কালের পুরাণ-আল্লাহর ওয়াস্তে একবার ‘ভুল’ করুন by সোহরাব হাসান
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভুল করেছিলেন। এ কথা স্বীকার করা হয়েছে কংগ্রেস প্রকাশিত বইতে। আমাদের দেশে কোনো দলের কোনো নেতা বা নেত্রী কখনো ভুল করেন না। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের শতবর্ষ (১৮৮৫-১৯৮৪) উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে চার খণ্ডে ইতিহাস প্রকাশ করা হয়েছে।
এর চতুর্থ খণ্ডের মেয়াদ ছিল ১৯৬০ থেকে ১৯৮৪। এর মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীই দেশ শাসন করেছেন প্রায় ১৮ বছর। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন এবং ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত সেই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর সময়ে ভারতের ভেতরে ও বাইরে তোলপাড় করা বহু ঘটনা ঘটে (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা অন্যতম), যা ইন্দিরা গান্ধীকে রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদা দিয়েছে, আবার জরুরি অবস্থা জারিসহ তাঁর বেশ কিছু পদক্ষেপ ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
এ সেঞ্চুরি হিস্টরি অব ইন্ডিয়ান কংগ্রেস শিরোনামের এই বইতে ১৭ জন বিশেষজ্ঞের লেখা রয়েছে। বইটির সম্পাদনা পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রণব মুখার্জি এবং সদস্যসচিব আনন্দ শর্মা। এতে সুধা পাই নামের এক ইতিহাসবিদ ইন্দিরার ক্ষমতাকেন্দ্রীভূতকরণ, রাজ্যগুলোতে দলের গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল করা এবং জরুরি অবস্থা জারির ক্ষতিকর প্রভাবে নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করতে নিয়মতান্ত্রিক পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। যদিও এই নিবন্ধে ইন্দিরা গান্ধীর সাংগঠনিক দক্ষতা, গরিব-সহায়ক নীতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার ও পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা রয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বরাবর ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করেছেন, সে কথা আমরা জানি। কিন্তু এবার কংগ্রেসের ইতিহাসে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনের সমালোচনা হওয়ায় দলের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কংগ্রেসের ইতিহাস বইয়ে একাধিক লেখক ইন্দিরার একনায়কসুলভ দল পরিচালনা, কর্তৃত্ববাদী দেশ শাসনের উল্লেখ করে বলেছেন, তাঁর ভুল নীতির খেসারত এখনো দলকে দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে, সত্তরের দশকের শেষার্ধে উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস যে জনপ্রিয়তা হারায়, তা এখনো পুনরুদ্ধার করা যায়নি। সেখানে কংগ্রেসের অবস্থান চার নম্বরে।
এ বই প্রকাশের পর অনেকে প্রণব মুখার্জি ও আনন্দ শর্মার সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ প্রণব মুখার্জিকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী সেই দাবি নাকচ করে বলেছেন, এতে অন্যায়ের কিছু নেই। যাঁরা বইটির সমালোচনা করেছেন, তাঁরা ভালো করে পড়লে দেখতে পেতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ছোট করা হয়নি; বরং আধুনিক ভারত নির্মাণে কংগ্রেসের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। চারটি লাইন দিয়ে বইটি বিচার করা ঠিক হবে না। প্রণব মুখার্জি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘এতে যেসব লেখক ও বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, তাঁদের সঙ্গে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গির মিল থাকতে হবে, এমন কথা নেই। এটি কংগ্রেসের অফিশিয়াল ইতিহাসও নয়।’
সোনিয়া গান্ধী অতি তোষামদকারীদের পক্ষ নেননি। তিনি সমালোচনাকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন।
কেবল কংগ্রেস নয়, যেকোনো দলের আত্মশুদ্ধির জন্য ভুল স্বীকার করা প্রয়োজন। কাজের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। বিরোধীদের মুখ বন্ধ করাই নয়, দলকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্যও আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে।
এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নেতা-নেত্রীদের মানসিকতা তুলনা করুন। তাঁরা কখনো ভুল করেন না। আর ভুল না করলে স্বীকার করা বা শোধরানোরও প্রশ্ন আসে না।
ভারতীয় লেখক, ইতিহাসবিদেরা কেবল ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচনা করেননি, সমালোচনা করেছেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, রাজীব গান্ধী, নরসিমা রাও, মোরারজি দেশাই, ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর, অটল বিহারি বাজপেয়িসহ অনেক জাতীয় নেতার। এ জন্য কেউ কংগ্রেস বা বিজেপির দালাল হয়ে যাননি।
ছোট ছেলে সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী যখন বড় ছেলে রাজীবকে রাজনীতিতে নামানোর সিদ্ধান্ত নেন, তখন সোনিয়া প্রবলভাবে বিরোধিতা করেছিলেন। এ নিয়ে পারিবারিক বিরোধও দেখা দেয়। কিন্তু ইন্দিরার মুখের ওপর ‘না’ বলার সাহস কারও ছিল না। আজ ইতিহাসের অমোঘ নিয়তি, সেই সোনিয়া গান্ধীর হাতেই কংগ্রেসের পুনরুত্থান ঘটেছে। তাঁর বিচক্ষণ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দল পর পর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বিরোধীদের আপত্তির কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হয়েও প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেননি।
এর বিপরীতে আমাদের রাজনীতিকদের কথা ভাবুন। তাঁরা কারও সমালোচনা সহ্য করেন না। কেউ সমালোচনা করলে তাঁকে দেশদ্রোহী বা জঙ্গি-সহযোগী বানানো হয়। সব সময় তাঁরা স্তুতিকার পরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করেন। নেত্রী যদি বলেন, আজ থেকে সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হবে, দলীয় কর্মী-ক্যাডাররা সেটাই বিশ্বাস করেন এবং দেশবাসীকেও জোর করে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেন।
বাঙালির ইতিহাস নেই বলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে মন্তব্য করেছিলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য তা শতভাগ সত্য। ইতিহাসের নামে দলের পক্ষ থেকে যে লিখিত বয়ান প্রকাশিত হয়, তা নিছক স্তুতি ছাড়া কিছু নয়। দেশের সর্ববৃহৎ দল থেকে শুরু করে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয় এমন দলও কখনো ভুল স্বীকার করেনি। এখনো করছে না।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে কিংবা পঁচাত্তরে বাকশাল গঠন করে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে ভুল করেছিলেন, সে কথা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এখন পর্যন্ত স্বীকার করেন না। তেমনি জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঠেকানোর নামে যে শত শত সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে ভুল করেছিলেন, সে কথাও বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী স্বীকার করেন না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও স্বীকার করেন না, বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে তিনি ভুল করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামীও একাত্তরের ভুলের কথা স্বীকার করে না। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদও স্বীকার করেন না, স্বাধীনতার পর মুজিব উৎখাতের রাজনীতি করে তারা ভুল করেছে। কমিউনিস্ট পার্টিও জিয়ার খাল কাটাকে সমর্থন করে যে রাজনৈতিক ভুল করেছিল, তা স্বীকার করতে চায় না। মওলানা ভাসানীর অনুসারীরাও মানতে চান না, তাঁদের নেতা আইয়ুব খানকে সমর্থন করে এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভুল স্বীকার করলে দেশের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন ১৯৮১ সালে, দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বিএনপির দায়িত্ব নিয়েছেন ১৯৮৩ সালে। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁরা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ কথা স্বীকার করেন না। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না গেলে এরশাদ আরও চার বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতেন না, দলের এত নেতা-কর্মীকেও জীবন দিতে হতো না। ২০০৭ সালে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ পাঁচ দফা চুক্তি করে ভুল করেছে, সে কথাও দলীয় নেতৃত্ব স্বীকার করতে চান না।
বিএনপি নিজেকে সাচ্চা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল বলে দাবি করে। আবার মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে তার গলায় গলায় খাতির জমাতেও বাধে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তারা বাংলা ভাই-শায়খ আবদুর রহমানদের মদদ দিয়েছে। চারদলীয় জোটের আমলে বাংলাদেশ মৌলবাদীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র ছিল, বোমা-গ্রেনেডের বলি হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এ জন্য বিএনপির কোনো দুঃখবোধ বা অনুশোচনা নেই।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা যেভাবে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ২০০৮ সালে খালেদা জিয়াও তা-ই করেছেন। তিনি বিদেশের তৃতীয় সারির নেতা-এমপিদের সঙ্গে বৈঠক করে মধ্যবর্তী নির্বাচন চেয়েছেন। বলেছেন, জনগণের ভোটে নয়, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান সরকার। আমাদের নেতা-নেত্রীদের কথা হলো, জয়ী হলে সব ভালো, পরাজিত হলে সব খারাপ। মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন খারাপ। সাহাবুদ্দীন-লতিফুর রহমান খারাপ। তবে এসব কথা যখন বলছি, তখন ২০০১-এর নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপির ক্যাডারদের ‘জাতি নির্মূলকরণ’ অভিযান কিংবা ২০০৬ সালের অক্টোবরে রাজপথে লগি-বৈঠার সহিংসতার কথা ভুলে যাচ্ছি না। যে জাতি ৬০ বছর ধরে রাজপথে হিংসা ছড়িয়ে আসছে, সেই জাতির উন্নতি কী করে হবে?
বিএনপিকে বলব, রাজপথ ছেড়ে সংসদে আসুন। কথা বলুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে আপনাদের যুক্তি তুলে ধরুন। কিন্তু মনে হচ্ছে, ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যে রাস্তা দেখিয়েছে, বিএনপি সেই রাস্তাতেই হাঁটছে। হিংসা-দ্বেষ-ঘৃণা ছড়িয়ে, দেশ অচল করে দিয়ে দাবি আদায় করবে।
এর নাম কি গণতন্ত্র? এর নাম কি রাজনীতি? আবারও বলছি, আমাদের রাজনীতিকেরা, নেতা-নেত্রীরা কোনো ভুল করেন না। শতভাগ নির্ভুল। শতভাগ বিশুদ্ধ। কিন্তু আমরা একজন ভুল করা নেতা-নেত্রী চাই, যিনি বিজয়ের জন্য গৌরব বোধ করবেন, আবার পরাজয়ের গ্লানি অবনত মস্তকে মেনে নিয়ে জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করবেন। ভুল স্বীকারে দোষ নেই। বরং ভুলকে আঁকড়ে ধরলে আরও পাঁচটি ভুল করার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আমিই দেশপ্রেমিক আর সব দেশদ্রোহী—এই মনোভাবও পরিহার করুন। ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’-এর নামে মানুষ মারার রাজনীতি চাই না। ‘দিনবদল’-এর নামে কতিপয় ক্ষমতাধর ভাগ্যবদল কিংবা হাজার হাজার খুদে বিনিয়োগকারীর সর্বস্ব লুট করাও নয়। একটু নিচে তাকান—যারা চাষ করে, কারখানায় চাকা ঘোরায়, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, যারা অপুষ্টিতে ভোগে, ক্ষুধায় কাতর হয়, যাদের চালচুলা নেই, যারা আমৃত্যু দিনযাপনের গ্লানি বয়ে বেড়ায়, সেই মূঢ় ম্লান-মুখ মানুষগুলোর কথা ভাবুন।
সামনে কঠিন বিপদ। নেতা-নেত্রীদের নয়; দেশের সাধারণ মানুষের। খালেদা জিয়া যদি ‘ভুল’ করে হরতাল প্রত্যাহার করেন, কিংবা শেখ হাসিনা যদি ‘ভুল’ করে সমঝোতার পথ খোঁজেন, তাহলে দেশটি বেঁচে যায়।
আল্লাহর ওয়াস্তে একবার ‘ভুল’ করুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
এ সেঞ্চুরি হিস্টরি অব ইন্ডিয়ান কংগ্রেস শিরোনামের এই বইতে ১৭ জন বিশেষজ্ঞের লেখা রয়েছে। বইটির সম্পাদনা পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রণব মুখার্জি এবং সদস্যসচিব আনন্দ শর্মা। এতে সুধা পাই নামের এক ইতিহাসবিদ ইন্দিরার ক্ষমতাকেন্দ্রীভূতকরণ, রাজ্যগুলোতে দলের গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল করা এবং জরুরি অবস্থা জারির ক্ষতিকর প্রভাবে নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করতে নিয়মতান্ত্রিক পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। যদিও এই নিবন্ধে ইন্দিরা গান্ধীর সাংগঠনিক দক্ষতা, গরিব-সহায়ক নীতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার ও পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা রয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বরাবর ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করেছেন, সে কথা আমরা জানি। কিন্তু এবার কংগ্রেসের ইতিহাসে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনের সমালোচনা হওয়ায় দলের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কংগ্রেসের ইতিহাস বইয়ে একাধিক লেখক ইন্দিরার একনায়কসুলভ দল পরিচালনা, কর্তৃত্ববাদী দেশ শাসনের উল্লেখ করে বলেছেন, তাঁর ভুল নীতির খেসারত এখনো দলকে দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে, সত্তরের দশকের শেষার্ধে উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস যে জনপ্রিয়তা হারায়, তা এখনো পুনরুদ্ধার করা যায়নি। সেখানে কংগ্রেসের অবস্থান চার নম্বরে।
এ বই প্রকাশের পর অনেকে প্রণব মুখার্জি ও আনন্দ শর্মার সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ প্রণব মুখার্জিকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী সেই দাবি নাকচ করে বলেছেন, এতে অন্যায়ের কিছু নেই। যাঁরা বইটির সমালোচনা করেছেন, তাঁরা ভালো করে পড়লে দেখতে পেতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ছোট করা হয়নি; বরং আধুনিক ভারত নির্মাণে কংগ্রেসের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। চারটি লাইন দিয়ে বইটি বিচার করা ঠিক হবে না। প্রণব মুখার্জি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘এতে যেসব লেখক ও বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, তাঁদের সঙ্গে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গির মিল থাকতে হবে, এমন কথা নেই। এটি কংগ্রেসের অফিশিয়াল ইতিহাসও নয়।’
সোনিয়া গান্ধী অতি তোষামদকারীদের পক্ষ নেননি। তিনি সমালোচনাকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন।
কেবল কংগ্রেস নয়, যেকোনো দলের আত্মশুদ্ধির জন্য ভুল স্বীকার করা প্রয়োজন। কাজের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। বিরোধীদের মুখ বন্ধ করাই নয়, দলকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্যও আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে।
এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নেতা-নেত্রীদের মানসিকতা তুলনা করুন। তাঁরা কখনো ভুল করেন না। আর ভুল না করলে স্বীকার করা বা শোধরানোরও প্রশ্ন আসে না।
ভারতীয় লেখক, ইতিহাসবিদেরা কেবল ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচনা করেননি, সমালোচনা করেছেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, রাজীব গান্ধী, নরসিমা রাও, মোরারজি দেশাই, ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর, অটল বিহারি বাজপেয়িসহ অনেক জাতীয় নেতার। এ জন্য কেউ কংগ্রেস বা বিজেপির দালাল হয়ে যাননি।
ছোট ছেলে সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী যখন বড় ছেলে রাজীবকে রাজনীতিতে নামানোর সিদ্ধান্ত নেন, তখন সোনিয়া প্রবলভাবে বিরোধিতা করেছিলেন। এ নিয়ে পারিবারিক বিরোধও দেখা দেয়। কিন্তু ইন্দিরার মুখের ওপর ‘না’ বলার সাহস কারও ছিল না। আজ ইতিহাসের অমোঘ নিয়তি, সেই সোনিয়া গান্ধীর হাতেই কংগ্রেসের পুনরুত্থান ঘটেছে। তাঁর বিচক্ষণ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দল পর পর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বিরোধীদের আপত্তির কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হয়েও প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেননি।
এর বিপরীতে আমাদের রাজনীতিকদের কথা ভাবুন। তাঁরা কারও সমালোচনা সহ্য করেন না। কেউ সমালোচনা করলে তাঁকে দেশদ্রোহী বা জঙ্গি-সহযোগী বানানো হয়। সব সময় তাঁরা স্তুতিকার পরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করেন। নেত্রী যদি বলেন, আজ থেকে সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হবে, দলীয় কর্মী-ক্যাডাররা সেটাই বিশ্বাস করেন এবং দেশবাসীকেও জোর করে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেন।
বাঙালির ইতিহাস নেই বলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে মন্তব্য করেছিলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য তা শতভাগ সত্য। ইতিহাসের নামে দলের পক্ষ থেকে যে লিখিত বয়ান প্রকাশিত হয়, তা নিছক স্তুতি ছাড়া কিছু নয়। দেশের সর্ববৃহৎ দল থেকে শুরু করে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয় এমন দলও কখনো ভুল স্বীকার করেনি। এখনো করছে না।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে কিংবা পঁচাত্তরে বাকশাল গঠন করে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে ভুল করেছিলেন, সে কথা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এখন পর্যন্ত স্বীকার করেন না। তেমনি জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঠেকানোর নামে যে শত শত সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে ভুল করেছিলেন, সে কথাও বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী স্বীকার করেন না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও স্বীকার করেন না, বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে তিনি ভুল করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামীও একাত্তরের ভুলের কথা স্বীকার করে না। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদও স্বীকার করেন না, স্বাধীনতার পর মুজিব উৎখাতের রাজনীতি করে তারা ভুল করেছে। কমিউনিস্ট পার্টিও জিয়ার খাল কাটাকে সমর্থন করে যে রাজনৈতিক ভুল করেছিল, তা স্বীকার করতে চায় না। মওলানা ভাসানীর অনুসারীরাও মানতে চান না, তাঁদের নেতা আইয়ুব খানকে সমর্থন করে এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভুল স্বীকার করলে দেশের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন ১৯৮১ সালে, দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বিএনপির দায়িত্ব নিয়েছেন ১৯৮৩ সালে। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁরা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ কথা স্বীকার করেন না। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না গেলে এরশাদ আরও চার বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতেন না, দলের এত নেতা-কর্মীকেও জীবন দিতে হতো না। ২০০৭ সালে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ পাঁচ দফা চুক্তি করে ভুল করেছে, সে কথাও দলীয় নেতৃত্ব স্বীকার করতে চান না।
বিএনপি নিজেকে সাচ্চা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল বলে দাবি করে। আবার মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে তার গলায় গলায় খাতির জমাতেও বাধে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তারা বাংলা ভাই-শায়খ আবদুর রহমানদের মদদ দিয়েছে। চারদলীয় জোটের আমলে বাংলাদেশ মৌলবাদীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র ছিল, বোমা-গ্রেনেডের বলি হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এ জন্য বিএনপির কোনো দুঃখবোধ বা অনুশোচনা নেই।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা যেভাবে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ২০০৮ সালে খালেদা জিয়াও তা-ই করেছেন। তিনি বিদেশের তৃতীয় সারির নেতা-এমপিদের সঙ্গে বৈঠক করে মধ্যবর্তী নির্বাচন চেয়েছেন। বলেছেন, জনগণের ভোটে নয়, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে বর্তমান সরকার। আমাদের নেতা-নেত্রীদের কথা হলো, জয়ী হলে সব ভালো, পরাজিত হলে সব খারাপ। মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন খারাপ। সাহাবুদ্দীন-লতিফুর রহমান খারাপ। তবে এসব কথা যখন বলছি, তখন ২০০১-এর নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপির ক্যাডারদের ‘জাতি নির্মূলকরণ’ অভিযান কিংবা ২০০৬ সালের অক্টোবরে রাজপথে লগি-বৈঠার সহিংসতার কথা ভুলে যাচ্ছি না। যে জাতি ৬০ বছর ধরে রাজপথে হিংসা ছড়িয়ে আসছে, সেই জাতির উন্নতি কী করে হবে?
বিএনপিকে বলব, রাজপথ ছেড়ে সংসদে আসুন। কথা বলুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে আপনাদের যুক্তি তুলে ধরুন। কিন্তু মনে হচ্ছে, ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যে রাস্তা দেখিয়েছে, বিএনপি সেই রাস্তাতেই হাঁটছে। হিংসা-দ্বেষ-ঘৃণা ছড়িয়ে, দেশ অচল করে দিয়ে দাবি আদায় করবে।
এর নাম কি গণতন্ত্র? এর নাম কি রাজনীতি? আবারও বলছি, আমাদের রাজনীতিকেরা, নেতা-নেত্রীরা কোনো ভুল করেন না। শতভাগ নির্ভুল। শতভাগ বিশুদ্ধ। কিন্তু আমরা একজন ভুল করা নেতা-নেত্রী চাই, যিনি বিজয়ের জন্য গৌরব বোধ করবেন, আবার পরাজয়ের গ্লানি অবনত মস্তকে মেনে নিয়ে জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করবেন। ভুল স্বীকারে দোষ নেই। বরং ভুলকে আঁকড়ে ধরলে আরও পাঁচটি ভুল করার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আমিই দেশপ্রেমিক আর সব দেশদ্রোহী—এই মনোভাবও পরিহার করুন। ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’-এর নামে মানুষ মারার রাজনীতি চাই না। ‘দিনবদল’-এর নামে কতিপয় ক্ষমতাধর ভাগ্যবদল কিংবা হাজার হাজার খুদে বিনিয়োগকারীর সর্বস্ব লুট করাও নয়। একটু নিচে তাকান—যারা চাষ করে, কারখানায় চাকা ঘোরায়, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, যারা অপুষ্টিতে ভোগে, ক্ষুধায় কাতর হয়, যাদের চালচুলা নেই, যারা আমৃত্যু দিনযাপনের গ্লানি বয়ে বেড়ায়, সেই মূঢ় ম্লান-মুখ মানুষগুলোর কথা ভাবুন।
সামনে কঠিন বিপদ। নেতা-নেত্রীদের নয়; দেশের সাধারণ মানুষের। খালেদা জিয়া যদি ‘ভুল’ করে হরতাল প্রত্যাহার করেন, কিংবা শেখ হাসিনা যদি ‘ভুল’ করে সমঝোতার পথ খোঁজেন, তাহলে দেশটি বেঁচে যায়।
আল্লাহর ওয়াস্তে একবার ‘ভুল’ করুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments