টির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া এক পরম সৌভাগ্যের বিষয়। জাতির ইতিহাস দশকে দশকে সৃষ্টি হয় না। তবে বাংলাদেশে দশকে দশকে রচিত হয় নতুন নতুন ইতিহাস। নিজের চোখে দেখা ইতিহাসের সঙ্গে রচিত ইতিহাসের গরমিল দেখলে কেমন কষ্ট হয়। একদিকে মেলাতে পারি না, অন্যদিকে প্রতিবাদ করারও উপায় নেই। এবং করেও কোনো লাভ নেই।
বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা প্রয়োজন—এ কথা একাত্তরের আগে প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়নি। ’৭০ থেকে প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রযুবসমাজের মধ্যে এই ভূখণ্ডে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটি ছোট অংশের ঘরোয়া কথাবার্তার মধ্যেও বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে।
জহির রায়হান ছিলেন কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক। অসামান্য মেধাবী শিল্পী। রাজনীতিতে কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাঁদের পরিবারের প্রায় সবাই ছিলেন প্রগতিশীল বাম রাজনীতির মানুষ। জহির রায়হান আমূল সমাজ রূপান্তরে বিশ্বাস করতেন। অবিচল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। তিনি বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানি কাঠামোর মধ্যে থেকে তা সম্ভব নয়। ষাটের দশকের শেষদিকে আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব তাঁর সঙ্গে ঘোরাফেরা করতাম। জীবন থেকে নেয়া তৈরির দেড়-দুই বছর আগে একদিন তাঁদের কায়েতটুলীর বাড়িতে কি কথা প্রসঙ্গে বললেন: থাকা যাবে না। আমাদের একজন বললেন: কোথায় থাকা যাবে না? তিনি বললেন: পশ্চিমাদের সঙ্গে। সম্ভব নয়।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে যে থাকা যাবে না, সে কথা আমি তার আগে অত পরিষ্কারভাবে কারও কাছে শুনিনি। এর মধ্যে ঘটে গেল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। যাঁরা জীবন থেকে নেয়া দেখেছেন, তাঁরা লক্ষ করবেন, ওতে একটি গানের কথা এ রকম: ‘এ খাঁচা ভাঙব বলে...’ খাঁচা কী? খাঁচা হলো পূর্ববাংলা। বাঙালিরা যে খাঁচায় পাঞ্জাবিদের হাতে বন্দী। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের অধীনে শৃঙ্খলিত থাকা। তা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। আরেকটি সংলাপ আছে:
‘একেবারে মিলিটারি মেজাজ!’
তখন দেশে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন বাংলার মানুষ আর সামরিক শাসনে থাকতে চাইছিল না। পাকিস্তানিদের সঙ্গেও নয়। জীবন থেকে নেয়ার স্ক্রিপ্ট যখন তিনি লেখেন এবং শুটিং করেন, তখন তাঁর সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল। আমরা অনিয়মিত পত্রিকা ও সংকলন বের করতাম। জহির ভাইয়ের কাছে লেখা চাইলে দিতে পারতেন না। ওই চিত্রনাট্যেরই কিছু অংশ দিয়ে দিতেন। আমরা সংকলনে ছাপতাম।
তেমন একটি সংকলনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তখন আমি রামকৃষ্ণ মিশন রোডে থাকতাম। পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্র ইউনিয়নের গোপীবাগ আঞ্চলিক শাখাটি ছিল খুবই মিলিট্যান্ট। তখন তার নেতৃত্বে ছিলেন আরশাদুল সামাদ, সাদেক হোসেন খোকা (অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র), নাজির হোসেন, জাকির হোসেন, আহসামুল বাসার, শাহ আলম, দুলাল প্রমুখ। অঙ্গীকার নামে একুশের সংকলন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৯৭০-এ। তার উদ্দেশ্য ‘মেহনতি কৃষক, সর্বহারা শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীদের শোষণ-মুক্তির জন্য জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদ এবং নয়া সংশোধনবাদবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলা।’ জহির রায়হান লেখা দিয়েছিলেন। চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে ঘুরে ব্যর্থ হই। হাশেম খান প্রচ্ছদ এঁকে দিয়ে আমাদের উদ্ধার করেন। লাল ও সবুজের প্রচ্ছদটি ছিল চমৎকার।
একদিকে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, অন্যদিকে বামদের ‘জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। একপর্যায়ে বিশেষ করে সত্তরের নির্বাচনের পরে, দুটি ধারা মতাদর্শে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একসঙ্গে মিশে যায়। মানুষের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা: একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে নেয় বাংলার মুক্তিকামী মানুষ। এর মধ্যে সত্তরের ১২ নভেম্বরের গোর্কির পর মানুষ আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়। স্বাধীনতা বিষয়ে প্রথম কবিতা শামসুর রাহমানের ‘সফেদ পাঞ্জাবী’। তাঁর ভাষায়: ‘হায়, আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী!’ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মন্ত্র বড় কঠিন মন্ত্র। তা একবার জপা শুরু হলে তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থামে না।
একাত্তরের জানুয়ারির শেষ দিকে মোজাম্মেল হোসেন মন্টু (সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক) ও বাবুল আকতার (রেডিও-টিভি সংবাদ পাঠক) আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে মুন্সিগঞ্জে যান এক অনুষ্ঠানে। খালের পাড়ে তাঁর বাড়িতে রাত যাপন করি। প্রচণ্ড শীত। সারা শহর ঘুরে বেড়াই। দেখতে পাই বহু বাড়িতে এবং গাছের মাথায় এক নতুন পতাকা উড়ছে। সবুজ জমিনে লাল সূর্য—যেমনটি বর্তমান পতাকা।
বাংলাদেশের পতাকা বিষয়ে আজকাল নানা রকম কথা শোনা যায়। পতাকা বিষয়ে প্রথম খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক পূর্বদেশ-এ। একাত্তরের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। তাতে বলা হয়েছিল: ‘সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জ শহর ও মহকুমার বিভিন্ন স্থানে সবুজের মাঝে গোলাকার লাল সূর্য আঁকা কয়েকটি বড় আকারের পতাকা উড়তে দেখা যায়। মুন্সিগঞ্জ শহরের প্রবেশ তোরণ, হরগঙ্গা মহাবিদ্যালয়ের ভবন ও শহর কমিটির নির্মীয়মাণ ভবনের উপর এ পতাকা উড়তে দেখা যায়। এ ছাড়াও কাঠপট্টি, কমলাঘাট, তালতলা, লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী ও বাহের-কামরাখাড়া ইউনিয়নের কমিউনিটি ভবনের উপরেও এ পতাকা উড়তে দেখা যায় বলে এখানে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে। এ সমস্ত পতাকার নিকটস্থ বিভিন্ন প্রাচীরগাত্রে “স্বাধীন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা” লেখা ছিল। এবং এর পাশে লেখা ছিল—পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকার প্রতি প্রতিটি বাঙালীর সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। কে বা কারা রাতের অন্ধকারে এ পতাকা উত্তোলন করে তা জানা যায়নি।’
স্বাধীনতাকামী মানুষ যেদিকে পারছিল তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটাচ্ছিল। পতাকার লাল সূর্যের মধ্যে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র যোগ করে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ২ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তোলন করেন। ২৩ মার্চ সেনানিবাস ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো হয়নি।
ফেব্রুয়ারিও উত্তাল ছিল। প্রতিদিন সভা-সমাবেশ। মার্চের ১ তারিখ থেকে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছু দেশের মানুষ, অল্পসংখ্যক পাকিস্তানবাদী ছাড়া মেনে নিতে সম্মত ছিল না। মিছিল আর স্লোগান। স্লোগান আর মিছিল। সেদিন দল আর মত বলে কিছু ছিল না। দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষের গন্তব্য ছিল ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন। কোনো না কোনো সংগঠনের সঙ্গে আমরা প্রতিদিন হাঁটতে হাঁটতে ৩২ নম্বরে আসতাম। নেতা নতুন কী নির্দেশ দেন তা পরদিন কাগজে না পড়ে তাঁর নিজের মুখে শোনার আগ্রহ সবার।
কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে সুবিধাবাদী কেউ কেউ এদিকেও ছিলেন ওদিকেও ছিলেন। তাঁরা একপর্যায়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। সামনে চলে আসেন তরুণ কবি-লেখক-শিল্পীরা। গঠিত হয় ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’। প্রতিদিন প্রতিরাতে চলত পল্টন ময়দানে, বাহাদুর শাহ পার্কে, শহীদ মিনারে, বাংলা একাডেমীসহ নানা জায়গায় গণসংগীত, পথসভা, কবিতাপাঠ, মশাল মিছিল, সংগীত মিছিল প্রভৃতি। লেখক সংগ্রাম শিবির গড়ে তুলতে আমার দুই বন্ধু আহমদ ছফা ও হুমায়ুন কবির অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। কবি ও সমালোচক হুমায়ুন কবির, বাম রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী, স্বাধীনতার কয়েক মাস পরে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
প্রবীণদের মধ্যে আহমদ শরীফ ছিলেন আপসহীন। তরুণদের নিয়ে কাজ করতে পারতেন। আমাদের অগ্রজতুল্য বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ছিলেন খুবই তৎপর। ২৪ মার্চ বাংলা একাডেমীতে লেখকদের একটি সমাবেশ করার কথা ছিল। আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার, বোরহান ভাই সাংগঠনিক কাজ করছিলেন। আমরা স্বাধীনতাসংক্রান্ত লিফলেট ছেপেছিলাম রাত জেগে। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় সভাটি হয়নি। পঁচিশে মার্চ থেকে পরিস্থিতি অকল্পনীয় আকার ধারণ করে।
নারী কবি-শিল্পী-লেখকও সেদিন রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁরা গান গাইতেন, কবিতা পাঠ করতেন, বক্তব্যও দিতেন। তাঁদের একজনের কথা আজও মনে পড়ে। ষোলোই ডিসেম্বরের পরে ঢাকায় এসে তাঁকে আর পাইনি। কবি মেহেরুন্নেসা। ভালো কবিতা লিখতেন। ষাটের দশকে বাংলা একাডেমীর কবিতা পাঠের আসরে তাঁর উপস্থিতি ছিল অবধারিত। একাত্তরের মার্চেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। মিছিলে আমাদের সঙ্গে হাঁটতেন। আমার চেয়ে বছর খানেকের বড়। এক কোম্পানিতে ছোট চাকরি করতেন। শ্যামবর্ণ। হালকা-পাতলা। বাংলা একাডেমী থেকে তাঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসির দিকে আসতে সেই মার্চে আমার মনে হতো পলাশ, শিমুল ও কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো আরও সুন্দর। আকাশের নীলকে মনে হতো আরও বেশি নীল। রমনার উচ্ছৃঙ্খল ঘাসগুলোকে মনে হতো আরও বেশি সবুজ। মধুদার কেনটিন বা শরিফ মিয়ার দোকানে বসতাম। খাঁটি মাখনের পোচ দেওয়া দুটো টোস্ট বিস্কুট ও চা খেতাম। একাত্তরের ঘাতকেরা ওর মতো নিরপরাধ মানুষকেও বাঁচতে দেয়নি। মেহেরুন্নেসাকে যারা হত্যা করেছে, জহির রায়হানকেও ওই গোত্রই হত্যা করে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা আজ সবাই জানে। প্রস্তুতিপর্বটির কথা প্রায় হারিয়েই গেছে। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। দেশেরও উন্নতি হয়েছে বটে। স্বাধীনতা অর্জনে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ যে কত বেশি তা জানার পথগুলো যতই দিন যাচ্ছে ততই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কষ্ট হয়। মধ্যরাতে ঘুম ভাঙে। ছাদে গিয়ে দাঁড়াই। মধ্যরাতেও হাজার হাজার গাড়ি ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে। বাইশ পরিবার নয়, ২২ হাজার পরিবার আজ শতকোটি টাকার মালিক। তাদের সৌভাগ্যের মূলে কারা, তারা তা জানে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments