ইসলাম সম্পর্কে যা বললেন বলিভিয়ার নওমুসলিম মিখাইল
ল্যাটিন
আমেরিকার দেশ বলিভিয়ার নও-মুসলিম 'মিখাইল ক'রবখল তানসা' -এর মুসলমান হওয়ার
কাহিনী এবং ইসলাম সম্পর্কে তাঁর কিছু বক্তব্য ও চিন্তাধারা তুলে ধরা হলো:
খোদা বা স্রষ্টার পরিচয় জানা মানুষের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। মানুষ
চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা বা বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে আল্লাহর অস্তিত্বকে অনুভব
করতে পারে। মানুষের মধ্যে আল্লাহ নিজের থেকে রুহ ফুঁকে দিয়েছেন বলেই
আল্লাহর প্রতি মানুষের রয়েছে প্রকৃতিগত ঝোঁক। তাই মহান আল্লাহর স্মরণ ও
তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত ছাড়া মানুষের আত্মা প্রশান্ত হয় না। মহান আল্লাহর অসীম
সত্ত্বার প্রতি মানুষের আকর্ষণে বদলে দিয়েছে বলিভিয়ার যুবক 'মিখাইল ক'রবখল
তানসা'র জীবন।
তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন : যৌবনের শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন
জাগত আমার মধ্যে। মানুষের বিস্ময়কর নানা দিক ও বিশ্ব জগতের আকর্ষণীয় নানা
বিষয় নিয়ে ভাবতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যেমন, কোনো এক বইয়ে পড়েছিলাম মানুষ দিন ও
রাতে কয়েক হাজার বার শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকে। হাজারো রকম বিস্ময়কর
বিষয়ের মধ্যে এটা কেবল একটি বিষয়। এই জটিল ব্যবস্থাপনা কে পরিচালনা করে
থাকেন? এ প্রশ্ন আমাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। আমি নিজেই সব সময় এটা অনুভব
করতাম যে, এতসব বিস্ময়কর বিষয় অর্থহীনভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। এই ভাবনার
প্রেক্ষিতে জেগে ওঠে নতুন প্রশ্ন: জীবন-যাপনের সঠিক পদ্ধতি কী? কোন্ কারণে
বা কী লক্ষ্যে আমাদেরকে অস্তিত্বের জগতে আনা হয়েছে? মানব সৃষ্টির পেছনে
মহান আল্লাহর যে উদ্দেশ্য কাজ করছে তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইসলাম ধর্ম
সম্পর্কে গবেষণা ও অনুসন্ধান শুরু করেন বলিভিয়ার নাগরিক মিখাইল। তিনি এ
প্রসঙ্গে বলেছেন: ইসলাম সম্পর্কে তখনও কিছু জানার সুযোগ পাইনি। সামান্য
যেসব ধারণা ছিল সেসবই ছিল অস্পষ্ট। কারণ, পশ্চিমা গণমাধ্যম থেকে ইসলাম
সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিল না। এইসব প্রচার মাধ্যম ইসলামকে
সন্ত্রাসবাদের সমর্থক বলে প্রচার করে। তারা বলে, ইসলাম সহিংসতায় বিশ্বাসী
এবং নারীর অবমাননা করে। ফলে ইসলাম সম্পর্কে আমার ভাল ধারণা ছিল না। ফলে
ইসলাম নিয়ে চিন্তাভাবনা করাটা অর্থহীন বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে
বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি ঘোর বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত ছিলাম। ঘটনাক্রমে
আমার মায়ের সঙ্গে জার্মানিতে সফর করেছিলাম। আমার মা ছিলেন একজন জার্মান।
দীর্ঘ এক বছর স্থায়ী হয়েছিল সেই সফর। আমার সেইসব প্রশ্নের উত্তর জানার
চেষ্টা তখনও বজায় রেখেছিলাম। কিন্তু যতবারই চেষ্টা করতাম ততবারই অনুভব
করতাম যে ইসলাম সম্পর্কে অবশ্যই বেশি জানা উচিত এবং সে জন্য নিজেকেই
উদ্যোগী হতে হবে। ফলে জার্মানির কয়েকজন মুসলমানের সঙ্গে পরিচিত হলাম।
কিছুকাল পর কুরআন ও আরবি ভাষার প্রতি আগ্রহী হই। বলিভিয়ার নওমুসলিম মিখাইল
আরো বলেছেন: পবিত্র কুরআনের বক্তব্য ও স্টাইলের সৌন্দর্য আমাকে আকৃষ্ট
করেছিল। ফলে আরবী ভাষা শেখা শুরু করি। কিছুকাল মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশার
সুবাদে এটা বুঝতে পারি যে, মুসলমানরা খারাপ মানুষ নয় বরং তাদের পরস্পরের
মধ্যে রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, অথচ পাশ্চাত্যে এ বিষয়টি ম্লান হয়ে
গেছে। আমি এও অনুভব করছিলাম যে, আমাদের সমাজে জীবন-যাপনের পদ্ধতিতে এবং
চিন্তা-ভাবনার পদ্ধতিতে অনেক ভুল রয়েছে। আর অবশ্যই এইসব পদ্ধতি পরিবর্তিত
হওয়া উচিত। কিন্তু আমি জানতাম না এইসব সমস্যার সমাধান কি হতে পারে। মায়ের
দেশ জার্মানিতে এক বছর থাকার পর বলিভিয় যুবক মিখাইল চীন সফরের সিদ্ধান্ত
নেন। চীনে তার সফর প্রসঙ্গে মিখাইল বলেছেন: ১৯৯২ সালে চীনে সফর করি আমি।
আমার অনুসন্ধানী মন তখনও ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিল। সেখানে
ব্রাজিলের একজন মুসলমানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এক সময় তিনি ছিলেন আমার
সহপাঠী। তার সঙ্গে ইসলামসহ নানা ধর্ম নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা ও মত বিনিময়
করলাম। বলিভিয়ার নওমুসলিম মিখাইল আরো বলেছেন: আমার সেই মুসলিম সহপাঠীর
সঙ্গে এইসব আলোচনার মধ্যে আমি ইসলাম সম্পর্কে আমার নানা প্রশ্নের উত্তর
পেয়ে যাই। এরপর ইসলাম সম্পর্কে আরো গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য সচেষ্ট হই।
কারণ এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে ইসলাম চিরস্থায়ী বা চিরজীবন্ত ধর্ম। আমি এটাও
নিশ্চিত ছিলাম যে আল্লাহ আমাকে সঠিক পথ দেখাবেন এবং অবশেষে আমার সামনে খুলে
যায় হেদায়াত বা সুপথ লাভের দরজাগুলো। ইসলামের যে শিক্ষাটি মিখাইলকে আকৃষ্ট
করেছে তা হল আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের
নানা আয়াতে এই বাস্তবতা উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ মানুষের খুব কাছেই রয়েছে।
এই নৈকট্য ছাড়াও মহান আল্লাহ মানুষকে জীবনের সব ক্ষেত্রের জন্য বিধান
দিয়েছেন। অর্থাত এই দুনিয়ায় মানুষকে নিজের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়নি এবং মানুষকে
তার কাজ ও আচরণের জন্য জবাব দিতে হবে। কারণ, বিশ্ব জগতের স্রষ্টা মানুষকে
কোরেছেন আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব; আর এর পেছনে রয়েছে
গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তথা পরিপূর্ণতা ও সৌভাগ্য অর্জন করা।
মিখাইল এ প্রসঙ্গে বলেছেন: ইসলাম জীবনের সব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা
করা ও তাকে স্মরণ করার ওপর জোর দিয়েছে।
আর এ বিষয়টি আমাকে খুব আকৃষ্ট
করেছে। একজন মুসলমানের উচিত নয় কোনো কাজেই আল্লাহকে ভুলে না যাওয়া, এমনকি
তা যত ক্ষুদ্র কাজ বা বিষয়ই হোক না কেন। আমরা যদি যথাযথভাবে দৃষ্টি দেই
তাহলে দেখব যে সব নেয়ামতই এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন
মানুষকে এবং মানুষের জীবনে যা যা দরকার তার সবই তিনি তাকে দিয়েছেন। তাই
জীবন যাপনের নানা পর্যায়ে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে এসেছে, আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি মেহেরবান।
এমনকি কুরআনের আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি তোমাদের শাহরগের চেয়েও বেশি
কাছে রয়েছি। আমি বিস্মিত হই যে মানুষ কিভাবে জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে আল্লাহকে
ভুলে যেতে পারে? অথচ আমার বিশ্বাস হল, মানুষ প্রতিটি নিঃশ্বাস নেয়ার সময়
আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের কথা স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারে। ইসলামের ছায়াতলে
লক্ষ্য ও অর্থপূর্ণ জীবন প্রসঙ্গে বলিভিয়ার নওমুসলিম মিখাইল বলেছেন:
মুসলমান হওয়ার পর সবার ব্যাপারেই দায়িত্বশীলতা অনুভব করছি। আমি অন্যদের
কাছেও বিশেষ করে বলিভিয়ার জনগণের কাছেও ইসলামের আলো তুলে ধরতে চাই।
অন্যদেরকে এ ব্যাপারে এমন সুযোগ দেয়া উচিত যাতে তারা ইসলাম সম্পর্কে
গবেষণা, বিতর্ক বা আলোচনায় লিপ্ত হয়। আমাদের উচিত অত্যন্ত ভদ্রভাবে ও কোমল
বক্তব্যের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত আলোচনা করা। ইসলাম সম্পর্কে অনেক সুন্দর কথা
রয়েছে যা আমি আমার দেশবাসীর কাছে খুলে বলব। অবশ্য আমাকে এ জন্য পড়াশোনার
মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হবে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর মিখাইল নিজের জন্য
মুহাম্মাদ নামটি বেছে নিয়েছেন। তিনি মুসলমান হতে পারাকে আল্লাহর দয়া ও
অনুগ্রহ বলে মনে করেন। মিখাইল বলেন: আসলে আমার বলিভিয়া থেকে চীন সফরের
মধ্যে আল্লাহর কোনো হেকমাত ছিল এবং একটি অমুসলিম দেশেই আমি ইসলামের সঙ্গে
পরিচিত হই।
No comments