বিশ্বাসের সংকটে ভোট
তিন
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে
বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। হংকংভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান
হিউম্যান রাইটস কমিশন বলেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশনে
জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া প্রতারণায় পর্যবসিত হয়েছে। ভোট কারচুপির
অভিযোগের তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। প্রক্রিয়া
এবং নির্বাচনের দিন সংঘটিত অপকর্ম এবং অনিয়মের কারণে এ নির্বাচন
বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে বলেছে,
নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি হয়েছে। সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, জালভোট ও নানা
অনিয়মের মধ্যে প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে বলে মনে করে মানবাধিকার সংগঠন
অধিকার। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভোটে জালিয়াতির
বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন পেয়েছে তারা।
নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়নি: ইডব্লিউজি
তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)। নির্বাচনের দিন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নির্বাচনী অনিয়ম এবং সহিংসতার ঘটনায় ভরপুর ছিল বলে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের পর্যবেক্ষণ তথ্য তুলে ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার এ জোট। পর্যবেক্ষকদের মতে, জোর করে ব্যালটে সিল, কেন্দ্র দখল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ নানা অনিয়ম- অব্যবস্থাপনা ছিল সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে থাকা ৯৯ শতাংশ ভোট কেন্দ্রে। সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে সংস্থাটি। তিন সিটি করপোরেশনের ৬১৯টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছে ইডব্লিউজির সদস্যরা। পর্যবেক্ষকদের দেয়া ভোট চিত্রের তথ্য দেখে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ব্যালট ছিনতাই করে সিল মারার ঘটনা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোট কক্ষ দখল এবং নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। পর্যবেক্ষিত অনেক ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ কার্যক্রমের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও নানা ধরনের নির্বাচনী অনিয়মের কারণে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সার্বিক সততা ক্ষুণ্ন হয়েছে।
ইডব্লিউজি পর্যবেক্ষণ করা ভোট কেন্দ্রের মধ্যে জোরপূর্বক ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৩৮টিতে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫৫, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৪৬ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৩৭টি। সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৬৪টি। তার মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬৬, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২৬ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৭২টি। এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ৭৮টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২৮, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৯ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৩১টি। ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে ১০২টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ঘটেছে ৩৩, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩৯ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৩০টি। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৫৮টি ভোট কেন্দ্র। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২১, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ছয় ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩১টি। এ ছাড়াও পর্যবেক্ষিত ভোট কেন্দ্রের মধ্যে প্রতি সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে দুই জন করে ছয় জনকে কেন্দ্রের ভেতর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি ঘটনার সুনির্দিষ্ট উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়। এসব অনিয়ম ও সহিংস ঘটনা ব্যাপক ঘটনার অংশমাত্র। এসব ঘটনার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে তিন সিটি করপোরেশনে যেসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা নির্বাচনী ফলকে পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিটি ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা, নির্বাচন কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই ঘটেছে বলে জানান ইডব্লিউজির সদস্যবৃন্দ। উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা জানান, নির্বাচনের দিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আট নম্বর ওয়ার্ডে সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে ২৫-৩০ জন জোর করে কেন্দ্রে ঢোকে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভীতিময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে বেশির ভাগ ভোটার আতঙ্কে কেন্দ্র ছেড়ে চলে যান। যারা কেন্দ্র ছেড়ে যেতে পারেননি তাদের মারধর করা হয়। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে দুপুর ১২টা ৮মিনিটে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। ১০ নম্বর ওয়ার্ডে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজনের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বিকাল ৪টার দিকে ওই কেন্দ্রে তিনটি ব্যালট বাক্স পুড়িয়ে ফেলা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ডে ১১টা ৩৪মিনিটে ১০-১২ জন একটি কেন্দ্রে প্রবেশ করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়। পরে তাতে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয় তারা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সহযোগিতা করে বলে ইডব্লিউজির সদস্যরা জানান। চার নম্বর ওয়ার্ডে ৩০ মিনিট পর্যন্ত মেয়র প্রার্থীর কোন ব্যালট পেপার ভোটারদের প্রদান করা হয়নি। ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ভোটারদের কেন্দ্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয়নি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্র একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র-যুবকরা দখল করে নেয়। এজেন্ট ও পর্যবেক্ষকদের বের করে দিয়ে ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রথমে এসব ঘটনার পেছনে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের কথা বলা হলেও পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইডব্লিউজির সদস্যরা জানান, আওয়ামী লীগ তথা সরকার দল সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মীরা এসব ঘটিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ইডব্লিউজির এক কর্মী জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ে অবাধে সিল মারার দৃশ্য দেখেন তাদের পর্যবেক্ষক। ওই দৃশ্য দেখার কারণে পিস্তল দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয় তাকে। এসব বিষয়ে ইডব্লিউজির সদস্য তালেয়া রেহমান বলেন, পরে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। এতে নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে। কমিশন সম্পর্কে মন্তব্য কি জানতে চাইলে ইডব্লিউজির সদস্যরা জানান, নির্বাচন কমিশন কোথাও কোথাও পুনঃনির্বাচন করছে কি-না তা এখন দেখার বিষয়। এজন্য কমিশন সম্পর্কে চূড়ান্ত কোন মন্তব্য করতে চান না তারা। তবে শুরু থেকেই নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেছে ইডব্লিউজি। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ১৪০ কার্ডের আবেদন করলেও নির্বাচন কমিশন তাদের মাত্র ৩০টি কার্ড প্রদান করে বলে জানান তারা। সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে ইডব্লিউজির সদস্য কামরুল হাসান মঞ্জু বলেন, জোর করে ব্যালটে সিল, কেন্দ্র দখল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ নানা অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ছিল ৯৯ শতাংশ ভোট কেন্দ্রে। এ বিষয়ে ইডব্লিউজির সদস্য তালেয়া রেহমান জানান, পর্যবেক্ষিত ভোট কেন্দ্র অনুসারে এটি বলেছেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন পাঠ করেন, ইডব্লিউজির পরিচালক ড. মো. আবদুল আলীম। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।
নজিরবিহীন কারচুপি হয়েছে: টিআইবি
তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি হয়েছে উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির এক বিবৃতিতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রনির্ভর নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ব্যর্থতায় গভীর হতাশা প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রে গোলযোগ ও সহিংসতা, ভোট দেয়ায় বাধা, দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে অনৈতিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে বলে দাবি টিআইবি’র। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, বিতর্কিতভাবে মাঝপথে নির্বাচন বর্জন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার পথে নতুন করে ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় সকল রাজনৈতিক দলকে সংযত, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
গতকাল এক বিবৃতিতে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ও পেশিশক্তির প্রয়োগে ব্যাপক অনিয়ম সংঘটিত হওয়ায় সদ্য-সমাপ্ত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনী আইনপ্রয়োগসহ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ব্যাপক কারচুপির নির্ভরযোগ্য তথ্য আর প্রমাণ থাকার পরেও কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অস্বীকৃতি, মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে বিব্রত করেছে। যথাযথ দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন শুধু যে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, বরং কমিশন ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আচরণ করায় সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ও জন-আস্থা ধূলিসাৎ হয়েছে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী একদিকে নীরব দর্শক ও অন্যদিকে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করে শুধু ব্যর্থই হয়েছে তাই নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক শিখণ্ডি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উপর মহলের নির্দেশের অজুহাত দেখিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশী-বিদেশী সংস্থার প্রতিনিধিদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদানে ব্যর্থ হয়ে এই বাহিনী তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার এরূপ ব্যর্থতা মানুষের ভোটের অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব করেছে এবং একইসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানই নিজেদেরকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিব্রত করেছে বলে মনে করছে টিআইবি। অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝপথে নির্দলীয় এই নির্বাচন বিতর্কিতভাবে বর্জন করে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নতুন করে ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনীতি থেকে উত্তরণে যে ইতিবাচক সুযোগের সৃষ্টি হয়েছিল, মঙ্গলবারের তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনই সামগ্রিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির ঝুঁকি পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জনজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সকল দলসমূহকে রাজনৈতিক সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক চর্চার ধারা অনুশীলন ও তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রতারণায় পর্যবসিত
আরেকটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যক্ষ করলো বাংলাদেশ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া প্রতারণায় পর্যবসিত হয়েছে। দুই শহরজুড়ে সরকারদলীয় ক্যাডার, পোলিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কারচুপি ও বাক্সে গণহারে ব্যালট ঢুকিয়ে নির্বাচনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। নির্বাচন কমিশন শাসক দলের জন্য সকল পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এ ধরনের নির্বাচন হচ্ছে উচ্চপদস্থ অভিজাতদের বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের মূল কারণ। একটি ত্রুটিপূর্ণ বিচারবিভাগ ও দুর্বল প্রতিষ্ঠান থাকার সুবিধা তারা ভোগ করেন। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি ও সিটি নির্বাচনের মতো ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন রাষ্ট্রের কার্যাবলির প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা আরও বাড়ায়। গতকাল সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে এসব কথা বলেছে হংকংভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছে তারা। এতে আরও বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলেরই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ব্যাপকহারে সহিংসতা হয়েছে। এর ফলে ভোটাররা বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারেন নি। দুপুরের মধ্যে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে পুলিশ ও পোলিং কর্মকর্তারা ভোটারদের ভোট না দিয়ে চলে যেতে বলেন। ভোটারদের জানিয়ে দেয়া হয়, তাদের ভোট ইতিমধ্যেই দিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি বহু প্রার্থী স্বয়ং নিজেই ভোট দিতে পারেন নি! শাসক দল সমর্থিত প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছাড়া আর সকল প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। এজেন্টদের অনেককে আবার আক্রমণ করা হয়েছে, কিংবা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের কাছে বারবার লিখিত অভিযোগ করেছেন প্রতিযোগী প্রার্থীরা। তবে তাদের অভিযোগ সত্ত্বেও সহিংসতা ও নির্বাচনে নগ্ন জালিয়াতি থামাতে কোন ভূমিকাই নেয়া হয়নি। এরই ফলশ্রুতিতে বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিকালের মধ্যেই ভোট বর্জন করেন।
পুলিশ সাংবাদিকদের নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে বাধা দিয়েছে। এ ছাড়া কারচুপির ভিডিও ও ছবি তুলতেও পুলিশ বাধা সৃষ্টি করেছে। অন্তত এক ডজন সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, অথবা ভেঙে ফেলা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, গণমাধ্যম সফলভাবে নির্বাচনী কারচুপির খবর সংগ্রহ করেছে। সেসব পত্রপত্রিকা ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারও হয়েছে।
তবে হাস্যকর হলেও, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে’। সিইসি ও নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কোন বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সিইসি সকল ধরনের নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তার ভাষায়, সেসব ‘বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা’। প্রকৃতপক্ষে, নির্বাচন কমিশন শাসক দলের জন্য সকল পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এ দলটিই ‘যে কোন মূল্যে’ সিটি করপোরেশন নির্বাচন জয়ের ইচ্ছার কথা ঘোষণা দিয়েছিল।
এটি একটি প্রকৃত তথ্য যে, বিশ্বাসযোগ্য ও সামর্থ্যবান কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব এদেশে নেই। সেটা হোক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, হোক নির্বাচন কমিশন কিংবা বিচার বিভাগ। সাধারণত, বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বাস করে যে, বিরোধী দলের কর্মী ব্যতীত দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হবে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামে যে লজ্জাকর ঘটনাসমূহ ঘটেছে, তার দায়ভার নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বর্তমান সরকার ও পূর্বের সকল সরকারসমূহের ভাগাভাগি করে নেয়া উচিত বাংলাদেশের সুশীল সমাজ নিরপেক্ষভাবে আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সমাজে তাদের ভূমিকা পালনে আদর্শ অবস্থান সমুন্নত রাখতেও ব্যর্থ হয়েছে। তাই এ লজ্জার দায়ভার তাদেরও বহন করা উচিত।
বাংলাদেশের এসব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন দেশটির মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়। আইনের শাসন সমুন্নত রাখার সামর্থ্য, স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্বের ব্যাপক অভাব রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে। এসব দুর্বল প্রতিষ্ঠানের ওপর ছড়ি ঘুরানোটা এক ধরনের বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ ছাড়াও রয়েছে, গঠনমূলক পদক্ষেপের বদলে গায়ের জোরে রাজনৈতিক পদ কেড়ে নেয়ার গেঁড়ে বসা অভ্যাস।
নিকট ভবিষ্যতে একটি প্রগতিশীল ও রাজনৈতিক বাংলাদেশ দেখতে যারা আগ্রহী, তাদের উচিত, ‘কারচুপির তদন্ত হবে’- এমন বিভ্রম থেকে বেরিয়ে আসা। বাংলাদেশে এসব কারচুপিকে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বলা হয়।
সময় ও সমপদ নষ্টের বদলে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের উপযোগী করে গড়ে তোলাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জনগণ তাদের করের অর্থ প্রদান করছে, গণতন্ত্র ও সমাজে বৃহত্তর ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করছে। এসব বাস্তবায়নে বিলম্ব ও ব্যর্থতা ঘটলে, কর্তৃত্বপরায়ণ ও বিশৃঙ্খল শাসনব্যস্থার অধীনে আরও অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। আরও হতাশার জন্ম দিতে পারে। এ অবস্থায়, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়তে প্রয়োজনীয় মনোযোগ না দিলে, সবচেয়ে বিপজ্জনক উগ্রপন্থিরাই লাভবান হবে বেশি। তাদের শক্তিবৃদ্ধি জাতীয় নিরাপত্তা ও এ অঞ্চলের বৈদেশিক নিরাপত্তার জন্য আরও বৃহৎ সমস্যা সৃষ্টি করবে।
ভোট কারচুপির তদন্ত চায় জাতিসংঘ
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট কারচুপির সব অভিযোগের তদন্ত চায় জাতিসংঘ। এজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। পাশাপাশি তিনি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করার জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আবারও আহ্বান জানিয়েছেন। সব রাজনৈতিক দলকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের মতপার্থক্য দূর করার আহ্বান জানান বান কি মুন। মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র ফারহান হক ২৮শে এপ্রিল নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন। এ সময় উঠে আসে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের প্রসঙ্গ। বলা হয়, ব্যাপক ভোট কারচুপি হয়েছে নির্বাচনে। ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। পোলিং স্টেশনগুলোতে আগেই ব্যালট ভরা হয়েছে। এমনকি সাংবাদিকদের প্রহার করা হয়েছে। নির্বাচনের ফল প্রচারে মিডিয়াকে বাধা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হতাশা প্রকাশ করেছে। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের এমন সব বিষয়ের জবাব দেন ফারহান হক। তার কাছে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন- আপনাকে ধন্যবাদ, ফারহান। জাতিসংঘ অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু, মঙ্গলবার আমরা বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তেমনটা দেখতে পাই নি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচন মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকাল ৪টায় শেষ হয়েছে। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। আগেই ভোটপূর্ণ ভোটকেন্দ্র পাওয়া গেছে। এমনকি সাংবাদিকদেরও মারধর করা হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলের বিষয়ে প্রতিবেদন করতে গণমাধ্যমকে বাধা দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে এ ধরনের ভোট জালিয়াতি ও সহিংসতার বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। এ বিষয়গুলোতে আপনার মন্তব্য কি?
উত্তরে ফারহান হক বলেন- কারচুপির অভিযোগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে মহাসচিব অবগত রয়েছেন। তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সব অভিযোগ তদন্ত করতে এবং বিরোধী দলকে তাদের উদ্বেগ প্রকাশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সব পক্ষকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য প্রকাশের অনুরোধ জানিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে সব রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান গুরুত্ব সহকারে পুনর্ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ব্রিফিংয়ে আলোচনা হয়। সেখানে এক সাংবাদিক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী জেফ রাথকের কাছে জানতে চান- বাংলাদেশে মঙ্গলবার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। এ নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তিনি সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। বিএনপি মধ্যপথে নির্বাচন বর্জন করেছে। এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
তার প্রশ্নের উত্তরে জেফ রাথক বলেন, আমাদের দূতাবাস এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ করার মতো আমার কাছে আর কিছু নেই। আমি দূতাবাসের ওই বিবৃতিই আপনার জন্য তুলে ধরলাম।
প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে: অধিকার
সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান ও বিভিন্ন অনিয়মের মধ্য দিয়ে ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে প্রহসনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করছে ‘অধিকার’। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার এই সংকট ও এব্যাপারে সৃষ্ট ব্যাপক হতাশাজনক পরিস্থিতিতে অধিকার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। অধিকার মনে করে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া বাতিল করে দেশকে এক চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৪ এর ৫ই জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচন এবং ২০১৪ এর উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অধিকার আশা করে, সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবিলম্বে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে দ্রুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে। নতুবা জনগণ প্রতারিত হতেই থাকবে; যা দেশকে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবে। এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এসব মন্তব্য করে। অধিকার জানায়, তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন অধিকারকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়নি। নির্বাচনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে অধিকার-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার কর্মীরা ভোটকেন্দ্রগুলোর বাইরে থেকে নির্বাচনের সার্বিক অবস্থা এবং সহিংস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। আর চট্টগ্রামে মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে জড়িতরা অনুমতি নিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়াও বিভিন্নভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে সমন্বয় করে রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়।
অধিকার-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই সম্প্রতি সরকার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচনের আগে থেকেই রাস্তায় নামলে গ্রেপ্তার ও বাধার সম্মুখীন হয়েছেন ২০দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থী যেমন গণসংহতি আন্দোলনের মেয়রপ্রার্থী এবং সিপিবি-বাসদের মেয়রপ্রার্থীর সমর্থকদের ওপরও বিভিন্ন জায়গায় হামলা করে সরকার সমর্থকরা। নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে গিয়ে বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িতে গুলিবর্ষণ সহ কয়েকবার হামলা করেছে সরকার সমর্থকরা। সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের আগে গত ২৩শে এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন ‘নির্বাচনে কিভাবে জয়ী হতে হয় আওয়ামী লীগ তা ভালোভাবেই জানে’। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাপকভাবে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এর প্রতিবাদে দুপুর ১২টার পর তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল সমর্থিত প্রার্থীরা এবং বামপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থী জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী আবদুল্লাহ আল কাফী ও বজলুর রশীদ ফিরোজ এবং জাতীয় পার্টির সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমদ মিলন নির্বাচন বর্জন করেন। বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও সহিংস ঘটনা ঘটার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন থাকলেও তাদের নিষ্ক্রিয়তা ছিল দৃশ্যমান এবং অনেক জায়গাতেই তাদেরকে সরকার সমর্থকদের সহায়তা করতে দেখা গেছে। এছাড়া, গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন জায়গায় সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তোলার সময় বাধা দেয়া হয়।
অধিকার তাদের প্রতিবেদনে বলে, নির্বাচনের আগের রাতেই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্র দখলের অভিযোগ পাওয়া যায়। গভীর রাতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোনে এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে একাধিক কেন্দ্র দখলের খবর আসে। কোথাও কোথাও প্রিজাইডিং অফিসারকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। ঢাকা দক্ষিণের খিলগাঁও সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার স্কুলের (কেন্দ্র নং-১৯) প্রিজাইডিং অফিসারকে ছুটি দেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয় সরকার সমর্থকরা। সরজমিন সেখানে গিয়ে কেন্দ্রের বাইরে যুবলীগের কর্মীরা পাহারা দিচ্ছে এমন দৃশ্য দেখা যায়। একই রকম চিত্র দেখা গেছে খিলগাঁও সরকারি কলোনি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খিলগাঁও মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র, ঢাকা উত্তর ৩৬ নং ওয়ার্ডের শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নাখালপাড়া আলী হোসেন স্কুলেও।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণের নারিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দরজা বন্ধ করে ভোট দেয়া হয়। এই সময় সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে দেয়া হচ্ছিল না বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় ভোটাররা। এই কেন্দ্রটি আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন ও কাউন্সিলর প্রার্থী সারোয়ার হাসানের এজেন্টরা দখলে নিয়ে নেন। এই কেন্দ্রের ভোটার আবুল কালাম তার পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে ভোট দিতে যান, কিন্তু কেন্দ্রে ঢোকার পর তাদের বলা হয় ‘ভোট দেয়া হয়ে গেছে’। দক্ষিণ মৈশণ্ডি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রবেশ পথে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী সাঈদ খোকন ও কাউন্সিলর প্রার্থী সারোয়ার হাসানের ব্যাজ পরে শতাধিক ব্যক্তি ভোটকেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টায় ঐ কেন্দ্রে ভোটাররা ঢুকতে চাইলে ব্যাজ পরা কয়েকজন যুবক তাদের বাধা দিয়ে বলে ‘ওদিকে যায়েন না। দুইটার পরে আসেন’। ঢাকা উত্তরের মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ইনস্টিটিউট ভোট কেন্দ্র থেকে ২০দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্টদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। পুলিশের দাবি তারা মামলার আসামি। ঢাকা উত্তরের মোহাম্মদপুর এলাকার তিনটি ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের ছবি তুলতে বাধা দেয় পুলিশ। পুলিশের এস আই গোলাম কবির জানান, ‘পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে গণমাধ্যমকর্মীদের ছবি তুলতে দেয়া হচ্ছে না’। এছাড়া, ঢাকা উত্তরের মিরপুর ১১ নং ওয়ার্ডের বাঙলা উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের ঢুকতে বাধা দেয় সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ। ঢাকা উত্তরে এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউট ভোটকেন্দ্র ও দক্ষিণে ফরিদাবাদ মাদরাসা ভোটকেন্দ্র ছাড়া আর কোথাও কোন বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে ভোটকেন্দ্রের বাইরে দেখা যায়নি। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে সরকার সমর্থিত প্রার্থীর লোকজনকে ভোটার স্লিপ বিতরণ করতে দেখা গেছে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের সমর্থকদের ভোটার স্লিপ দিতে দেয়া হয়নি। আবার পুলিশ সরকারি দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোস্টার সংবলিত ভোটার স্লিপ ছাড়া সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন অনেক ভোটার। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ইস্টবেঙ্গল ইনস্টিটিউশন ভোটকেন্দ্রে সকাল সাড়ে ৯টায় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী সাঈদ খোকনের ব্যাজ লাগানো কয়েকশ’ লোক ভোটকেন্দ্রের চারপাশে অবস্থান নেয়। এই সময় ২০/২৫ জন কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে। আধাঘণ্টারও কিছু বেশি সময় পর তারা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসে। সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা দুইজন নারী ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিকারকে জানান, সকাল ৯টায় তারা ভোটকেন্দ্রে এসেছেন। কেন্দ্রে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন লোক এসে তাদের বলেন ‘আপনাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে, আপনারা চলে যান।’ ঢাকা দক্ষিণের পগোজ স্কুল ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই গ্রুপের সমর্থকদের মধ্যে জালভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। এই সময় একপক্ষ কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। ঘণ্টাখানেক পর আবারও ভোটগ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে আতঙ্কে সাধারণ ভোটাররা কেন্দ্র ছেড়ে চলে যান। ফরিদাবাদ মাদরাসা ভোটকেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুল মান্নানের ভোটকেন্দ্র সংলগ্ন স্লিপ প্রদান ক্যাম্প ভাঙচুর করে সরকার সমর্থকরা। তেজগাঁও সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের একটি ভোটকেন্দ্রে বুথ দখল করে একদল কর্মীকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর প্রতীকে ব্যাপকভাবে সিল মারতে দেখা গেছে। এই সময় ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং অফিসার নিষ্ক্রিয় হয়ে বসেছিলেন। এই ভোট জালিয়াতির ঘটনা বিবিসি’র এক সংবাদদাতা প্রত্যক্ষ করেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আলী আহমেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শুরু হলে তিন-চারশ’ যুবক সব ভোটারদের বের করে দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ব্যালটে সিল মারার পর মিছিল করে। সকাল আনুমানিক ৯টায় ফতেয়াবাদ ছড়ারকুল এলাকার আলি আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র এবং সকাল আনুমানিক সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রামের মেরিট বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গোলাগুলি ছুড়ে দখলে নেয়। এছাড়া, বলিহার হাট সানোয়ারা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর বারোটায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়।
নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়নি: ইডব্লিউজি
তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)। নির্বাচনের দিন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নির্বাচনী অনিয়ম এবং সহিংসতার ঘটনায় ভরপুর ছিল বলে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের পর্যবেক্ষণ তথ্য তুলে ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার এ জোট। পর্যবেক্ষকদের মতে, জোর করে ব্যালটে সিল, কেন্দ্র দখল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ নানা অনিয়ম- অব্যবস্থাপনা ছিল সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে থাকা ৯৯ শতাংশ ভোট কেন্দ্রে। সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে সংস্থাটি। তিন সিটি করপোরেশনের ৬১৯টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছে ইডব্লিউজির সদস্যরা। পর্যবেক্ষকদের দেয়া ভোট চিত্রের তথ্য দেখে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ব্যালট ছিনতাই করে সিল মারার ঘটনা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোট কক্ষ দখল এবং নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। পর্যবেক্ষিত অনেক ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ কার্যক্রমের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও নানা ধরনের নির্বাচনী অনিয়মের কারণে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সার্বিক সততা ক্ষুণ্ন হয়েছে।
ইডব্লিউজি পর্যবেক্ষণ করা ভোট কেন্দ্রের মধ্যে জোরপূর্বক ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৩৮টিতে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫৫, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৪৬ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৩৭টি। সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৬৪টি। তার মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬৬, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২৬ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৭২টি। এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ৭৮টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২৮, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৯ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৩১টি। ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে ১০২টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ঘটেছে ৩৩, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩৯ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৩০টি। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৫৮টি ভোট কেন্দ্র। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২১, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ছয় ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩১টি। এ ছাড়াও পর্যবেক্ষিত ভোট কেন্দ্রের মধ্যে প্রতি সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে দুই জন করে ছয় জনকে কেন্দ্রের ভেতর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি ঘটনার সুনির্দিষ্ট উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়। এসব অনিয়ম ও সহিংস ঘটনা ব্যাপক ঘটনার অংশমাত্র। এসব ঘটনার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে তিন সিটি করপোরেশনে যেসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা নির্বাচনী ফলকে পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিটি ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা, নির্বাচন কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই ঘটেছে বলে জানান ইডব্লিউজির সদস্যবৃন্দ। উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা জানান, নির্বাচনের দিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আট নম্বর ওয়ার্ডে সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে ২৫-৩০ জন জোর করে কেন্দ্রে ঢোকে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভীতিময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে বেশির ভাগ ভোটার আতঙ্কে কেন্দ্র ছেড়ে চলে যান। যারা কেন্দ্র ছেড়ে যেতে পারেননি তাদের মারধর করা হয়। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে দুপুর ১২টা ৮মিনিটে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। ১০ নম্বর ওয়ার্ডে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজনের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বিকাল ৪টার দিকে ওই কেন্দ্রে তিনটি ব্যালট বাক্স পুড়িয়ে ফেলা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ডে ১১টা ৩৪মিনিটে ১০-১২ জন একটি কেন্দ্রে প্রবেশ করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়। পরে তাতে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয় তারা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সহযোগিতা করে বলে ইডব্লিউজির সদস্যরা জানান। চার নম্বর ওয়ার্ডে ৩০ মিনিট পর্যন্ত মেয়র প্রার্থীর কোন ব্যালট পেপার ভোটারদের প্রদান করা হয়নি। ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ভোটারদের কেন্দ্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয়নি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্র একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র-যুবকরা দখল করে নেয়। এজেন্ট ও পর্যবেক্ষকদের বের করে দিয়ে ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রথমে এসব ঘটনার পেছনে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের কথা বলা হলেও পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইডব্লিউজির সদস্যরা জানান, আওয়ামী লীগ তথা সরকার দল সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মীরা এসব ঘটিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ইডব্লিউজির এক কর্মী জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ে অবাধে সিল মারার দৃশ্য দেখেন তাদের পর্যবেক্ষক। ওই দৃশ্য দেখার কারণে পিস্তল দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয় তাকে। এসব বিষয়ে ইডব্লিউজির সদস্য তালেয়া রেহমান বলেন, পরে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। এতে নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে। কমিশন সম্পর্কে মন্তব্য কি জানতে চাইলে ইডব্লিউজির সদস্যরা জানান, নির্বাচন কমিশন কোথাও কোথাও পুনঃনির্বাচন করছে কি-না তা এখন দেখার বিষয়। এজন্য কমিশন সম্পর্কে চূড়ান্ত কোন মন্তব্য করতে চান না তারা। তবে শুরু থেকেই নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেছে ইডব্লিউজি। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ১৪০ কার্ডের আবেদন করলেও নির্বাচন কমিশন তাদের মাত্র ৩০টি কার্ড প্রদান করে বলে জানান তারা। সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে ইডব্লিউজির সদস্য কামরুল হাসান মঞ্জু বলেন, জোর করে ব্যালটে সিল, কেন্দ্র দখল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ নানা অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ছিল ৯৯ শতাংশ ভোট কেন্দ্রে। এ বিষয়ে ইডব্লিউজির সদস্য তালেয়া রেহমান জানান, পর্যবেক্ষিত ভোট কেন্দ্র অনুসারে এটি বলেছেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন পাঠ করেন, ইডব্লিউজির পরিচালক ড. মো. আবদুল আলীম। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।
নজিরবিহীন কারচুপি হয়েছে: টিআইবি
তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি হয়েছে উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির এক বিবৃতিতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রনির্ভর নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ব্যর্থতায় গভীর হতাশা প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রে গোলযোগ ও সহিংসতা, ভোট দেয়ায় বাধা, দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে অনৈতিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে বলে দাবি টিআইবি’র। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, বিতর্কিতভাবে মাঝপথে নির্বাচন বর্জন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার পথে নতুন করে ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় সকল রাজনৈতিক দলকে সংযত, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
গতকাল এক বিবৃতিতে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ও পেশিশক্তির প্রয়োগে ব্যাপক অনিয়ম সংঘটিত হওয়ায় সদ্য-সমাপ্ত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনী আইনপ্রয়োগসহ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ব্যাপক কারচুপির নির্ভরযোগ্য তথ্য আর প্রমাণ থাকার পরেও কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অস্বীকৃতি, মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে বিব্রত করেছে। যথাযথ দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন শুধু যে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, বরং কমিশন ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আচরণ করায় সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ও জন-আস্থা ধূলিসাৎ হয়েছে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী একদিকে নীরব দর্শক ও অন্যদিকে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করে শুধু ব্যর্থই হয়েছে তাই নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক শিখণ্ডি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উপর মহলের নির্দেশের অজুহাত দেখিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশী-বিদেশী সংস্থার প্রতিনিধিদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদানে ব্যর্থ হয়ে এই বাহিনী তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার এরূপ ব্যর্থতা মানুষের ভোটের অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব করেছে এবং একইসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানই নিজেদেরকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিব্রত করেছে বলে মনে করছে টিআইবি। অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঝপথে নির্দলীয় এই নির্বাচন বিতর্কিতভাবে বর্জন করে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নতুন করে ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনীতি থেকে উত্তরণে যে ইতিবাচক সুযোগের সৃষ্টি হয়েছিল, মঙ্গলবারের তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনই সামগ্রিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির ঝুঁকি পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জনজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সকল দলসমূহকে রাজনৈতিক সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক চর্চার ধারা অনুশীলন ও তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রতারণায় পর্যবসিত
আরেকটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যক্ষ করলো বাংলাদেশ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া প্রতারণায় পর্যবসিত হয়েছে। দুই শহরজুড়ে সরকারদলীয় ক্যাডার, পোলিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কারচুপি ও বাক্সে গণহারে ব্যালট ঢুকিয়ে নির্বাচনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। নির্বাচন কমিশন শাসক দলের জন্য সকল পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এ ধরনের নির্বাচন হচ্ছে উচ্চপদস্থ অভিজাতদের বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের মূল কারণ। একটি ত্রুটিপূর্ণ বিচারবিভাগ ও দুর্বল প্রতিষ্ঠান থাকার সুবিধা তারা ভোগ করেন। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি ও সিটি নির্বাচনের মতো ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন রাষ্ট্রের কার্যাবলির প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা আরও বাড়ায়। গতকাল সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে এসব কথা বলেছে হংকংভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছে তারা। এতে আরও বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলেরই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ব্যাপকহারে সহিংসতা হয়েছে। এর ফলে ভোটাররা বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারেন নি। দুপুরের মধ্যে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে পুলিশ ও পোলিং কর্মকর্তারা ভোটারদের ভোট না দিয়ে চলে যেতে বলেন। ভোটারদের জানিয়ে দেয়া হয়, তাদের ভোট ইতিমধ্যেই দিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি বহু প্রার্থী স্বয়ং নিজেই ভোট দিতে পারেন নি! শাসক দল সমর্থিত প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছাড়া আর সকল প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। এজেন্টদের অনেককে আবার আক্রমণ করা হয়েছে, কিংবা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের কাছে বারবার লিখিত অভিযোগ করেছেন প্রতিযোগী প্রার্থীরা। তবে তাদের অভিযোগ সত্ত্বেও সহিংসতা ও নির্বাচনে নগ্ন জালিয়াতি থামাতে কোন ভূমিকাই নেয়া হয়নি। এরই ফলশ্রুতিতে বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিকালের মধ্যেই ভোট বর্জন করেন।
পুলিশ সাংবাদিকদের নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে বাধা দিয়েছে। এ ছাড়া কারচুপির ভিডিও ও ছবি তুলতেও পুলিশ বাধা সৃষ্টি করেছে। অন্তত এক ডজন সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, অথবা ভেঙে ফেলা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, গণমাধ্যম সফলভাবে নির্বাচনী কারচুপির খবর সংগ্রহ করেছে। সেসব পত্রপত্রিকা ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারও হয়েছে।
তবে হাস্যকর হলেও, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে’। সিইসি ও নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কোন বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সিইসি সকল ধরনের নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তার ভাষায়, সেসব ‘বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা’। প্রকৃতপক্ষে, নির্বাচন কমিশন শাসক দলের জন্য সকল পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এ দলটিই ‘যে কোন মূল্যে’ সিটি করপোরেশন নির্বাচন জয়ের ইচ্ছার কথা ঘোষণা দিয়েছিল।
এটি একটি প্রকৃত তথ্য যে, বিশ্বাসযোগ্য ও সামর্থ্যবান কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব এদেশে নেই। সেটা হোক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, হোক নির্বাচন কমিশন কিংবা বিচার বিভাগ। সাধারণত, বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বাস করে যে, বিরোধী দলের কর্মী ব্যতীত দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হবে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামে যে লজ্জাকর ঘটনাসমূহ ঘটেছে, তার দায়ভার নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বর্তমান সরকার ও পূর্বের সকল সরকারসমূহের ভাগাভাগি করে নেয়া উচিত বাংলাদেশের সুশীল সমাজ নিরপেক্ষভাবে আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সমাজে তাদের ভূমিকা পালনে আদর্শ অবস্থান সমুন্নত রাখতেও ব্যর্থ হয়েছে। তাই এ লজ্জার দায়ভার তাদেরও বহন করা উচিত।
বাংলাদেশের এসব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন দেশটির মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়। আইনের শাসন সমুন্নত রাখার সামর্থ্য, স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্বের ব্যাপক অভাব রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে। এসব দুর্বল প্রতিষ্ঠানের ওপর ছড়ি ঘুরানোটা এক ধরনের বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ ছাড়াও রয়েছে, গঠনমূলক পদক্ষেপের বদলে গায়ের জোরে রাজনৈতিক পদ কেড়ে নেয়ার গেঁড়ে বসা অভ্যাস।
নিকট ভবিষ্যতে একটি প্রগতিশীল ও রাজনৈতিক বাংলাদেশ দেখতে যারা আগ্রহী, তাদের উচিত, ‘কারচুপির তদন্ত হবে’- এমন বিভ্রম থেকে বেরিয়ে আসা। বাংলাদেশে এসব কারচুপিকে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বলা হয়।
সময় ও সমপদ নষ্টের বদলে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের উপযোগী করে গড়ে তোলাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জনগণ তাদের করের অর্থ প্রদান করছে, গণতন্ত্র ও সমাজে বৃহত্তর ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করছে। এসব বাস্তবায়নে বিলম্ব ও ব্যর্থতা ঘটলে, কর্তৃত্বপরায়ণ ও বিশৃঙ্খল শাসনব্যস্থার অধীনে আরও অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। আরও হতাশার জন্ম দিতে পারে। এ অবস্থায়, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়তে প্রয়োজনীয় মনোযোগ না দিলে, সবচেয়ে বিপজ্জনক উগ্রপন্থিরাই লাভবান হবে বেশি। তাদের শক্তিবৃদ্ধি জাতীয় নিরাপত্তা ও এ অঞ্চলের বৈদেশিক নিরাপত্তার জন্য আরও বৃহৎ সমস্যা সৃষ্টি করবে।
ভোট কারচুপির তদন্ত চায় জাতিসংঘ
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট কারচুপির সব অভিযোগের তদন্ত চায় জাতিসংঘ। এজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। পাশাপাশি তিনি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করার জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আবারও আহ্বান জানিয়েছেন। সব রাজনৈতিক দলকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের মতপার্থক্য দূর করার আহ্বান জানান বান কি মুন। মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র ফারহান হক ২৮শে এপ্রিল নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন। এ সময় উঠে আসে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের প্রসঙ্গ। বলা হয়, ব্যাপক ভোট কারচুপি হয়েছে নির্বাচনে। ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। পোলিং স্টেশনগুলোতে আগেই ব্যালট ভরা হয়েছে। এমনকি সাংবাদিকদের প্রহার করা হয়েছে। নির্বাচনের ফল প্রচারে মিডিয়াকে বাধা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হতাশা প্রকাশ করেছে। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের এমন সব বিষয়ের জবাব দেন ফারহান হক। তার কাছে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন- আপনাকে ধন্যবাদ, ফারহান। জাতিসংঘ অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু, মঙ্গলবার আমরা বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তেমনটা দেখতে পাই নি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচন মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকাল ৪টায় শেষ হয়েছে। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। আগেই ভোটপূর্ণ ভোটকেন্দ্র পাওয়া গেছে। এমনকি সাংবাদিকদেরও মারধর করা হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলের বিষয়ে প্রতিবেদন করতে গণমাধ্যমকে বাধা দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে এ ধরনের ভোট জালিয়াতি ও সহিংসতার বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। এ বিষয়গুলোতে আপনার মন্তব্য কি?
উত্তরে ফারহান হক বলেন- কারচুপির অভিযোগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে মহাসচিব অবগত রয়েছেন। তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সব অভিযোগ তদন্ত করতে এবং বিরোধী দলকে তাদের উদ্বেগ প্রকাশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সব পক্ষকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য প্রকাশের অনুরোধ জানিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে সব রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান গুরুত্ব সহকারে পুনর্ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ব্রিফিংয়ে আলোচনা হয়। সেখানে এক সাংবাদিক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী জেফ রাথকের কাছে জানতে চান- বাংলাদেশে মঙ্গলবার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। এ নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তিনি সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। বিএনপি মধ্যপথে নির্বাচন বর্জন করেছে। এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
তার প্রশ্নের উত্তরে জেফ রাথক বলেন, আমাদের দূতাবাস এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ করার মতো আমার কাছে আর কিছু নেই। আমি দূতাবাসের ওই বিবৃতিই আপনার জন্য তুলে ধরলাম।
প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে: অধিকার
সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান ও বিভিন্ন অনিয়মের মধ্য দিয়ে ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে প্রহসনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করছে ‘অধিকার’। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার এই সংকট ও এব্যাপারে সৃষ্ট ব্যাপক হতাশাজনক পরিস্থিতিতে অধিকার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। অধিকার মনে করে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া বাতিল করে দেশকে এক চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৪ এর ৫ই জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচন এবং ২০১৪ এর উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অধিকার আশা করে, সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবিলম্বে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে দ্রুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে। নতুবা জনগণ প্রতারিত হতেই থাকবে; যা দেশকে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবে। এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এসব মন্তব্য করে। অধিকার জানায়, তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন অধিকারকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়নি। নির্বাচনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে অধিকার-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার কর্মীরা ভোটকেন্দ্রগুলোর বাইরে থেকে নির্বাচনের সার্বিক অবস্থা এবং সহিংস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। আর চট্টগ্রামে মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে জড়িতরা অনুমতি নিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়াও বিভিন্নভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে সমন্বয় করে রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়।
অধিকার-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই সম্প্রতি সরকার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচনের আগে থেকেই রাস্তায় নামলে গ্রেপ্তার ও বাধার সম্মুখীন হয়েছেন ২০দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থী যেমন গণসংহতি আন্দোলনের মেয়রপ্রার্থী এবং সিপিবি-বাসদের মেয়রপ্রার্থীর সমর্থকদের ওপরও বিভিন্ন জায়গায় হামলা করে সরকার সমর্থকরা। নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে গিয়ে বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িতে গুলিবর্ষণ সহ কয়েকবার হামলা করেছে সরকার সমর্থকরা। সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের আগে গত ২৩শে এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন ‘নির্বাচনে কিভাবে জয়ী হতে হয় আওয়ামী লীগ তা ভালোভাবেই জানে’। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাপকভাবে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এর প্রতিবাদে দুপুর ১২টার পর তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল সমর্থিত প্রার্থীরা এবং বামপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থী জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী আবদুল্লাহ আল কাফী ও বজলুর রশীদ ফিরোজ এবং জাতীয় পার্টির সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমদ মিলন নির্বাচন বর্জন করেন। বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও সহিংস ঘটনা ঘটার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন থাকলেও তাদের নিষ্ক্রিয়তা ছিল দৃশ্যমান এবং অনেক জায়গাতেই তাদেরকে সরকার সমর্থকদের সহায়তা করতে দেখা গেছে। এছাড়া, গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন জায়গায় সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তোলার সময় বাধা দেয়া হয়।
অধিকার তাদের প্রতিবেদনে বলে, নির্বাচনের আগের রাতেই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্র দখলের অভিযোগ পাওয়া যায়। গভীর রাতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোনে এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে একাধিক কেন্দ্র দখলের খবর আসে। কোথাও কোথাও প্রিজাইডিং অফিসারকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। ঢাকা দক্ষিণের খিলগাঁও সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার স্কুলের (কেন্দ্র নং-১৯) প্রিজাইডিং অফিসারকে ছুটি দেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয় সরকার সমর্থকরা। সরজমিন সেখানে গিয়ে কেন্দ্রের বাইরে যুবলীগের কর্মীরা পাহারা দিচ্ছে এমন দৃশ্য দেখা যায়। একই রকম চিত্র দেখা গেছে খিলগাঁও সরকারি কলোনি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খিলগাঁও মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র, ঢাকা উত্তর ৩৬ নং ওয়ার্ডের শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নাখালপাড়া আলী হোসেন স্কুলেও।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণের নারিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দরজা বন্ধ করে ভোট দেয়া হয়। এই সময় সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে দেয়া হচ্ছিল না বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় ভোটাররা। এই কেন্দ্রটি আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন ও কাউন্সিলর প্রার্থী সারোয়ার হাসানের এজেন্টরা দখলে নিয়ে নেন। এই কেন্দ্রের ভোটার আবুল কালাম তার পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে ভোট দিতে যান, কিন্তু কেন্দ্রে ঢোকার পর তাদের বলা হয় ‘ভোট দেয়া হয়ে গেছে’। দক্ষিণ মৈশণ্ডি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রবেশ পথে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী সাঈদ খোকন ও কাউন্সিলর প্রার্থী সারোয়ার হাসানের ব্যাজ পরে শতাধিক ব্যক্তি ভোটকেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টায় ঐ কেন্দ্রে ভোটাররা ঢুকতে চাইলে ব্যাজ পরা কয়েকজন যুবক তাদের বাধা দিয়ে বলে ‘ওদিকে যায়েন না। দুইটার পরে আসেন’। ঢাকা উত্তরের মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ইনস্টিটিউট ভোট কেন্দ্র থেকে ২০দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্টদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। পুলিশের দাবি তারা মামলার আসামি। ঢাকা উত্তরের মোহাম্মদপুর এলাকার তিনটি ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের ছবি তুলতে বাধা দেয় পুলিশ। পুলিশের এস আই গোলাম কবির জানান, ‘পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে গণমাধ্যমকর্মীদের ছবি তুলতে দেয়া হচ্ছে না’। এছাড়া, ঢাকা উত্তরের মিরপুর ১১ নং ওয়ার্ডের বাঙলা উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের ঢুকতে বাধা দেয় সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ। ঢাকা উত্তরে এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউট ভোটকেন্দ্র ও দক্ষিণে ফরিদাবাদ মাদরাসা ভোটকেন্দ্র ছাড়া আর কোথাও কোন বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে ভোটকেন্দ্রের বাইরে দেখা যায়নি। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে সরকার সমর্থিত প্রার্থীর লোকজনকে ভোটার স্লিপ বিতরণ করতে দেখা গেছে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের সমর্থকদের ভোটার স্লিপ দিতে দেয়া হয়নি। আবার পুলিশ সরকারি দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোস্টার সংবলিত ভোটার স্লিপ ছাড়া সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন অনেক ভোটার। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ইস্টবেঙ্গল ইনস্টিটিউশন ভোটকেন্দ্রে সকাল সাড়ে ৯টায় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী সাঈদ খোকনের ব্যাজ লাগানো কয়েকশ’ লোক ভোটকেন্দ্রের চারপাশে অবস্থান নেয়। এই সময় ২০/২৫ জন কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে। আধাঘণ্টারও কিছু বেশি সময় পর তারা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসে। সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা দুইজন নারী ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিকারকে জানান, সকাল ৯টায় তারা ভোটকেন্দ্রে এসেছেন। কেন্দ্রে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন লোক এসে তাদের বলেন ‘আপনাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে, আপনারা চলে যান।’ ঢাকা দক্ষিণের পগোজ স্কুল ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই গ্রুপের সমর্থকদের মধ্যে জালভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। এই সময় একপক্ষ কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। ঘণ্টাখানেক পর আবারও ভোটগ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে আতঙ্কে সাধারণ ভোটাররা কেন্দ্র ছেড়ে চলে যান। ফরিদাবাদ মাদরাসা ভোটকেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুল মান্নানের ভোটকেন্দ্র সংলগ্ন স্লিপ প্রদান ক্যাম্প ভাঙচুর করে সরকার সমর্থকরা। তেজগাঁও সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের একটি ভোটকেন্দ্রে বুথ দখল করে একদল কর্মীকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর প্রতীকে ব্যাপকভাবে সিল মারতে দেখা গেছে। এই সময় ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং অফিসার নিষ্ক্রিয় হয়ে বসেছিলেন। এই ভোট জালিয়াতির ঘটনা বিবিসি’র এক সংবাদদাতা প্রত্যক্ষ করেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আলী আহমেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শুরু হলে তিন-চারশ’ যুবক সব ভোটারদের বের করে দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ব্যালটে সিল মারার পর মিছিল করে। সকাল আনুমানিক ৯টায় ফতেয়াবাদ ছড়ারকুল এলাকার আলি আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র এবং সকাল আনুমানিক সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রামের মেরিট বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গোলাগুলি ছুড়ে দখলে নেয়। এছাড়া, বলিহার হাট সানোয়ারা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর বারোটায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়।
No comments