মানুষের মুখ-কবিতাপাগল মানুষটি by শর্মিলা সিনড্রেলা
‘মৌমাছি ছোট বটে, দিয়ে থাকে মধু প্রজাপতি রং-বাহার, গুণহীন শুধু। এক ভরি সোনা আর লৌহ এক মণ জ্ঞানীতুল্য মূল্য তাঁর হয় না কখন।’ শুধু রং আর ঢং থাকলেই হয় না, পাশাপাশি প্রয়োজন গুণের। কিন্তু কজনেরই বা গুণের তেমন কদর হয়, বলুন তো? কেউ যদি একটু সুযোগ পায় সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার, তো অনেকে পড়ে থাকে অজানাতেই।
বছরের পর বছর ভালোবাসার বিষয়টি নিয়ে সাধনা করেও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকে না কারও কারও। এমনই অগোচরে পড়ে থাকা এক মৌমাছির নাম ফজলুর রহমান, যিনি তাঁর এলাকার অনেকের কাছে ফজলু কবি নামে পরিচিত।
নজরুল আর জসীমউদ্দীনের কবিতা নিয়ে ছিল তাঁর ব্যাপক আগ্রহ। ছোট থেকেই এগুলো পড়তেন বিপুল উৎসাহে। একসময় ভালোবাসার জায়গাটা পুরোপুরিই অর্জন করে নেয় নজরুলের কবিতা। তারপর সেই ভালোলাগা থেকেই ধীরে ধীরে কবিতা লেখার শুরু। তখন কেবল নবম শ্রেণীতে পড়েন তিনি। সেই শুরু তাঁর কবিতা লেখার। তারপর আর থামেননি। এখন বয়স ৬০ বছর। এখনো কোনো একটি বিষয় যদি সবাইকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেন, তবে তা নিয়ে লিখে ফেলেন একটি কবিতা।
অনেক দিন আগের কিছু গল্প শোনা যাক তাঁরই মুখে। ‘আমার লেখা কবিতা নিয়ে আগে আসর বসত। চার-পাঁচ শ লোক জমা হতো সেই আসরে। আর আমি একের পর এক শুনিয়ে যেতাম নিজের লেখা কবিতা। একটানা ১৩ রাত আমার কবিতা শুনিয়ে কেটেছে। আমার কবিতায় আমি গ্রামবাংলার কথা বেশি লিখি। আর সব সময় কিছু উপদেশ দিতে চাই সবাইকে। তবে এখন আর অনেক দিন এমন আসর বসানো হয় না। সেই ১৯৯২ সালে শেষবারের মতো এমন আসর বসেছিল।’
একটানা কয়েক দিন গানের আসরের কথা শোনা যায়। কিন্তু কবিতার আসরের কথা শুনে একটু অবাকই হই। ভাবি, কী আছে তাঁর লেখা কবিতায়? কবিতাগুলো দেখার পর মনে হয়, কী নেই তাঁর কবিতায়? গ্রামের মাঠ, ধান, বনভোজন, কৃষিখেত থেকে শুরু করে পাশ দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদী ছাড়াও চাষি, পল্লি—সবই উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। পাশাপাশি রয়েছে ইসলাম ধর্মভিত্তিক কিছু কবিতা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর উপজেলার চৌডালায় হাউসনগর গ্রামে এই কবির বাড়ি। এখনো তিনি তাঁর ভাব প্রকাশ করেন কবিতার মাধ্যমেই। আর তাঁর এই কাজকে শ্রদ্ধা জানাতে এগিয়ে আসে ‘আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগার’ ও ‘ইউস্যাক’। লুকিয়ে থাকা এই প্রতিভা খুঁজে বের করে আনেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার জমিনপুর গ্রামে অবস্থিত আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগারের একদল কর্মী। আর তাঁদের সাহায্য করে ইউস্যাক (ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব চৌডালা)। গত ২৫ মার্চ এই কবিকে তাঁর সারা জীবন লিখে যাওয়া কবিতার স্বীকৃতিস্বরূপ আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগারের উদ্যোগে ও ইউস্যাকের আয়োজনে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ওই দিন কবির বেশ কিছু শ্রোতা এবং কবিসহ আরও উপস্থিত ছিলেন তহুর আহমেদ মিয়া, যাঁকে নিয়ে প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ফজলু কবি। রহনপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান তহুর আহমেদ বলেন, ‘মনের ভাব যেখানে গভীর, ভাষা সেখানে মূক। ফজলু কবির চিন্তাভাবনা অনেক বেশি গভীর। আমরা শুধু চাই, এগুলো যেন একেবারে বিলীন হয়ে না যায়।’
কবিতা লিখতে গিয়ে সবারই সহযোগিতা পেয়েছেন ফজলুর রহমান। বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক বলতেন, ‘আরে, কবিতা আল্লার দান। লিখে যা।’ স্ত্রী পিয়ারা বেগম তো এখনো অবাক হয়ে বলেন, ‘তুমি কীভাবে এত সুন্দর কবিতা লিখ জি!’
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ফজলুর রহমান আরও বলেন, ‘১৯৭৪ সালে বাবার সাথে গেছিলাম ঢাকায়। সেখানে দেখা হয়েছিল আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। তখন তাঁর বাকশক্তি নেই। আমি তাঁর লেখা কবিতাগুলো একের পর এক আবৃত্তি করে শোনাতে লাগলাম। কবি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। কাঁদতেও শুরু করেছিলেন। আমার কবিতা আবৃত্তি শুনে কবি নজরুলের ছেলে কাজী সব্যসাচী আমাকে নজরুল পরিচিতি নামের একটা বই উপহার দিয়েছিলেন।’
গ্রামাঞ্চলে সন্ধ্যা পেরোতেই নেমে আসে গভীর রাত। তাই এশার নামাজটা পড়েই এখনো কবিতা লিখতে বসে যান ফজলুর রহমান। তারপর ধীরে ধীরে রাত ভোর হয়। আর কবির হাতের কলমে মনে জমে থাকা শব্দগুলো কবিতা হয়ে ওঠে। নতুন-পুরোনো অনেক বিষয়ই উঠে আসে তাঁর রাতভর জেগে লেখা কবিতাগুলোয়। ইউস্যাকের এক সদস্য রুজেল আলম বলেন, ‘ফজলুর রহমান কবির কবিতার সুনাম আমরা আগে অনেকেই শুনেছি। কিন্তু তিনি তাঁর এই প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পাননি। গ্রামের আনাচকানাচে অনেক সময় অনেক প্রতিভা অজানায় থেকে যায়। এমন একজন মানুষকে খুঁজে বের করতে পেরে আমরা খুশি এবং আমরা চাই, যাঁদের প্রতিভা আছে, তাঁরা যেন তাঁদের প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পান; অন্ধকারেই থেকে না যান সারা জীবন।’
শর্মিলা সিনড্রেলা
নজরুল আর জসীমউদ্দীনের কবিতা নিয়ে ছিল তাঁর ব্যাপক আগ্রহ। ছোট থেকেই এগুলো পড়তেন বিপুল উৎসাহে। একসময় ভালোবাসার জায়গাটা পুরোপুরিই অর্জন করে নেয় নজরুলের কবিতা। তারপর সেই ভালোলাগা থেকেই ধীরে ধীরে কবিতা লেখার শুরু। তখন কেবল নবম শ্রেণীতে পড়েন তিনি। সেই শুরু তাঁর কবিতা লেখার। তারপর আর থামেননি। এখন বয়স ৬০ বছর। এখনো কোনো একটি বিষয় যদি সবাইকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেন, তবে তা নিয়ে লিখে ফেলেন একটি কবিতা।
অনেক দিন আগের কিছু গল্প শোনা যাক তাঁরই মুখে। ‘আমার লেখা কবিতা নিয়ে আগে আসর বসত। চার-পাঁচ শ লোক জমা হতো সেই আসরে। আর আমি একের পর এক শুনিয়ে যেতাম নিজের লেখা কবিতা। একটানা ১৩ রাত আমার কবিতা শুনিয়ে কেটেছে। আমার কবিতায় আমি গ্রামবাংলার কথা বেশি লিখি। আর সব সময় কিছু উপদেশ দিতে চাই সবাইকে। তবে এখন আর অনেক দিন এমন আসর বসানো হয় না। সেই ১৯৯২ সালে শেষবারের মতো এমন আসর বসেছিল।’
একটানা কয়েক দিন গানের আসরের কথা শোনা যায়। কিন্তু কবিতার আসরের কথা শুনে একটু অবাকই হই। ভাবি, কী আছে তাঁর লেখা কবিতায়? কবিতাগুলো দেখার পর মনে হয়, কী নেই তাঁর কবিতায়? গ্রামের মাঠ, ধান, বনভোজন, কৃষিখেত থেকে শুরু করে পাশ দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদী ছাড়াও চাষি, পল্লি—সবই উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। পাশাপাশি রয়েছে ইসলাম ধর্মভিত্তিক কিছু কবিতা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর উপজেলার চৌডালায় হাউসনগর গ্রামে এই কবির বাড়ি। এখনো তিনি তাঁর ভাব প্রকাশ করেন কবিতার মাধ্যমেই। আর তাঁর এই কাজকে শ্রদ্ধা জানাতে এগিয়ে আসে ‘আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগার’ ও ‘ইউস্যাক’। লুকিয়ে থাকা এই প্রতিভা খুঁজে বের করে আনেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার জমিনপুর গ্রামে অবস্থিত আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগারের একদল কর্মী। আর তাঁদের সাহায্য করে ইউস্যাক (ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব চৌডালা)। গত ২৫ মার্চ এই কবিকে তাঁর সারা জীবন লিখে যাওয়া কবিতার স্বীকৃতিস্বরূপ আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগারের উদ্যোগে ও ইউস্যাকের আয়োজনে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ওই দিন কবির বেশ কিছু শ্রোতা এবং কবিসহ আরও উপস্থিত ছিলেন তহুর আহমেদ মিয়া, যাঁকে নিয়ে প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ফজলু কবি। রহনপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান তহুর আহমেদ বলেন, ‘মনের ভাব যেখানে গভীর, ভাষা সেখানে মূক। ফজলু কবির চিন্তাভাবনা অনেক বেশি গভীর। আমরা শুধু চাই, এগুলো যেন একেবারে বিলীন হয়ে না যায়।’
কবিতা লিখতে গিয়ে সবারই সহযোগিতা পেয়েছেন ফজলুর রহমান। বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক বলতেন, ‘আরে, কবিতা আল্লার দান। লিখে যা।’ স্ত্রী পিয়ারা বেগম তো এখনো অবাক হয়ে বলেন, ‘তুমি কীভাবে এত সুন্দর কবিতা লিখ জি!’
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ফজলুর রহমান আরও বলেন, ‘১৯৭৪ সালে বাবার সাথে গেছিলাম ঢাকায়। সেখানে দেখা হয়েছিল আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। তখন তাঁর বাকশক্তি নেই। আমি তাঁর লেখা কবিতাগুলো একের পর এক আবৃত্তি করে শোনাতে লাগলাম। কবি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। কাঁদতেও শুরু করেছিলেন। আমার কবিতা আবৃত্তি শুনে কবি নজরুলের ছেলে কাজী সব্যসাচী আমাকে নজরুল পরিচিতি নামের একটা বই উপহার দিয়েছিলেন।’
গ্রামাঞ্চলে সন্ধ্যা পেরোতেই নেমে আসে গভীর রাত। তাই এশার নামাজটা পড়েই এখনো কবিতা লিখতে বসে যান ফজলুর রহমান। তারপর ধীরে ধীরে রাত ভোর হয়। আর কবির হাতের কলমে মনে জমে থাকা শব্দগুলো কবিতা হয়ে ওঠে। নতুন-পুরোনো অনেক বিষয়ই উঠে আসে তাঁর রাতভর জেগে লেখা কবিতাগুলোয়। ইউস্যাকের এক সদস্য রুজেল আলম বলেন, ‘ফজলুর রহমান কবির কবিতার সুনাম আমরা আগে অনেকেই শুনেছি। কিন্তু তিনি তাঁর এই প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পাননি। গ্রামের আনাচকানাচে অনেক সময় অনেক প্রতিভা অজানায় থেকে যায়। এমন একজন মানুষকে খুঁজে বের করতে পেরে আমরা খুশি এবং আমরা চাই, যাঁদের প্রতিভা আছে, তাঁরা যেন তাঁদের প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পান; অন্ধকারেই থেকে না যান সারা জীবন।’
শর্মিলা সিনড্রেলা
No comments