অসংবাদমাধ্যমের উত্থান: সাংবাদিকতার কী হবে?
ভুয়া
খবর ও গুজব রটানোর কাজে গুগল–ফেসবুকের জুড়ি মেলা ভার—এ রকম অভিযোগে
ইউরোপ-আমেরিকায় তোলপাড় চলছে। কিন্তু এ রকম অভিযোগ ইতিমধ্যে পুরোনো হয়ে
গেছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ শুরুর দিকে স্বীকার করেনি যে এটা একটা বড় সমস্যা,
কিন্তু এখন স্বীকার করছে যে এটা গুরুতর সমস্যা। তারা এই সমস্যা দূর করার
চেষ্টা করছে বলে বিশ্ববাসীকে আশ্বাসও দিচ্ছে।
২. ভুয়া খবর ও গুজবের ছড়াছড়ি দেখে অনেকে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন যে তাহলে সাংবাদিকতার কী দশা হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কারণ, ভুয়া খবর খবর নয়, গুজবও খবর নয়। সাংবাদিকতার সঙ্গে এসব অপকর্মের কোনোই সম্পর্ক নেই। বরং সাংবাদিকতার কদর ভুয়া খবরের যুগেই বেশি বাড়ার কথা: চারদিক যখন ভুয়া খবর আর গুজবে সয়লাব, তখন আপনার দরকার সত্য খবর, সঠিক তথ্য। সেটা আপনাকে দেবেন দায়িত্বশীল, পেশাদার সাংবাদিকেরা, যাঁরা তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই না করে তা প্রকাশ করেন না, যাঁরা ভুয়া খবর ও মিথ্যা তথ্যের বিপরীতে হাজির করেন সঠিক খবর, অথেন্টিক ইনফরমেশন।
৩. সঠিক খবরের জন্য প্রয়োজন পেশাদার সাংবাদিক; ফেসবুক বন্ধু নয়, ব্লগার নয়, তথাকথিত ‘সিটিজেন জার্নালিস্ট’ নয়, এমনকি ‘ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক’ও নয়। কারণ, এঁদের পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক লজিস্টিকস নেই; সঠিক সংবাদ সংগ্রহ করার, তথ্য যাচাই-বাছাই করার বাধ্যবাধকতা নেই। বরং চাঞ্চল্য সৃষ্টির মোহ থাকতে পারে, গুজব রটানোর উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, আদর্শিক, দার্শনিক অবস্থানের অনুকূল ভুয়া খবর প্রচার করতে পারেন, শেয়ার করতে পারেন, এমনকি ভাইরাল করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ তৎপরতাও চালাতে পারেন (উদাহরণ: তথাকথিত আরব বসন্ত, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন)। সুতরাং পেশাদার, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দায়িত্বশীল, সৎ ও আন্তরিক সাংবাদিকের বিকল্প অন্য কেউই হতে পারেন না।
৪. পেশাদার সাংবাদিক রাখে শুধুই পেশাদার সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলো: সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদ সংস্থা। ডিজিটাল যুগে এসে এরাও ডিজিটাল বা অনলাইন সংস্করণ চালু করেছে। প্রতিটিই তথ্যপ্রযুক্তি তথা ইন্টারনেটের মাধ্যমেও সাংবাদিকতা করছে। ‘সাংবাদিকতা করছে’ কথাটার ওপর জোর দিতে চাই। কারণ, সাংবাদিকতার সংকট নিয়েই কথা বলব বলে এই লেখা লিখতে বসেছি। কেউ কেউ বলছেন, সাংবাদিকতার সংকট নয়, মৃত্যু ঘটতে চলেছে। কেউ কেউ বলছেন, সংবাদমাধ্যম যুগের অবসান ঘটেছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগের জগৎ ও মাধ্যমটা এখন আর সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে নেই, অসংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
৫. ‘অসংবাদমাধ্যম’ কী? যে মাধ্যম মানুষে মানুষে বহুমুখী যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়, কিন্তু সাংবাদিকতা করে না। ওই মাধ্যমে সংবাদ সঞ্চালিত বা প্রচারিত হয়, কিন্তু মাধ্যমগুলো নিজেরা সংবাদ তৈরি করে না, সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় পেশাদার সাংবাদিকদের দ্বারা তৈরি সংবাদ ওইসব মাধ্যমে সঞ্চালিত, প্রচারিত, বিনিময় হতে পারে, হয়। অসংবাদমাধ্যমের উদাহরণ? গুগল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আমাজন, ইনস্টাগ্রাম...ইত্যাদি। এরা সাংবাদিক রাখে না, সাংবাদিকতা করে না। এগুলো একেকটা নেটওয়ার্ক: মানুষে মানুষে বহুমুখী যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়াই এদের কাজ ও ব্যবসা।
৬. ইন্টারনেটে এখন আধিপত্য চলছে এই অসংবাদমাধ্যমের। নিউইয়র্ক টাইমস কিংবা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য টাইমস বা দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, সিএনএন, টাইম ম্যাগাজিন বা দ্য ইকোনমিস্ট-এসব সংবাদপ্রতিষ্ঠান এখন পেছনে পড়ে গেছে। অথচ এই কিছুকাল আগেও ‘মিডিয়া’ বলতেই এদের বোঝাত এবং জনপ্রিয়তা, প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ব্যবসায় এরাই ছিল সামনের সারিতে। এদের কী ঘটেছে? সাংবাদিকতার মান খারাপ হয়ে গেছে? নাকি এরা ভুয়া খবর ও গুজব প্রচারের কাজে নেমেছে? না, এদের সাংবাদিকতা ঠিক জায়গাতেই আছে, কিন্তু আয় কমে গেছে। শুধু কমে গেছে নয়, এদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কেন? কীভাবে? এদের আয় কোথায় গেল? কোথায় যাচ্ছে?
৭. অসংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। গুগল-ফেসবুকের কাছে। ২০১৭ সালে সারা পৃথিবীর অনলাইন বিজ্ঞাপনের ৬১ শতাংশই পেয়েছে এই দুটো অসংবাদপ্রতিষ্ঠান। তারা আমেরিকান মোট অনলাইন বিজ্ঞাপনের ৭৩ শতাংশ পেয়েছে। এক বছরে সারা দুনিয়ায় অনলাইন বিজ্ঞাপনের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার ৮৩ শতাংশ গেছে তাদের ভাগে। গুগল আর ফেসবুকের মধ্যে গুগলের আয় ফেসবুকের আয়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি।
৮. অন্যদিকে সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন থেকে আয় (আয়ের প্রধান উৎস) দ্রুত কমে যাচ্ছে। যেমন নিউইয়র্ক টাইমস-এর মুদ্রিত বিজ্ঞাপনের আয় ২০১৭ সালে কমে গেছে ২০ শতাংশ, অনলাইন ও মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনসহ মোট বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমেছে ৯ শতাংশ। গুগল আর নিউইয়র্ক টাইমস-এর অনলাইন বিজ্ঞাপনের আয়ের পার্থক্য লক্ষ করলে বিস্মিত হতে হবে: ২০১৬ সালে গুগল আয় করেছে মোট ৭ হাজার ৯৪০ কোটি মার্কিন ডলার (৭৯.৪ বিলিয়ন)। আর একই বছরে নিউইয়র্ক টাইমস-এর আয় হয়েছে মাত্র ৫৮ কোটি ৭ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার (৫৮০.৭৩ মিলিয়ন)। আমেরিকার একসময়ের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সংবাদপত্রগুলোর অন্যতম নিউইয়র্ক টাইমস, তার ক্রমবর্ধমান দুরবস্থার চিত্র পাওয়া যায় গত এক দশকে আয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ার হিসাবের দিকে তাকালে। ২০০৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমস আয় করেছিল ২১৫ কোটি ৩০ লাখ ৯৪ হাজার মার্কিন ডলার (২১৫৩.৯৪ মিলিয়ন)। ২০১৫ সালে তার আয় কমে গিয়ে নামে মাত্র ৬৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭১ হাজার ডলারে (৬৩৮.৭১ মিলিয়ন)।
মারাত্মক দুর্দশায় পড়েছে ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলো: দ্য ইনডিপেনডেন্ট অর্থসংকটে পড়ে বিক্রি হয়ে গেছে, ব্যাপক সাংবাদিক ছাঁটাই চলেছে সেখানে। এক ভুঁইফোড় রুশ ধনকুবের পত্রিকাটি কিনে নেওয়ার পর অল্প কিছুদিন ভালোই চলেছিল, কিন্তু লোকসান তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গেছে যে এখন আর পত্রিকাটি ছাপাই হয় না, শুধু অনলাইন সংস্করণ টিকে আছে। মর্মান্তিক দুরবস্থা দ্য গার্ডিয়ান-এরও। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো সংবাদপত্রটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। টিকে থাকলেও সে আর আগের চেহারায় টিকে থাকতে পারবে না, তা নিশ্চিত হয়ে গেছে। লোকসান কমাতে পত্রিকাটি চলতি মাসেই কমপ্যাক্ট বা ট্যাবলয়েড আকারে ছাপা শুরু হবে। এর নিজস্ব ছাপাখানাও তুলে দেওয়া হবে, ছাপার জন্য মিরর গ্রুপের প্রেসের সঙ্গে ইতিমধ্যে চুক্তি হয়ে গেছে। খরচ কমানোর জন্য সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মী ছাঁটাই অনেক হয়েছে, আরও হচ্ছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে ২০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করা হবে এবং ২০ শতাংশ ব্যয় কমানো হবে। রুপার্ট মারডকের দ্য টাইমস, পয়সা ছাড়া যার অনলাইন সংস্করণের একটা খবর বা লেখাও পড়া যায় না (টোটাল পে-ওয়াল), তার অবস্থাও ভালো নয়। মারডকের পুরো মিডিয়ার সাম্রাজ্যই এখন কঠিন সংকটের মধ্যে আছে।
৯. এই পরিস্থিতি সাংবাদিকতার জন্য সংকটময়। গুণগত মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা বজায় রেখে এই সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য নানা ধরনের ‘বিজনেস মডেল’ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। সেগুলোর কোনটা কী মাত্রায় সফল হবে, তা এখন বলা খুব কঠিন। তবে একটা বিষয় সম্ভবত অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। তা হলো সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতার দিন শেষ। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ানসহ আরও কিছু সংবাদপত্র এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে আমার মনে হচ্ছে। এরা এখন বিজ্ঞাপন বাড়ানোর ওপর যত জোর দিচ্ছে, তার চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে অনলাইনের গ্রাহক বাড়ানোর দিকে, যাঁরা দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর মেয়াদে চাঁদা দিয়ে অনলাইনে পত্রিকা পড়বেন। এই ‘ডিজিটাল অনলি সাবস্ক্রিপশন’ নিউইয়র্ক টাইমস-এর অনেক বেড়েছে বলে বিদায়ী বছরে তাদের আয় কিছুটা বেড়েছে। এটাই হয়তো আগামী দিনের সংবাদপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক মডেল হয়ে উঠবে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul. alam@gmail. com
২. ভুয়া খবর ও গুজবের ছড়াছড়ি দেখে অনেকে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন যে তাহলে সাংবাদিকতার কী দশা হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কারণ, ভুয়া খবর খবর নয়, গুজবও খবর নয়। সাংবাদিকতার সঙ্গে এসব অপকর্মের কোনোই সম্পর্ক নেই। বরং সাংবাদিকতার কদর ভুয়া খবরের যুগেই বেশি বাড়ার কথা: চারদিক যখন ভুয়া খবর আর গুজবে সয়লাব, তখন আপনার দরকার সত্য খবর, সঠিক তথ্য। সেটা আপনাকে দেবেন দায়িত্বশীল, পেশাদার সাংবাদিকেরা, যাঁরা তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই না করে তা প্রকাশ করেন না, যাঁরা ভুয়া খবর ও মিথ্যা তথ্যের বিপরীতে হাজির করেন সঠিক খবর, অথেন্টিক ইনফরমেশন।
৩. সঠিক খবরের জন্য প্রয়োজন পেশাদার সাংবাদিক; ফেসবুক বন্ধু নয়, ব্লগার নয়, তথাকথিত ‘সিটিজেন জার্নালিস্ট’ নয়, এমনকি ‘ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক’ও নয়। কারণ, এঁদের পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক লজিস্টিকস নেই; সঠিক সংবাদ সংগ্রহ করার, তথ্য যাচাই-বাছাই করার বাধ্যবাধকতা নেই। বরং চাঞ্চল্য সৃষ্টির মোহ থাকতে পারে, গুজব রটানোর উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, আদর্শিক, দার্শনিক অবস্থানের অনুকূল ভুয়া খবর প্রচার করতে পারেন, শেয়ার করতে পারেন, এমনকি ভাইরাল করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ তৎপরতাও চালাতে পারেন (উদাহরণ: তথাকথিত আরব বসন্ত, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন)। সুতরাং পেশাদার, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দায়িত্বশীল, সৎ ও আন্তরিক সাংবাদিকের বিকল্প অন্য কেউই হতে পারেন না।
৪. পেশাদার সাংবাদিক রাখে শুধুই পেশাদার সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলো: সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদ সংস্থা। ডিজিটাল যুগে এসে এরাও ডিজিটাল বা অনলাইন সংস্করণ চালু করেছে। প্রতিটিই তথ্যপ্রযুক্তি তথা ইন্টারনেটের মাধ্যমেও সাংবাদিকতা করছে। ‘সাংবাদিকতা করছে’ কথাটার ওপর জোর দিতে চাই। কারণ, সাংবাদিকতার সংকট নিয়েই কথা বলব বলে এই লেখা লিখতে বসেছি। কেউ কেউ বলছেন, সাংবাদিকতার সংকট নয়, মৃত্যু ঘটতে চলেছে। কেউ কেউ বলছেন, সংবাদমাধ্যম যুগের অবসান ঘটেছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগের জগৎ ও মাধ্যমটা এখন আর সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে নেই, অসংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
৫. ‘অসংবাদমাধ্যম’ কী? যে মাধ্যম মানুষে মানুষে বহুমুখী যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়, কিন্তু সাংবাদিকতা করে না। ওই মাধ্যমে সংবাদ সঞ্চালিত বা প্রচারিত হয়, কিন্তু মাধ্যমগুলো নিজেরা সংবাদ তৈরি করে না, সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় পেশাদার সাংবাদিকদের দ্বারা তৈরি সংবাদ ওইসব মাধ্যমে সঞ্চালিত, প্রচারিত, বিনিময় হতে পারে, হয়। অসংবাদমাধ্যমের উদাহরণ? গুগল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আমাজন, ইনস্টাগ্রাম...ইত্যাদি। এরা সাংবাদিক রাখে না, সাংবাদিকতা করে না। এগুলো একেকটা নেটওয়ার্ক: মানুষে মানুষে বহুমুখী যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়াই এদের কাজ ও ব্যবসা।
৬. ইন্টারনেটে এখন আধিপত্য চলছে এই অসংবাদমাধ্যমের। নিউইয়র্ক টাইমস কিংবা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য টাইমস বা দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, সিএনএন, টাইম ম্যাগাজিন বা দ্য ইকোনমিস্ট-এসব সংবাদপ্রতিষ্ঠান এখন পেছনে পড়ে গেছে। অথচ এই কিছুকাল আগেও ‘মিডিয়া’ বলতেই এদের বোঝাত এবং জনপ্রিয়তা, প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ব্যবসায় এরাই ছিল সামনের সারিতে। এদের কী ঘটেছে? সাংবাদিকতার মান খারাপ হয়ে গেছে? নাকি এরা ভুয়া খবর ও গুজব প্রচারের কাজে নেমেছে? না, এদের সাংবাদিকতা ঠিক জায়গাতেই আছে, কিন্তু আয় কমে গেছে। শুধু কমে গেছে নয়, এদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কেন? কীভাবে? এদের আয় কোথায় গেল? কোথায় যাচ্ছে?
৭. অসংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। গুগল-ফেসবুকের কাছে। ২০১৭ সালে সারা পৃথিবীর অনলাইন বিজ্ঞাপনের ৬১ শতাংশই পেয়েছে এই দুটো অসংবাদপ্রতিষ্ঠান। তারা আমেরিকান মোট অনলাইন বিজ্ঞাপনের ৭৩ শতাংশ পেয়েছে। এক বছরে সারা দুনিয়ায় অনলাইন বিজ্ঞাপনের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার ৮৩ শতাংশ গেছে তাদের ভাগে। গুগল আর ফেসবুকের মধ্যে গুগলের আয় ফেসবুকের আয়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি।
৮. অন্যদিকে সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন থেকে আয় (আয়ের প্রধান উৎস) দ্রুত কমে যাচ্ছে। যেমন নিউইয়র্ক টাইমস-এর মুদ্রিত বিজ্ঞাপনের আয় ২০১৭ সালে কমে গেছে ২০ শতাংশ, অনলাইন ও মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনসহ মোট বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমেছে ৯ শতাংশ। গুগল আর নিউইয়র্ক টাইমস-এর অনলাইন বিজ্ঞাপনের আয়ের পার্থক্য লক্ষ করলে বিস্মিত হতে হবে: ২০১৬ সালে গুগল আয় করেছে মোট ৭ হাজার ৯৪০ কোটি মার্কিন ডলার (৭৯.৪ বিলিয়ন)। আর একই বছরে নিউইয়র্ক টাইমস-এর আয় হয়েছে মাত্র ৫৮ কোটি ৭ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার (৫৮০.৭৩ মিলিয়ন)। আমেরিকার একসময়ের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সংবাদপত্রগুলোর অন্যতম নিউইয়র্ক টাইমস, তার ক্রমবর্ধমান দুরবস্থার চিত্র পাওয়া যায় গত এক দশকে আয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ার হিসাবের দিকে তাকালে। ২০০৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমস আয় করেছিল ২১৫ কোটি ৩০ লাখ ৯৪ হাজার মার্কিন ডলার (২১৫৩.৯৪ মিলিয়ন)। ২০১৫ সালে তার আয় কমে গিয়ে নামে মাত্র ৬৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭১ হাজার ডলারে (৬৩৮.৭১ মিলিয়ন)।
মারাত্মক দুর্দশায় পড়েছে ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলো: দ্য ইনডিপেনডেন্ট অর্থসংকটে পড়ে বিক্রি হয়ে গেছে, ব্যাপক সাংবাদিক ছাঁটাই চলেছে সেখানে। এক ভুঁইফোড় রুশ ধনকুবের পত্রিকাটি কিনে নেওয়ার পর অল্প কিছুদিন ভালোই চলেছিল, কিন্তু লোকসান তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গেছে যে এখন আর পত্রিকাটি ছাপাই হয় না, শুধু অনলাইন সংস্করণ টিকে আছে। মর্মান্তিক দুরবস্থা দ্য গার্ডিয়ান-এরও। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো সংবাদপত্রটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। টিকে থাকলেও সে আর আগের চেহারায় টিকে থাকতে পারবে না, তা নিশ্চিত হয়ে গেছে। লোকসান কমাতে পত্রিকাটি চলতি মাসেই কমপ্যাক্ট বা ট্যাবলয়েড আকারে ছাপা শুরু হবে। এর নিজস্ব ছাপাখানাও তুলে দেওয়া হবে, ছাপার জন্য মিরর গ্রুপের প্রেসের সঙ্গে ইতিমধ্যে চুক্তি হয়ে গেছে। খরচ কমানোর জন্য সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মী ছাঁটাই অনেক হয়েছে, আরও হচ্ছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে ২০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করা হবে এবং ২০ শতাংশ ব্যয় কমানো হবে। রুপার্ট মারডকের দ্য টাইমস, পয়সা ছাড়া যার অনলাইন সংস্করণের একটা খবর বা লেখাও পড়া যায় না (টোটাল পে-ওয়াল), তার অবস্থাও ভালো নয়। মারডকের পুরো মিডিয়ার সাম্রাজ্যই এখন কঠিন সংকটের মধ্যে আছে।
৯. এই পরিস্থিতি সাংবাদিকতার জন্য সংকটময়। গুণগত মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা বজায় রেখে এই সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য নানা ধরনের ‘বিজনেস মডেল’ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। সেগুলোর কোনটা কী মাত্রায় সফল হবে, তা এখন বলা খুব কঠিন। তবে একটা বিষয় সম্ভবত অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। তা হলো সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতার দিন শেষ। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ানসহ আরও কিছু সংবাদপত্র এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে আমার মনে হচ্ছে। এরা এখন বিজ্ঞাপন বাড়ানোর ওপর যত জোর দিচ্ছে, তার চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে অনলাইনের গ্রাহক বাড়ানোর দিকে, যাঁরা দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর মেয়াদে চাঁদা দিয়ে অনলাইনে পত্রিকা পড়বেন। এই ‘ডিজিটাল অনলি সাবস্ক্রিপশন’ নিউইয়র্ক টাইমস-এর অনেক বেড়েছে বলে বিদায়ী বছরে তাদের আয় কিছুটা বেড়েছে। এটাই হয়তো আগামী দিনের সংবাদপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক মডেল হয়ে উঠবে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul. alam@gmail. com
No comments