মোবাইল আমদানিতে বছরে ৪শকোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি by মুজিব মাসুদ
আমদানি করা মোবাইল হ্যান্ডসেটের দাম কম দেখিয়ে (আন্ডার ইনভয়েসিং) বছরে ৪শ’ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে অসাধু আমদানিকারকরা। আর এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত কাস্টমস ও বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন)। অথচ সেসব হ্যান্ডসেট তারা বাজারে বিক্রি করছে ৩শ’ থেকে ৫শ’ গুণ বেশি দামে।
কাস্টমস থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, নামি কোম্পানির ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার মার্কিন ডলারের সর্বাধুনিক ফোনসেট আমদানি করা হচ্ছে মাত্র ৩০০ ডলার দাম দেখিয়ে। ৫শ’ থেকে ১ হাজার ডলার মূল্যের সেট আসছে ১০ থেকে ১৫ ডলারে। ৫০ থেকে ৯০ ডলারের হ্যান্ডসেট আসছে ২/৩ ডলারের রেডিও ইকুইপমেন্টের নামে। মোবাইল সেটকে রেডিও ইকুইপমেন্ট দেখিয়েও দেয়া হচ্ছে বড় অংকের রাজস্ব ফাঁকি।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, এক্ষেত্রে আমদানিকারক এইচএস কোড জালিয়াতি করে দাম কম দেখায়। আর জেনেশুনেও চালান খালাস দিতে হচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ঘোষিত মূল্যের চেয়ে ৫/৬ ডলার কখনও ৫০ সেন্ট কিংবা ৭৫ সেন্ট বেশি দাম ধরে চালান খালাস দিচ্ছে তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রফর্মা ইনভয়েসের এ ধরনের মূল্য জালিয়াতি খোদ বিটিআরসিও অনুমোদন দিচ্ছে। মালামাল খালাসের জন্য বিটিআরসি থেকে এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নিতে হয়। একটি হ্যান্ডসেটের দাম কত হতে পারে সেটা কাস্টমস কর্মকর্তারা না জানলেও বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ফাঁকি দেয়ার কোনো রাস্তা নেই। তারপরও জেনেশুনে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিটিআরসি ওইসব আন্ডার ইনভয়েসিং করা হ্যান্ডসেটের জন্য এনওসি দিচ্ছে।
কাস্টমস বলছে, এ ক্ষেত্রে তাদের করার কিছুই নেই। তবে বিটিআরসি বলছে, অধিকাংশ সময় কাস্টমস ও আমদানিকারকরা যোগসাজশে বিটিআরসির এনওসি জাল করে মালামাল খালাস করে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বিটিআরসির অনুমোদন থাকায় ২শ’ থেকে ৭শ’ ডলার মূল্যের মোবাইল ফোন সেটের আমদানি ইনভয়েসে ১৫ থেকে ৩০ ডলারের অনুমোদন থাকায় ব্যাংকগুলোও এলসি খুলতে বাধ্য হচ্ছে!
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান জানান, উত্তরা থেকে অভিযান চালিয়ে তারা এ ধরনের অসংখ্য ভুয়া এনওসি উদ্ধার করেছেন। এছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অসংখ্য হ্যান্ডসেট আমদানিকারকের লাইসেন্স বাতিল ও স্থগিত করা হয়েছে। এ ঘটনায় অসংখ্য মামলা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বিটিআরসির দেয়া রেডিও ইকুইপমেন্ট ও ভেন্ডর এনলিস্টমেন্ট সনদ ব্যবহার করে বর্তমানে ২ শতাধিক মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানিকারক বছরে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার কোটির বেশি অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। এদের মধ্যে কেউ বৈধ পন্থায় কেউ অবৈধ পন্থায় লাগেজ পার্টির মাধ্যমে হ্যান্ডসেট এনে এই অর্থ পাচার করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার শীর্ষ ৫০ আমদানিকারক আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৫ বছর ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে মোবাইল ফোন আমদানি জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কিছু দিন আগে বিটিআরসি কিছু কিছু দুর্নীতিবাজ ও জালিয়াত কোম্পানির লাইসেন্স স্থগিত এবং কিছু প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিল করে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই এ অসাধু ব্যবসা। একজনের লাইসেন্স বাতিল করলে নামে-বেনামে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, শ্বশুর, জামাই ও আত্মীয়-স্বজনের নামে লাইসেন্স করে বিটিআরসি থেকে এনওসি নিচ্ছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও বিটিআরসি সম্প্রতি আন্ডার ইনভয়েসিং করে খালাস করা ফোন সেটের তালিকা তৈরি করে। রেডিও ইকুইপমেন্ট লাইসেন্সধারী শীর্ষ ৫০ মোবাইল ফোন আমদানিকারক এসব সেট আমদানি করে। তালিকায় থাকা হ্যান্ডসেটগুলো হল- মটোমেক্স এম২৫, টেলকো এক্স-৯, ইনটেক্স স্টার ওয়ান, উইনমেক্স ডব্লিউআই, ডব্লিউএক্স-২, ডব্লিউএক্স-১৩, ডব্লিউ-২০২, ডব্লিউ-১০৩, এস-২৪, ডব্লিউ-১০৪, ডব্লিউ-২০৬, ডব্লিউ-১১১, নকিয়া ৭৩০/আরএম-১০৪০, নোকিয়া-২১০, জি-ফাইভ এল২২৮, জেড-৫, জি-জি-১, ডব্লিউআই, এ-৯৭, জেড-২, উইনস্টার ডব্লিউ-৮৮, মাইক্রোম্যাক্স এক্স-০৮৮, প্রেসিডেন্ট স্মার্ট-২, ওয়ালটন ১০-এক্স (ওয়ালপ্যাড), প্রিমো জিএফ-২, গ্ল্যালাক্সি জি-৪, এইচ-১, মাইসেল বিইই-৪, অকটেন টি-১২৩১, কিউ ফোন কিউ-১১০, বে-২, এস-১০২, কেএন্ডসি এফ-৩০০, ডি-২৪, অপো আর-১০০১, আর ৮৩১-কে, এন-৫১১১, ম্যাক্সিমাস আইএক্স, এম ২৬৬-এস, স্যামসাং এসএম-বি ৩১০ই, লাভা এক্স-১, টিনমো, টিনমো ট্যাব অন্যতম। আবার অনেক আমদানিকারক এসব ফোনের উৎপাদনকারী কোম্পানিকে না জানিয়ে কম দামে চায়না থেকে হুবহু হ্যান্ডসেট (নকল) বানিয়ে আমদানি করছে।
এক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে দেখা গেছে, এসব হ্যান্ডসেটগুলো যে দাম দেখিয়ে আনা হয়েছে পরে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সেগুলোর গায়ের দামের চেয়ে বেশি দাম ধরে খালাস করেছে। কিন্তু আন্ডার ইনভয়েসিং করার জন্য কোনো কোম্পানীকে দায়ী করা হয়নি।
বিটিআরসির তালিকা অনুযায়ী, সারা দেশে বর্তমানে যেসব কোম্পানি এভাবে আন্ডার ইনভয়েসিং করে হ্যান্ডসেট আমদানি করছে তাদের মধ্যে এম হোসেন ইলেক্ট্রনিক্স, মেসার্স এসকে ট্রেডিং, মেসার্স মোল্লা ইন্টারন্যাশনাল, এমজেড মোবাইল (প্রা.) লিমিটেড, এসএইচ ইন্টারন্যাশনাল, অনিক ইলেক্ট্রনিক্স মিউজিয়াম, সেল টোন, মোবাইল সোর্স, আবীর এন্টারপ্রাইজ, ম্যাপল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, অনন্যা ইলেক্ট্রনিক্স, মেহেদি টেলিকম, নিউ নোকিয়া টেলিকম, নাঈম এন্টারপ্রাইজ, আকাশ ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, রুবোটেল কমিউনিকেশন, জেসই কম, আক্কাস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ম্যাক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এসআর এন্টারপ্রাইজ, ভিসা টেলিকম, কাপল ইন্টারন্যাশনাল, এমকে ট্রেডিং, ফয়সল ট্রেডার্স, যোশ টেলিকম, মিম এন্টারপ্রাইজ, সোর্স ট্রেডিং, এশিয়ান ট্রেডিং কোম্পানি, মোবাইল বাংলা, মোবাইল ওয়ার্ল্ড, রহমত টেলিকম, ইয়াজ ট্রেডার্স, ফ্রেস টেলিকম, সিটি কমিউনিকেশন, লোপা এন্টারপ্রাইজ, আইসিই টেলিকম, ডিজি এন্টারপ্রাইজ, বিএম এন্টারপ্রাইজ, টিএম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, তালুকদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, স্কাইনেট অন্যতম।
অভিযোগ রয়েছে, দেশে প্রতি মাসে ২০ লাখ মোবাইল ফোনসেট আমদানি হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা দামের ঊর্ধ্বে হ্যান্ডসেট আসছে মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ। বিটিআরসির ছাড়পত্র ছাড়াও বিভিন্ন লাগেজ পার্টির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মোবাইল সেট আমদানি হচ্ছে।
কিছু দিন আগে আমদানি করা ৬০ লাখ পিস মোবাইল ফোনের শুল্কায়ন মূল্য ছিল ১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা (প্রায় ২৫ কোটি ডলার)। সেটপ্রতি তৎকালীন দর ৩শ’ টাকা হিসাবে এ খাত থেকে ১৮৫ কোটি টাকার আমদানি শুল্ক এবং ৬২ কোটি টাকার এটিভি আদায় হয়েছে বলে ঢাকা কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে। অথচ আন্ডার ইনভয়েসিং না হলে এসব ফোনের প্রকৃত আমদানি মূল্য দাঁড়াত ১শ’ কোটি ডলারেরও বেশি- যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। বিদেশী সরবরাহকারীকে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে আমদানিকৃত ফোনের প্রকৃত মূল্য পরিশোধে এভাবে বছরেই প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে।
আমদানিকারককে প্রতিটি ইনভয়েসে ৩ থেকে ১০ লাখ পিস পর্যন্ত বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও মডেলের মোবাইল ফোন আমদানির জন্য অবাধে ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে। অথচ এর বিপরীতে আমদানি করা হচ্ছে মাত্র ২০ হাজার থেকে ১ লাখ পিস। এভাবে অস্বাভাবিক হারে ফোন আমদানির ছাড়পত্র দেয়ায় অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও এটিভি ফাঁকি দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, আমদানি নীতিতে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে এলসি খোলার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ব্যাংকগুলো তা মানছে না- যা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে মুদ্রা পাচারকে উৎসাহিত করছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একই ব্রান্ডের একই ফোনসেট ৭শ’ ডলারে খালাস দিচ্ছে আবার তা ৩৫ ডলারেও শুল্কায়ন করছে। গত ১৩ ডিসেম্বর টিনমো মোবাইল এফ-৩০০ মডেলের ৪০ পিস মোবাইল আমদানি হয়েছে- যার মূল্য দেখানো হয়েছিল শুল্কসহ প্রতিটি ৩১৭২ টাকা। কিন্তু এই মোবাইল সেটটি বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৭ হাজার ৯শ’ টাকায়। আন্ডার ইনভয়েসিং করে এই খাতে প্রতিটি সেট থেক সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা। একই মাসে প্রেসিডেন্ট স্মার্ট-২ মডেলের ১ হাজার পিস হ্যান্ডসেটের আমদানি মূল্য দেখানো হয় মাত্র ২ হাজার ৫০ টাকা। কিন্তু ওই মোবাইলটি খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৫শ’ থেকে ৫ হাজার টাকায়। এই সেটটিও আন্ডার ইনভয়েসিং করে আমদানি করা হয়েছে। নভেম্বর মাসে উইনম্যাক্স ডব্লিউ-২০২ মডেলের ৪ হাজার ৭শ’ পিস মোবাইল আমদানি করা হয়। প্রতিটির আমদানি মূল্য দেখানো হয় মাত্র ৫৬০ টাকা। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ওই সেটটি বিক্রি করা হচ্ছে ৫ হাজার ৩শ’ টাকায়। এক্ষেত্রে সেটপ্রতি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ৯শ’ থেকে ১১শ’ টাকা। ২৪ নভেম্বর ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৯শ’ পিস হ্যান্ডসেট আমদানি করা হয় প্রতিটি মাত্র ৬ ডলারে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ১ ডলার বাড়িয়ে শুল্কায়ন করলেও বাজার দর অনুযায়ী সেটপ্রতি কমপক্ষে ১০ ডলার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।
১১ ডিসেম্বর ওয়ালটন মোবাইল ফোন ওয়ালপ্যাড-১০এক্স মডেলের ১ হাজার হ্যান্ডসেট আমদানি করে। তারা প্রতিটি সেটের বাজার দর দেখায় ১৬১ ডলার। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন করে সেটপ্রতি ৫৫ সেন্ট বাড়িয়ে দিয়ে। একইভাবে ওয়ালটন প্রিমো জি-ফাইভ ২ মডেলের ৭ হাজার ৬শ’ পিস আমদানি করা হয় ৬১.৫৭ ডলারে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নামকাওয়াস্তে মাত্র ১৯ সেন্ট বাড়িয়ে দিয়ে সেটগুলো খালাস দেয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি সেট এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে আমদানি দরের অনেক বেশি দামে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
একই দিন ডব্লিউ-১৫-১ মডেলের ২০ হাজার হ্যান্ডসেট আমদানি করা হয়। শুল্কায়নের সময় প্রতিটির আমদানি দর দেখানো হয় ২৯.৫০ ডলার। কিন্তু বাস্তবে বাজারে প্রতিটি সেট বিক্রি হচ্ছে দেড়শ’ ডলারের বেশি দামে। একই ভাবে নকিয়া-৫১৫ ও ২০০ মডেলের বেশ কিছু হ্যান্ডসেট আমদানি করা হয় যথাক্রমে ৫৬ ও ১১৮ ডলারে। জানা গেছে, এতেও সেটপ্রতি গড়ে ১ হাজার টাকা রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। এই হিসাবে বছরে ৪শ’ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে কাস্টমসের এক কর্মকর্তা জানান, শুল্কায়নের সঙ্গে পরিদর্শক থেকে প্রতিটি শিফট প্রধান পর্যন্ত জড়িত। বিনিময়ে সবাই মোটা অংকের টাকা ভাগ পায়। তিনি বলেন, আইনের ফাঁকফোকর থাকায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন করতে বাধ্য। তাছাড়া বিটিআরসির ছাড়পত্র থাকায় কাস্টমস হ্যান্ডসেটগুলো আমদানিকারকদের দেয়া দরে শুল্কায়ন করতে হচ্ছে। এতে তাদের করার কিছুই নেই।
বিটিআরসি বলছে, কাস্টমসের শুল্কায়ন প্রতিবেদনে ১শ’ ভাগ কায়িক পরীক্ষার কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে তা করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ১ লাখ পিস ফোনকে সহজেই ৫ থেকে ৭০ হাজার দেখিয়ে ফাঁকির ঘটনা অহরহ ঘটছে। এতে আমদানিকারক ও কাস্টমস কর্মকর্তারা লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া বিটিআরসির ছাড়পত্রে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফোনের কান্ট্রি অব অরিজিন হাঙ্গেরি, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, কোরিয়া উল্লেখ থাকলেও তা আসছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, চীন ও হংকং থেকে। এরপরও এসব পণ্য বাজেয়াফত না হয়ে অবাধে খালাস দেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার লুৎফুর রহমান জানান, এ ধরনের অভিযোগ তিনি শুনেছেন। তিনি বলেন, এ ধরনের অনিয়ম বন্ধ করার জন্য শিগগিরই তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিটিআরসির সঙ্গে বৈঠক করবেন- যাতে আগামী বাজেটে হ্যান্ডসেট আমদানিতে নতুন নীতিমালা তৈরি সম্ভব হয়। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার রোধ হবে।
মোবাইল হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারক কোম্পানি স্যামসাং বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ লাখ মোবাইল হ্যান্ডসেট বাংলাদেশে আসছে। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা দামের ঊর্ধ্বে হ্যান্ডসেট আসছে মাসে ৮০ থেকে ১ লাখ পিস। তারা যেসব হ্যান্ডসেট ২০ থেকে ৬৭ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন কোনো কোনো বাজারে হুবহু একই মানের ও দামের হ্যান্ডসেট ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কমে পাওয়া যাচ্ছে। তার প্রশ্ন, তাহলে কিভাবে এই সেটগুলো দেশে আসছে? নিশ্চয় কোনো ধরনের শুল্ক দিতে হয় না তাদের। লাগেজ পার্টি কিংবা কাস্টমসকে ম্যানেজ করে এই সেটগুলো তারা অবৈধভাবে দেশে নিয়ে আসছে। তিনি বলেন, বিষয়টি তারা বিটিআরসিকে জানিয়েছে। কিন্তু দেশের আইন অনুযায়ী এক্ষেত্রে বিটিআরসির কোনো ভূমিকা নেই।
কাস্টমস থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, নামি কোম্পানির ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার মার্কিন ডলারের সর্বাধুনিক ফোনসেট আমদানি করা হচ্ছে মাত্র ৩০০ ডলার দাম দেখিয়ে। ৫শ’ থেকে ১ হাজার ডলার মূল্যের সেট আসছে ১০ থেকে ১৫ ডলারে। ৫০ থেকে ৯০ ডলারের হ্যান্ডসেট আসছে ২/৩ ডলারের রেডিও ইকুইপমেন্টের নামে। মোবাইল সেটকে রেডিও ইকুইপমেন্ট দেখিয়েও দেয়া হচ্ছে বড় অংকের রাজস্ব ফাঁকি।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, এক্ষেত্রে আমদানিকারক এইচএস কোড জালিয়াতি করে দাম কম দেখায়। আর জেনেশুনেও চালান খালাস দিতে হচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ঘোষিত মূল্যের চেয়ে ৫/৬ ডলার কখনও ৫০ সেন্ট কিংবা ৭৫ সেন্ট বেশি দাম ধরে চালান খালাস দিচ্ছে তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রফর্মা ইনভয়েসের এ ধরনের মূল্য জালিয়াতি খোদ বিটিআরসিও অনুমোদন দিচ্ছে। মালামাল খালাসের জন্য বিটিআরসি থেকে এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নিতে হয়। একটি হ্যান্ডসেটের দাম কত হতে পারে সেটা কাস্টমস কর্মকর্তারা না জানলেও বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ফাঁকি দেয়ার কোনো রাস্তা নেই। তারপরও জেনেশুনে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিটিআরসি ওইসব আন্ডার ইনভয়েসিং করা হ্যান্ডসেটের জন্য এনওসি দিচ্ছে।
কাস্টমস বলছে, এ ক্ষেত্রে তাদের করার কিছুই নেই। তবে বিটিআরসি বলছে, অধিকাংশ সময় কাস্টমস ও আমদানিকারকরা যোগসাজশে বিটিআরসির এনওসি জাল করে মালামাল খালাস করে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বিটিআরসির অনুমোদন থাকায় ২শ’ থেকে ৭শ’ ডলার মূল্যের মোবাইল ফোন সেটের আমদানি ইনভয়েসে ১৫ থেকে ৩০ ডলারের অনুমোদন থাকায় ব্যাংকগুলোও এলসি খুলতে বাধ্য হচ্ছে!
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান জানান, উত্তরা থেকে অভিযান চালিয়ে তারা এ ধরনের অসংখ্য ভুয়া এনওসি উদ্ধার করেছেন। এছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অসংখ্য হ্যান্ডসেট আমদানিকারকের লাইসেন্স বাতিল ও স্থগিত করা হয়েছে। এ ঘটনায় অসংখ্য মামলা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বিটিআরসির দেয়া রেডিও ইকুইপমেন্ট ও ভেন্ডর এনলিস্টমেন্ট সনদ ব্যবহার করে বর্তমানে ২ শতাধিক মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানিকারক বছরে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার কোটির বেশি অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। এদের মধ্যে কেউ বৈধ পন্থায় কেউ অবৈধ পন্থায় লাগেজ পার্টির মাধ্যমে হ্যান্ডসেট এনে এই অর্থ পাচার করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার শীর্ষ ৫০ আমদানিকারক আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৫ বছর ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে মোবাইল ফোন আমদানি জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কিছু দিন আগে বিটিআরসি কিছু কিছু দুর্নীতিবাজ ও জালিয়াত কোম্পানির লাইসেন্স স্থগিত এবং কিছু প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিল করে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই এ অসাধু ব্যবসা। একজনের লাইসেন্স বাতিল করলে নামে-বেনামে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, শ্বশুর, জামাই ও আত্মীয়-স্বজনের নামে লাইসেন্স করে বিটিআরসি থেকে এনওসি নিচ্ছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও বিটিআরসি সম্প্রতি আন্ডার ইনভয়েসিং করে খালাস করা ফোন সেটের তালিকা তৈরি করে। রেডিও ইকুইপমেন্ট লাইসেন্সধারী শীর্ষ ৫০ মোবাইল ফোন আমদানিকারক এসব সেট আমদানি করে। তালিকায় থাকা হ্যান্ডসেটগুলো হল- মটোমেক্স এম২৫, টেলকো এক্স-৯, ইনটেক্স স্টার ওয়ান, উইনমেক্স ডব্লিউআই, ডব্লিউএক্স-২, ডব্লিউএক্স-১৩, ডব্লিউ-২০২, ডব্লিউ-১০৩, এস-২৪, ডব্লিউ-১০৪, ডব্লিউ-২০৬, ডব্লিউ-১১১, নকিয়া ৭৩০/আরএম-১০৪০, নোকিয়া-২১০, জি-ফাইভ এল২২৮, জেড-৫, জি-জি-১, ডব্লিউআই, এ-৯৭, জেড-২, উইনস্টার ডব্লিউ-৮৮, মাইক্রোম্যাক্স এক্স-০৮৮, প্রেসিডেন্ট স্মার্ট-২, ওয়ালটন ১০-এক্স (ওয়ালপ্যাড), প্রিমো জিএফ-২, গ্ল্যালাক্সি জি-৪, এইচ-১, মাইসেল বিইই-৪, অকটেন টি-১২৩১, কিউ ফোন কিউ-১১০, বে-২, এস-১০২, কেএন্ডসি এফ-৩০০, ডি-২৪, অপো আর-১০০১, আর ৮৩১-কে, এন-৫১১১, ম্যাক্সিমাস আইএক্স, এম ২৬৬-এস, স্যামসাং এসএম-বি ৩১০ই, লাভা এক্স-১, টিনমো, টিনমো ট্যাব অন্যতম। আবার অনেক আমদানিকারক এসব ফোনের উৎপাদনকারী কোম্পানিকে না জানিয়ে কম দামে চায়না থেকে হুবহু হ্যান্ডসেট (নকল) বানিয়ে আমদানি করছে।
এক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে দেখা গেছে, এসব হ্যান্ডসেটগুলো যে দাম দেখিয়ে আনা হয়েছে পরে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সেগুলোর গায়ের দামের চেয়ে বেশি দাম ধরে খালাস করেছে। কিন্তু আন্ডার ইনভয়েসিং করার জন্য কোনো কোম্পানীকে দায়ী করা হয়নি।
বিটিআরসির তালিকা অনুযায়ী, সারা দেশে বর্তমানে যেসব কোম্পানি এভাবে আন্ডার ইনভয়েসিং করে হ্যান্ডসেট আমদানি করছে তাদের মধ্যে এম হোসেন ইলেক্ট্রনিক্স, মেসার্স এসকে ট্রেডিং, মেসার্স মোল্লা ইন্টারন্যাশনাল, এমজেড মোবাইল (প্রা.) লিমিটেড, এসএইচ ইন্টারন্যাশনাল, অনিক ইলেক্ট্রনিক্স মিউজিয়াম, সেল টোন, মোবাইল সোর্স, আবীর এন্টারপ্রাইজ, ম্যাপল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, অনন্যা ইলেক্ট্রনিক্স, মেহেদি টেলিকম, নিউ নোকিয়া টেলিকম, নাঈম এন্টারপ্রাইজ, আকাশ ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, রুবোটেল কমিউনিকেশন, জেসই কম, আক্কাস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ম্যাক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এসআর এন্টারপ্রাইজ, ভিসা টেলিকম, কাপল ইন্টারন্যাশনাল, এমকে ট্রেডিং, ফয়সল ট্রেডার্স, যোশ টেলিকম, মিম এন্টারপ্রাইজ, সোর্স ট্রেডিং, এশিয়ান ট্রেডিং কোম্পানি, মোবাইল বাংলা, মোবাইল ওয়ার্ল্ড, রহমত টেলিকম, ইয়াজ ট্রেডার্স, ফ্রেস টেলিকম, সিটি কমিউনিকেশন, লোপা এন্টারপ্রাইজ, আইসিই টেলিকম, ডিজি এন্টারপ্রাইজ, বিএম এন্টারপ্রাইজ, টিএম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, তালুকদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, স্কাইনেট অন্যতম।
অভিযোগ রয়েছে, দেশে প্রতি মাসে ২০ লাখ মোবাইল ফোনসেট আমদানি হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা দামের ঊর্ধ্বে হ্যান্ডসেট আসছে মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ। বিটিআরসির ছাড়পত্র ছাড়াও বিভিন্ন লাগেজ পার্টির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মোবাইল সেট আমদানি হচ্ছে।
কিছু দিন আগে আমদানি করা ৬০ লাখ পিস মোবাইল ফোনের শুল্কায়ন মূল্য ছিল ১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা (প্রায় ২৫ কোটি ডলার)। সেটপ্রতি তৎকালীন দর ৩শ’ টাকা হিসাবে এ খাত থেকে ১৮৫ কোটি টাকার আমদানি শুল্ক এবং ৬২ কোটি টাকার এটিভি আদায় হয়েছে বলে ঢাকা কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে। অথচ আন্ডার ইনভয়েসিং না হলে এসব ফোনের প্রকৃত আমদানি মূল্য দাঁড়াত ১শ’ কোটি ডলারেরও বেশি- যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। বিদেশী সরবরাহকারীকে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে আমদানিকৃত ফোনের প্রকৃত মূল্য পরিশোধে এভাবে বছরেই প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে।
আমদানিকারককে প্রতিটি ইনভয়েসে ৩ থেকে ১০ লাখ পিস পর্যন্ত বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও মডেলের মোবাইল ফোন আমদানির জন্য অবাধে ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে। অথচ এর বিপরীতে আমদানি করা হচ্ছে মাত্র ২০ হাজার থেকে ১ লাখ পিস। এভাবে অস্বাভাবিক হারে ফোন আমদানির ছাড়পত্র দেয়ায় অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও এটিভি ফাঁকি দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, আমদানি নীতিতে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে এলসি খোলার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ব্যাংকগুলো তা মানছে না- যা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে মুদ্রা পাচারকে উৎসাহিত করছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একই ব্রান্ডের একই ফোনসেট ৭শ’ ডলারে খালাস দিচ্ছে আবার তা ৩৫ ডলারেও শুল্কায়ন করছে। গত ১৩ ডিসেম্বর টিনমো মোবাইল এফ-৩০০ মডেলের ৪০ পিস মোবাইল আমদানি হয়েছে- যার মূল্য দেখানো হয়েছিল শুল্কসহ প্রতিটি ৩১৭২ টাকা। কিন্তু এই মোবাইল সেটটি বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৭ হাজার ৯শ’ টাকায়। আন্ডার ইনভয়েসিং করে এই খাতে প্রতিটি সেট থেক সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা। একই মাসে প্রেসিডেন্ট স্মার্ট-২ মডেলের ১ হাজার পিস হ্যান্ডসেটের আমদানি মূল্য দেখানো হয় মাত্র ২ হাজার ৫০ টাকা। কিন্তু ওই মোবাইলটি খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৫শ’ থেকে ৫ হাজার টাকায়। এই সেটটিও আন্ডার ইনভয়েসিং করে আমদানি করা হয়েছে। নভেম্বর মাসে উইনম্যাক্স ডব্লিউ-২০২ মডেলের ৪ হাজার ৭শ’ পিস মোবাইল আমদানি করা হয়। প্রতিটির আমদানি মূল্য দেখানো হয় মাত্র ৫৬০ টাকা। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ওই সেটটি বিক্রি করা হচ্ছে ৫ হাজার ৩শ’ টাকায়। এক্ষেত্রে সেটপ্রতি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ৯শ’ থেকে ১১শ’ টাকা। ২৪ নভেম্বর ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৯শ’ পিস হ্যান্ডসেট আমদানি করা হয় প্রতিটি মাত্র ৬ ডলারে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ১ ডলার বাড়িয়ে শুল্কায়ন করলেও বাজার দর অনুযায়ী সেটপ্রতি কমপক্ষে ১০ ডলার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।
১১ ডিসেম্বর ওয়ালটন মোবাইল ফোন ওয়ালপ্যাড-১০এক্স মডেলের ১ হাজার হ্যান্ডসেট আমদানি করে। তারা প্রতিটি সেটের বাজার দর দেখায় ১৬১ ডলার। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন করে সেটপ্রতি ৫৫ সেন্ট বাড়িয়ে দিয়ে। একইভাবে ওয়ালটন প্রিমো জি-ফাইভ ২ মডেলের ৭ হাজার ৬শ’ পিস আমদানি করা হয় ৬১.৫৭ ডলারে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নামকাওয়াস্তে মাত্র ১৯ সেন্ট বাড়িয়ে দিয়ে সেটগুলো খালাস দেয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি সেট এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে আমদানি দরের অনেক বেশি দামে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
একই দিন ডব্লিউ-১৫-১ মডেলের ২০ হাজার হ্যান্ডসেট আমদানি করা হয়। শুল্কায়নের সময় প্রতিটির আমদানি দর দেখানো হয় ২৯.৫০ ডলার। কিন্তু বাস্তবে বাজারে প্রতিটি সেট বিক্রি হচ্ছে দেড়শ’ ডলারের বেশি দামে। একই ভাবে নকিয়া-৫১৫ ও ২০০ মডেলের বেশ কিছু হ্যান্ডসেট আমদানি করা হয় যথাক্রমে ৫৬ ও ১১৮ ডলারে। জানা গেছে, এতেও সেটপ্রতি গড়ে ১ হাজার টাকা রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। এই হিসাবে বছরে ৪শ’ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে কাস্টমসের এক কর্মকর্তা জানান, শুল্কায়নের সঙ্গে পরিদর্শক থেকে প্রতিটি শিফট প্রধান পর্যন্ত জড়িত। বিনিময়ে সবাই মোটা অংকের টাকা ভাগ পায়। তিনি বলেন, আইনের ফাঁকফোকর থাকায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন করতে বাধ্য। তাছাড়া বিটিআরসির ছাড়পত্র থাকায় কাস্টমস হ্যান্ডসেটগুলো আমদানিকারকদের দেয়া দরে শুল্কায়ন করতে হচ্ছে। এতে তাদের করার কিছুই নেই।
বিটিআরসি বলছে, কাস্টমসের শুল্কায়ন প্রতিবেদনে ১শ’ ভাগ কায়িক পরীক্ষার কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে তা করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ১ লাখ পিস ফোনকে সহজেই ৫ থেকে ৭০ হাজার দেখিয়ে ফাঁকির ঘটনা অহরহ ঘটছে। এতে আমদানিকারক ও কাস্টমস কর্মকর্তারা লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া বিটিআরসির ছাড়পত্রে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফোনের কান্ট্রি অব অরিজিন হাঙ্গেরি, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, কোরিয়া উল্লেখ থাকলেও তা আসছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, চীন ও হংকং থেকে। এরপরও এসব পণ্য বাজেয়াফত না হয়ে অবাধে খালাস দেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার লুৎফুর রহমান জানান, এ ধরনের অভিযোগ তিনি শুনেছেন। তিনি বলেন, এ ধরনের অনিয়ম বন্ধ করার জন্য শিগগিরই তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিটিআরসির সঙ্গে বৈঠক করবেন- যাতে আগামী বাজেটে হ্যান্ডসেট আমদানিতে নতুন নীতিমালা তৈরি সম্ভব হয়। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার রোধ হবে।
মোবাইল হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারক কোম্পানি স্যামসাং বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ লাখ মোবাইল হ্যান্ডসেট বাংলাদেশে আসছে। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা দামের ঊর্ধ্বে হ্যান্ডসেট আসছে মাসে ৮০ থেকে ১ লাখ পিস। তারা যেসব হ্যান্ডসেট ২০ থেকে ৬৭ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন কোনো কোনো বাজারে হুবহু একই মানের ও দামের হ্যান্ডসেট ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কমে পাওয়া যাচ্ছে। তার প্রশ্ন, তাহলে কিভাবে এই সেটগুলো দেশে আসছে? নিশ্চয় কোনো ধরনের শুল্ক দিতে হয় না তাদের। লাগেজ পার্টি কিংবা কাস্টমসকে ম্যানেজ করে এই সেটগুলো তারা অবৈধভাবে দেশে নিয়ে আসছে। তিনি বলেন, বিষয়টি তারা বিটিআরসিকে জানিয়েছে। কিন্তু দেশের আইন অনুযায়ী এক্ষেত্রে বিটিআরসির কোনো ভূমিকা নেই।
No comments