শুধু এরশাদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড? by সোহরাব হাসান

২৮ এপ্রিল যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে এখন আর কারও সন্দেহ নেই। তবে নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও অবাধ হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহমুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত ভোটাররা নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কি না? ভোট দিতে পারলেও ফলাফলে জনরায়ের প্রতিফলন ঘটবে কি না?
এই আশঙ্কার কারণ প্রধানত রাজনৈতিক হলেও রাজনৈতিক দলের বাইরেও প্রভাব বিস্তারকারী নানা পক্ষ আছে। আছে অনেক প্রভাবশালী গোষ্ঠী। বিশেষ করে সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও নারী ভোটারদের প্রতি স্থানীয় প্রভাবশালী ও ধর্মীয় আধিপত্যের বিষয়টি উপেক্ষণীয় নয়। তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে জড়িত একটি সংস্থার প্রধান জানিয়েছেন, সবাই রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলেন, কিন্তু জনসংখ্যার অর্ধেক নারী এবং তার বাইরে সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও গরিব মানুষের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা কেউ বলেন না। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তিন সিটিতে সংখ্যালঘু ভোটের হার ১০-১২ শতাংশ হলেও তাদের প্রার্থিতার হার মাত্র দেড় শতাংশ। তিন সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নারী প্রার্থী শূন্য।
প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পক্ষ ও প্রার্থীর মতো ভোটারদের জন্যও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা জরুরি। পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী লাঞ্ছনার ঘটনাটির সঙ্গে সিটি নির্বাচনের গভীর যোগসূত্র আছে বলে জানালেন এক নারীনেত্রী। তাঁর মতে, নারী ভোটাররা যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে না যান, সে জন্যই পরিকল্পিতভাবে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হামলা চালানো হয়েছে। তবে কারা এই হামলা চালিয়েছে, গত ১২ দিনেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বের করতে না পারায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও আনন্দমুখর পরিবেশে হবে কি না, সেটি অনেকাংশে নির্ভর করছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার ওপর। আবার প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থক রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ভূমিকাও কম নয়। কোনো পক্ষের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড পুরো আয়োজনটাই ভন্ডুল করে দিতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। প্রার্থী নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করলে তারা যেমন তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পরে, তেমনি প্রয়োজনে নির্বাচন বাতিল বা স্থগিত করতে পারে। সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে হলে প্রার্থীকে যেমন আইন মেনে চলতে হবে, তেমনি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের মনে রাখা প্রয়োজন, এক অভাবিত রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনের প্রতি কেবল দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষই তাকিয়ে নেই, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও এটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। অর্থাৎ এটি নিছক স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন নয়, তার চেয়েও কিছু বেশি। এই নির্বাচনটি সুষ্ঠু হলে তিন সিটি করপোরেশনভুক্ত মানুষ কেবল নিজেদের পছন্দসই প্রতিনিধিই বেছে নিতে পারবেন না, নির্বাচনটি বাংলাদেশের রাজনীতির মোড়ও ঘুরিয়ে দিতে পারে। আর যদি সেটি সম্ভব না হয়, সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠবে।
তিন সিটি করপোরেশনে নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে পরিবেশ-পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত ছিল এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পক্ষ থেকে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কমিশন ও তাদের পক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তারা দলমত-নির্বিশেষে বেশ কয়েকজন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রথমত, নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে কমিশনের দ্বৈত ও স্ববিরোধী অবস্থান। এ কথা ঠিক যে নির্বাচনের মতো সম্পূর্ণ বেসামরিক বিষয়ে সামরিক বাহিনীকে না টানলেই ভালো হতো। কিন্তু রাজনৈতিক পক্ষগুলোর পারস্পরিক অনাস্থা এবং বেসামরিক প্রশাসনের দলীয় পক্ষপাত এতটাই প্রকট যে গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ মনে করে, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আরেকটি মজার বিষয় হলো ক্ষমতাসীনেরা বরাবর সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে এবং বিরোধী দল পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে। বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে অনেক ভেবেচিন্তে নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিল, নির্বাচনের চার দিন আগে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েন করা হবে। সব নির্বাচনে সেটাই হয়ে থাকে।
কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, কয়েক ঘণ্টা না যেতেই কমিশন সিদ্ধান্তটি পাল্টে জানিয়ে দিল, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নয়, সেনাবাহিনী রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সেনানিবাসেই অবস্থান করবে এবং রিটার্নিং কর্মকর্তার চাহিদা অনুযায়ী তারা মাঠে নামবে। তাদের এই প্রস্তাব অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় শত শত ভোটকেন্দ্র আছে। এ অবস্থায় কোনো কেন্দ্রে গোলযোগ হলে সেই কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কখন রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানাবেন এবং তিনিই বা কখন সেনানিবাসে অবস্থানরত রিজার্ভ ফোর্সকে তলব করবেন? সেনা তলব করার আগেই তো যা ঘটার ঘটে যাবে।
অন্যদিকে সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকেরা তিন দিন ধরে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালালেও নির্বাচন কমিশন টুঁ শব্দ করেনি। অন্য কোনো ঘটনায় তিনি ক্ষমতাসীনদের হাতে আক্রান্ত হলে নির্বাচন কমিশনের বলার কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি নির্বাচন কমিশন ঘোষিত নির্বাচনে তাঁর সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচার করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। এর দায় কমিশন এড়াতে পারে না।
ঘটনার পাঁচ দিন পর নির্বাচন কমিশন জানায়, গাড়িবহর নিয়ে খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। শুক্রবারে কমিশনাররা কেউ অফিসে না থাকায় একজন কর্মকর্তা তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই কৈফিয়তনামায় সই নিয়ে এসেছেন। খালেদা জিয়া আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে নির্বাচন কমিশন অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু কমিশনের নোটিশ অগ্রাহ্য করে যখন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করে প্রচার অব্যাহত রাখেন, তখন কমিশনকে তৎপর হতে দেখা যায় না। তারা সাবেক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। তাহলে কি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড শুধু এরশাদের জন্য? একজন গণধিক্কৃত স্বৈরাচারের প্রতি কমিশনের এ কেমন বদান্যতা?
তাই কমিশনকে বলব, এখনো সময় আছে। আরেকটি মাগুরা মার্কা নির্বাচন না চাইলে এখনই সজাগ হোন। সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.