ইরান বিক্ষোভ ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা
সদ্য
চলে যাওয়া ২০১৭ সালে ক্রিসমাস ও খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদ্যাপনের মাঝামাঝি
সময়ে অনেকটা হঠাৎ করেই যেন জেগে উঠল ইরানের জনগণ। না, এটা আরব বসন্তের কোনো
ধারাবাহিকতা নয়। তিউনিসীয় যুবক বোয়াজিজির আত্মাহুতি যে আরব বসন্তের সূচনা
করেছিল, তা অনেক আগেই পশ্চিমাদের হাতে চুরি হয়ে গিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে
হতে পারে, কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিরুদ্ধে ইরানের বিভিন্ন শহরে জনতা মাঠে
নেমেছে। সর্বশেষ খবর অনুসারে চলমান বিক্ষোভে ২২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে
বিক্ষোভকারী ছাড়াও সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও আছে। অবশ্য
এই বিক্ষোভের বিপরীতে সরকারের পক্ষেও ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ
খামেনির ছবি নিয়ে লাখো জনতা মিছিল করেছে। বলা হচ্ছে, ২০০৯ সালের পর এটিই
ইরানে বড় ধরনের কোনো জনবিক্ষোভ। গত ২৮ ডিসেম্বর শিয়াদের অন্যতম পবিত্র শহর
মাশহাদে বিক্ষোভ শুরু হয়। মাশহাদ মূলত প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির বিরোধী
কট্টরপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। এরপর কৌম, নাজাফাবাদ, রাশত,
খোরামাবাদ হয়ে তেহরানেও দ্রুত বিক্ষোভ পৌঁছে যায়। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীরাও এই বিক্ষোভে যোগ দেন। বিক্ষোভ শুরুর পরই যথারীতি পশ্চিমা
গণমাধ্যম এই আন্দোলনকে সমর্থন করে সংবাদ প্রকাশ করছে। এবং এই বিক্ষোভকে
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক্স্বাধীনতা ও নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলন বলে
মূল্যায়িত করছে। এর সঙ্গে ইরানি বংশোদ্ভূত প্রবাসীদের একটি বড় অংশই
বৃদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে যোগ দিয়েছে। ইস্তাম্বুলভিত্তিক থিংক ট্যাংক আল
শারকের তামারা বাদাওয়ির মতে, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির বিস্তর ফারাক
জনসাধারণকে মাঠে নামিয়েছে। ক্রমাগম জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি, বেকারত্বের হার
বেড়ে যাওয়া, কৃচ্ছ্র সাধনের নামে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির অতি দরিদ্র ও
দরিদ্রদের আর্থিক সুবিধা হ্রাসের সিদ্ধান্ত জনগণের বিক্ষোভকে উসকে দিয়েছে। এ
ছাড়া ইরানি শাসকগোষ্ঠীর কঠোর রাজনৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ভেতরে-ভেতরে
পরিস্থিতিকে ঘোলা করে তুলছিল। এ ছাড়া অনির্বাচিত সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা
আয়াতুল্লাহ খামেনির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণও প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির
সমর্থকেরা ভালোভাবে নেয়নি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের বেশ কিছু
প্রস্তাব খামেনি বাতিল করেছেন বা ফিরিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে
সংস্কারপন্থী অপেক্ষাকৃত উদার বলে পরিচিত হাসান রুহানি একটি রক্ষণশীল
মন্ত্রিসভা করে কট্টরপন্থীদেরও আস্থায় আনতে চাইছেন। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ
মনে করছেন, এই বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে হাসান রুহানির সমর্থকেরা খামেনির
প্রভাবকে খর্ব করতে চাইছেন। ঘটনার বিশ্লেষণে স্পষ্টতই বোঝা যায়, এই
বিক্ষোভকে আলতো করে হাসান রুহানি ও রুহানিবিরোধী—এই উভয় পক্ষই ব্যবহার করে
সুবিধা নিতে চাইছে। বিষয়টি এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকলে ইরানের রাজনীতিতে
হয়তোবা আমরা একটি পরিবর্তন দেখতে পারতাম। কিন্তু অভ্যন্তরীণ শক্তির
সংশ্লিষ্টতার বাইরে বহিঃশক্তির সম্পৃক্ততা ইরানের বিক্ষোভকে প্রশ্নের মুখে
ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইট ও
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিক্ষোভকারীদের সমর্থন করে
বক্তব্য। ইরানের এমন এক সময়ে বিক্ষোভ বা অস্থিরতা শুরু হলো, যখন আরব
উপদ্বীপ একধরনের অস্থিরতা শেষ করে নতুন একধরনের অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে।
সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেন ফ্রন্টে সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোট পরাজিত না হলেও
পর্যুদস্ত হয়েছে ইরান-তুরস্ক-রাশিয়া জোটের কাছে।
সর্বশেষ জেরুজালেম ইস্যুতে
মার্কিন ঘোষণায় নতুন অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। মুসলিম বিশ্বের প্রতিবাদ,
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনীহা বা একধরনের নির্লিপ্ততা, জাতিসংঘের ভোটে হেরে
যাওয়ার পর মার্কিনরা বেশ বেকায়দায়ই ছিল। ইরানের বিক্ষোভ জেরুসালেম থেকে
আমাদের নজরও খানিকটা ভিন্ন দিকে সরিয়ে নিল। সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোটের
বিপরীতে আরবের রাজনীতিতে কার্যকর বিরোধী জোট হচ্ছে ইরান-সিরিয়া-তুরস্ক জোট।
ইরান-সিরিয়া-তুরস্ক জোটের প্রতি আবার রাশিয়া ও চীনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন
রয়েছে। তাই আরবের ভূরাজনীতির নিয়ন্ত্রণে সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোট
ইরান-সিরিয়া-তুরস্ক জোটের যেকোনো একটি দেশের শাসকদের পতনে মরিয়া।
সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোটের আকাঙ্ক্ষা অন্তত একটি দেশে তাদের পক্ষের শক্তি
ক্ষমতায় আসুক। যেমনটা মিসরে হয়েছে। মুরসির পতনের পর সিসির মিসর
সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোটের জন্য কোনো হুমকি নয়। যদি ইরান-সিরিয়া-তুরস্ক
জোটের অন্তত একটি দেশকে নিজেদের পক্ষে আনা যায়, তবে আরবে ইসরায়েল-মার্কিন
নীতি বাস্তবায়নের পথ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। আর এ ক্ষেত্রে
ইসরায়েল-মার্কিনদের জন্য পথ সহজ করে দিয়েছে আরবের দেশগুলোর গণতন্ত্রহীনতা।
শুধু আরব দেশগুলোই নয়, আরবসহ বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশে নিয়মিত
নির্বাচনের মাধ্যমের ক্ষমতার পালাবদল হয় কদাচিৎ। আর মুসলিম দেশগুলোর
অগণতান্ত্রিক বাদশাহি, রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও রেজিমতন্ত্রের কারণে
পশ্চিমারা নিজেদের নীতি বাস্তবায়নের সহজ সুযোগ করে নেয় তথাকথিত গণতান্ত্রিক
আন্দোলনের নামে। আরব বসন্তের নামে সিরিয়ায় শুরু হয়েছিল বাশার পতনের মিশন।
পরে সেটি কী হয়েছে, আমরা দেখছি। তুরস্কের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে
ক্ষমতার পালাবদলের চেষ্টা করা হয়েছিল। সেটিও সফল হয়নি। এবার ইরানের পালা।
ইরান অনেক কারণেই সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোটের জন্য হুমকি। বিশেষ করে ইরানের
সামরিক সক্ষমতা। ইরান যতই দাবি করুক শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু কর্মসূচি
পালন করছে, এরপরও ইরানের পরমাণু সক্ষমতা নিয়ে শঙ্কা ও সন্দেহ রয়েই যায়।
আহমাদিনেজাদের থেকে অপেক্ষাকৃত উদার বলে পরিচিত হাসান রুহানিও সেই অর্থে
পরমাণু কর্মসূচি বাতিল করেননি। ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্যও ইরান বড় ধনের
হুমকি। বিশেষ করে ইসরায়েলের দখলীকৃত ভূমিতে রাষ্ট্র প্রসারণের পথে বড় বাধা
হতে পারে পারমাণবিক শক্তি সমৃদ্ধ ইরান। সিরিয়া, লেবানন হয়ে ইরান এখন
ইসরায়েলের ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরানের প্রভাব ক্রমেই
বাড়ছে। এসব কারণে ইরানকে দুর্বল করে দেওয়াই সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোটের
অন্যতম উদ্দেশ্য। ইরানের এই বিক্ষোভ এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রধান সংবাদে ইরানের বিক্ষোভ স্থান হারিয়েছে।
ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কারিম সাজাদপৌর
বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পরপরই ‘দ্য আটলান্টিক’-এ একটি কলাম লিখেছিলেন। তিনি
বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে গণ-আন্দোলনের পথে নানাবিধ বাধা রয়েছে। আরবে কোনো
গণ-আন্দোলনই সফল হয় না। এবং সহজেই সাফল্য আসে না। সাফল্য ব্যর্থতার দোলাচলে
ঘটে যায় ব্যাপক রক্তক্ষয়। শেষাবধি আন্দোলন সফল হলেও ক্ষমতা প্রকারান্তরে
আবার স্বৈরশাসকদের হাতেই চলে যায়। আন্দোলনের ফল জনসাধারণের হাতে আর থাকে
না। তবে তিনি উল্লেখ করেননি পরমাণু ইস্যুতে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের মাধ্যমে
ইরানে বিক্ষোভ, বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার যে বৃক্ষ মার্কিন প্রশাসন রোপণ
করেছিল, সেই বৃক্ষ এখন ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে। সেই বৃক্ষের ফল মার্কিনরা
আদৌ পাড়তে পারবে কি না বা ইরানের শাসকেরা সেই বৃক্ষ উপড়ে দেবে কি না, সেটি
সময়ই বলে দেবে। কিন্তু আদৌ ইরানে বিক্ষোভকারীদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, সে নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়। ইরান, তুরস্ক, সিরিয়ায়
গণতন্ত্রের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট যতটা মরিয়া, সৌদি আরব,
আরব আমিরাত, জর্ডান বা সিসির মিসরে গণতন্ত্রের জন্য ঠিক ততটাই অনাগ্রহী।
সিরিয়ায় বাশারবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আমাদের আতঙ্কিত করে। গণতান্ত্রিক
নয়, একটি দুর্বল ও নতজানু ইরান এই মুহূর্তে সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোটের
জন্য খুব প্রয়োজন। বিশেষ করে তাদের আরব ডকট্রিন বাস্তবায়নের জন্য।
ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি
ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি
No comments