ঐতিহ্যের মনিপুরী তাঁত
বর্তমানে
সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় মনিপুরী জনগোষ্ঠীর বসবাস
রয়েছে। এখন দেশে যে ক’টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম মনিপুরী
সম্প্রদায়। তাদের ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য ও সমৃদ্ধসংস্কৃতি এ দেশে যোগ
করেছে ভিন্ন মাত্রা। মনিপুরীরা বুননশিল্পে খুব দক্ষ। নিজেদের কাপড় তারা
নিজেরাই বুনে। প্রবাদ আছে- মনিপুরী মেয়েরা জন্মসূত্রেই তাঁতি ও প্রায় ৯০
শতাংশ নারী তাঁতের সাথে যুক্ত। মনিপুরীদের উৎপাদিত তাঁতপণ্যের মধ্যে রয়েছে-
ফানেক (মনিপুরীদের বিশেষ এক ধরনের পোশাক) শাড়ি, শাল, ওড়না, থ্রি-পিস,
গামছা, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, বিছানার চাদর ইত্যাদি। মনিপুরী ভাষায় তাঁতকে বলে
‘ইয়োং’। ইয়োং আবার দু’ধরনের। মোয়াং ও পাং। মোয়াং তাঁতে সাধারণত মোটা সুতার
কাপড় তৈরি করা হয়। আর পাং তাঁতে সাধারণত চিকন সুতার কাপড় তৈরি হয়। একসময়
নিজেদের প্রয়োজনে মনিপুরীরা তাঁতের কাপড় বুনলেও ধীরে ধীরে এটি বাণিজ্যিক
রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে মনিপুরী শাড়ির বাজার বেড়েছে। কারণ, ঐতিহ্য ও
আধুনিকতার মেলবন্ধনে মনিপুরী শাড়ি এখন যেকোনো সম্প্রদায়ের ফ্যাশনসচেতন
নারীর কাছে পছন্দনীয়। মনিপুরী শাড়ির রঙ ও নকশা দেখলেই বোঝা যাবে, এটি
মনিপুরী শাড়ি। কারণ, মনিপুরী শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হলোÑ এর নকশায় মাইরাংগ
(টেম্পল) বা মন্দিরের প্রতিকৃতি থাকবে। তাই প্রায় প্রতিটি শাড়ির আঁচল, জমিন
ও পাড়ের নকশায় দেখা যায় এই প্রতিকৃতি। মনিপুরী শাড়ি তৈরি হয় বরাবরই
উজ্জ্বল রঙের সুতায়। বর্তমানে আঁচল, জমিন ও পাড়ে মন্দির প্রতিকৃতির
পাশাপাশি আঁচল ও জমিনে বিভিন্ন নকশা থাকে। এ ছাড়াও শাড়ির রঙ, নকশায়ও ধীরে
ধীরে পরিবর্তন আসছে। অনেক তাঁতিই শাড়ির রঙ, বুননে, নকশায় বৈচিত্র্য আনার
চেষ্টা করছেন। চলেছে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রাজশাহীর সিল্ক সুতায়ও
মনিপুরী শাড়ি বুনা হচ্ছে। সিল্ক সুতার তৈরি মনিপুরী শাড়ি দেখতে যেমন
সুন্দর, তেমনি মসৃণ ও হালকা। সিল্ক সুতার মনিপুরী শাড়ি বাজারে জনপ্রিয়তাও
পেয়েছে বেশ। মনিপুরীদের শাড়ি বুননের প্রক্রিয়াও অনেকটা আমাদের জামদানি বা
দেশী তাঁতের শাড়ির মতো। একটি তাঁতে দু’জন তাঁতি কাজ করেন দুই দিকে বসে।
প্রথমে সুতা মাড় দিয়ে শুকাতে হয়। তারপর শুকানো সুতা চরকায় পেঁচিয়ে গুঁটিতে
ভরে সেখান থেকে মাকুতে নিয়ে বুনতে হয়। আর সবার আগে শাড়ির টানা বাঁধতে হয়।
তারপর বুনন কাজ চলে। একটি শাড়ি বুনতে চার থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে। তবে
শাড়ির রঙ ও নকশার ওপর নির্ভর করে বোনার সময়। সাধারণত মনিপুরী শাড়ির দাম ৬০০
থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে দাম কমবেশি নির্ভর করে শাড়ির
নকশার ওপর ভিত্তি করে। এই শাড়ি এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন
ফ্যাশন হাউজে মনিপুরী শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন
স্থানে আদিবাসীদের নিজস্ব দোকানে মনিপুরী শাড়ি পাওয়া যায়। সিলেটের বিভিন্ন
স্থানে মনিপুরীদের বসবাস হলেও সবচেয়ে বেশি মনিপুরী বসবাস করে মৌলভীবাজার
জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায়। তাই মনিপুরী তাঁতিতের বেশির ভাগ এই উপজেলার বিভিন্ন
গ্রামে বসবাস করে। আদমপুর, তিলকপুর, মাধবপুর, মঙ্গলপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের
মনিপুরীদের বাড়িতে বাড়িতে গেলেই দেখা যাবে মনিপুরী তাঁতিদের বুনন ব্যস্ততা।
ঘুরে দেখে আসা যায় মনিপুরীপাড়ায়। তাদের বুননশৈলী, তাদের জীবন ধারা।
মনিপুরী দেশীয় বুননশিল্পের অন্যতম একটি মাধ্যম। মনিপুরী শাড়ি এখন দেশীয়
শাড়ির একটি হিসেবে পরিচিত। মনিপুরী তাঁতশিল্প পুরোটাই চলছে মনিপুরীদের
লোকজ্ঞানে। এই শিল্পের আরো উন্নয়নে জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা,
প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ। তাহলেই সম্ভাবনাময় এই শিল্প পৃথিবীর
বুকে সগৌরবে তার অস্তিত্ব ধরে রাখবে।
No comments