জলবায়ু পরিবর্তন-কার্বন নিঃসরণের রেকর্ড: মানবতার জন্য অশনিসংকেত by পিটার কাস্টার্স
এবার কোনো জলবায়ু-বিজ্ঞানী অথবা পরিবেশকর্মী বাজাননি অশনিসংকেত। আর কেউ নয়, এবার তা বাজিয়েছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ)। ১৯৭০ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল সংস্থাটি, পশ্চিমা তেলভোক্তা দেশগুলোর স্বার্থে। গত ৩০ মে আইইএ প্রকাশিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পশ্চিমা বিশ্বকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে ২০১০ সালে। অর্থনৈতিক মন্দার পর ২০০৯ সালে যদিও নিঃসরণ স্তর সাময়িকভাবে কিছুটা কমে এসেছিল, তবে ২০১০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০.৬ গিগা টন। বিশেষজ্ঞ নন এমন কারও কাছে এই সংখ্যার মানে তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার না-ও হতে পারে। তবে এই বিমূর্ত সংখ্যা যথাযথভাবেই ইঙ্গিত দেয় যে কার্বন নিঃসরণের সূচকগত বৃদ্ধি বন্ধ হয়নি, যদিও সেটাই ছিল ১৯৯০-এর দশকে যৌথ আন্তর্জাতিক উদ্যোগের লক্ষ্য। এক দশক আগে, ২০০০ সালে নিঃসরণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩ গিগা টন। অর্থাৎ শুধু গত ১০ বছরেই বার্ষিক নিঃসরণ স্তর বেড়েছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। কতটা বিচলিত হওয়ার বিষয়! তাই, আইইএর প্রধান অর্থনীতিবিদ ফাতিহ বিরল সতর্কসংকেত বাজিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের সর্বশেষ হিসাব নিদ্রাভঙ্গের আরেক দফা ডাক। ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০২০ সালের আগে নিঃসরণের যে স্তরে পৌঁছানো উচিত নয়, তার ভয়ানক কাছাকাছি আমরা চলে এসেছি।’
জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে মানুষের প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে আইইএর এই বক্তব্যের তাৎপর্য আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? শুরুতে একটু নজর দেওয়া যাক, কোন অবস্থান থেকে আইইএ এই সতর্কসংকেতটা দিল। প্রখ্যাত জলবায়ু-বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে মানুষের কী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত তা নিয়ে তর্কে লিপ্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় এড়াতে হলে বায়ুমণ্ডলে সর্বোচ্চ কী মাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস মেনে নেওয়া যায়? বিজ্ঞানীদের একাংশ জোরের সঙ্গে বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা উচিত প্রতি মিলিয়নে ৩৫০ অংশ; অর্থাৎ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বায়ুর ১০ লাখ অণুর মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস অণুর উপস্থিতি ৩৫০ অণুর বেশি হওয়া উচিত নয়। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন সম্মেলনের সময় অধিকাংশ দেশে ক্রমশ মতৈক্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে জলবায়ু-বিজ্ঞানীদের সতর্কমূলক কথা মন থেকে গ্রহণ করা উচিত। আর ১ দশমিক ৫ সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখাকে লক্ষ্যমাত্রা ধরা উচিত। এ কারণে কোনো সমালোচক যখন আইইএর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পড়বেন, তখন তাঁর প্রতিক্রিয়া কিংবা জবাব হবে, সতর্কসংকেতটি যতটা উচ্চকিত স্বরে দেওয়া উচিত, ততটা উচ্চকিত হয়নি। কারণ, সংস্থাটি এখনো এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে যাচ্ছে যে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা রক্ষা করা সম্ভব। অথচ হুঁশিয়ারিমূলক জলবায়ু-বিজ্ঞান ভিন্ন পাঠ দেয়।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান জলবায়ু প্রত্নতাত্ত্বিক জেমস হানসেন যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছেন, তা হয়তো এখানে উল্লেখ করা অসমীচীন হবে না। সভ্যতা সৃষ্টির আগে কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর জলবায়ু যে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, সেই বৈজ্ঞানিক ও প্রচারধর্মী কাজের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী তিনি। ৩০ লাখ বছর আগে কী অবস্থা বিরাজ করছিল, সে ব্যাপারে তিনি উপাত্ত হাজির করেছেন। সেই সময় পৃথিবী আজকের থেকে ২ অথবা ৩ ডিগ্রি উষ্ণতর ছিল। এই গ্রহ এখন একেবারেই অন্য রকম—সমুদ্রের পানির স্তর আজকের থেকে সামান্য উঁচুই ছিল না, ছিল প্রায় ২৫ মিটার উঁচু! সভ্যতার কালে সমুদ্রের পানির নিম্নস্তর বহু উপকূলীয় এলাকায়, যা একসময় পানিতে নিমজ্জিত অথবা বরফে ঢাকা ছিল, সেখানে মানববসতি স্থাপনের সুযোগ তৈরি হয়। পার্থক্যটা ব্যাখ্যা করতে হবে মূলত আজকের দিনের (অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের মতো জায়গায়) বিশাল বরফখণ্ডের উপস্থিতির মাধ্যমে। হানসেন আরও বলেছেন, অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের বরফখণ্ড গলতে হাজার বছর লাগবে না। আগে অবশ্য তেমনটাই মনে করা হতো। বিপৎসীমায় পৌঁছে গেলে দ্রুত বরফ গলে যাবে। সুতরাং এই মার্কিন বিজ্ঞানীর মত হলো, ‘২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অথবা এমনকি ১.৭ ডিগ্রি উষ্ণায়ন হলো দুর্যোগ পরিস্থিতি।’ স্পষ্টত, ২০১০ সালের কার্বন নিঃসরণের বিষয়ে আইইএ উপাত্ত হাতে থাকায় জেমস হানসেনের কথা এখন আর কোনো দুর্বল সতর্কধ্বনি নয়, মনে হবে মানুষের বিবেকের কাছে তীক্ষ চিৎকার।
আইইএর এসব তথ্য প্রকাশ করা থেকে নীতিগত কী সিদ্ধান্ত টানা উচিত? নিঃসরণের সূচক বৃদ্ধি থামাতে এখন পর্যন্ত নীতিনির্ধারকেরা যে দুটি পথ মাড়িয়েছেন, সেগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। পথ দুটি ‘প্রযুক্তিগত’ ও ‘বাজারভিত্তিক’ সমাধানের। চমকে যাওয়ার মতো ঘটনা হলো, আইইএর প্রধান অর্থনীতিবিদ ফাতিহ বিরল এখনো প্রযুক্তিগত সমাধানের পূতপবিত্র বিশ্বাসের কথাই বলে চলেছেন। তাই কার্বন নিঃসরণের উপাত্ত প্রকাশের সময় তিনি বলেছেন সব প্রযুক্তিগত সমাধানের কথা, পারমাণবিক জ্বালানির ওপর নির্ভরতা অব্যাহত রাখার কথা। তাঁর এই অবস্থান বিস্ময়কর। কেননা, পুঁজিঘন পারমাণবিক উৎপাদন বিস্তৃতির ক্ষেত্রে অনেক সময় লাগে। তাই কার্বন নিঃসরণের সূচকগত বৃদ্ধির ফলে শিগগিরই কোনো বিপর্যয়ে রূপ নেওয়া ঠেকাতে তা অতি সামান্যই কাজে আসে। তারও চেয়ে খারাপ খবর হলো: পারমাণবিক উৎপাদন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভরতার ফলে এমন ধরনের বর্জ্য তৈরি হয়, যা থেকে কোনো নিস্তার নেই; অর্থাৎ মানবজাতির জন্য তা এক কানাগলি হিসেবে হাজির হয়। দুই ধরনের বর্জ্যের মধ্যকার বিশাল পার্থক্যকে অস্বীকার করে এ কথা বলছি না। গ্রিনহাউস গ্যাস (যেমন কার্বন ডাই-অক্সাইড) প্রকৃতিতে বিরাজমান। কিন্তু তা বিপজ্জনক বর্জ্যে রূপান্তরিত হয়েছে কেবল শিল্পব্যবস্থার ভেতর দিয়ে, যে ব্যবস্থা কয়লা, তেল ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। অন্যদিকে পারমাণবিক বর্জ্যের বেশ কিছু বিকিরক উপাদান প্রকৃতিতে বিরাজ করে না। বরং পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের উপজাত হিসেবে তৈরি হয়। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং পারমাণবিক উৎপাদন শৃঙ্খল উভয়ই মানবজাতির ওপর এমন পরিণতির আশঙ্কা চাপিয়ে দেয়, যা থেকে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার পথ থাকে না। পারমাণবিক বর্জ্যের ক্ষেত্রে—থোরিয়াম-২৩০, প্লোটোনিয়াম-২৪২ ও জোডিয়াম-১২৯-এর বিকিরণের অর্ধেক-জীবনের স্থায়িত্বকাল যথাক্রমে ৭৬ হাজার, তিন লাখ ৮০ হাজার ও দেড় কোটি বছরের অধিককাল!
সুতরাং পারমাণবিক উৎপাদনের বিস্তৃতির মাধ্যমে প্রযুক্তিগত সমাধান প্রশ্নসাপেক্ষ। এবার তাহলে দৃষ্টি ফেরানো যাক জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার ‘বাজারভিত্তিক’ সমাধানে। এ বিষয়ে বিতর্কে আগাম সিদ্ধান্ত টানতে হয়তো আরও কিছুকাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবু জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাজারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে ২০১০ সালে কার্বন নিঃসরণসংক্রান্ত আইইএর ঘোষণা। কিয়েটো চুক্তিতে (১৯৯৭) নীতিনির্ধারকেরা ১৯৯০-এর দশকে কার্বনের বৈশ্বিক নিঃসরণ কমানোর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। সূচকগত বৃদ্ধি থামাতে বাধ্যতামূলক নিঃসরণ হ্রাসে সম্মত হয়েছিলেন। তথাপি বাস্তবিক যেসব পদক্ষেপের প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেগুলো ছিল মূলত বাজারভিত্তিক। তাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড বর্জ্যকে বিনিময়যোগ্য পণ্য করে তোলা হয়। আবার কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা রাখার দায়িত্ব অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে হস্তান্তরের ব্যবস্থাও করা হয়। আইইএর এ ঘোষণা থেকে ঐতিহাসিক শিক্ষা নেওয়ার আছে হয়তো এতটুকুই যে বাজারভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় শেষ। ব্যর্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মানবজাতির পক্ষে আর নেওয়া সম্ভব নয়। কাণ্ডজ্ঞান বলে যে জলবায়ুর বিপর্যয় এড়াতে হলে আমাদের দ্রুত ভিন্ন ধরনের, আরও ‘চরম’ পথে যেতে হবে। জেমস হানসেনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আর আইইএর ঐতিহাসিক (ত্রুটিপূর্ণ হলেও) ঘোষণা দ্বারা তাড়িত হয়ে আমি বলতে চাই, জলবায়ুর বিপর্যয় এড়াতে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর দেওয়া জরুরি। জ্বালানির অধিকারের বৈশ্বিক রেশনিং আরোপে সহায়তা করতে পশ্চিমা বিশ্ব সম্মত হওয়ার প্রস্তাব দিক না কেন? পশ্চিমের কাছে দাবি তুলুন না কেন তারা যেন বিশ্বব্যাপী এমন এক জ্বালানি রেশনিং-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রাজি হয়, যা একই সঙ্গে বিশ্বের দরিদ্র এবং নাজুক দেশগুলোর প্রতিও ন্যায্য হবে এবং বৈশ্বিক নিঃসরণের ওপর স্থায়ী ও কড়া সীমারেখা টেনে দেবে? এ বছর জলবায়ু পরিবর্তনের সতর্কসংকেত বাজছে। যাদের কান খাড়া, তারা নিশ্চয় শুনতে পাচ্ছে, এটা বিপদের চিৎকার।
লেইডেন, নেদারল্যান্ড
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে মানুষের প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে আইইএর এই বক্তব্যের তাৎপর্য আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? শুরুতে একটু নজর দেওয়া যাক, কোন অবস্থান থেকে আইইএ এই সতর্কসংকেতটা দিল। প্রখ্যাত জলবায়ু-বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে মানুষের কী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত তা নিয়ে তর্কে লিপ্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় এড়াতে হলে বায়ুমণ্ডলে সর্বোচ্চ কী মাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস মেনে নেওয়া যায়? বিজ্ঞানীদের একাংশ জোরের সঙ্গে বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা উচিত প্রতি মিলিয়নে ৩৫০ অংশ; অর্থাৎ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বায়ুর ১০ লাখ অণুর মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস অণুর উপস্থিতি ৩৫০ অণুর বেশি হওয়া উচিত নয়। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন সম্মেলনের সময় অধিকাংশ দেশে ক্রমশ মতৈক্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে জলবায়ু-বিজ্ঞানীদের সতর্কমূলক কথা মন থেকে গ্রহণ করা উচিত। আর ১ দশমিক ৫ সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখাকে লক্ষ্যমাত্রা ধরা উচিত। এ কারণে কোনো সমালোচক যখন আইইএর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পড়বেন, তখন তাঁর প্রতিক্রিয়া কিংবা জবাব হবে, সতর্কসংকেতটি যতটা উচ্চকিত স্বরে দেওয়া উচিত, ততটা উচ্চকিত হয়নি। কারণ, সংস্থাটি এখনো এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে যাচ্ছে যে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্যমাত্রা রক্ষা করা সম্ভব। অথচ হুঁশিয়ারিমূলক জলবায়ু-বিজ্ঞান ভিন্ন পাঠ দেয়।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান জলবায়ু প্রত্নতাত্ত্বিক জেমস হানসেন যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছেন, তা হয়তো এখানে উল্লেখ করা অসমীচীন হবে না। সভ্যতা সৃষ্টির আগে কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর জলবায়ু যে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, সেই বৈজ্ঞানিক ও প্রচারধর্মী কাজের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী তিনি। ৩০ লাখ বছর আগে কী অবস্থা বিরাজ করছিল, সে ব্যাপারে তিনি উপাত্ত হাজির করেছেন। সেই সময় পৃথিবী আজকের থেকে ২ অথবা ৩ ডিগ্রি উষ্ণতর ছিল। এই গ্রহ এখন একেবারেই অন্য রকম—সমুদ্রের পানির স্তর আজকের থেকে সামান্য উঁচুই ছিল না, ছিল প্রায় ২৫ মিটার উঁচু! সভ্যতার কালে সমুদ্রের পানির নিম্নস্তর বহু উপকূলীয় এলাকায়, যা একসময় পানিতে নিমজ্জিত অথবা বরফে ঢাকা ছিল, সেখানে মানববসতি স্থাপনের সুযোগ তৈরি হয়। পার্থক্যটা ব্যাখ্যা করতে হবে মূলত আজকের দিনের (অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের মতো জায়গায়) বিশাল বরফখণ্ডের উপস্থিতির মাধ্যমে। হানসেন আরও বলেছেন, অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের বরফখণ্ড গলতে হাজার বছর লাগবে না। আগে অবশ্য তেমনটাই মনে করা হতো। বিপৎসীমায় পৌঁছে গেলে দ্রুত বরফ গলে যাবে। সুতরাং এই মার্কিন বিজ্ঞানীর মত হলো, ‘২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অথবা এমনকি ১.৭ ডিগ্রি উষ্ণায়ন হলো দুর্যোগ পরিস্থিতি।’ স্পষ্টত, ২০১০ সালের কার্বন নিঃসরণের বিষয়ে আইইএ উপাত্ত হাতে থাকায় জেমস হানসেনের কথা এখন আর কোনো দুর্বল সতর্কধ্বনি নয়, মনে হবে মানুষের বিবেকের কাছে তীক্ষ চিৎকার।
আইইএর এসব তথ্য প্রকাশ করা থেকে নীতিগত কী সিদ্ধান্ত টানা উচিত? নিঃসরণের সূচক বৃদ্ধি থামাতে এখন পর্যন্ত নীতিনির্ধারকেরা যে দুটি পথ মাড়িয়েছেন, সেগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। পথ দুটি ‘প্রযুক্তিগত’ ও ‘বাজারভিত্তিক’ সমাধানের। চমকে যাওয়ার মতো ঘটনা হলো, আইইএর প্রধান অর্থনীতিবিদ ফাতিহ বিরল এখনো প্রযুক্তিগত সমাধানের পূতপবিত্র বিশ্বাসের কথাই বলে চলেছেন। তাই কার্বন নিঃসরণের উপাত্ত প্রকাশের সময় তিনি বলেছেন সব প্রযুক্তিগত সমাধানের কথা, পারমাণবিক জ্বালানির ওপর নির্ভরতা অব্যাহত রাখার কথা। তাঁর এই অবস্থান বিস্ময়কর। কেননা, পুঁজিঘন পারমাণবিক উৎপাদন বিস্তৃতির ক্ষেত্রে অনেক সময় লাগে। তাই কার্বন নিঃসরণের সূচকগত বৃদ্ধির ফলে শিগগিরই কোনো বিপর্যয়ে রূপ নেওয়া ঠেকাতে তা অতি সামান্যই কাজে আসে। তারও চেয়ে খারাপ খবর হলো: পারমাণবিক উৎপাদন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভরতার ফলে এমন ধরনের বর্জ্য তৈরি হয়, যা থেকে কোনো নিস্তার নেই; অর্থাৎ মানবজাতির জন্য তা এক কানাগলি হিসেবে হাজির হয়। দুই ধরনের বর্জ্যের মধ্যকার বিশাল পার্থক্যকে অস্বীকার করে এ কথা বলছি না। গ্রিনহাউস গ্যাস (যেমন কার্বন ডাই-অক্সাইড) প্রকৃতিতে বিরাজমান। কিন্তু তা বিপজ্জনক বর্জ্যে রূপান্তরিত হয়েছে কেবল শিল্পব্যবস্থার ভেতর দিয়ে, যে ব্যবস্থা কয়লা, তেল ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। অন্যদিকে পারমাণবিক বর্জ্যের বেশ কিছু বিকিরক উপাদান প্রকৃতিতে বিরাজ করে না। বরং পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের উপজাত হিসেবে তৈরি হয়। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং পারমাণবিক উৎপাদন শৃঙ্খল উভয়ই মানবজাতির ওপর এমন পরিণতির আশঙ্কা চাপিয়ে দেয়, যা থেকে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার পথ থাকে না। পারমাণবিক বর্জ্যের ক্ষেত্রে—থোরিয়াম-২৩০, প্লোটোনিয়াম-২৪২ ও জোডিয়াম-১২৯-এর বিকিরণের অর্ধেক-জীবনের স্থায়িত্বকাল যথাক্রমে ৭৬ হাজার, তিন লাখ ৮০ হাজার ও দেড় কোটি বছরের অধিককাল!
সুতরাং পারমাণবিক উৎপাদনের বিস্তৃতির মাধ্যমে প্রযুক্তিগত সমাধান প্রশ্নসাপেক্ষ। এবার তাহলে দৃষ্টি ফেরানো যাক জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার ‘বাজারভিত্তিক’ সমাধানে। এ বিষয়ে বিতর্কে আগাম সিদ্ধান্ত টানতে হয়তো আরও কিছুকাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবু জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাজারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে ২০১০ সালে কার্বন নিঃসরণসংক্রান্ত আইইএর ঘোষণা। কিয়েটো চুক্তিতে (১৯৯৭) নীতিনির্ধারকেরা ১৯৯০-এর দশকে কার্বনের বৈশ্বিক নিঃসরণ কমানোর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। সূচকগত বৃদ্ধি থামাতে বাধ্যতামূলক নিঃসরণ হ্রাসে সম্মত হয়েছিলেন। তথাপি বাস্তবিক যেসব পদক্ষেপের প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেগুলো ছিল মূলত বাজারভিত্তিক। তাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড বর্জ্যকে বিনিময়যোগ্য পণ্য করে তোলা হয়। আবার কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা রাখার দায়িত্ব অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে হস্তান্তরের ব্যবস্থাও করা হয়। আইইএর এ ঘোষণা থেকে ঐতিহাসিক শিক্ষা নেওয়ার আছে হয়তো এতটুকুই যে বাজারভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় শেষ। ব্যর্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মানবজাতির পক্ষে আর নেওয়া সম্ভব নয়। কাণ্ডজ্ঞান বলে যে জলবায়ুর বিপর্যয় এড়াতে হলে আমাদের দ্রুত ভিন্ন ধরনের, আরও ‘চরম’ পথে যেতে হবে। জেমস হানসেনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আর আইইএর ঐতিহাসিক (ত্রুটিপূর্ণ হলেও) ঘোষণা দ্বারা তাড়িত হয়ে আমি বলতে চাই, জলবায়ুর বিপর্যয় এড়াতে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর দেওয়া জরুরি। জ্বালানির অধিকারের বৈশ্বিক রেশনিং আরোপে সহায়তা করতে পশ্চিমা বিশ্ব সম্মত হওয়ার প্রস্তাব দিক না কেন? পশ্চিমের কাছে দাবি তুলুন না কেন তারা যেন বিশ্বব্যাপী এমন এক জ্বালানি রেশনিং-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রাজি হয়, যা একই সঙ্গে বিশ্বের দরিদ্র এবং নাজুক দেশগুলোর প্রতিও ন্যায্য হবে এবং বৈশ্বিক নিঃসরণের ওপর স্থায়ী ও কড়া সীমারেখা টেনে দেবে? এ বছর জলবায়ু পরিবর্তনের সতর্কসংকেত বাজছে। যাদের কান খাড়া, তারা নিশ্চয় শুনতে পাচ্ছে, এটা বিপদের চিৎকার।
লেইডেন, নেদারল্যান্ড
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
No comments