কৃষি-কৃষি উপকরণের বাইরেও ভাবতে হবে by মাহবুব হোসেন
আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়া সারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্য সংকটসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সামনের দিনে কমার সম্ভাবনা কম। তেলের দাম বাড়লে ইউরিয়ার দামও বাড়ে। এরই মধ্যে দাম যে পরিমাণে বেড়েছে, তাতে আগামী অর্থবছরে শুধু ইউরিয়া সারেই সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ ছয় হাজার কোটি টাকা
ছাড়িয়ে যাবে। আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশের পক্ষে এই পরিমাণ আর্থিক চাপ সহ্য করা কঠিন। সরকার বাজেটের আগে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে ইউরিয়ার দাম বাড়ানোর ন্যায্য কারণ রয়েছে।
অন্যদিক থেকে দেশে ইউরিয়া সারের দাম এখনো অন্যান্য সারের তুলনায় বেশ কমই আছে। সত্তরের দশকে টিএসপি ও ইউরিয়া সারের দাম প্রায় সমান ছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, ধানের জমিতে ৫০ শতাংশ ইউরিয়া ও বাকি ৫০ শতাংশ অন্যান্য সার ব্যবহার করা উচিত। আশির দশকে বিশ্ববাজারে টিএসপি সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারও এই সারের দাম বাড়িয়ে দেয়। দেশে যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদন হওয়ায় সরকার ইউরিয়ার দাম কমায়নি। তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় কৃষক ৮০ শতাংশ ইউরিয়া সার ব্যবহার করতেন। এটা মাটির জন্য খুবই ক্ষতিকর। ইউরিয়া দিলে এর ফলাফল দ্রুত দেখা যায়, ধানসহ অন্যান্য ফসলের পাতা দ্রুত সবুজ হয়। ফলে কৃষক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহার করায় মাটির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল। এখন দাম বাড়ানোর ফলে কৃষক ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও অন্যান্য সার প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করবেন। দীর্ঘ মেয়াদে এটা কৃষির জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্যাস-সংকটের কারণে দেশের কারখানাগুলোতে ইউরিয়ার উৎপাদন অনেক কমেছে। বোরোর চাষ বাড়ায় প্রয়োজনীয় বাড়তি ইউরিয়া বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হয়েছে। তাই একবাক্যে বলতে গেলে ইউরিয়ার দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অর্থনৈতিক ও কৃষির দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির দিক থেকে ন্যায্য। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সব ধরনের সারের দাম সমান পর্যায়ে রাখতে হবে। তবে কৃষির ক্ষেত্রে সরকারের বেশির ভাগ চিন্তা, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত অনেক বেশি শস্যকেন্দ্রিক। মনে হচ্ছে, ধান ও অন্যান্য ফসলের বাইরে কৃষির অন্য কোনো খাত নেই। এ ছাড়া সরকারের কৃষিবিষয়ক পরিকল্পনা অনেক বেশি উপকরণ বা সার, বীজ, সেচ প্রভৃতির সরবরাহনির্ভর। এগুলোর সরবরাহ পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কৃষি গবেষণার বিষয়ে নিয়মিত ওয়াকিবহাল থাকেন, নিয়মিত নির্দেশনা দিচ্ছেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন, উন্নত বেশ কিছু ধানের জাত বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন। বন্যা ও লবণাক্ত-সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করে মাঠপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কৃষক পর্যায়ে বৃহৎ পরিসরে নেওয়ার আগে পাইলট ভিত্তিতে চাষাবাদ হওয়া উচিত ছিল। লবণাক্ত এলাকায় বিআর-৪৭ জাতের ধান এফএওর মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছানো হলো। কিন্তু সব ধরনের কৃষক এই জাত চাষ করে পোষাতে পারবেন কি না, তা ভেবে দেখা উচিত ছিল। যেসব কৃষক ঝুঁকি নিতে আগ্রহী, তাঁদের চিহ্নিত করে নতুন জাতের ধান চাষ করতে দেওয়া উচিত। এতে জাতগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা যাবে। সফল হলে বা ভালো ফলন দিলে বৃহৎ পরিসরে কৃষক পর্যায়ে পৌঁছানো যাবে। গবেষণা খাতে সরকারের আরও বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। বেশির ভাগ কৃষিনির্ভর দেশ ভ্যালু অ্যাডেড শস্যে ভর্তুকির ক্ষেত্রে বাজেটে মোট বরাদ্দের ২ শতাংশ গবেষণা খাতে দেয়। বাংলাদেশে কৃষি খাতে বরাদ্দের দশমিক ২ শতাংশ গবেষণায় দেওয়া হয়। এটা কমপক্ষে ১ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
চলতি বছরের বাজেট থেকেই সরকার গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো শুরু করতে পারে। তবে গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অতিরিক্ত বরাদ্দ খরচ করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সরকারের উচিত কৃষির বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত জনবল তৈরি করা। উন্নত কৃষিশিক্ষা নিতে বিদেশে পিএইচডিসহ বিভিন্ন গবেষণায় প্রশিক্ষণ নিতে শিক্ষার্থীদের পাঠাতে হবে। দেশে তাঁদের ভালো বেতনে কাজের সুযোগ দিতে হবে। গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক গবেষণাযন্ত্র নিয়ে আসতে হবে। সব মিলিয়ে কৃষিতে গবেষণার বিষয়টিকে ঢেলে সাজাতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতকে অবহেলা করা হচ্ছে। বাজেটে বরাদ্দ, উপকরণ সহজলভ্যসহ বিভিন্ন দিক থেকে শস্য খাত সব সময় প্রাধান্য পায়। শস্যের বাইরে পোলট্রি ও চিংড়ি বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্ব পেয়েছে। অথচ দেশে বিপুল পরিমাণ প্লাবনভূমি রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই প্লাবনভূমিতে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কোন ধরনের মাছ চাষ করা যাবে, তা চিহ্নিত করেছেন। প্লাবনভূমিগুলোর বেশির ভাগই কমন প্রপার্টি হওয়ায় গ্রামের সাধারণ মানুষ এতে অংশীদারি পেতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনে তা সহায়ক হতে পারে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে এই সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ দেখা যায়নি। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের প্লাবনভূমির উৎপাদনশীলতা বাংলাদেশের তিন গুণ। দেশে পুকুরে পরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ হওয়ায় তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের জোগান বেড়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের দেশীয় প্রজাতির শিং, মাগুরসহ অন্যান্য জাতের মাছের উৎপাদন কমেছে। ফলে এগুলোর দাম বেড়েছে। প্লাবনভূমিতে দেশি ও আধুনিক জাতের মাছের চাষ বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে।
পোলট্রি খাতে সাম্প্রতিক সময়ে ঝুঁকির পরিমাণ বেড়েছে। বার্ড ফ্লুসহ নানা রোগের কারণে পোলট্রি খাতের জৈবনিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। রোগ-ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। না হলে পোলট্রি-শিল্পে ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগ আসবে না। বাণিজ্যিকভাবে গবাদিপশু পালন বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে। কেননা, এ জন্য প্রয়োজনীয় গোচারণভূমি ও খাদ্যের জোগান দেওয়ার মতো সম্পদ বাংলাদেশে কম। ভারতের সঙ্গে আমরা এ ক্ষেত্রে পেরে উঠব না। সরকার এ ক্ষেত্রে দুগ্ধশিল্পের সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে পারে। কেননা, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর দুগ্ধসামগ্রীর ডাম্পিং গ্রাউন্ড হয়ে উঠছে। দেশীয় দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দিতে হবে।
বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ কম, জনসংখ্যা বেশি—এই বাস্তব পরিস্থিতি মাথায় রেখে দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্যনিরাপত্তার পরিকল্পনা করতে হবে। দেশের ভেতরে যতই উৎপাদন বাড়াই না কেন, আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে খাদ্য আমদানি করতে হবে। প্রবাসী-আয়, রাজস্ব বাড়ানো ও রপ্তানির মাধ্যমে আমরা আমাদের আয় বাড়াতে পারি। কিন্তু ২০০৭ ও ২০১০-এর অভিজ্ঞতা বলছে, টাকা থাকলেও সব সময় আমদানির জন্য খাদ্য পাওয়া যায় না। ভারত থেকে চাল ও রাশিয়া থেকে গম আমদানির ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় চুক্তি করেও শেষ পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি। তাই খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টিকে আমাদের ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। আফ্রিকার দেশগুলোর কৃষিজমি কিনে চাষ করার একটি সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। চীন ও সিঙ্গাপুর আফ্রিকার অনেক দেশে জমি কিনে চাষ শুরু করেছে। সৌদি আরব ও ভারতের ব্যবসায়ীরা ইথিওপিয়াসহ অন্যান্য দেশে জমি কিনেছে।
বাংলাদেশের সামনেও আফ্রিকার জমি কেনার এই সুযোগ এসেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা আছে। যেমন, কোন দেশে কী পরিমাণ জমি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা নেবেন, তার কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। যেমন—কেনিয়া, উগান্ডার মতো দেশগুলো জমি ইজারা দিতে রাজি হচ্ছে। কিন্তু পূর্ব আফ্রিকার এই দেশগুলোতে বৃষ্টি কম হয়। ফলে সেখানে ধান চাষ করা কঠিন। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে বেশ বৃষ্টি হয়। সেখানে জমি ইজারা নিয়ে বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে ধান উৎপাদন করতে পারে। তবে এ জন্য বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরতে হবে। কমপক্ষে আট বছর লাগবে জঙ্গলাকীর্ণ ওই কৃষিজমিগুলোকে চাষাবাদের উপযোগী করে পূর্ণাঙ্গভাবে উৎপাদনে যেতে।
পশ্চিম আফ্রিকায় উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে উৎপাদন আট গুণ বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু আফ্রিকার এই দেশগুলো সেখানে উৎপাদিত ফসলের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বাংলাদেশে রপ্তানি করতে দেবে কি না, তা আলোচনা করে দেখতে হবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আফ্রিকার দেশগুলোতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হারে ব্যাংকঋণ নিয়ে কৃষির মতো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা সরকারের কাছে টাকাকে ডলারে পরিণত করে আফ্রিকায় বিনিয়োগের অনুমতি চাইছেন। অনেকে মনে করছেন, শেয়ারবাজার থেকে যে টাকাগুলো সরানো হয়েছে, তা বিদেশে পাচারের জন্য ব্যবসায়ীরা আফ্রিকায় বিনিয়োগের কথা বলে টাকাকে ডলার করতে চাইছেন। এতে মুদ্রা পাচার হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক পরোক্ষভাবে বিষয়টি চিহ্নিত করে আপত্তি জানিয়েছে।
কিন্তু আফ্রিকায় জমি কেনার এখন যে সুযোগটি এসেছে, তাও নষ্ট করা যাবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অবকাঠামোর দিক বিবেচনা করে আফ্রিকার দেশগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। স্বল্প মেয়াদে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে শুধু চাল নয়, ধানের দামও দ্রুত নির্ধারণ করতে হবে। বিদ্যমান প্রযুক্তিগুলোকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে কৃষি বিষয়ে গবেষণার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
ড. মাহবুব হোসেন: নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক।
অন্যদিক থেকে দেশে ইউরিয়া সারের দাম এখনো অন্যান্য সারের তুলনায় বেশ কমই আছে। সত্তরের দশকে টিএসপি ও ইউরিয়া সারের দাম প্রায় সমান ছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, ধানের জমিতে ৫০ শতাংশ ইউরিয়া ও বাকি ৫০ শতাংশ অন্যান্য সার ব্যবহার করা উচিত। আশির দশকে বিশ্ববাজারে টিএসপি সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারও এই সারের দাম বাড়িয়ে দেয়। দেশে যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদন হওয়ায় সরকার ইউরিয়ার দাম কমায়নি। তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় কৃষক ৮০ শতাংশ ইউরিয়া সার ব্যবহার করতেন। এটা মাটির জন্য খুবই ক্ষতিকর। ইউরিয়া দিলে এর ফলাফল দ্রুত দেখা যায়, ধানসহ অন্যান্য ফসলের পাতা দ্রুত সবুজ হয়। ফলে কৃষক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহার করায় মাটির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল। এখন দাম বাড়ানোর ফলে কৃষক ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও অন্যান্য সার প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করবেন। দীর্ঘ মেয়াদে এটা কৃষির জন্য ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্যাস-সংকটের কারণে দেশের কারখানাগুলোতে ইউরিয়ার উৎপাদন অনেক কমেছে। বোরোর চাষ বাড়ায় প্রয়োজনীয় বাড়তি ইউরিয়া বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হয়েছে। তাই একবাক্যে বলতে গেলে ইউরিয়ার দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অর্থনৈতিক ও কৃষির দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির দিক থেকে ন্যায্য। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সব ধরনের সারের দাম সমান পর্যায়ে রাখতে হবে। তবে কৃষির ক্ষেত্রে সরকারের বেশির ভাগ চিন্তা, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত অনেক বেশি শস্যকেন্দ্রিক। মনে হচ্ছে, ধান ও অন্যান্য ফসলের বাইরে কৃষির অন্য কোনো খাত নেই। এ ছাড়া সরকারের কৃষিবিষয়ক পরিকল্পনা অনেক বেশি উপকরণ বা সার, বীজ, সেচ প্রভৃতির সরবরাহনির্ভর। এগুলোর সরবরাহ পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কৃষি গবেষণার বিষয়ে নিয়মিত ওয়াকিবহাল থাকেন, নিয়মিত নির্দেশনা দিচ্ছেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন, উন্নত বেশ কিছু ধানের জাত বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন। বন্যা ও লবণাক্ত-সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করে মাঠপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কৃষক পর্যায়ে বৃহৎ পরিসরে নেওয়ার আগে পাইলট ভিত্তিতে চাষাবাদ হওয়া উচিত ছিল। লবণাক্ত এলাকায় বিআর-৪৭ জাতের ধান এফএওর মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছানো হলো। কিন্তু সব ধরনের কৃষক এই জাত চাষ করে পোষাতে পারবেন কি না, তা ভেবে দেখা উচিত ছিল। যেসব কৃষক ঝুঁকি নিতে আগ্রহী, তাঁদের চিহ্নিত করে নতুন জাতের ধান চাষ করতে দেওয়া উচিত। এতে জাতগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা যাবে। সফল হলে বা ভালো ফলন দিলে বৃহৎ পরিসরে কৃষক পর্যায়ে পৌঁছানো যাবে। গবেষণা খাতে সরকারের আরও বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। বেশির ভাগ কৃষিনির্ভর দেশ ভ্যালু অ্যাডেড শস্যে ভর্তুকির ক্ষেত্রে বাজেটে মোট বরাদ্দের ২ শতাংশ গবেষণা খাতে দেয়। বাংলাদেশে কৃষি খাতে বরাদ্দের দশমিক ২ শতাংশ গবেষণায় দেওয়া হয়। এটা কমপক্ষে ১ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
চলতি বছরের বাজেট থেকেই সরকার গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো শুরু করতে পারে। তবে গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অতিরিক্ত বরাদ্দ খরচ করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সরকারের উচিত কৃষির বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত জনবল তৈরি করা। উন্নত কৃষিশিক্ষা নিতে বিদেশে পিএইচডিসহ বিভিন্ন গবেষণায় প্রশিক্ষণ নিতে শিক্ষার্থীদের পাঠাতে হবে। দেশে তাঁদের ভালো বেতনে কাজের সুযোগ দিতে হবে। গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক গবেষণাযন্ত্র নিয়ে আসতে হবে। সব মিলিয়ে কৃষিতে গবেষণার বিষয়টিকে ঢেলে সাজাতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতকে অবহেলা করা হচ্ছে। বাজেটে বরাদ্দ, উপকরণ সহজলভ্যসহ বিভিন্ন দিক থেকে শস্য খাত সব সময় প্রাধান্য পায়। শস্যের বাইরে পোলট্রি ও চিংড়ি বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্ব পেয়েছে। অথচ দেশে বিপুল পরিমাণ প্লাবনভূমি রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই প্লাবনভূমিতে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কোন ধরনের মাছ চাষ করা যাবে, তা চিহ্নিত করেছেন। প্লাবনভূমিগুলোর বেশির ভাগই কমন প্রপার্টি হওয়ায় গ্রামের সাধারণ মানুষ এতে অংশীদারি পেতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনে তা সহায়ক হতে পারে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে এই সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ দেখা যায়নি। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের প্লাবনভূমির উৎপাদনশীলতা বাংলাদেশের তিন গুণ। দেশে পুকুরে পরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ হওয়ায় তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের জোগান বেড়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের দেশীয় প্রজাতির শিং, মাগুরসহ অন্যান্য জাতের মাছের উৎপাদন কমেছে। ফলে এগুলোর দাম বেড়েছে। প্লাবনভূমিতে দেশি ও আধুনিক জাতের মাছের চাষ বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে।
পোলট্রি খাতে সাম্প্রতিক সময়ে ঝুঁকির পরিমাণ বেড়েছে। বার্ড ফ্লুসহ নানা রোগের কারণে পোলট্রি খাতের জৈবনিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। রোগ-ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। না হলে পোলট্রি-শিল্পে ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগ আসবে না। বাণিজ্যিকভাবে গবাদিপশু পালন বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে। কেননা, এ জন্য প্রয়োজনীয় গোচারণভূমি ও খাদ্যের জোগান দেওয়ার মতো সম্পদ বাংলাদেশে কম। ভারতের সঙ্গে আমরা এ ক্ষেত্রে পেরে উঠব না। সরকার এ ক্ষেত্রে দুগ্ধশিল্পের সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে পারে। কেননা, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর দুগ্ধসামগ্রীর ডাম্পিং গ্রাউন্ড হয়ে উঠছে। দেশীয় দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দিতে হবে।
বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ কম, জনসংখ্যা বেশি—এই বাস্তব পরিস্থিতি মাথায় রেখে দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্যনিরাপত্তার পরিকল্পনা করতে হবে। দেশের ভেতরে যতই উৎপাদন বাড়াই না কেন, আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে খাদ্য আমদানি করতে হবে। প্রবাসী-আয়, রাজস্ব বাড়ানো ও রপ্তানির মাধ্যমে আমরা আমাদের আয় বাড়াতে পারি। কিন্তু ২০০৭ ও ২০১০-এর অভিজ্ঞতা বলছে, টাকা থাকলেও সব সময় আমদানির জন্য খাদ্য পাওয়া যায় না। ভারত থেকে চাল ও রাশিয়া থেকে গম আমদানির ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় চুক্তি করেও শেষ পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি। তাই খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টিকে আমাদের ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। আফ্রিকার দেশগুলোর কৃষিজমি কিনে চাষ করার একটি সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। চীন ও সিঙ্গাপুর আফ্রিকার অনেক দেশে জমি কিনে চাষ শুরু করেছে। সৌদি আরব ও ভারতের ব্যবসায়ীরা ইথিওপিয়াসহ অন্যান্য দেশে জমি কিনেছে।
বাংলাদেশের সামনেও আফ্রিকার জমি কেনার এই সুযোগ এসেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা আছে। যেমন, কোন দেশে কী পরিমাণ জমি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা নেবেন, তার কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। যেমন—কেনিয়া, উগান্ডার মতো দেশগুলো জমি ইজারা দিতে রাজি হচ্ছে। কিন্তু পূর্ব আফ্রিকার এই দেশগুলোতে বৃষ্টি কম হয়। ফলে সেখানে ধান চাষ করা কঠিন। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে বেশ বৃষ্টি হয়। সেখানে জমি ইজারা নিয়ে বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে ধান উৎপাদন করতে পারে। তবে এ জন্য বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরতে হবে। কমপক্ষে আট বছর লাগবে জঙ্গলাকীর্ণ ওই কৃষিজমিগুলোকে চাষাবাদের উপযোগী করে পূর্ণাঙ্গভাবে উৎপাদনে যেতে।
পশ্চিম আফ্রিকায় উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে উৎপাদন আট গুণ বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু আফ্রিকার এই দেশগুলো সেখানে উৎপাদিত ফসলের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বাংলাদেশে রপ্তানি করতে দেবে কি না, তা আলোচনা করে দেখতে হবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আফ্রিকার দেশগুলোতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হারে ব্যাংকঋণ নিয়ে কৃষির মতো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা সরকারের কাছে টাকাকে ডলারে পরিণত করে আফ্রিকায় বিনিয়োগের অনুমতি চাইছেন। অনেকে মনে করছেন, শেয়ারবাজার থেকে যে টাকাগুলো সরানো হয়েছে, তা বিদেশে পাচারের জন্য ব্যবসায়ীরা আফ্রিকায় বিনিয়োগের কথা বলে টাকাকে ডলার করতে চাইছেন। এতে মুদ্রা পাচার হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক পরোক্ষভাবে বিষয়টি চিহ্নিত করে আপত্তি জানিয়েছে।
কিন্তু আফ্রিকায় জমি কেনার এখন যে সুযোগটি এসেছে, তাও নষ্ট করা যাবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অবকাঠামোর দিক বিবেচনা করে আফ্রিকার দেশগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। স্বল্প মেয়াদে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে শুধু চাল নয়, ধানের দামও দ্রুত নির্ধারণ করতে হবে। বিদ্যমান প্রযুক্তিগুলোকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে কৃষি বিষয়ে গবেষণার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
ড. মাহবুব হোসেন: নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক।
No comments