২০১৮: নির্বাচন নিয়ে আশাবাদ by আসিফ নজরুল
নির্বাচন
নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের তুমুল আগ্রহ ছিল গত বছরে। এর মূল কারণ ছিল
উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে উগ্র জাতীয়তাবাদী, রক্ষণশীল ও সাম্প্রদায়িক
শক্তিগুলোর অভাবিত উত্থান। এই উত্থান এসব দেশের অভিবাসী ও সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়, এদের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবারগুলো এবং এসব দেশে নানা কারণে
গমনেচ্ছু মানুষের জন্য নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করে। ফলে ২০১৬ সালে আমেরিকার
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও যুক্তরাজ্যের ‘ব্রেক্সিট’ নির্বাচন নিয়ে সারা
বিশ্বে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়, আলোচনায় আসে অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস,
ফ্রান্স, জার্মানি বা নিউজিল্যান্ডের নির্বাচনও। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে
দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, জাপান, তুরস্কের নির্বাচন এবং ইরাক ও স্পেনে যথাক্রমে
কুর্দি ও কাতালোনিয়ানদের গণভোট মানুষের মনে আগ্রহের সৃষ্টি করে। নির্বাচন
নিয়ে একই রকম আগ্রহ থাকবে ২০১৮ সালেও। এ বছর গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোর
মধ্যে রয়েছে মেক্সিকো, রাশিয়া ও মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, কম্বোডিয়া,
ইতালির সাধারণ নির্বাচন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচন।
এই নির্বাচনগুলোতে দুটো সুস্পষ্ট ধারা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। যেমন রাশিয়া,
কম্বোডিয়া ও মিসরের নির্বাচন যে পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না, তা অনেকটাই
নিশ্চিত করে বলা যায়। অন্যদিকে ইতালিতে যতই নড়বড়ে সরকার গঠিত হোক না কেন
বা আমেরিকায় ট্রাম্পের দলের যত বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকুক না কেন, নির্বাচন
হবে সুষ্ঠু। ২০১৮ সালে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হতে পারে এবং সেটি
বাংলাদেশে। দক্ষিণ এশিয়ায় গত বছর নেপাল ও ভারতের রাজ্যগুলোতে সুষ্ঠু
নির্বাচন হয়েছে। এর আগে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের নির্বাচনও হয়েছে অনেকাংশে
সুষ্ঠুভাবে। বেশি দিন আগের কথা নয়, একসময়ে এই অঞ্চলে ভারতের পাশাপাশি
সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ঐতিহ্য হারিয়েছে
বাংলাদেশ। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১৮ সালে নির্বাচন হলে কোন দিকে যাবে বাংলাদেশ?
২. ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাদে ১৯৯০ সালের পর ২০০৮ পর্যন্ত এ দেশে চারটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনগুলোতে সব বড় দল অংশ নিয়েছে, ব্যাপকসংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে, তিনটি সংসদ তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে এবং পরাজিত দল সংসদে অনিয়মিতভাবে হলেও অংশ নিয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার কারণে এ সময়কালে নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ নির্বাচনের গুণগত দিক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা শুরু করে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রদান, নির্বাচনে কালোটাকার প্রকোপ হ্রাস নিয়ে বিভিন্ন দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। প্রচারণা চলে নির্বাচনে ‘না’ ভোট প্রদান ও ভোটের আনুপাতিক ভিত্তিতে সংসদে আসন নির্ধারণের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কারের দাবি নিয়েও। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এসব দাবি আকাশকুসুম কল্পনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই নির্বাচন শুধু অধিকাংশ দল বর্জন করেনি, ১৫৩টি আসনে ভোটাররা ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত হন। বাদবাকি আসনের নির্বাচনেও ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ভিন্নমত চর্চার ক্ষেত্রেও নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য করাতে ব্যর্থ হয়ে বিরোধী দল সহিংস আন্দোলন শুরু করে ২০১৫ সালে। সরকার তা শক্ত হাতে দমন করার পর একের পর এক নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নিয়ে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কর্তৃত্ব থাকার কারণে আওয়ামী লীগ কি ২০১৪ সালের মতো আগামী সংসদ নির্বাচনও একতরফাভাবে করতে সক্ষম বা আগ্রহী হবে? সম্ভবত না। এর প্রধান কারণ, আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা। ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানোর শক্তি বা পরিবেশ যে নেই, তা দলটির এত দিনে ভালোভাবে উপলব্ধি করার কথা। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমানে নিরাপত্তা ইস্যু সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ানোতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দাতাগোষ্ঠীগুলো আগের মতো চাপ সৃষ্টি করবে না, সেটিও এখন অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বড় ধরনের কোনো নতুন প্রতিকূলতা সৃষ্টি না হলে নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যেও সম্ভবত চেষ্টা থাকবে ২০১৪ সালের চেয়ে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের। সরকার নিশ্চয়ই জানে যে তাদের বর্তমান ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস জনসমর্থন কি না, তা নিয়ে সমাজে প্রশ্ন রয়েছে। যে দলটি এ দেশে স্বাধীনতাসংগ্রাম, গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছে, যে দলটির জন্ম ও বিকাশ পুরোপুরি গণতান্ত্রিকভাবে, তার জন্য এ ধরনের প্রশ্ন সম্মানজনক বা স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা নয়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এ কথা কয়েকবার বলেছেন যে ২০১৪ সালের চেয়ে উন্নততর একটি নির্বাচন তাঁরা অনুষ্ঠিত করতে চান। এটি তাই বিশ্বাস করার কারণ আছে যে আগামী নির্বাচন অন্তত ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের চেয়ে শ্রেয়তর হবে। কিন্তু তা কতটা শ্রেয়, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।
৩. আগামী সাধারণ নির্বাচন সম্ভবত ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হবে। তবে এই নির্বাচন ২০১৯ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে হলেও তা সংবিধানের ব্যত্যয় হবে না। সংবিধানের ৭২ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রথম অধিবেশনের (২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি) পর ৫ বছর অতিবাহিত হলে বর্তমান সংসদ ভেঙে যাবে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারিতে। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) অনুসারে মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে, অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তবে কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি আগেই সংসদ ভেঙে দিলে বা বাংলাদেশ কারও সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে এই সময় যথাক্রমে এগোতে বা পেছাতে পারে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি খুবই কম বলে এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে ২০১৮ সালেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বা অন্তত এর তফসিল ঘোষিত হবে। এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে চারটি। ১. সব দলের, বিশেষ করে বিএনপির অংশগ্রহণ। ২. ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছেন, এমন নিশ্চয়তা। ৩. ভোট ঠিকমতো গণনা ও ঘোষণা করা হচ্ছে, এর নিশ্চয়তা। ৪. সরকারি দল পরাজিত হলে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। আগামী নির্বাচনে সরকার সত্যিই বিএনপির অংশগ্রহণ চায় কি না, তা বিএনপি-প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলোর রায়-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বোঝা যাবে। রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ মামলা দুটোতে তাঁর সাজা হলেও হাইকোর্ট তা স্থগিত করলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ খোলা থাকবে তাঁর জন্য। তবে বিচারিক আদালতে শাস্তি হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে না-সরকার এ ধরনের কোনো নতুন আইন করে বেগম জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা করলে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে বাড়তি জটিলতা তৈরি হবে। সে ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার গত নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর অনেকগুলোকে বিভিন্নভাবে নির্বাচনে নিয়ে আসতে পারে, ৩০০ আসনেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতারও পরিবেশ সৃষ্টির চিন্তা করতে পারে। কিন্তু তারপরও বিপুল জনসমর্থিত দল বিএনপিকে ছাড়া সেই নির্বাচন কখনো দেশে সত্যিকারের নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি করতে পারবে না, সেই নির্বাচন দেশের বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকারের এটি না জানার কথা নয়। নির্বাচনের ২ ও ৩ নম্বর চ্যালেঞ্জ বিষয়ে প্রতিকারমূলক বিভিন্ন পরামর্শ ইতিমধ্যে সমাজে উচ্চারিত হয়েছে। নির্বাচনকালে ভোটকেন্দ্রগুলোতে সেনা মোতায়েন, অন্তত গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকায় রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের নিয়োগ, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, ভোটকেন্দ্র থেকেই প্রাথমিক ফলাফল জানিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। চতুর্থ চ্যালেঞ্জটি নতুন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি না হওয়ার নজির আফ্রিকান দেশগুলোতে রয়েছে, এ দেশেও একই কাণ্ড করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) অনুসারে ২০১৮ সালে নির্বাচন হলে বর্তমান সাংসদেরা ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারির আগে কার্যভার গ্রহণ করতে পারবেন না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে তাই ক্ষমতা হস্তান্তরে জটিলতা সৃষ্টির অপচেষ্টার সুযোগ থাকবে।
৪. এত কিছুর পরও আগামী নির্বাচন নিয়ে কিছু আশাবাদের কারণ রয়েছে। এই নির্বাচন ২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়ে অংশগ্রহণমূলক হবে। এতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা বিতর্কিত রকিব কমিশনের চেয়ে শ্রেয়তর হবে বলেও কিছু আশাবাদ রাজনৈতিক মহলে রয়েছে। সব প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে ৩০০ আসনেই বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে নির্বাচনে কারচুপি করাও কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া নির্বাচনকালে পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক ভূমিকা পালনের অবকাশ রয়েছে। সহজে এবং দ্রুত এসব মাধ্যমে কোনো ঘটনার ব্যাপক প্রচার সম্ভব বলে তা অনিয়ম ও কারচুপির পথে বিরাট প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। আমরা আশা করি, ২০১৮ হবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে আশাবাদের বছর। বাংলাদেশের মানুষ শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শাসক দলের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করার সুযোগ পায়। সেটিও ৫ বছরে মাত্র একবারের জন্য। এটি কেড়ে নেওয়া অব্যাহত থাকলে দেশে কুশাসন, অরাজকতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সীমাহীন পর্যায়ে চলে যাবে, বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত শক্তি আরও হ্রাস পাবে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এই উপলব্ধি সবার মধ্যে যেন থাকে, নতুন বছরে এই প্রত্যাশা রইল।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২. ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাদে ১৯৯০ সালের পর ২০০৮ পর্যন্ত এ দেশে চারটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনগুলোতে সব বড় দল অংশ নিয়েছে, ব্যাপকসংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে, তিনটি সংসদ তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে এবং পরাজিত দল সংসদে অনিয়মিতভাবে হলেও অংশ নিয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার কারণে এ সময়কালে নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ নির্বাচনের গুণগত দিক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা শুরু করে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রদান, নির্বাচনে কালোটাকার প্রকোপ হ্রাস নিয়ে বিভিন্ন দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। প্রচারণা চলে নির্বাচনে ‘না’ ভোট প্রদান ও ভোটের আনুপাতিক ভিত্তিতে সংসদে আসন নির্ধারণের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কারের দাবি নিয়েও। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এসব দাবি আকাশকুসুম কল্পনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই নির্বাচন শুধু অধিকাংশ দল বর্জন করেনি, ১৫৩টি আসনে ভোটাররা ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত হন। বাদবাকি আসনের নির্বাচনেও ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ভিন্নমত চর্চার ক্ষেত্রেও নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য করাতে ব্যর্থ হয়ে বিরোধী দল সহিংস আন্দোলন শুরু করে ২০১৫ সালে। সরকার তা শক্ত হাতে দমন করার পর একের পর এক নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নিয়ে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কর্তৃত্ব থাকার কারণে আওয়ামী লীগ কি ২০১৪ সালের মতো আগামী সংসদ নির্বাচনও একতরফাভাবে করতে সক্ষম বা আগ্রহী হবে? সম্ভবত না। এর প্রধান কারণ, আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা। ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানোর শক্তি বা পরিবেশ যে নেই, তা দলটির এত দিনে ভালোভাবে উপলব্ধি করার কথা। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমানে নিরাপত্তা ইস্যু সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ানোতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দাতাগোষ্ঠীগুলো আগের মতো চাপ সৃষ্টি করবে না, সেটিও এখন অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বড় ধরনের কোনো নতুন প্রতিকূলতা সৃষ্টি না হলে নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যেও সম্ভবত চেষ্টা থাকবে ২০১৪ সালের চেয়ে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের। সরকার নিশ্চয়ই জানে যে তাদের বর্তমান ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস জনসমর্থন কি না, তা নিয়ে সমাজে প্রশ্ন রয়েছে। যে দলটি এ দেশে স্বাধীনতাসংগ্রাম, গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছে, যে দলটির জন্ম ও বিকাশ পুরোপুরি গণতান্ত্রিকভাবে, তার জন্য এ ধরনের প্রশ্ন সম্মানজনক বা স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা নয়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এ কথা কয়েকবার বলেছেন যে ২০১৪ সালের চেয়ে উন্নততর একটি নির্বাচন তাঁরা অনুষ্ঠিত করতে চান। এটি তাই বিশ্বাস করার কারণ আছে যে আগামী নির্বাচন অন্তত ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের চেয়ে শ্রেয়তর হবে। কিন্তু তা কতটা শ্রেয়, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।
৩. আগামী সাধারণ নির্বাচন সম্ভবত ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হবে। তবে এই নির্বাচন ২০১৯ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে হলেও তা সংবিধানের ব্যত্যয় হবে না। সংবিধানের ৭২ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রথম অধিবেশনের (২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি) পর ৫ বছর অতিবাহিত হলে বর্তমান সংসদ ভেঙে যাবে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারিতে। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) অনুসারে মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে, অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তবে কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি আগেই সংসদ ভেঙে দিলে বা বাংলাদেশ কারও সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে এই সময় যথাক্রমে এগোতে বা পেছাতে পারে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি খুবই কম বলে এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে ২০১৮ সালেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বা অন্তত এর তফসিল ঘোষিত হবে। এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে চারটি। ১. সব দলের, বিশেষ করে বিএনপির অংশগ্রহণ। ২. ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছেন, এমন নিশ্চয়তা। ৩. ভোট ঠিকমতো গণনা ও ঘোষণা করা হচ্ছে, এর নিশ্চয়তা। ৪. সরকারি দল পরাজিত হলে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। আগামী নির্বাচনে সরকার সত্যিই বিএনপির অংশগ্রহণ চায় কি না, তা বিএনপি-প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলোর রায়-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বোঝা যাবে। রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ মামলা দুটোতে তাঁর সাজা হলেও হাইকোর্ট তা স্থগিত করলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ খোলা থাকবে তাঁর জন্য। তবে বিচারিক আদালতে শাস্তি হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে না-সরকার এ ধরনের কোনো নতুন আইন করে বেগম জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা করলে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে বাড়তি জটিলতা তৈরি হবে। সে ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার গত নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর অনেকগুলোকে বিভিন্নভাবে নির্বাচনে নিয়ে আসতে পারে, ৩০০ আসনেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতারও পরিবেশ সৃষ্টির চিন্তা করতে পারে। কিন্তু তারপরও বিপুল জনসমর্থিত দল বিএনপিকে ছাড়া সেই নির্বাচন কখনো দেশে সত্যিকারের নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি করতে পারবে না, সেই নির্বাচন দেশের বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকারের এটি না জানার কথা নয়। নির্বাচনের ২ ও ৩ নম্বর চ্যালেঞ্জ বিষয়ে প্রতিকারমূলক বিভিন্ন পরামর্শ ইতিমধ্যে সমাজে উচ্চারিত হয়েছে। নির্বাচনকালে ভোটকেন্দ্রগুলোতে সেনা মোতায়েন, অন্তত গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকায় রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের নিয়োগ, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, ভোটকেন্দ্র থেকেই প্রাথমিক ফলাফল জানিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। চতুর্থ চ্যালেঞ্জটি নতুন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি না হওয়ার নজির আফ্রিকান দেশগুলোতে রয়েছে, এ দেশেও একই কাণ্ড করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) অনুসারে ২০১৮ সালে নির্বাচন হলে বর্তমান সাংসদেরা ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারির আগে কার্যভার গ্রহণ করতে পারবেন না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে তাই ক্ষমতা হস্তান্তরে জটিলতা সৃষ্টির অপচেষ্টার সুযোগ থাকবে।
৪. এত কিছুর পরও আগামী নির্বাচন নিয়ে কিছু আশাবাদের কারণ রয়েছে। এই নির্বাচন ২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়ে অংশগ্রহণমূলক হবে। এতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা বিতর্কিত রকিব কমিশনের চেয়ে শ্রেয়তর হবে বলেও কিছু আশাবাদ রাজনৈতিক মহলে রয়েছে। সব প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে ৩০০ আসনেই বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে নির্বাচনে কারচুপি করাও কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া নির্বাচনকালে পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক ভূমিকা পালনের অবকাশ রয়েছে। সহজে এবং দ্রুত এসব মাধ্যমে কোনো ঘটনার ব্যাপক প্রচার সম্ভব বলে তা অনিয়ম ও কারচুপির পথে বিরাট প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। আমরা আশা করি, ২০১৮ হবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে আশাবাদের বছর। বাংলাদেশের মানুষ শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শাসক দলের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করার সুযোগ পায়। সেটিও ৫ বছরে মাত্র একবারের জন্য। এটি কেড়ে নেওয়া অব্যাহত থাকলে দেশে কুশাসন, অরাজকতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সীমাহীন পর্যায়ে চলে যাবে, বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত শক্তি আরও হ্রাস পাবে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এই উপলব্ধি সবার মধ্যে যেন থাকে, নতুন বছরে এই প্রত্যাশা রইল।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments