বিএনপির ভেতরে–বাইরে নানা প্রশ্ন by সেলিম জাহিদ
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাঝপথে ভোট বর্জন এবং কেন্দ্রে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্ট ও নেতা-কর্মীদের ব্যাপক অনুপস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ওঠা নানা প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা বিএনপি থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা রাজনৈতিক কৌশল ছিল কি না, তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। আবার নির্বাচন বর্জনের পরও বিপুল ভোট পাওয়া নিয়েও তাদের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
নির্বাচন সমন্বয়ে থাকা বিএনপির নেতারা অবশ্য দাবি করেছেন, নির্বাচন বর্জনের জন্য আগে থেকে দলের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি দেখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য দলীয় প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁরা আরও দাবি করেছেন, মেয়র পদপ্রার্থীদের পাওয়া ভোটগুলোও তাঁদের নয়। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে দল-সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্ট ও নেতা-কর্মীদের ব্যাপক অনুপস্থিতি নিয়ে বিএনপির ভেতরেই এখন আত্মসমালোচনা তীব্র হচ্ছে। অন্যদিকে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বের প্রকট রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ব্যর্থতাও প্রকাশ পেয়েছে।
এজেন্ট ও নেতা-কর্মীদের কেন্দ্রে না যাওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্যে হয়রানি ও ভয়ভীতির অভিযোগ করলেও নির্বাচনের পর একাধিক প্রার্থী ও বিএনপির নেতা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন, খরচাপাতির চাহিদা মেটানো হলেও নির্ধারিত এজেন্ট ও দলের নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রে যাননি। গতকাল বুধবার ঢাকার একজন মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে গেলে এজেন্ট ও দলের নেতা-কর্মীদের কেন্দ্রে না যাওয়া নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে দেখা যায়। এ সময় মেয়র প্রার্থীর এক সমর্থক ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রশ্ন করেন, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কয়েকজন এজেন্ট ও বিএনপির নেতা-কর্মী মার খেয়েছেন।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের ৯০ ভাগ এজেন্টকেই ভোটকেন্দ্রে পাওয়া যায়নি। নির্বাচনের দিন প্রথম আলোর ৪১ জন প্রতিবেদক ও আলোকচিত্র সাংবাদিক সারা দিনে তিন সিটির ৪০৬টি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তাতে মাত্র ১৬৬টি কেন্দ্রে দিনের কোনো না কোনো সময় বিএনপি-সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টদের দেখেন।
অবশ্য বিএনপি-সমর্থিত এজেন্টদের কেন্দ্রে না যাওয়া এবং আকস্মিকভাবে বিএনপির নির্বাচন বর্জনকে ‘সাজানো’ ও ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বলছে সরকার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সিলেটে বলেন, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও বর্জন ছিল একটি সাজানো নাটক। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে বিএনপির নীরব ভোটবিপ্লবের ডাক দেওয়া ও নীরবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘটনা রহস্যজনক। নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদও বলেছেন, বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের কাছ থেকে কমিশন কোনো অভিযোগ পায়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের অন্যতম নির্বাচন সমন্বয়কারী আবদুল্লাহ আল হারুন জানান, সকাল ১০টায় তাঁরা প্রথম অভিযোগ দায়ের করেন এবং দুপুরের মধ্যে অন্তত ২০টি অভিযোগ জমা দিয়ে সেগুলোর স্বীকৃতিপত্র নিয়েছেন। তাঁরা আরও ৫০টির মতো অভিযোগ দাখিল করতে গেলেও সেগুলো গ্রহণ করা হয়নি। অপর প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষ থেকেও তিনটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
নির্বাচন বর্জনের ঘটনা সাজানো নাটক বলে যে সমালোচনা উঠেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে গেছি জয়ী হওয়ার জন্য। হেরে যাওয়ার জন্য নয়, বর্জন করার জন্য নয়।’
বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীসহ নির্বাচনের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা নেতারা ভোটের কয়েক দিন আগে থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন যে দলের নেতা-কর্মী ও নির্বাচনী এজেন্টদের ঘরে ঘরে গিয়ে পুলিশ হুমকি দিচ্ছে। গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। সর্বশেষ ভোটের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রে যে এজেন্ট ছিল না, সে বিষয়ে তাঁদের অভিযোগ হচ্ছে, বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্টদের বেশির ভাগকে কেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। যাঁরা কেন্দ্রে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কিছু এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে টেনেহিঁচড়ে আটকও করা হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেন, সিটি নির্বাচনে দলের নেতা-কর্মীদের জন্য একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতি ছিল এটা সত্য। এর চেয়েও সত্য হচ্ছে, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকায় বিএনপির সাংগঠনিক দৈন্যের পাশাপাশি দলের প্রতি নেতা-কর্মীদের উদাসীনতা আরেক দফা খোলাসা হয়েছে। অথচ ভোটের এক দিন আগে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নেতা-কর্মী ও জনগণকে ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসাতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করতে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্বাচনের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপি এজেন্ট রাখতে পারেনি। নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী মাঠে ছিলেন না। গ্রেপ্তার-আতঙ্কে প্রায় সবাই ছিলেন চুপচাপ।
জানা গেছে, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে সিটি নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির প্রতিবাদে হরতালের মতো কর্মসূচিতে যেতে চাইছে না বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকেরা দলকে আবার সংগঠিত করে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করতেই আগ্রহী। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর ২০-দলীয় জোটের সভা আহ্বান করা হতে পারে।
নির্বাচন সমন্বয়ে যুক্ত নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা যদি মাঠে থাকতেন তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। এ কারণে ভোট শুরুর সাড়ে চার ঘণ্টা পর নির্বাচন থেকে বিএনপির সরে দাঁড়ানো নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। কারণ, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনে কোনো অভিযোগ জানানো হয়নি। তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, যাঁরা প্রশ্ন তোলার, তাঁরা সকাল নয়টায় বর্জন করলেও প্রশ্ন তুলতেন, বিকেল তিনটায় করলেও তুলতেন। নির্বাচনের দিন তাঁরা যেসব অভিযোগ দিয়েছেন, সেগুলোর একটির ব্যাপারেও কমিশন পদক্ষেপ নেয়নি। তাঁরা এ-ও বলছেন, প্রায় সব প্রার্থী নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি করেছিলেন। সেনা মোতায়েন করা হলে এত প্রশ্ন ওঠার সুযোগই থাকত না।
নির্বাচন বর্জন করাটা পরিকল্পিত কি না, জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না।’ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাই যদি হতো বিএনপির চেয়ারপারসন এত পরিশ্রম করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইতেন না। তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ভোট দিয়ে গণনা পর্যন্ত কেন্দ্রে থেকে রায় বুঝে নিতে। নির্বাচন বর্জন আমাদের চিন্তাতেই ছিল না।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, নির্বাচন বর্জন করা হয় যখন দেখা যায় নির্বাচনই হচ্ছে না। তাহলে সেখানে থাকার তো কোনো যুক্তি নেই।
নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের বিপুল ভোট নিয়েও রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি, মাঝপথে নির্বাচন বর্জন ও মাঠে না থাকার পরও বিএনপি-সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী বিপুল ভোট পেয়েছেন। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট পান। বিপরীতে বিএনপি-সমর্থিত তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। ঢাকা দক্ষিণে সাঈদ খোকন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়েছেন। মির্জা আব্বাস পেয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। আর চট্টগ্রামে বিএনপি-সমর্থিত মনজুর আলম পেয়েছেন ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত ১৯ জন পুরুষ ও নারী কাউন্সিলর প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এ তিন সিটিতে জামায়াত-সমর্থিত তিনজন নারী কাউন্সিলর জয়ী হয়েছেন। ভোট বর্জন করেও দল-সমর্থিত প্রার্থীরা এত ভোট কীভাবে পেলেন, কাউন্সিলররা কীভাবে জিতলেন? এ নিয়ে বিএনপিতে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও বিস্মিত হয়েছেন।
অবশ্য নির্বাচন সমন্বয়ে যুক্ত বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করছেন সরকার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য দেখাতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের কিছু ভোট দিয়েছে। কারণ, বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-কর্মী ১০টার পর কেন্দ্রেই যাননি। তাই এত ভোট পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
নির্বাচন সমন্বয়ে থাকা বিএনপির নেতারা অবশ্য দাবি করেছেন, নির্বাচন বর্জনের জন্য আগে থেকে দলের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি দেখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য দলীয় প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁরা আরও দাবি করেছেন, মেয়র পদপ্রার্থীদের পাওয়া ভোটগুলোও তাঁদের নয়। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে দল-সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্ট ও নেতা-কর্মীদের ব্যাপক অনুপস্থিতি নিয়ে বিএনপির ভেতরেই এখন আত্মসমালোচনা তীব্র হচ্ছে। অন্যদিকে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বের প্রকট রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ব্যর্থতাও প্রকাশ পেয়েছে।
এজেন্ট ও নেতা-কর্মীদের কেন্দ্রে না যাওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্যে হয়রানি ও ভয়ভীতির অভিযোগ করলেও নির্বাচনের পর একাধিক প্রার্থী ও বিএনপির নেতা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন, খরচাপাতির চাহিদা মেটানো হলেও নির্ধারিত এজেন্ট ও দলের নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রে যাননি। গতকাল বুধবার ঢাকার একজন মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে গেলে এজেন্ট ও দলের নেতা-কর্মীদের কেন্দ্রে না যাওয়া নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে দেখা যায়। এ সময় মেয়র প্রার্থীর এক সমর্থক ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রশ্ন করেন, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কয়েকজন এজেন্ট ও বিএনপির নেতা-কর্মী মার খেয়েছেন।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের ৯০ ভাগ এজেন্টকেই ভোটকেন্দ্রে পাওয়া যায়নি। নির্বাচনের দিন প্রথম আলোর ৪১ জন প্রতিবেদক ও আলোকচিত্র সাংবাদিক সারা দিনে তিন সিটির ৪০৬টি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তাতে মাত্র ১৬৬টি কেন্দ্রে দিনের কোনো না কোনো সময় বিএনপি-সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টদের দেখেন।
অবশ্য বিএনপি-সমর্থিত এজেন্টদের কেন্দ্রে না যাওয়া এবং আকস্মিকভাবে বিএনপির নির্বাচন বর্জনকে ‘সাজানো’ ও ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বলছে সরকার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সিলেটে বলেন, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও বর্জন ছিল একটি সাজানো নাটক। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে বিএনপির নীরব ভোটবিপ্লবের ডাক দেওয়া ও নীরবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘটনা রহস্যজনক। নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদও বলেছেন, বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের কাছ থেকে কমিশন কোনো অভিযোগ পায়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের অন্যতম নির্বাচন সমন্বয়কারী আবদুল্লাহ আল হারুন জানান, সকাল ১০টায় তাঁরা প্রথম অভিযোগ দায়ের করেন এবং দুপুরের মধ্যে অন্তত ২০টি অভিযোগ জমা দিয়ে সেগুলোর স্বীকৃতিপত্র নিয়েছেন। তাঁরা আরও ৫০টির মতো অভিযোগ দাখিল করতে গেলেও সেগুলো গ্রহণ করা হয়নি। অপর প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষ থেকেও তিনটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
নির্বাচন বর্জনের ঘটনা সাজানো নাটক বলে যে সমালোচনা উঠেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে গেছি জয়ী হওয়ার জন্য। হেরে যাওয়ার জন্য নয়, বর্জন করার জন্য নয়।’
বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীসহ নির্বাচনের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা নেতারা ভোটের কয়েক দিন আগে থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন যে দলের নেতা-কর্মী ও নির্বাচনী এজেন্টদের ঘরে ঘরে গিয়ে পুলিশ হুমকি দিচ্ছে। গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। সর্বশেষ ভোটের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রে যে এজেন্ট ছিল না, সে বিষয়ে তাঁদের অভিযোগ হচ্ছে, বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্টদের বেশির ভাগকে কেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। যাঁরা কেন্দ্রে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কিছু এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে টেনেহিঁচড়ে আটকও করা হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেন, সিটি নির্বাচনে দলের নেতা-কর্মীদের জন্য একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতি ছিল এটা সত্য। এর চেয়েও সত্য হচ্ছে, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকায় বিএনপির সাংগঠনিক দৈন্যের পাশাপাশি দলের প্রতি নেতা-কর্মীদের উদাসীনতা আরেক দফা খোলাসা হয়েছে। অথচ ভোটের এক দিন আগে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নেতা-কর্মী ও জনগণকে ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসাতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করতে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্বাচনের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপি এজেন্ট রাখতে পারেনি। নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী মাঠে ছিলেন না। গ্রেপ্তার-আতঙ্কে প্রায় সবাই ছিলেন চুপচাপ।
জানা গেছে, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে সিটি নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির প্রতিবাদে হরতালের মতো কর্মসূচিতে যেতে চাইছে না বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকেরা দলকে আবার সংগঠিত করে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করতেই আগ্রহী। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর ২০-দলীয় জোটের সভা আহ্বান করা হতে পারে।
নির্বাচন সমন্বয়ে যুক্ত নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা যদি মাঠে থাকতেন তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। এ কারণে ভোট শুরুর সাড়ে চার ঘণ্টা পর নির্বাচন থেকে বিএনপির সরে দাঁড়ানো নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। কারণ, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনে কোনো অভিযোগ জানানো হয়নি। তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, যাঁরা প্রশ্ন তোলার, তাঁরা সকাল নয়টায় বর্জন করলেও প্রশ্ন তুলতেন, বিকেল তিনটায় করলেও তুলতেন। নির্বাচনের দিন তাঁরা যেসব অভিযোগ দিয়েছেন, সেগুলোর একটির ব্যাপারেও কমিশন পদক্ষেপ নেয়নি। তাঁরা এ-ও বলছেন, প্রায় সব প্রার্থী নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি করেছিলেন। সেনা মোতায়েন করা হলে এত প্রশ্ন ওঠার সুযোগই থাকত না।
নির্বাচন বর্জন করাটা পরিকল্পিত কি না, জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না।’ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাই যদি হতো বিএনপির চেয়ারপারসন এত পরিশ্রম করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইতেন না। তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ভোট দিয়ে গণনা পর্যন্ত কেন্দ্রে থেকে রায় বুঝে নিতে। নির্বাচন বর্জন আমাদের চিন্তাতেই ছিল না।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, নির্বাচন বর্জন করা হয় যখন দেখা যায় নির্বাচনই হচ্ছে না। তাহলে সেখানে থাকার তো কোনো যুক্তি নেই।
নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের বিপুল ভোট নিয়েও রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি, মাঝপথে নির্বাচন বর্জন ও মাঠে না থাকার পরও বিএনপি-সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী বিপুল ভোট পেয়েছেন। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট পান। বিপরীতে বিএনপি-সমর্থিত তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। ঢাকা দক্ষিণে সাঈদ খোকন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়েছেন। মির্জা আব্বাস পেয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। আর চট্টগ্রামে বিএনপি-সমর্থিত মনজুর আলম পেয়েছেন ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত ১৯ জন পুরুষ ও নারী কাউন্সিলর প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এ তিন সিটিতে জামায়াত-সমর্থিত তিনজন নারী কাউন্সিলর জয়ী হয়েছেন। ভোট বর্জন করেও দল-সমর্থিত প্রার্থীরা এত ভোট কীভাবে পেলেন, কাউন্সিলররা কীভাবে জিতলেন? এ নিয়ে বিএনপিতে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও বিস্মিত হয়েছেন।
অবশ্য নির্বাচন সমন্বয়ে যুক্ত বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করছেন সরকার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য দেখাতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের কিছু ভোট দিয়েছে। কারণ, বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-কর্মী ১০টার পর কেন্দ্রেই যাননি। তাই এত ভোট পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
No comments