নারীদের সাগরজয়ে ‘নিরাপত্তার’ বাধা by মাসুদ মিলাদ
এইচএসসি
পাসের পর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ছয় বছর আগে সাগরজয়ের স্বপ্ন নিয়ে
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হন ১৬ তরুণী। সেখানে দুই
বছরের কোর্স (শিক্ষা কার্যক্রম) সাফল্যের সঙ্গে শেষ করেন তাঁরা। এরপরই
‘অপ্রত্যাশিত’ যুদ্ধ শুরু হয় তাঁদের। অনেক বাধা পেরিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজে
এক বছরের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ শেষ করেন ১৬ নারী মেরিন ক্যাডেট। কিন্তু
যোগ্যতার সব পরীক্ষায় সফল হলেও সাগরজয়ের পথে বাধা পিছু ছাড়ছে না তাঁদের। ১৬
নারীর একজনও গত দুই বছরে চাকরিতে ঢুকতে পারেননি। আরও স্পষ্ট করে বললে
যোগ্যতা থাকার পরও তাঁদের সমুদ্রগামী জাহাজে নিয়োগ দিতে চাচ্ছে না কেউ। এর
কারণ হিসেবে ‘নিরাপত্তা’ ঝুঁকির কথা বলছেন এই খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা
(সমুদ্রগামী জাহাজমালিকেরা)। নারী মেরিন ক্যাডেটদের চাকরির ক্ষেত্র
শুধুমাত্র সমুদ্রগামী জাহাজ। উড়োজাহাজের পাইলট, সশস্ত্র বাহিনীর ছত্রীসেনা
এবং নৌবাহিনীতে নাবিকের মতো পেশায় নারীরা সাফল্য দেখিয়েছেন। এরই
ধারাবাহিকতায় বাণিজ্যিক জাহাজে চড়ে এ দেশের নারীরা যাতে সাগরজয়ের স্বপ্ন
পূরণ করতে পারেন, সে জন্যই মেরিন একাডেমিতে নারী ক্যাডেট ভর্তি করা হচ্ছে।
অথচ ‘নিরাপত্তা’ নিয়ে মানসিক শঙ্কার কারণে তাঁদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে না।
২০১২ সালে মেরিন একাডেমির ৪৮তম ব্যাচে প্রথমবারের মতো ১৬ জন নারী ক্যাডেটকে
ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে মোট চার ব্যাচে ৫৪ জন নারী মেরিন একাডেমি থেকে
কোর্স শেষ করেছেন।
কোর্স শেষ করার অপেক্ষায় আছেন আরও সাত নারী। একেক
ব্যাচের নারী ক্যাডেটরা একেক ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করে চলেছেন। মেরিন
একাডেমির প্রথম ব্যাচের নারীদের একজন বিউটি আক্তার। ছয় বছর আগে যা ছিল
স্বপ্ন এখন সেটিই তাঁর কাছে হতাশা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেদের সঙ্গে
পাল্লা দিয়েই বিভিন্ন পরীক্ষায় যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু পাস
করার পর এখন মেয়েদের জাহাজে নিয়োগ দিতে চাচ্ছে না কেউ। কী সমস্যা সেটিও
স্পষ্ট করে বলে না কেউ। জাহাজমালিকেরা ঝুঁকির কথা বললেও নিয়োগের অপেক্ষায়
থাকা নারীরা বলছেন তাঁরা এটিকে ঝুঁকি হিসেবে দেখেন না। যেকোনো পরিস্থিতিতে
কাজ করতে প্রস্তুত তাঁরা। সমুদ্রগামী জাহাজের ভেতরে থাকার পরিবেশ এবং
সেখানে নারীদের কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। প্রথম ব্যাচের নারী
ক্যাডেটরা শর্ত পূরণ করে সমুদ্রগামী জাহাজের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের
জন্য ‘ক্লাস থ্রি’ বা যোগ্যতার পরীক্ষায় অংশ নেন। নটিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং
শাখায় সিওসি (সার্টিফিকেট অব কম্পিট্যান্সি বা যোগ্যতা সনদ) পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ ক্যাডেটরা জাহাজে যথাক্রমে থার্ড অফিসার ও চতুর্থ প্রকৌশলী পদে
নিয়োগ পান। চতুর্থ প্রকৌশলী পদের কর্মকর্তারা ইঞ্জিন পরিচালনা ও
রক্ষণাবেক্ষণ করেন। থার্ড অফিসাররা জাহাজের ডেকে ক্যাপ্টেনের নির্দেশে
যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করেন। স্টিয়ারিং পরিচালনা, ডেকের নিরাপত্তা,
সাগরে পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি কাজ করেন তাঁরা। কিন্তু পরীক্ষায় পাস করা নারী
ক্যাডেটরা প্রায় দুই বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি জাহাজ কোম্পানিগুলোর দ্বারে
দ্বারে ঘুরলেও কেউ নিয়োগ দিতে চাচ্ছে না। মেরিন একাডেমির ৪৮তম ব্যাচে ১৬
নারীসহ ছিল ৩০৪ জন ক্যাডেট। পাস করার পর ছেলেদের অনেকে পর্যায়ক্রমে ছয় মাস
বা এক বছর মেয়াদে দেশি-বিদেশি সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরি করেছেন। অনেকে ছয়
মাস বা এক বছরের চুক্তিতে চাকরি করে দেশেও ফিরে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ
কেউ আবার দেশি-বিদেশি জাহাজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করার
অপেক্ষায় রয়েছেন। শুধু নারীরা বারবার বাধার মুখে পড়েছেন। জাহাজে সাধারণত
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হয়। নৌপরিবহন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি
পতাকাবাহী নিবন্ধিত জাহাজ রয়েছে ৩৮টি। তবে সচল রয়েছে ৩০টি। এর মধ্যে সরকারি
প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজ রয়েছে দুটি।
বাকিগুলো বেসরকারি খাতের। আবার বিদেশি জাহাজে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারেনি
কোনো ম্যানিং এজেন্সি (নাবিক নিয়োগদানকারী প্রতিষ্ঠান)। নৌপরিবহন
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের
পতাকাবাহী জাহাজে নারীদের যাতে নিয়োগ দেওয়া হয়, সে জন্য জাহাজমালিকদের
বারবার অনুরোধ করছেন তাঁরা। নারীদের নিয়োগ দিতে হলে আন্তর্জাতিক কনভেনশন
(রীতি) অনুযায়ী জাহাজে তাঁদের থাকার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হয়। দেশীয়
জাহাজে এখনো এমন ব্যবস্থা না থাকলেও এটি করা কঠিন কোনো বিষয় নয়। বিশ্বে
নারী নাবিকদের সংখ্যা কম হলেও তাঁদের সাফল্য কম নয়। সমুদ্রগামী জাহাজে ১৯৪৫
সাল থেকে বিশ্বে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। নারী ক্যাডেটদের ব্যবহারিক
প্রশিক্ষণের মূল্যায়ন সম্পর্কে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের সাবেক
ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, মেরিন
একাডেমির নারী ক্যাডেটদের যোগ্যতার কোনো ঘাটতি ছিল না। এমনকি প্রশিক্ষণরত
অবস্থায় জাহাজে কোনো সমস্যাও হয়নি। যোগ্যতার ঘাটতি না থাকলেও নারীরা কেন
জাহাজে নিয়োগ পাচ্ছেন না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক
সমিতির সহসভাপতি শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, এখানে নিরাপত্তাটা বড় বিষয়।
তাই
কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না। বাংলাদেশের জাহাজমালিকেরা নারী নাবিক নিতে উৎসাহী
নন। যে ঝুঁকির কথা জাহাজমালিকেরা বলছেন, এটি আসলে কোনো ঝুঁকি নয় বলে
মন্তব্য করেছেন সরকারি নাবিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র ন্যাশনাল মেরিটাইম
ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ফয়সাল আজিম। তিনি বলেন, দুই-একজন
জাহাজমালিক যদি সাহস করে নারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেন তাহলে নিরাপত্তার কথা আর
কেউ মাথায় আনবে না। সমুদ্রগামী জাহাজের অবকাঠামো বা পরিবেশ কোনোটিই
নারীদের জন্য বাধা নয়। উড়োজাহাজে, ট্রেনে সব ক্ষেত্রেই নারীরা কাজ করছেন।
বিদেশিরা বহু আগেই সমুদ্রগামী জাহাজে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ
দিয়েছে। সেখানে তো কোনো সমস্যা হয়নি। দেশের বিভিন্ন বাহিনীতে পুরুষদের
সঙ্গে থেকে নারীরা যখন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন তখন তো নিরাপত্তাঝুঁকির
প্রশ্ন আসে না। নিরাপত্তাঝুঁকির এই ধারণা ভাঙতে হবে। মেরিন একাডেমির প্রথম
ব্যাচের নারীরা যখন জাহাজে নিয়োগ পেতে ঘুরছেন, তখন পরবর্তী ব্যাচের নারীদের
জন্য অপেক্ষা করছে আরও কঠিন যুদ্ধ। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজে এক
বছর ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের শর্ত পূরণ করে ৪৯তম ব্যাচের ১৯ জন নৌপরিবহন
অধিদপ্তরের যোগ্যতার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পরীক্ষায়
অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করার সময় ওই ক্যাডেটরা জানতে পারেন, বিএসসির জাহাজ
দেশের বাইরে না যাওয়ায় তাঁদের জাহাজে প্রশিক্ষণের বিষয়টি শর্ত হিসেবে পূরণ
হচ্ছে না। জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর সৈয়দ আরিফুল
ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএসসির জাহাজ দেশের বাইরে যাচ্ছে না। এ কারণে আইন
অনুযায়ী বিএসসির দুটি জাহাজে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ শর্ত হিসেবে পূরণ হচ্ছে
না।
No comments