মাদক কেনাবেচায় রাখঢাক নেই
টিটিপাড়ার
রেললাইন-সংলগ্ন ‘মেথরপট্টি’র বাইরে মুগদা থানা-পুলিশের টহল গাড়ি দাঁড়িয়ে।
ভেতরে ঢুকতেই একজন বেরিয়ে এসে অমায়িক ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, কোনটা দরকার?
কথায় কথায় জানা গেল, চোলাই মদ থেকে শুরু করে গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা— কোনো
কিছুই সেখানে দুর্লভ নয়। দরকার কেবল ক্রেতার চাহিদা জানা। গত মঙ্গলবার
সন্ধ্যার চিত্র এটি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায়
রেললাইন-সংলগ্ন বস্তি, ছাপরাঘর, ছোটখাটো দোকানগুলো মাদক কেনাবেচার অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় রেলওয়েকেন্দ্রিক মাদক
কেনাবেচার প্রধান কেন্দ্র হলো টিটিপাড়া, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ও তেজগাঁও
রেলওয়ে স্টেশন। এর মধ্যে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ও তেজগাঁওয়ে মাদক কেনাবেচা
বন্ধ করতে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়েছিল। সে
অভিযান কাজে এসেছে। কিন্তু টিটিপাড়া এলাকা এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের
বাইরে। সেখানে মাদক কেনাবেচা হচ্ছে প্রকাশ্যে। ২ জানুয়ারি টিটিপাড়া
মেথরপট্টিতে গিয়ে মাদক ব্যবসায়ী-মাদকসেবীদের সঙ্গে পুলিশের সহাবস্থান দেখা
গেল। সেখানে ছোট ছোট চা-সিগারেটের দোকানে কেউ কেউ আড্ডা দিচ্ছেন। কোনো কোনো
ঘর থেকে গন্ধ ভেসে আসছে। এক যুবক জানালেন, এসব ইয়াবার গন্ধ। সন্ধ্যার পর
টি-শার্ট ও জিনস পরা এক তরুণকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। একই সময় দুই
ব্যক্তিকে ভেতরে ঢুকতেও দেখা যায়। চান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে
জানা গেল, ভেতরে হাত বাড়ালেই মাদক। বাইরে ইউনিফর্ম পরে টহল গাড়িতে ঘুরছেন
পুলিশ সদস্যরা, মাঝে মাঝে তাঁদের গাড়ির গতি কমে আসছে। কখনো কখনো কোনো কোনো
সদস্য গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছেন। মেথরপট্টিতে ঢোকার মুখে কোনো কিছু দরকার কি
না জানতে চেয়েছিলেন যে ব্যক্তি, ওখানে থাকতে থাকতেই তেমনই আরও এক ব্যক্তির
সঙ্গে কথা হয়। তিনি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ
করেন। ওই ব্যক্তি এলাকার একজন খুচরা মাদক বিক্রেতা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন,
তিনি মূলত গাঁজা বিক্রি করেন, টুকটাক ‘অন্য কিছু’ও বিক্রি করেন। ওই
বিক্রেতা বলেন, তাঁর নাম জেনে কাজ নেই। স্পটে এলেই জিনিস পাওয়া যাবে। যে
স্পটে দাঁড়িয়ে তিনি কাজ করছেন, পরদিন তাঁকে আর সেখানে পাওয়া যাবে না। ওই
জায়গায় মাদক বিক্রি করবেন অন্য কেউ।
পরদিন তিনি কোথায় দাঁড়াবেন তা তিনি
জানেন না, সেটা ঠিক করে দেবে অন্য কেউ। কে ঠিক করে দেবে এমন প্রশ্নে তিনি
‘নাসিরের আড্ডা’ সম্পর্কে খোঁজখবর করার পরামর্শ দেন। নাসির কে, নাসিরকে
চেনেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাব টিটিপাড়ার লোকজন দিতে চাননি। তবে স্থানীয়
দুজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি
বলেন, নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে টিটিপাড়া মাদকের জন্য বিখ্যাত। একসময়
এলাকাটি ‘আসিফ’ নামে এক সন্ত্রাসীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। আসিফ প্রতিপক্ষের হাতে
নিহত হওয়ার পর নাসির ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন। তবে নাসির এখন দেশে নেই।
তিনি ইতালিতে থেকেই তাঁর ‘ছেলে’দের দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর এনএস
সিএনজি স্টেশন নামের একটি ফিলিং স্টেশন আছে, রেলের কনটেইনার স্থানান্তরের
জন্য ‘মুভার’ আছে। এসব বৈধ ব্যবসার আড়ালে এলাকায় অবৈধ ব্যবসা চালান তিনি।
ওই এলাকায় বাড়ি করলে বা বাড়ি ভাঙলে নাসিরের নামে চাঁদা দিতে হয়, গরুর হাট
যার নামেই ইজারা হোক চাঁদা দিতে হয় নাসিরকে। এলাকার লোকজনের অভিযোগ, যাঁরা
এই চাঁদা তোলেন, তাঁরাই মাদক কেনাবেচা করেন। এদের সংখ্যা শতাধিক বলে
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের একজন স্থানীয় নেতা নাম
প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধরুন আওয়ামী লীগ ও তার
অঙ্গসংগঠনের সভা-সমিতি, মিছিলে যাঁরা অংশ নেন, তাঁরা দলের কমান্ডের চেয়েও
নাসিরের কমান্ড মানতে বেশি উৎসাহী।’ তিনি আরও বলেন, এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে
যে তিনি নিজে মাদকের বিক্রি বন্ধে দলের লোকজনের নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ
করেছেন। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরেনি। জানতে চাইলে মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, টিটিপাড়ার মেথরপট্টি তাঁর
এলাকায় পড়ে না। ওটি শাহজাহানপুর থানার মধ্যে পড়ে। তা হলে ২ জানুয়ারি ওই
এলাকায় কেন মুগদা থানার টহল ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর গাড়ি যাওয়ার
কথা নয়। কে বা কারা কেন গেছে, তিনি জানেন না। শাহজাহানপুর থানার ওসি শফিকুর
ইসলামের দাবি, তিনি মাদকের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্ট’। তাঁর প্রত্যয়
এলাকাকে মাদকমুক্ত করবেন। পুলিশ সূত্র বলছে, টিটিপাড়ায় একাধিক থানার এলাকা
পড়েছে। এর একটি অংশ মুগদা থানায় পড়েছে, একটি অংশ শাহজাহানপুরে, রেলপথ
রেলওয়ে থানার মধ্যেও কিছু এলাকা আছে। কেউই মাদক বিক্রির দায় নিতে চায় না।
তেজগাঁওয়ে মাদক কেনাবেচা বন্ধে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর
নিবিড়ভাবে কাজ করছে, এমন দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো। তবে ২
জানুয়ারি তেজগাঁওয়ের রেলপথ ধরে মিনিট কুড়ি হেঁটে যেতে চারটি মাদকের আড্ডা
চোখে পড়ে। এর মধ্যে রেলপথের দুধারে কমপক্ষে দুটি কক্ষে আয়োজন করে ইয়াবার
আসর বসাতে দেখা যায়। রেলপথের ওপর জটলা করে বিক্রি হতেও দেখা যায় মাদক।
তেজগাঁও রেলক্রসিংয়ের মুখে এক চা দোকানির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ইয়াবা
এখনো বিক্রি হচ্ছে। তবে পরিমাণে কিছুটা কম। কটি ঘরে ইয়াবা পাওয়া যায়, এমন
প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। ইয়াবা নিয়ে কাউকে কোনো প্রশ্ন করতেই কেউ না কেউ
সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন এবং কথোপকথন শুনেছেন। তাঁদের দেখে পিছিয়ে গেছেন
সাক্ষাৎকারদাতারা। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘিরে মাদক কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণের
চেষ্টা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ
না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিজে যেদিন পরিদর্শনে গেছেন, সেদিন
একটি মাইক্রোবাস থেকে এক ব্যক্তিকে নেমে ভ্যানচালকের কাছ থেকে প্যাকেট নিতে
দেখেছেন। কমলাপুর স্টেশনের ডোম ঘর থেকে মাদক কেনাবেচা হয় বলে জানান তিনি।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে অবশ্য ডোমঘরটি তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।
রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন ফকির প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ডোম
ঘর তালা মেরে দিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি শৌচাগার ছিল।
সন্ধ্যার সময় নেশাখোরদের আনাগোনার অভিযোগ পাওয়ার পর সেটিও বন্ধ করে
দিয়েছেন। সব মিলিয়ে টিটিপাড়া, তেজগাঁও ও কমলাপুর এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণির
মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এসব এলাকায় মাদক বিক্রি হয় প্রকাশ্যে। এতে
কোনো রাখঢাক নেই। এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণের অধিদপ্তরের
লোকজনের যোগসাজশেই মাদক ব্যবসা চলেছে। এ ক্ষেত্রে রেলওয়ে পুলিশ ও
নিরাপত্তার সদস্যদেরও একটি অংশ জড়িত। ফলে বিভিন্ন সময় লেখালেখি হলেও কাজের
কাজ কিছুই হয় না। মাদকের ব্যবসা চলে অবাধে।
No comments