যা ঘটল তা কারও জন্য মঙ্গলজনক নয় -সাক্ষাৎকারে এ টি এম শামসুল হুদা by মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো: তিন সিটি নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
এ টি এম শামসুল হুদা: আমি ব্যক্তিগতভাবে সিটি নির্বাচন নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলাম। দেশজুড়ে একটা ভয়াবহ সন্ত্রাস নেমেছিল, দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে সিটি নির্বাচনের ঘোষণা এসেছিল এবং তাতে অংশগ্রহণে বিএনপির আগ্রহের ফলে মনে হয়েছিল গণতন্ত্র যেভাবে লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছিল, সেটা বুঝি আবার লাইনে আসবে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্রের একটা নতুন সূচনা হবে। গত মঙ্গলবার দুপুরের আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল যেভাবে সব দল মিলে নির্বাচন করেছে, একসঙ্গে গলাগলি করেছেন, তাতে আমরা একটা সুস্থ ধরায় ফিরে যাচ্ছি।
কিন্তু এই প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি দেখা গেল। অনেক কেন্দ্রে একমাত্র সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্যদের পোলিং এজেন্ট ছিল না। এ বিষয়ে অভিযোগ হলো, আগের রাতে অনেক পোলিং এজেন্টের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের ভয়ভীতি দেখিয়ে না আসতে বলা হয়েছে। তার পরও যাঁরা এসেছেন তাঁদের অনেককে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আবার অনেককে বের করে দেওয়া হয়েছে। পোলিং এজেন্ট ভোট গ্রহণের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কারণ, তাঁরা দেখেন যে ভোটাররা এলেন কি না, ভোট গ্রহণপ্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো গলদ হলো কি না। কিংবা জাল ভোট দেওয়ার কোনো চেষ্টা চলছে কি না—তাঁরাই সব সময় এটা অণুবীক্ষণ করেন। সেটা ঘটেনি। এরপর তৃতীয় চোখ হিসেবে ছিলেন সাংবাদিকেরা। কিন্তু অনেক স্থানে বুথে তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কোথাও তাঁরা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আবার কেন এটাই হলো নির্বাচন পরিচালনার অস্বাভাবিকতা। এসব তো একদমই অনভিপ্রেত ছিল। এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে তা অবশ্যই ব্যাহত করেছে।
প্রথম আলো: নির্বাহী হাকিমদের ভূমিকা কেমন ছিল ?
শামসুল হুদা: আমাদের সময় এই নির্বাহী হাকিমরা যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। কেউ কোথাও কোনো বিধিবিধান লঙ্ঘন করলে তার বিচার করে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিয়েছেন। এবারে সেখানে দুর্বলতা লক্ষণীয়। বিরোধী দলের তোলা অভিযোগের বিষয়ে তাঁরা কখন কী ব্যবস্থা নিলেন, তা অজ্ঞাত। আদৌ তদন্ত হলো কি না, জানা গেল না। অথচ ইসি দাবি করেছে ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। কোথাও কোনো অভিযোগ আসেনি। এখন প্রশ্ন হলো, যদি কোনো অভিযোগ না-ই আসবে তাহলে টিভিতে যে আমরা দেখলাম, একের পর এক প্রার্থী অভিযোগ তুললেন, সেগুলো কি তাহলে অভিযোগ ছিল না? তাহলে সেসব অভিযোগের কোনো প্রতিকার কেন হলো না।
প্রথম আলো: বিএনপির বর্জনের সিদ্ধান্ত?
শামসুল হুদা: এটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। বর্জনের ফল কখনো কারও জন্য ভালো হয় না। এটা অবিবেচনাপ্রসূত ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। মেয়রের ভোট বর্জন করে কাউন্সিলরদের বিষয়ে কিছু বলা হলো না। তাহলে তাঁদের কাউন্সিলর প্রার্থীরা এই নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় টিকেছিলেন বলে গণ্য হবে? যাঁরা দিনের দ্বিতীয় ভাগে ভোট দিতে যাবেন বলে মনস্থির করেছিলেন, তাঁরা তো বিফল মনোরথ হলেন। অনেকে হয়তো মেয়র প্রার্থী নেই জেনে ভোট দিতে যাননি, গেলে হয়তো কাউন্সিলরদের ভোট দিতেন। ভোটের পর ফলাফল প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ তো খোলাই ছিল।
প্রথম আলো: যদি ভোট হয়েই যেত তারপর তা প্রত্যাখ্যান করে কী লাভ হতো?
শামসুল হুদা: তারা তাদের অভিযোগসমূহ প্রিসাইডিং অফিসার, রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে লিপিবদ্ধ করে লিখতে পারত। তারপর ভোট গ্রহণ শেষ হওয়া মাত্র তারা তাদের অবস্থান প্রকাশ করতে পারত। এর কারণ হলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে দল লাভবান হয়। দলীয় কর্মীদের মধ্যে একটা চাঙা ভাব আসে। সংগঠন শক্তিশালী হয়। এখন মাঝপথে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হতোদ্যম হলেন এবং অনেকের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত ক্ষোভ ও উষ্মার সৃষ্টি করেছে। জানা যায়, বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে এটা ঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। সুতরাং বিরোধী দলের নিজেদের স্বার্থে এই নির্বাচনপ্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত যেতে দেওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। তারা আরও বলতে পারত যে আমরা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আশ্বাসে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। এখন জনগণের মধ্যে একটা ধোঁয়াশা থেকে গেল।
প্রথম আলো: অনেকের সন্দেহ এত ভোট কীভাবে এল? আমাদের রাজনীতির প্রচলিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আপনার অজানা নয়।
শামসুল হুদা: দুপুর ১২টায় ভোট বর্জনের পরেও তারা উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছে। মানুষ বুঝতে পারছে না যে ভোট বর্জন না করলে কী হতো। তাদের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রচুর ভোট পেয়েছেন। হ্যাঁ। পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু বিএনপির অভিযোগ হচ্ছে যে ক্ষমতাসীন দল-সমর্থকেরা কারচুপি করেছে। তাহলে নিশ্চয় তারা বিরোধী দল-সমর্থকদের পক্ষে বাক্স ভরেনি। আমার এই অনুমানের ভিত্তি হলো আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা। এরশাদের আমলের নির্বাচনের ফলাফলেও আমরা দেখি, যাকে পরাজিত করা হয়েছে তার পক্ষে তেমন কোনো ভোটই পড়েনি। এখানেও আমার এটা মনে হয় না যে কথিতমতে সরকারদলীয় লোক যারা এটা করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তারা একটা কৃত্রিম ভারসাম্য সৃষ্টি করার জন্য নিজেদের প্রার্থীদের পক্ষে সিল মারার পাশাপাশি বিএনপির প্রার্থীদের পক্ষেও ব্যালটে সিল মেরেছে। সেটা আমি মনে করছি না। আমি মনে করি ভোটের যে পরিমাণ বিএনপির সমর্থকেরা পেয়েছে বলে দেখানো হয়েছে, সে পরিমাণ ভোট তারা প্রকৃতপক্ষেই পেয়েছে। তাই আমার মনে হয়, অনেক ধরনের জটিলতা সত্ত্বেও এবারের নির্বাচন ভালোই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। বিএনপি কিন্তু শুরুটাই করেছে অনেক দুর্বলতা নিয়ে। প্রথমেই হোঁচট খেল তাদের অন্যতম মুখ্য প্রার্থীর (আবদুল আউয়াল মিন্টু) মনোনয়ন বাতিলের মধ্য দিয়ে।
প্রথম আলো: তাঁর মনোনয়নপত্রের একটা টেকনিক্যাল ত্রুটি কি ইসির পক্ষে এড়ানো একেবারেই অসম্ভব ছিল?
শামসুল হুদা: এ-বিষয়ক আইনটা খুব পরিষ্কার ছিল। তাই সম্ভব ছিল না। আরেক প্রার্থী (মির্জা আব্বাস) পুরো প্রচারাভিযানে তাঁর নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে হাজিরই হতে পারলেন না। তাঁর স্ত্রী প্রচারণা চালালেন। এখানেই তো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকল না। মাঠ সমতলের দায়িত্ব কেবল ইসির নয়, এটা সামগ্রিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। নির্বাচনের আগে বিএনপির অভ্যন্তরীণ ও সাংগঠনিক দুর্বলতার আলামত পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছিল। সে কারণেই আমি বলছি, এত বেশি প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা যে ভোট পেয়েছে, তা প্রমাণ করে যে বর্জন দরকার ছিল না। এর আগে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে তারা কৌশলগত বিরাট ভুল করেছিল।
আফ্রিকায় একটা সময় ছিল যখন নির্বাচন বয়কট চলেছে। কিন্তু তারা বহু মূল্য দিয়ে শিখেছে যে বয়কটে ফায়দা নেই। আফ্রিকা বয়কট ভুলেছে কারণ তারা বুঝেছে বয়কট করে চূড়ান্ত পরিণামে লাভ হয় না। নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় থাকলে হয়তো কখনো পুরো লাভ হয় না। কিন্তু দলগুলোকে চাঙা রাখতে সুবিধা হয়। বিএনপি যেটা করল তাতে দেশের গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগত দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকেও ভালো হয়নি। ২৫ ভাগ স্বতন্ত্র ভোটারকে হয়তো তাঁদের ভোট দেওয়ার অধিকার ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হলো। প্রত্যাখ্যান ও প্রতিবাদের অন্য আরও উপায় আছে। চট্টগ্রামের বিদায়ী মেয়রের রাজনৈতিক পটভূমি আমার জানা নেই। তিনি আবার রাজনীতি থেকেই অবসরের ঘোষণা দিলেন। আমি সার্বিক বিচারে বলতে চাই, যা ঘটে গেল তা আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং ইসি কারও জন্যই মঙ্গলজনক হয়নি।
প্রথম আলো: স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচন আপনি করে এসেছেন। ইসির ভূমিকা সম্পর্কে নির্দিষ্ট মন্তব্য করুন। তারা বলেছিল প্রয়োজন হলেই সেনাবাহিনী নামানো হবে।
শামসুল হুদা: হ্যাঁ, সেটা তারা করেনি। তবে সরকারি হস্তক্ষেপের কথা যতই বলা হোক, চূড়ান্ত দায় ইসির ওপর বর্তায়। কালকেই হয়তো সরকার বলবে, নির্বাচন পরিচালনা করে ইসি। তাদের চাহিদামতো আমরা সব দিয়েছি। তাদের আমরা ৮২ হাজার পুলিশ, ২০০ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েছি। শতকোটি টাকা দিয়েছি। সেনা মোতায়েন করতে চেয়েছে। সরকার বলে দিয়েছে আচ্ছা আর্মি নামাও।
আমাদের সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাই আমরা নিজেদের মতো চলার চেষ্টা করেছি। বুঝেই নিয়েছি, বিপদকালে আমার পক্ষে কথা বলার জন্য কেউ থাকবে না। এতগুলো পোলিং এজেন্ট কেন থাকল না, সাংবাদিক নিগ্রহ কেন ঘটল; অভিযোগ উঠল যে একটা অজানা সংস্থার ৫০০ লোককে পর্যবেক্ষক করা হয়েছে, এসব কি তদন্ত করে তারা জনগণকে জানিয়েছে? পুলিশকে বরং বলতে শোনা গেছে সব ঠিক আছে। পুরো নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আচরণবিধির অব্যাহত লঙ্ঘন ঘটেছে। এ ধরনের ক্রিয়াকাণ্ড কিন্তু ইসির নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই দেশকে গণতন্ত্রের পথে নেওয়ার জন্য ইসির যে দায়িত্ব আছে, সেই দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করেছে কি না, সেটা নিয়ে লোকে অনেক দিন ধরে প্রশ্ন করতে থাকবে।
প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নির্বাচনের কথিত কারচুপি খতিয়ে দেখতে তদন্ত চাইছে। ইসি এটা করতে পারে?
শামসুল হুদা: নির্বাচনী অনিয়মের জন্য তো সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে ইসিতে দরখাস্ত করতে হবে। সেটা কি প্রার্থীরা করেছেন?
প্রথম আলো: না করলেও গণমাধ্যমে অনেক কিছু ছাপা হয়েছে। বিচারকেরা পত্রিকার রিপোর্টের ভিত্তিতে যেভাবে সুয়োমোটো আমলে নেন, প্রচলিত আইনে ইসি তেমন পদক্ষেপ নিতে পারে কি না?
শামসুল হুদা: বিদ্যমান নির্বাচনী আইনে এটা সম্ভব। নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে।
প্রথম আলো: আর কোনো মন্তব্য?
এ টি এম শামসুল হুদা: আমি একটা নতুন আশার স্বপ্ন এঁকেছিলাম, সেখানে হতাশায় নিমজ্জিত হলাম। নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাকে আবার একসঙ্গে করে চাঙা করা অনেক কঠিন কাজ।
এ টি এম শামসুল হুদা: আমি ব্যক্তিগতভাবে সিটি নির্বাচন নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলাম। দেশজুড়ে একটা ভয়াবহ সন্ত্রাস নেমেছিল, দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে সিটি নির্বাচনের ঘোষণা এসেছিল এবং তাতে অংশগ্রহণে বিএনপির আগ্রহের ফলে মনে হয়েছিল গণতন্ত্র যেভাবে লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছিল, সেটা বুঝি আবার লাইনে আসবে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্রের একটা নতুন সূচনা হবে। গত মঙ্গলবার দুপুরের আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল যেভাবে সব দল মিলে নির্বাচন করেছে, একসঙ্গে গলাগলি করেছেন, তাতে আমরা একটা সুস্থ ধরায় ফিরে যাচ্ছি।
কিন্তু এই প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি দেখা গেল। অনেক কেন্দ্রে একমাত্র সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্যদের পোলিং এজেন্ট ছিল না। এ বিষয়ে অভিযোগ হলো, আগের রাতে অনেক পোলিং এজেন্টের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের ভয়ভীতি দেখিয়ে না আসতে বলা হয়েছে। তার পরও যাঁরা এসেছেন তাঁদের অনেককে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আবার অনেককে বের করে দেওয়া হয়েছে। পোলিং এজেন্ট ভোট গ্রহণের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কারণ, তাঁরা দেখেন যে ভোটাররা এলেন কি না, ভোট গ্রহণপ্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো গলদ হলো কি না। কিংবা জাল ভোট দেওয়ার কোনো চেষ্টা চলছে কি না—তাঁরাই সব সময় এটা অণুবীক্ষণ করেন। সেটা ঘটেনি। এরপর তৃতীয় চোখ হিসেবে ছিলেন সাংবাদিকেরা। কিন্তু অনেক স্থানে বুথে তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কোথাও তাঁরা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আবার কেন এটাই হলো নির্বাচন পরিচালনার অস্বাভাবিকতা। এসব তো একদমই অনভিপ্রেত ছিল। এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে তা অবশ্যই ব্যাহত করেছে।
প্রথম আলো: নির্বাহী হাকিমদের ভূমিকা কেমন ছিল ?
শামসুল হুদা: আমাদের সময় এই নির্বাহী হাকিমরা যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। কেউ কোথাও কোনো বিধিবিধান লঙ্ঘন করলে তার বিচার করে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিয়েছেন। এবারে সেখানে দুর্বলতা লক্ষণীয়। বিরোধী দলের তোলা অভিযোগের বিষয়ে তাঁরা কখন কী ব্যবস্থা নিলেন, তা অজ্ঞাত। আদৌ তদন্ত হলো কি না, জানা গেল না। অথচ ইসি দাবি করেছে ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। কোথাও কোনো অভিযোগ আসেনি। এখন প্রশ্ন হলো, যদি কোনো অভিযোগ না-ই আসবে তাহলে টিভিতে যে আমরা দেখলাম, একের পর এক প্রার্থী অভিযোগ তুললেন, সেগুলো কি তাহলে অভিযোগ ছিল না? তাহলে সেসব অভিযোগের কোনো প্রতিকার কেন হলো না।
প্রথম আলো: বিএনপির বর্জনের সিদ্ধান্ত?
শামসুল হুদা: এটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। বর্জনের ফল কখনো কারও জন্য ভালো হয় না। এটা অবিবেচনাপ্রসূত ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। মেয়রের ভোট বর্জন করে কাউন্সিলরদের বিষয়ে কিছু বলা হলো না। তাহলে তাঁদের কাউন্সিলর প্রার্থীরা এই নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় টিকেছিলেন বলে গণ্য হবে? যাঁরা দিনের দ্বিতীয় ভাগে ভোট দিতে যাবেন বলে মনস্থির করেছিলেন, তাঁরা তো বিফল মনোরথ হলেন। অনেকে হয়তো মেয়র প্রার্থী নেই জেনে ভোট দিতে যাননি, গেলে হয়তো কাউন্সিলরদের ভোট দিতেন। ভোটের পর ফলাফল প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ তো খোলাই ছিল।
প্রথম আলো: যদি ভোট হয়েই যেত তারপর তা প্রত্যাখ্যান করে কী লাভ হতো?
শামসুল হুদা: তারা তাদের অভিযোগসমূহ প্রিসাইডিং অফিসার, রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে লিপিবদ্ধ করে লিখতে পারত। তারপর ভোট গ্রহণ শেষ হওয়া মাত্র তারা তাদের অবস্থান প্রকাশ করতে পারত। এর কারণ হলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে দল লাভবান হয়। দলীয় কর্মীদের মধ্যে একটা চাঙা ভাব আসে। সংগঠন শক্তিশালী হয়। এখন মাঝপথে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হতোদ্যম হলেন এবং অনেকের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত ক্ষোভ ও উষ্মার সৃষ্টি করেছে। জানা যায়, বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে এটা ঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। সুতরাং বিরোধী দলের নিজেদের স্বার্থে এই নির্বাচনপ্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত যেতে দেওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। তারা আরও বলতে পারত যে আমরা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আশ্বাসে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। এখন জনগণের মধ্যে একটা ধোঁয়াশা থেকে গেল।
প্রথম আলো: অনেকের সন্দেহ এত ভোট কীভাবে এল? আমাদের রাজনীতির প্রচলিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আপনার অজানা নয়।
শামসুল হুদা: দুপুর ১২টায় ভোট বর্জনের পরেও তারা উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছে। মানুষ বুঝতে পারছে না যে ভোট বর্জন না করলে কী হতো। তাদের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রচুর ভোট পেয়েছেন। হ্যাঁ। পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু বিএনপির অভিযোগ হচ্ছে যে ক্ষমতাসীন দল-সমর্থকেরা কারচুপি করেছে। তাহলে নিশ্চয় তারা বিরোধী দল-সমর্থকদের পক্ষে বাক্স ভরেনি। আমার এই অনুমানের ভিত্তি হলো আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা। এরশাদের আমলের নির্বাচনের ফলাফলেও আমরা দেখি, যাকে পরাজিত করা হয়েছে তার পক্ষে তেমন কোনো ভোটই পড়েনি। এখানেও আমার এটা মনে হয় না যে কথিতমতে সরকারদলীয় লোক যারা এটা করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তারা একটা কৃত্রিম ভারসাম্য সৃষ্টি করার জন্য নিজেদের প্রার্থীদের পক্ষে সিল মারার পাশাপাশি বিএনপির প্রার্থীদের পক্ষেও ব্যালটে সিল মেরেছে। সেটা আমি মনে করছি না। আমি মনে করি ভোটের যে পরিমাণ বিএনপির সমর্থকেরা পেয়েছে বলে দেখানো হয়েছে, সে পরিমাণ ভোট তারা প্রকৃতপক্ষেই পেয়েছে। তাই আমার মনে হয়, অনেক ধরনের জটিলতা সত্ত্বেও এবারের নির্বাচন ভালোই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। বিএনপি কিন্তু শুরুটাই করেছে অনেক দুর্বলতা নিয়ে। প্রথমেই হোঁচট খেল তাদের অন্যতম মুখ্য প্রার্থীর (আবদুল আউয়াল মিন্টু) মনোনয়ন বাতিলের মধ্য দিয়ে।
প্রথম আলো: তাঁর মনোনয়নপত্রের একটা টেকনিক্যাল ত্রুটি কি ইসির পক্ষে এড়ানো একেবারেই অসম্ভব ছিল?
শামসুল হুদা: এ-বিষয়ক আইনটা খুব পরিষ্কার ছিল। তাই সম্ভব ছিল না। আরেক প্রার্থী (মির্জা আব্বাস) পুরো প্রচারাভিযানে তাঁর নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে হাজিরই হতে পারলেন না। তাঁর স্ত্রী প্রচারণা চালালেন। এখানেই তো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকল না। মাঠ সমতলের দায়িত্ব কেবল ইসির নয়, এটা সামগ্রিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। নির্বাচনের আগে বিএনপির অভ্যন্তরীণ ও সাংগঠনিক দুর্বলতার আলামত পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছিল। সে কারণেই আমি বলছি, এত বেশি প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা যে ভোট পেয়েছে, তা প্রমাণ করে যে বর্জন দরকার ছিল না। এর আগে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে তারা কৌশলগত বিরাট ভুল করেছিল।
আফ্রিকায় একটা সময় ছিল যখন নির্বাচন বয়কট চলেছে। কিন্তু তারা বহু মূল্য দিয়ে শিখেছে যে বয়কটে ফায়দা নেই। আফ্রিকা বয়কট ভুলেছে কারণ তারা বুঝেছে বয়কট করে চূড়ান্ত পরিণামে লাভ হয় না। নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় থাকলে হয়তো কখনো পুরো লাভ হয় না। কিন্তু দলগুলোকে চাঙা রাখতে সুবিধা হয়। বিএনপি যেটা করল তাতে দেশের গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগত দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকেও ভালো হয়নি। ২৫ ভাগ স্বতন্ত্র ভোটারকে হয়তো তাঁদের ভোট দেওয়ার অধিকার ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হলো। প্রত্যাখ্যান ও প্রতিবাদের অন্য আরও উপায় আছে। চট্টগ্রামের বিদায়ী মেয়রের রাজনৈতিক পটভূমি আমার জানা নেই। তিনি আবার রাজনীতি থেকেই অবসরের ঘোষণা দিলেন। আমি সার্বিক বিচারে বলতে চাই, যা ঘটে গেল তা আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং ইসি কারও জন্যই মঙ্গলজনক হয়নি।
প্রথম আলো: স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচন আপনি করে এসেছেন। ইসির ভূমিকা সম্পর্কে নির্দিষ্ট মন্তব্য করুন। তারা বলেছিল প্রয়োজন হলেই সেনাবাহিনী নামানো হবে।
শামসুল হুদা: হ্যাঁ, সেটা তারা করেনি। তবে সরকারি হস্তক্ষেপের কথা যতই বলা হোক, চূড়ান্ত দায় ইসির ওপর বর্তায়। কালকেই হয়তো সরকার বলবে, নির্বাচন পরিচালনা করে ইসি। তাদের চাহিদামতো আমরা সব দিয়েছি। তাদের আমরা ৮২ হাজার পুলিশ, ২০০ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েছি। শতকোটি টাকা দিয়েছি। সেনা মোতায়েন করতে চেয়েছে। সরকার বলে দিয়েছে আচ্ছা আর্মি নামাও।
আমাদের সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাই আমরা নিজেদের মতো চলার চেষ্টা করেছি। বুঝেই নিয়েছি, বিপদকালে আমার পক্ষে কথা বলার জন্য কেউ থাকবে না। এতগুলো পোলিং এজেন্ট কেন থাকল না, সাংবাদিক নিগ্রহ কেন ঘটল; অভিযোগ উঠল যে একটা অজানা সংস্থার ৫০০ লোককে পর্যবেক্ষক করা হয়েছে, এসব কি তদন্ত করে তারা জনগণকে জানিয়েছে? পুলিশকে বরং বলতে শোনা গেছে সব ঠিক আছে। পুরো নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আচরণবিধির অব্যাহত লঙ্ঘন ঘটেছে। এ ধরনের ক্রিয়াকাণ্ড কিন্তু ইসির নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই দেশকে গণতন্ত্রের পথে নেওয়ার জন্য ইসির যে দায়িত্ব আছে, সেই দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করেছে কি না, সেটা নিয়ে লোকে অনেক দিন ধরে প্রশ্ন করতে থাকবে।
প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নির্বাচনের কথিত কারচুপি খতিয়ে দেখতে তদন্ত চাইছে। ইসি এটা করতে পারে?
শামসুল হুদা: নির্বাচনী অনিয়মের জন্য তো সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে ইসিতে দরখাস্ত করতে হবে। সেটা কি প্রার্থীরা করেছেন?
প্রথম আলো: না করলেও গণমাধ্যমে অনেক কিছু ছাপা হয়েছে। বিচারকেরা পত্রিকার রিপোর্টের ভিত্তিতে যেভাবে সুয়োমোটো আমলে নেন, প্রচলিত আইনে ইসি তেমন পদক্ষেপ নিতে পারে কি না?
শামসুল হুদা: বিদ্যমান নির্বাচনী আইনে এটা সম্ভব। নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে।
প্রথম আলো: আর কোনো মন্তব্য?
এ টি এম শামসুল হুদা: আমি একটা নতুন আশার স্বপ্ন এঁকেছিলাম, সেখানে হতাশায় নিমজ্জিত হলাম। নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাকে আবার একসঙ্গে করে চাঙা করা অনেক কঠিন কাজ।
No comments