মেয়রের হাতে কি আলাদিনের চেরাগ আছে? by মহিউদ্দিন আহমদ
অনেক বছর আগে একটি গান শুনেছিলাম—গণসংগীত।
একটি লাইন এখনো মনে পড়ে: ‘জান দিয়ে ইলেকশন পেলাম লাগল দেশে ধুম’। জনগণের
মৌলিক চাহিদাগুলোর কথা না বলে ভোটের রাজনীতি নিয়ে মাতামাতিকে বিদ্রূপ করে
ষাটের দশকে অনেক বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী এই গানটি গাইতেন। দুদিন পরই হতে
যাচ্ছে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। চারদিকে হইহই-রইরই।
দেশটা ভাসছে নির্বাচনের জোয়ারে।
দেশের আইন অনুযায়ী এই নির্বাচন হবে নির্দলীয় ভিত্তিতে। কিন্তু ঘটা করে যেভাবে দল থেকে মনোনয়ন কিংবা সমর্থন দেওয়া হচ্ছে এবং দলের রাঘববোয়ালেরা যেভাবে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাতে নির্বাচনটা আর নির্দলীয় থাকছে না। মসজিদেও শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনী প্রচার। নির্বাচনের আচরণবিধিকে যেভাবে বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন কমিশন কি নখ-দন্তহীন, না মেরুদণ্ডহীন? নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা অসীম। কিন্তু এই ক্ষমতা বাস্তবে প্রয়োগ করার ইচ্ছা, সাহস ও যোগ্যতা কমিশনের আছে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দল রীতি পাল্টে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার প্রস্তাব করেছে। শিগগিরই হয়তো আইন করে এটা জায়েজ করা হবে। রাজনৈতিক দলের জন্য এটা খুবই দরকার। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি এবং শিখেছি যে মেয়রের কাজ প্রধানত দুটি। দলের জনসভায় লোক সাপ্লাই দেওয়া এবং দলের ক্যাডারদের ঠিকাদারি পাইয়ে দেওয়া। যে ওয়ার্ডে সরকারদলীয় কাউন্সিলর নেই, সেই ওয়ার্ডে কোনো ‘উন্নয়ন’ হয় না, অথবা উন্নয়নের তাবৎ কাজ তত্ত্বাবধান করেন সরকারি দলের পরাজিত প্রার্থী অথবা তাঁর কোনো কুটুম।
আয়তনের দিক থেকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঢাকা একটি ছোট শহর, কিন্তু জনসংখ্যার দিক দিয়ে অনেক বড়। ঢাকার জনসংখ্যা কত? কেউ বলেন দেড় কোটি, কেউবা বলেন দুই কোটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘ঢাকা স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেট্রোপলিটন এরিয়া’র মধ্যে টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার এবং নারায়ণগঞ্জও আছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার জনসংখ্যা এক কোটির মতো। আমাদের তো সবকিছু বাড়িয়ে বলার অভ্যাস। এই শহরে মানুষ গাদাগাদি করে বাস করে। পানীয় জল, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ-সুবিধা এবং ঘরের মান অনুযায়ী বলা চলে এই শহরের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ প্রকৃত অর্থেই বস্তিবাসী। এ রকম সমস্যা-কণ্টকিত একটি জনপদকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্য নিয়ে আসাটা একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যার সমাধান জয় বাংলা কিংবা জিন্দাবাদ স্লোগানের মধ্যে নেই। সাধারণ মানুষের সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারলে নগরবাসী স্বস্তি পাবেন।
এবারের সিটি নির্বাচনে কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য নজরে পড়ছে। মেয়র প্রার্থীরা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। পেছনে তাঁদের রাজনৈতিক মুরব্বিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যতই খিস্তিখেউড় করুন না কেন, প্রার্থীরা কথা বলছেন ভদ্রলোকের মতো, ‘জিব ছিঁড়ে ফেলব’ বা ‘মাটির নিচে পুঁতে ফেলব’—এ-জাতীয় কথা মেয়র প্রার্থীদের মুখে এখনো শোনা যায়নি। এটা ভালো লক্ষণ।
দেশের আইন অনুযায়ী এই নির্বাচন হবে নির্দলীয় ভিত্তিতে। কিন্তু ঘটা করে যেভাবে দল থেকে মনোনয়ন কিংবা সমর্থন দেওয়া হচ্ছে এবং দলের রাঘববোয়ালেরা যেভাবে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাতে নির্বাচনটা আর নির্দলীয় থাকছে না। মসজিদেও শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনী প্রচার। নির্বাচনের আচরণবিধিকে যেভাবে বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন কমিশন কি নখ-দন্তহীন, না মেরুদণ্ডহীন? নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা অসীম। কিন্তু এই ক্ষমতা বাস্তবে প্রয়োগ করার ইচ্ছা, সাহস ও যোগ্যতা কমিশনের আছে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দল রীতি পাল্টে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার প্রস্তাব করেছে। শিগগিরই হয়তো আইন করে এটা জায়েজ করা হবে। রাজনৈতিক দলের জন্য এটা খুবই দরকার। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি এবং শিখেছি যে মেয়রের কাজ প্রধানত দুটি। দলের জনসভায় লোক সাপ্লাই দেওয়া এবং দলের ক্যাডারদের ঠিকাদারি পাইয়ে দেওয়া। যে ওয়ার্ডে সরকারদলীয় কাউন্সিলর নেই, সেই ওয়ার্ডে কোনো ‘উন্নয়ন’ হয় না, অথবা উন্নয়নের তাবৎ কাজ তত্ত্বাবধান করেন সরকারি দলের পরাজিত প্রার্থী অথবা তাঁর কোনো কুটুম।
আয়তনের দিক থেকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঢাকা একটি ছোট শহর, কিন্তু জনসংখ্যার দিক দিয়ে অনেক বড়। ঢাকার জনসংখ্যা কত? কেউ বলেন দেড় কোটি, কেউবা বলেন দুই কোটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘ঢাকা স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেট্রোপলিটন এরিয়া’র মধ্যে টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার এবং নারায়ণগঞ্জও আছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার জনসংখ্যা এক কোটির মতো। আমাদের তো সবকিছু বাড়িয়ে বলার অভ্যাস। এই শহরে মানুষ গাদাগাদি করে বাস করে। পানীয় জল, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ-সুবিধা এবং ঘরের মান অনুযায়ী বলা চলে এই শহরের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ প্রকৃত অর্থেই বস্তিবাসী। এ রকম সমস্যা-কণ্টকিত একটি জনপদকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্য নিয়ে আসাটা একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যার সমাধান জয় বাংলা কিংবা জিন্দাবাদ স্লোগানের মধ্যে নেই। সাধারণ মানুষের সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারলে নগরবাসী স্বস্তি পাবেন।
এবারের সিটি নির্বাচনে কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য নজরে পড়ছে। মেয়র প্রার্থীরা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। পেছনে তাঁদের রাজনৈতিক মুরব্বিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যতই খিস্তিখেউড় করুন না কেন, প্রার্থীরা কথা বলছেন ভদ্রলোকের মতো, ‘জিব ছিঁড়ে ফেলব’ বা ‘মাটির নিচে পুঁতে ফেলব’—এ-জাতীয় কথা মেয়র প্রার্থীদের মুখে এখনো শোনা যায়নি। এটা ভালো লক্ষণ।
মেয়র
প্রার্থীরা তাঁদের ইশতেহারে দুনিয়ার যত সুন্দর শব্দ ছেঁকে তুলেছেন, তা
নাগরিকদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় কোনো আবর্জনা
দেখা যাবে না, সবাই গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি পাবেন, যানজট জাদুঘরে চলে যাবে।
সবাই নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবেন, ইত্যাদি। প্রার্থীরা অনেকেই জানেন না,
তাঁরা তাঁদের এখতিয়ারের বাইরে কথা বলছেন। নির্বাচিত হয়ে যখন এর কোনোটাই
তাঁরা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না, তখন তাঁরা যুক্তি দেখাতে পারবেন, ‘আমাকে
সরকার এই ক্ষমতা দেয়নি, তাই আমি আন্তরিকতা সত্ত্বেও অঙ্গীকার পূরণ করতে
পারিনি।’ নিজস্ব সীমার মধ্যে থেকে প্রার্থীরা যদি কর্মসূচি দেন, তাহলে তা
মনিটর করা সহজ, সম্ভব তাঁদের জবাবদিহির মধ্যে আনা।
মেয়র সাহেবেরা অতীতে শুধু দোকান বানানো আর দোকান বেচাকেনার পেছনেই ছুটেছেন বেশি। কারণ, তাতে ‘নগদ নারায়ণ’ মেলে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ চলাচল করে। তাদের অনেককেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে থাকতে হয়। অথচ তাদের প্রয়োজনমতো ‘পাবলিক টয়লেট’ নেই। ‘পাবলিকের’ সুবিধা হয়, এমন কিছু নিয়ে মেয়র সাহেবেরা বেশি ভাবেন না। অথচ নির্বাচনী ইশতেহারে কেউ একজন বলতে পারতেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে আমি ৫০০ পাবলিক টয়লেট বানাব, ৫০০ একর জমি বনায়ন করব’—এই হচ্ছে তার ম্যাপ এবং লোকেশন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট করে সংখ্যা বা পরিমাণ উল্লেখ করে এবং কত দিনের মধ্যে তার কতটুকু বাস্তবায়ন করা হবে, এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। তাঁদের প্রতিশ্রুতিগুলো একেবারেই সাধারণ, বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং বায়বীয়। ‘সবুজ ঢাকা চাই’ কথাটি যথেষ্ট নয়। বলতে হবে নগরকে আবর্জনা ও দুর্গন্ধমুক্ত করার জন্য আমি এই জায়গায় এত টন ক্ষমতাসম্পন্ন বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরি করব তিন কিংবা চার বছরের মাথায়।
নিরাপদ নগরের কথা বলছেন প্রার্থীরা। নাগরিকেরা আতঙ্কিত। কারণ, অনেক কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা। অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও আছে। একজন মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা আছে। সব কি মিথ্যা মামলা? আমরা কাদের হাতে জিম্মি হব? মাস্তানদের হাতে?
নগরে সেবাদানকারী অনেক সংস্থা কাজ করে। এদের একটির সঙ্গে আরেকটির সমন্বয় নেই। ঢাকা শহর দুই টুকরা করা হলো। সমন্বয়টা হবে কীভাবে? তাঁদের হাতে কি আলাদিনের চেরাগ আছে?
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে’ তর্কযুদ্ধ করতে থাকুন, সাধারণ নাগরিকেরা অস্বস্তিতে আছেন। কারণ, তাঁদের জন্য সমতল জমি তৈরি করে দিচ্ছেন না কেউ। নগর সরকারের নামে মেয়ররা আরও ক্ষমতা চান। নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত ‘স্পেস’ তৈরি করার কথা কেউ ভাবেন না।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
মেয়র সাহেবেরা অতীতে শুধু দোকান বানানো আর দোকান বেচাকেনার পেছনেই ছুটেছেন বেশি। কারণ, তাতে ‘নগদ নারায়ণ’ মেলে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ চলাচল করে। তাদের অনেককেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে থাকতে হয়। অথচ তাদের প্রয়োজনমতো ‘পাবলিক টয়লেট’ নেই। ‘পাবলিকের’ সুবিধা হয়, এমন কিছু নিয়ে মেয়র সাহেবেরা বেশি ভাবেন না। অথচ নির্বাচনী ইশতেহারে কেউ একজন বলতে পারতেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে আমি ৫০০ পাবলিক টয়লেট বানাব, ৫০০ একর জমি বনায়ন করব’—এই হচ্ছে তার ম্যাপ এবং লোকেশন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট করে সংখ্যা বা পরিমাণ উল্লেখ করে এবং কত দিনের মধ্যে তার কতটুকু বাস্তবায়ন করা হবে, এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। তাঁদের প্রতিশ্রুতিগুলো একেবারেই সাধারণ, বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং বায়বীয়। ‘সবুজ ঢাকা চাই’ কথাটি যথেষ্ট নয়। বলতে হবে নগরকে আবর্জনা ও দুর্গন্ধমুক্ত করার জন্য আমি এই জায়গায় এত টন ক্ষমতাসম্পন্ন বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরি করব তিন কিংবা চার বছরের মাথায়।
নিরাপদ নগরের কথা বলছেন প্রার্থীরা। নাগরিকেরা আতঙ্কিত। কারণ, অনেক কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা। অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও আছে। একজন মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা আছে। সব কি মিথ্যা মামলা? আমরা কাদের হাতে জিম্মি হব? মাস্তানদের হাতে?
নগরে সেবাদানকারী অনেক সংস্থা কাজ করে। এদের একটির সঙ্গে আরেকটির সমন্বয় নেই। ঢাকা শহর দুই টুকরা করা হলো। সমন্বয়টা হবে কীভাবে? তাঁদের হাতে কি আলাদিনের চেরাগ আছে?
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে’ তর্কযুদ্ধ করতে থাকুন, সাধারণ নাগরিকেরা অস্বস্তিতে আছেন। কারণ, তাঁদের জন্য সমতল জমি তৈরি করে দিচ্ছেন না কেউ। নগর সরকারের নামে মেয়ররা আরও ক্ষমতা চান। নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত ‘স্পেস’ তৈরি করার কথা কেউ ভাবেন না।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments