চারদিক-অভিশপ্ত পনেরো বছর বয়স by আজাদ রহমান
তাজুল, সাইফুল আর আলেয়া। তিন ভাইবোন। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত হাঁটতে-চলতে পারতেন, আর দশজনের মতো স্বাভাবিক জীবন ছিল তাঁদের। স্কুলেও যেতেন তাঁরা। ১৫ বছর পার হওয়ার পর তাঁরা একে একে তিনজনই পঙ্গু হয়ে পড়েন। তাঁদের শরীরের নিচের অংশে কোনো শক্তি নেই।
এখন আর তাঁরা দাঁড়াতে পারেন না। বিছানায় শুয়ে সারা দিন কান্নাকাটি করেন।
মা রিজিয়া পারভিন জানিয়েছেন, অনেক চিকিৎসক দেখিয়েছেন। মাঠে চাষযোগ্য যে জমি ছিল, সব বিক্রি করেছেন। এখন সব হারিয়ে তাঁরা নিঃস্ব। আর্থিক কারণে আর চিকিৎসকের কাছে নিতে পারছেন না। বাড়ির বারান্দায় পড়ে কান্নাকাটি করছেন তাঁরা। চিকিৎসক জানিয়েছেন, শিরার সমস্যার কারণে তাঁদের এ অবস্থা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখালে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাঁদের প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার থেকে শুরু করে সব কাজই মাকে করতে হয়।
পঙ্গু এই তিন ভাইবোনের বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার জলিলপুর গ্রামে। ওই গ্রামের আলাউদ্দিন শেখের সন্তান তাঁরা। আলাউদ্দিন রাস্তার ধারে ডিম বিক্রি করে সংসার চালান। মাঠে দুই বিঘা চাষযোগ্য জমি ছিল তাঁর। আর ১১ শতক জমির ওপর দুটি মাটির ঘর। পঙ্গু তিন সন্তানের মধ্যে তাজুল ইসলামের বয়স ৩০ বছর, সাইফুল ইসলামের ২৬ আর আলেয়া খাতুনের ১৯ বছর। তাঁদের মা রিজিয়া পারভিন জানান, বড় ছেলে তাজুল ইসলাম মাদ্রাসায় পড়ালেখা করত। ১৫ বছর বয়সে সে যখন নবম শ্রেণীতে পড়ে, তখন হঠাৎ করে তাঁর পায়ের শিরায় ব্যথা শুরু হয়, যা আস্তে আস্তে বেড়ে শরীরের নিচের অংশ সম্পূর্ণ অবশ করে দেয়। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। রোগ দেখা দেওয়ার এক মাসের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ পঙ্গু হয়ে যান। রিজিয়া পারভিন আরও জানান, বড় ছেলের চিকিৎসা করাতে তাঁকে অনেক স্থানে নিয়ে গেছেন। অনেক চিকিৎসক দেখিয়েছেন। ভারতেও নিয়ে গেছেন। কিন্তু কেউ ভালো করতে পারেননি। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁর শিরার সমস্যা বলে জানিয়েছেন। ছেলের এই চিকিৎসা করাতে তাঁদের মাঠে যে চাষের জমি ছিল, তা বিক্রি করতে হয়েছে। এরপর টাকার অভাবে আর চিকিৎসা করাতে না পেরে বাড়িতে ফেলে রেখেছেন। রিজিয়া পারভিন জানান, এরপর সাইফুল ইসলামের একই রোগ দেখা দেয়। তাঁর বয়সও ১৫ বছর পার হয়ে গেলে এ অবস্থা হয়। পায়ের শিরায় ব্যথা থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে তিনিও পঙ্গু হয়ে যান। এখন তাঁর দুটি পা কাঁপে সারাক্ষণ, সোজা হতে পারেন না। ছোট মেয়ে আলেয়া খাতুন পঙ্গু হয়েছেন চার বছর হলো। তাঁর বয়স এখন ১৯। তিনিও পঙ্গু অবস্থায় বাড়ির বারান্দায় পড়ে আছেন। গত ৫ এপ্রিল তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পশ্চিম পাশের একটি ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন আলেয়া খাতুন। উত্তর পাশের ঘরের বারান্দায় পড়ে আছেন সাইফুল ইসলাম। আর ঘরের সঙ্গে বাঁধা চালার নিচে শুয়ে আছেন তাজুল ইসলাম। তাঁদের এ অবস্থা কীভাবে হলো জানতে চাওয়ামাত্র সবার চোখে পানি। তাঁদের প্রশ্ন: আমরা কি আর ভালো হতে পারব না? তাঁরা জানান, সাধারণ আর দশজন মানুষের মতোই সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের জীবনে ১৫ বছর বয়সটা অভিশাপ হয়ে আসে, একে একে তিনজনই পঙ্গু হয়ে যান। বাড়ির ভেতর দিয়ে কাউকে হাঁটাচলা করতে দেখলে তাঁদের কষ্ট হয়। সবাই হাঁটতে পারছে, অথচ তাঁরা পারছেন না। তাজুল ইসলাম দুঃখ করে বলেন, তাঁদের টাকা নেই, তাই চিকিৎসা হচ্ছে না।
প্রতিবেশী মোস্তফা কামাল এ সময় এসে দাঁড়ান। বলেন, তাঁদের করুণ অবস্থা দেখলে চোখে পানি এসে যায়। চাচাতো বোন মরিয়ম খাতুন জানান, ছোটবেলায় আলেয়ার সঙ্গে খেলাধুলা করেছেন। এখন এ অবস্থা দেখে তাঁর খুবই কষ্ট হয়।
রিজিয়া পারভিনের আরও দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে আছে। মেয়ে দুজনের বিয়ে দিয়েছেন। আর ছোট ছেলে খুলনায় তার মামার দোকানে কাজ করে। তারা তিনজন ভালো আছে। পঙ্গু তিন সন্তান নিয়ে রিজিয়া পারভিন অমানবিক জীবন যাপন করছেন। তাঁদের বাবা আলাউদ্দিন যা আয় করেন, তা দিয়ে ঠিকমতো সংসারই চলে না। মাঝেমধ্যে মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়েও চলতে হয় তাঁদের। এ অবস্থায় সন্তানদের আর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেন না। পঙ্গু সন্তানদের হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িভাড়া জোগাড় করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবদুল আজিজের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি বলেন, ওই তিন ভাইবোন স্নায়ুরোগে আক্রান্ত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়। তবে স্নায়ুরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখালে বলা যাবে আসল সমস্যা কী। ঝিনাইদহে নিউরো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই, তাই অন্য কোথাও নিয়ে দেখালে ভালো হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। কিন্তু কে দেবে টাকা? কে তাঁদের নিয়ে যাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে?
উত্তর মেলে না।
আজাদ রহমান
মা রিজিয়া পারভিন জানিয়েছেন, অনেক চিকিৎসক দেখিয়েছেন। মাঠে চাষযোগ্য যে জমি ছিল, সব বিক্রি করেছেন। এখন সব হারিয়ে তাঁরা নিঃস্ব। আর্থিক কারণে আর চিকিৎসকের কাছে নিতে পারছেন না। বাড়ির বারান্দায় পড়ে কান্নাকাটি করছেন তাঁরা। চিকিৎসক জানিয়েছেন, শিরার সমস্যার কারণে তাঁদের এ অবস্থা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখালে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাঁদের প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার থেকে শুরু করে সব কাজই মাকে করতে হয়।
পঙ্গু এই তিন ভাইবোনের বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার জলিলপুর গ্রামে। ওই গ্রামের আলাউদ্দিন শেখের সন্তান তাঁরা। আলাউদ্দিন রাস্তার ধারে ডিম বিক্রি করে সংসার চালান। মাঠে দুই বিঘা চাষযোগ্য জমি ছিল তাঁর। আর ১১ শতক জমির ওপর দুটি মাটির ঘর। পঙ্গু তিন সন্তানের মধ্যে তাজুল ইসলামের বয়স ৩০ বছর, সাইফুল ইসলামের ২৬ আর আলেয়া খাতুনের ১৯ বছর। তাঁদের মা রিজিয়া পারভিন জানান, বড় ছেলে তাজুল ইসলাম মাদ্রাসায় পড়ালেখা করত। ১৫ বছর বয়সে সে যখন নবম শ্রেণীতে পড়ে, তখন হঠাৎ করে তাঁর পায়ের শিরায় ব্যথা শুরু হয়, যা আস্তে আস্তে বেড়ে শরীরের নিচের অংশ সম্পূর্ণ অবশ করে দেয়। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। রোগ দেখা দেওয়ার এক মাসের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ পঙ্গু হয়ে যান। রিজিয়া পারভিন আরও জানান, বড় ছেলের চিকিৎসা করাতে তাঁকে অনেক স্থানে নিয়ে গেছেন। অনেক চিকিৎসক দেখিয়েছেন। ভারতেও নিয়ে গেছেন। কিন্তু কেউ ভালো করতে পারেননি। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁর শিরার সমস্যা বলে জানিয়েছেন। ছেলের এই চিকিৎসা করাতে তাঁদের মাঠে যে চাষের জমি ছিল, তা বিক্রি করতে হয়েছে। এরপর টাকার অভাবে আর চিকিৎসা করাতে না পেরে বাড়িতে ফেলে রেখেছেন। রিজিয়া পারভিন জানান, এরপর সাইফুল ইসলামের একই রোগ দেখা দেয়। তাঁর বয়সও ১৫ বছর পার হয়ে গেলে এ অবস্থা হয়। পায়ের শিরায় ব্যথা থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে তিনিও পঙ্গু হয়ে যান। এখন তাঁর দুটি পা কাঁপে সারাক্ষণ, সোজা হতে পারেন না। ছোট মেয়ে আলেয়া খাতুন পঙ্গু হয়েছেন চার বছর হলো। তাঁর বয়স এখন ১৯। তিনিও পঙ্গু অবস্থায় বাড়ির বারান্দায় পড়ে আছেন। গত ৫ এপ্রিল তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পশ্চিম পাশের একটি ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন আলেয়া খাতুন। উত্তর পাশের ঘরের বারান্দায় পড়ে আছেন সাইফুল ইসলাম। আর ঘরের সঙ্গে বাঁধা চালার নিচে শুয়ে আছেন তাজুল ইসলাম। তাঁদের এ অবস্থা কীভাবে হলো জানতে চাওয়ামাত্র সবার চোখে পানি। তাঁদের প্রশ্ন: আমরা কি আর ভালো হতে পারব না? তাঁরা জানান, সাধারণ আর দশজন মানুষের মতোই সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের জীবনে ১৫ বছর বয়সটা অভিশাপ হয়ে আসে, একে একে তিনজনই পঙ্গু হয়ে যান। বাড়ির ভেতর দিয়ে কাউকে হাঁটাচলা করতে দেখলে তাঁদের কষ্ট হয়। সবাই হাঁটতে পারছে, অথচ তাঁরা পারছেন না। তাজুল ইসলাম দুঃখ করে বলেন, তাঁদের টাকা নেই, তাই চিকিৎসা হচ্ছে না।
প্রতিবেশী মোস্তফা কামাল এ সময় এসে দাঁড়ান। বলেন, তাঁদের করুণ অবস্থা দেখলে চোখে পানি এসে যায়। চাচাতো বোন মরিয়ম খাতুন জানান, ছোটবেলায় আলেয়ার সঙ্গে খেলাধুলা করেছেন। এখন এ অবস্থা দেখে তাঁর খুবই কষ্ট হয়।
রিজিয়া পারভিনের আরও দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে আছে। মেয়ে দুজনের বিয়ে দিয়েছেন। আর ছোট ছেলে খুলনায় তার মামার দোকানে কাজ করে। তারা তিনজন ভালো আছে। পঙ্গু তিন সন্তান নিয়ে রিজিয়া পারভিন অমানবিক জীবন যাপন করছেন। তাঁদের বাবা আলাউদ্দিন যা আয় করেন, তা দিয়ে ঠিকমতো সংসারই চলে না। মাঝেমধ্যে মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়েও চলতে হয় তাঁদের। এ অবস্থায় সন্তানদের আর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেন না। পঙ্গু সন্তানদের হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িভাড়া জোগাড় করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবদুল আজিজের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি বলেন, ওই তিন ভাইবোন স্নায়ুরোগে আক্রান্ত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়। তবে স্নায়ুরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখালে বলা যাবে আসল সমস্যা কী। ঝিনাইদহে নিউরো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই, তাই অন্য কোথাও নিয়ে দেখালে ভালো হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। কিন্তু কে দেবে টাকা? কে তাঁদের নিয়ে যাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে?
উত্তর মেলে না।
আজাদ রহমান
No comments