সপ্তাহের হালচাল-সরকার কী চায় সেটাই আসল কথা by আব্দুল কাইয়ুম
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে কি থাকবে না—এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অন্তত দুটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। প্রথমত, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না, যা পরবর্তী নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। আর দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমোদন ছাড়া যেন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া না হয়।
আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ কমিটির বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান না রাখার সিদ্ধান্তটি এর একটিও পূরণ করছে না, যদিও আদালতের রায় অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা তারা বলছে। কিন্তু এতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। এখানেই গৃহীত সিদ্ধান্তের দুর্বলতা। একটা ঝুঁকিও বটে। কারণ, আগে থেকেই বিএনপি বলে আসছিল যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের চক্রান্ত চলছে। এটা তারা মানবে না। তারা আরও বলছিল, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে, তবে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তারা গ্রহণ করবে না। কারণ তিনি নাকি আওয়ামী লীগের অনুগত!
প্রধানমন্ত্রী গতকালসংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন এবং এর আগের দিন বিশেষ কমিটি যেসব যুক্তি দিয়েছে তা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। তাঁরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার সুযোগ নেই।আদালতের রায় মেনে চলাই ভালো। না হলে ভবিষ্যতে আদালতে চ্যালেঞ্জ হলে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সেদিক থেকে হয়তো কমিটির চিন্তায় ত্রুটি নেই। কিন্তু আদালতের রায়ে আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখা যেতে পারে বলে যে অভিমত দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে কমিটি নিজে থেকে কিছু না বলে কেন বিরোধী দলের ওপর ছেড়ে দিল? সরকার বলছে, বিরোধী দল বলুক তারা দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায় কি না। এতে সরকারের সুবিধা। তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারার আশা করছে। একদিকে, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে না মানার দাবিটি অকার্যকর হয়ে যাবে। একটা জিনিস আগ্রহভরে নিয়ে তার প্রধান উপাদানটি বাতিল করা কঠিন। এদিক থেকে সরকারি দল বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রাখার আশা করতে পারে।
অন্যদিকে দুই মেয়াদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। কারণ, ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি মেয়াদে সরকারের পালাবদল হতে দেখা যাচ্ছে। সেই হিসাবে ঐতিহ্য অনুযায়ী পালাবদল ঘটলে দ্বিতীয় মেয়াদের পর হয়তো আওয়ামী লীগ সরকারে যাবে এবং তারপর তাদের অধীনেই নির্বাচন হবে। সংকীর্ণ অর্থে দেখলে এতে তাদের পোয়াবারো।
কিন্তু আমরা আশা করব, আওয়ামী লীগ শুধু দলীয় স্বার্থে সবকিছু না দেখে বরং সুস্থ ও স্বচ্ছ রাজনীতির স্বার্থকে বড় করে দেখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না থাকলে শূন্যস্থান কে পূরণ করবে, আর থাকলে তার সংস্কার কতটুকু ও কীভাবে হবে—এসব বিষয়ে বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে মতবিনিময় দরকার। বিএনপিরও উদ্যোগী হয়ে আলোচনায় বসতে হবে। সংসদে যেতে হবে। ১৯৯৬ সালে যখন সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আনা হয়, তখন সংসদে বিরোধী দল ছিল না। কিন্তু তাই বলে বিএনপি এককভাবে কিছু করেনি। পরোক্ষভাবে হলেও ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে হয়তো আওয়ামী লীগ বা তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের পক্ষে প্রেরিত সবুজ সংকেতের ভিত্তিতে সবকিছু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। তা না হলে ত্রয়োদশ সংশোধনী সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেতো না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছিল, যদিও প্রতিটি নির্বাচনেই পরাজিত দল ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু সবাই বুঝেছে, সেটা বিরোধী রাজনীতির ধর্ম। আসলে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কারও মনে সন্দেহ ছিল না।
সুতরাং এবারও সেই পদ্ধতির অনুসরণ করা দরকার। এখন বিএনপি সংসদে যাচ্ছে না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হলে বিএনপির মতামত অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। পরোক্ষভাবে হলেও এটা দরকার। দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাওয়ার দায়িত্ব একা বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব রাজনীতির জন্য শুভ হবে না। আওয়ামী লীগ বড় ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। আদালত বলেছে বলেই সবকিছু করে ফেলা ঠিক হবে না।
সরকার কী চায়, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। তারা কি হরতাল, অবরোধ, লংমার্চের কর্মসূচি দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির একটি উপলক্ষ বিএনপির হাতে তুলে দিতে চায়? দেশে তো সমস্যার অন্ত নেই। মূল্যস্ফীতি একটি বড় সমস্যা। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সুরাহা হচ্ছে না। দুর্নীত নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্যে আবার রাজনৈতিক সংকট ডেকে আনার সুযোগ কোথায়? সরকার কয়টা ফ্রন্টে লড়বে? বাসভাড়া নিয়ন্ত্রণে যখন সরকারকে নাকানিচুবানি খেতে হয়, তখন আবার রাজপথে রাজনৈতিক বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ নামাবে? আর পুলিশ দিয়ে কি এসব দমন করা যায়? ২০০১ সালের পর পাঁচ-সাত বছরে তো আওয়ামী লীগ দেখেছে, পুলিশ দিয়ে রাজনীতি ঠান্ডা করা যায় না। মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে সবকিছু শেখে। সরকার কি কিছুই শিখবে না?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে কী থাকবে, সেটাও সরকারকে পরিষ্কারভাবে বলতে হবে। নির্বাচনের সময় নিশ্চয়ই একটা ছোট সরকার থাকবে, তার নাম যাই হোক। নির্দলীয় না হোক, কার্যত তাকে হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্বাচিত সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এ রকম ব্যবস্থা সব গণতান্ত্রিক দেশে আছে। সেই সরকার শুধু দৈনন্দিন কাজগুলো চালাবে। বড়, নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে না। আর নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা হবে। তাকে আর্থিক স্বাধীনতা দিতে হবে। এখন নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে ভাবতে হয়, টাকা পাব কোথায়? এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। তাই কমিশনের আর্থিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কিছু আইনের সংস্কারও দরকার।
এসব বিষয়ে অনেক কিছু আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধী দলকে আস্থায় না নিলে সরকারকে হয়তো বড় ধরনের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। বিরোধী দল হয়তো এসব ব্যাপারে উদাসীন থাকতে পারে, কিন্তু সরকার পারে না। কারণ, দায়টা তাদেরই বেশি। সরকার যদি বিরোধী দলের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ না চায়, অনমনীয় থাকে, তাহলে নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
মন্ত্রীরা কথায় কথায় বলেন, এক-এগারো আর হতে দেওয়া হবে না। কিন্তু কীভাবে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল? নির্বাচন অনুষ্ঠান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল বলেই ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়। এখন যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছু ভুল পদক্ষেপ নেয়, তাহলে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কেউ চায় না। মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়।
আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলেও চলবে, তাহলে বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা শুরু করুক। তবে শুধু কথায় হবে না, একই সঙ্গে বাস্তব কিছু পদক্ষেপ নিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার কোনো দুরভিসন্ধি তাদের নেই। খুব কম সময়ের মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের সদিচ্ছা দেখাতে পারে। বিষয়টা পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিক। মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের যে আইনগত সুযোগ এখন রয়েছে, তা পরিবর্তন করুক। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কমিশনকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেওয়া হোক। হার-জিত যা-ই হোক, সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে দিক।
পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা ছাড়া কিছু হবে না। শুধু আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে সরকার আসন্ন রাজনৈতিক সংকট পার হতে পারবে না। এটা প্রথমে বোঝা দরকার।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
প্রধানমন্ত্রী গতকালসংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন এবং এর আগের দিন বিশেষ কমিটি যেসব যুক্তি দিয়েছে তা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। তাঁরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার সুযোগ নেই।আদালতের রায় মেনে চলাই ভালো। না হলে ভবিষ্যতে আদালতে চ্যালেঞ্জ হলে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সেদিক থেকে হয়তো কমিটির চিন্তায় ত্রুটি নেই। কিন্তু আদালতের রায়ে আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখা যেতে পারে বলে যে অভিমত দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে কমিটি নিজে থেকে কিছু না বলে কেন বিরোধী দলের ওপর ছেড়ে দিল? সরকার বলছে, বিরোধী দল বলুক তারা দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায় কি না। এতে সরকারের সুবিধা। তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারার আশা করছে। একদিকে, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে না মানার দাবিটি অকার্যকর হয়ে যাবে। একটা জিনিস আগ্রহভরে নিয়ে তার প্রধান উপাদানটি বাতিল করা কঠিন। এদিক থেকে সরকারি দল বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রাখার আশা করতে পারে।
অন্যদিকে দুই মেয়াদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। কারণ, ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি মেয়াদে সরকারের পালাবদল হতে দেখা যাচ্ছে। সেই হিসাবে ঐতিহ্য অনুযায়ী পালাবদল ঘটলে দ্বিতীয় মেয়াদের পর হয়তো আওয়ামী লীগ সরকারে যাবে এবং তারপর তাদের অধীনেই নির্বাচন হবে। সংকীর্ণ অর্থে দেখলে এতে তাদের পোয়াবারো।
কিন্তু আমরা আশা করব, আওয়ামী লীগ শুধু দলীয় স্বার্থে সবকিছু না দেখে বরং সুস্থ ও স্বচ্ছ রাজনীতির স্বার্থকে বড় করে দেখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না থাকলে শূন্যস্থান কে পূরণ করবে, আর থাকলে তার সংস্কার কতটুকু ও কীভাবে হবে—এসব বিষয়ে বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে মতবিনিময় দরকার। বিএনপিরও উদ্যোগী হয়ে আলোচনায় বসতে হবে। সংসদে যেতে হবে। ১৯৯৬ সালে যখন সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আনা হয়, তখন সংসদে বিরোধী দল ছিল না। কিন্তু তাই বলে বিএনপি এককভাবে কিছু করেনি। পরোক্ষভাবে হলেও ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে হয়তো আওয়ামী লীগ বা তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের পক্ষে প্রেরিত সবুজ সংকেতের ভিত্তিতে সবকিছু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। তা না হলে ত্রয়োদশ সংশোধনী সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেতো না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছিল, যদিও প্রতিটি নির্বাচনেই পরাজিত দল ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু সবাই বুঝেছে, সেটা বিরোধী রাজনীতির ধর্ম। আসলে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কারও মনে সন্দেহ ছিল না।
সুতরাং এবারও সেই পদ্ধতির অনুসরণ করা দরকার। এখন বিএনপি সংসদে যাচ্ছে না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হলে বিএনপির মতামত অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। পরোক্ষভাবে হলেও এটা দরকার। দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাওয়ার দায়িত্ব একা বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব রাজনীতির জন্য শুভ হবে না। আওয়ামী লীগ বড় ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। আদালত বলেছে বলেই সবকিছু করে ফেলা ঠিক হবে না।
সরকার কী চায়, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। তারা কি হরতাল, অবরোধ, লংমার্চের কর্মসূচি দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির একটি উপলক্ষ বিএনপির হাতে তুলে দিতে চায়? দেশে তো সমস্যার অন্ত নেই। মূল্যস্ফীতি একটি বড় সমস্যা। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সুরাহা হচ্ছে না। দুর্নীত নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নবিদ্ধ। এর মধ্যে আবার রাজনৈতিক সংকট ডেকে আনার সুযোগ কোথায়? সরকার কয়টা ফ্রন্টে লড়বে? বাসভাড়া নিয়ন্ত্রণে যখন সরকারকে নাকানিচুবানি খেতে হয়, তখন আবার রাজপথে রাজনৈতিক বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ নামাবে? আর পুলিশ দিয়ে কি এসব দমন করা যায়? ২০০১ সালের পর পাঁচ-সাত বছরে তো আওয়ামী লীগ দেখেছে, পুলিশ দিয়ে রাজনীতি ঠান্ডা করা যায় না। মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে সবকিছু শেখে। সরকার কি কিছুই শিখবে না?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে কী থাকবে, সেটাও সরকারকে পরিষ্কারভাবে বলতে হবে। নির্বাচনের সময় নিশ্চয়ই একটা ছোট সরকার থাকবে, তার নাম যাই হোক। নির্দলীয় না হোক, কার্যত তাকে হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্বাচিত সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এ রকম ব্যবস্থা সব গণতান্ত্রিক দেশে আছে। সেই সরকার শুধু দৈনন্দিন কাজগুলো চালাবে। বড়, নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে না। আর নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা হবে। তাকে আর্থিক স্বাধীনতা দিতে হবে। এখন নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে ভাবতে হয়, টাকা পাব কোথায়? এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। তাই কমিশনের আর্থিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কিছু আইনের সংস্কারও দরকার।
এসব বিষয়ে অনেক কিছু আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধী দলকে আস্থায় না নিলে সরকারকে হয়তো বড় ধরনের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। বিরোধী দল হয়তো এসব ব্যাপারে উদাসীন থাকতে পারে, কিন্তু সরকার পারে না। কারণ, দায়টা তাদেরই বেশি। সরকার যদি বিরোধী দলের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ না চায়, অনমনীয় থাকে, তাহলে নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
মন্ত্রীরা কথায় কথায় বলেন, এক-এগারো আর হতে দেওয়া হবে না। কিন্তু কীভাবে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল? নির্বাচন অনুষ্ঠান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল বলেই ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়। এখন যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছু ভুল পদক্ষেপ নেয়, তাহলে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কেউ চায় না। মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়।
আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলেও চলবে, তাহলে বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা শুরু করুক। তবে শুধু কথায় হবে না, একই সঙ্গে বাস্তব কিছু পদক্ষেপ নিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার কোনো দুরভিসন্ধি তাদের নেই। খুব কম সময়ের মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের সদিচ্ছা দেখাতে পারে। বিষয়টা পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিক। মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের যে আইনগত সুযোগ এখন রয়েছে, তা পরিবর্তন করুক। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কমিশনকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেওয়া হোক। হার-জিত যা-ই হোক, সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে দিক।
পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা ছাড়া কিছু হবে না। শুধু আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে সরকার আসন্ন রাজনৈতিক সংকট পার হতে পারবে না। এটা প্রথমে বোঝা দরকার।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments