নির্বাচন নিয়ে আজিব তামাশা! by ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

ক্ষমতার মজায় বিভোর জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকার তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের অবরোধ আন্দোলনে খানিকটা যতি টানতে চেয়েছিল। সে ক্ষেত্রে তারা আপাতত সফলও হয়েছেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট প্রায় ১০০ দিন ধরে চলা অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেনি বটে, তবে এখন তা অতি সামান্যই কার্যকর আছে। দেশব্যাপী নৈশকোচগুলোর দামি গাড়িগুলো দিনে এক-আধ ট্রিপ মারে। রাতে সাহস পায় না। বসে থাকে। যদি ২০ দলীয় জোট ঘোষণা দিয়ে বলত, এখন আর অবরোধ নেই, তাহলে সম্ভবত এটুকুও থাকত না। সব কিছু ৩ জানুয়ারির আগের অবস্থায় ফেরত যেত। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে আলোচনার টেবিলে উভয় পক্ষ হাতে একটা মুরগি রাখতে চায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমন এক মুরগি ছিল বার্লিন, সোভিয়েতের হাতে।
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে যে পরাজয়ভীতি থেকে দুই টুকরো করা হয়েছিল, সেটি এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। পত্রিকায় কার্টুন দেখলাম, এক ভদ্রলোক যাবেন উত্তরা। সদরঘাট থেকে বাসে উঠেছেন। ফার্মগেটে তাকে বাস থেকে নামিয়ে দেয়া হলো। বলা হলো, ভাই, এইখানে নামেন। এটা ঢাকা দক্ষিণের বাস। উত্তরে যাবে না। বাংলাদেশ এখন আশ্চর্য এক হীরক রাজার দেশ। তারা খেয়াল খুশি মতো সময়ের নিয়ম পাল্টে দেন। অফিসের নিয়ম পাল্টে দেন। শিশুদের স্কুলের নিয়ম পাল্টে দেন। জীবনের স্বাভাবিক গতিপথগুলো অকারণে বদলে দিতে থাকেন।
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে যখন দু’ভাগ করা হয়, তার কিছুকাল আগেও এর মেয়র ছিলেন বিএনপির সমর্থনে নির্বাচিত সাদেক হোসেন খোকা। সরকারের গায়ে একেবারে জ্বালা ধরে গিয়েছিল। খোকা যদিও মেয়াদের চেয়ে বেশি সময় মেয়র পদে আসীন ছিলেন, তবুও আঁতাতের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার মেয়র নির্বাচন দিতে আর সাহস করেনি। ঢাকা সিটি করপোরেশনে দু’জন আমলা প্রশাসক নিয়োগ করেছিল। তারা হয়েছিলেন সুপার ফপ। তখনো ফ্লপ, এখনো ফ্লপ।
২০ দলীয় জোটের অবরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি অবরোধের ধারাবাহিকতায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এ দেশে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়। সে নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টিতেই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। ভোটারেরা কাউকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেননি। কতগুলো লোকের নাম ঘোষণা করে দেয়া হলো। বলা হলো, তারা এখন থেকে সংসদ সদস্য। সাথে সাথে সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন। বিশ্ব ছিঃ ছিঃ করল। দেশের মানুষ ছিঃ ছিঃ করল। সরকার ফিরেও তাকাল না। জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়া হলো।
গত ৫ জানুয়ারি ছিল গণতন্ত্র হত্যার সে ঘটনার প্রথম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে ঢাকায় একটি জনসমাবেশ করতে চেয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। সরকার তাতে বাধা দিতে গিয়ে দু’দিন আগে থেকে ঢাকামুখী সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে রাজধানীকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। তারপর প্রায় তিন মাস ধরে সরকার বেগম জিয়াকে তার গুলশানের কার্যালয়ে বন্দী করে রাখে। সেখানে তাকে প্রায় ৪০ জন কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। তাদের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হলো। বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া হলো। ইন্টারনেট, টেলিফোন সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। এ যেন হিটলারকেও হার মানিয়েছে। এ পরিস্থিতিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কেউ মেনে নেয়নি। বিশ্ববাসী দেখেছে, কিভাবে বাংলাদেশে নতুন এক স্বেচ্ছাচারের জন্ম হয়েছে।
এর মধ্যেই সরকার হুট করে ঢাকার দ্ইু ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণা করায় নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে। নির্বাচনের প্রশ্ন যখনই আসে, সাথে আসে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা। শিডিউল ঘোষণার দায়িত্ব যেমন নির্বাচন কমিশনের, তেমনি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দায়িত্বও নির্বাচন কমিশনের। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দল নয়। এই জোট নির্বাচনমুখী। তা ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন বরাবরই অরাজনৈতিক। রাজনৈতিক দলগুলো এর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করলেও যে কেউ ইচ্ছামতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। এখানে দলীয় মার্কা (প্রতীক) থাকে না। ফলে যারা ভোট ডাকাতি করে, কেন্দ্র দখল করে সিল মারে, তাদের জন্য কাজটা খুব সহজ হয় না।
কিন্তু অসৎ অভিপ্রায়ে আওয়ামী লীগ এই বলে দাবি তোলে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় ভিত্তিতে হওয়া উচিত। বিতর্কিত সংসদের মাধ্যমে সেটি তারা করতেও পারে। অবশ্য এখনো পর্যন্ত তা করেনি। তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন প্রক্রিয়া চূড়ান্তপর্যায়ে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জোর প্রচারণায় নেমে পড়েছে।
জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকার বোধহয় কল্পনাও করেনি যে, এত অত্যাচার নির্যাতন সত্ত্বেও ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বসবে। প্রথম থেকে তাই সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন কী করলে সরকারের সুবিধা হয়, কী করলে ২০ দলীয় জোটকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যায়, সে দিকেই মনোযোগী থেকেছে। প্রথমেই ধরা যাক, আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থিতার কথা। অত্যন্ত ঠুনকো কারণে নির্বাচন কমিশন ২০ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী মিন্টুর প্রার্থিতা বাতিল করে দিলো। ভুলটা ছিল এই- যিনি তার প্রার্থিতায় সমর্থন করেছিলেন, তিনি ঢাকা উত্তরের ভোটার নন। পরে এর আগের এক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার অব: সাখাওয়াত হোসেন টেলিভিশন টকশোতে জানিয়েছিলেন, এ ধরনের ছোটখাটো ভুলের জন্য তারা কখনো কারো প্রার্থিতা বাতিল করেননি। বরং দু-এক ঘণ্টা সময় দিয়ে, তা সংশোধনের সুযোগ করে দিয়েছেন। কমিশন ইচ্ছে করলে সে পথে অগ্রসর হতে পারত।
ঢাকা উত্তরে আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রার্থী হলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হকের সম্ভাবনা ক্ষীণতর হয়ে উঠত। ফলে মিন্টুকে ঠেকানো হলো। দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন। তার বিপরীতে ২০ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী সাবেক মেয়র ও মন্ত্রী মির্জা আব্বাস। নির্বাচনে প্রচারণার জন্য তিনি তার নামে দায়েরকৃত মামলায় জামিন চেয়েছিলেন। দু’একটা শুনানি হয়েছে। নির্বাচন ২৮ এপ্রিল। তার মামলার শুনানির পরবর্তী তারিখ ২৭ এপ্রিল। এদিকে, তাকে গ্রেফতার করা কিংবা তার নির্বাচন প্রচারাভিযানে অংশ নেয়া নিষিদ্ধ রয়েছে।
এত কিছু সত্ত্বেও যখন ২০ দলীয় জোট নির্বাচন নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকল, তখন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার চাপাবাজ মন্ত্রীরা একসুরে এই বলে রা তুললেন যে, ওদের জন্য কিসের আবার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। প্রধানমন্ত্রী বললেন, যারা মানুষ পুড়িয়ে মারে তারা ভোট চাইতে এসেছে কোন লজ্জায়? গত তিন মাস ধরে এ ধরনের কথা শুনতে শুনতে দেশবাসীর কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। মানুষ পুড়িয়ে মারা মানে যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা। অভিযোগের তীর সব সময় ২০ দলীয় জোটের দিকে থাকলেও পেট্রলবোমা হামলায় যাদের আটক করা হয়েছিল, দেখা গেল তারা আওয়ামী লীগের লোক। আওয়ামী লীগের অফিসে পাওয়া গেল পেট্রলবোমা। আওয়ামী নেতাদের কারো কারো ঘরবাড়ি হলো পেট্রলবোমা বানানোর কারখানা। আরো নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, পেট্রলবোমা মেরে ধরা পড়া নেতাকর্মীদের পক্ষে ‘সৎ ও মেধাবী’ সার্টিফিকেট দিলেন আওয়ামী এমপি ও নেতারা। তার পরও গোয়েবলসীয় কায়দায় এখনো অবিরাম বলা হচ্ছে, ২০ দলীয় জোটই পেট্রলবোমা মারার হোতা। এ জোট বারবার বলেছে, আপনারা তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ করুন যে, পেট্রলবোমা কারা মারছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। কান দিলো না কেউ।
ইতোমধ্যে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের তরফ থেকে আহ্বান জানানো হলো, নির্বাচনকালে যেন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। নির্বাচন কমিশন সর্বস্তরের মানুষের দাবির মুখে খানিকটা যেন বেকায়দায় পড়ে গেল। তারা বললেন, আমরা সবার কথা শুনেছি। শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রায় সাথে সাথে আওয়ামী লীগ নেতারা বলতে শুরু করলেন, নির্বাচন কমিশন চাইলেই সেনা মোতায়েন করতে পারবে না। অথচ নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণার পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরি সব বাহিনী ও প্রশাসনের কর্তৃত্ব কমিশনের হাতে চলে যায়। এটাই সংবিধান। কিন্তু আওয়ামী নেতারা জানতেন, মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনকে তারা যা বলবেন, কমিশন অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করবে।
ইতোমধ্যে ২০ দল সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নামেন বেগম খালেদা জিয়া। এখন প্রতীয়মান হয়েছে, এর প্রায় প্রতিদিনই ব্যক্তিগতভাবে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়িবহরে গুলি ও হামলা চালানো হয়। প্রথম দু’দিন টেলিভিশনে সেসব হামলার দৃশ্য সাধারণ মানুষ দেখেছে। কিন্তু গত বুধবার আবার তার গাড়িবহরে হামলা চালানো হলো, গুলি করে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়া হলো তাকে বহনকারী গাড়ি। রক্তাক্ত করে দেয়া হলো তার প্রচারসঙ্গীদের। সে দৃশ্য এক সেকেন্ডের জন্যও দেখাল না হাত-পা বাঁধা ও সরকারের লাউড-স্পিকার টিভি চ্যানেলগুলো। চ্যানেলগুলোকে দোষ দিই না। অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে সরকারের আদেশ মেনে নিতে তারা বাধ্য। খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে গিয়ে ১৭টি দেশের কূটনীতিকেরা গুলিবিদ্ধ সেই ভাঙা গাড়িগুলো দেখে এসেছেন। ছবি তুলেছেন। অবাধে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
রেজোয়ান সিদ্দিকী
এই মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়া একজন সাধারণ নাগরিক। তিনি মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও নন, বিরোধী দলীয় নেত্রীও নন। অথচ সরকারের কিম্ভূত সহযোগী এরশাদ মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। নির্বাচন কমিশন তাকে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। তিনি কমিশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নাসিম, কামরুলের মতো মন্ত্রীরা বলে যাচ্ছেন, খালেদা জিয়া যদি প্রচারাভিযান চালাতে পারেন, তবে তারা কেন পারবেন না? মূর্খতারও বোধকরি একটা সীমা থাকে। বরং নির্বাচন কমিশন ২০ দলীয় জোট সমর্থক প্রার্থী মির্জা আব্বাস ও তাবিথ আাউয়ালকে এই মর্মে নোটিশ দিয়েছে, তাদের হয়ে যেন ‘সাধারণ নাগরিক’ বেগম খালেদা জিয়া প্রচারাভিযানে অংশ না নেন। তাতে রাস্তায় যানযট সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ মানুষের অসুবিধা হয়। প্রশ্ন জাগে, আনিসুল- সাঈদ প্রচারে নামলে মানুষের অসুবিধা হয় না? সর্বশেষ : নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিলো, ২৬ থেকে ২৯ এপ্রিল নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকবে। ইতোমধ্যে খবরের কাগজে শিরোনাম হলো; টিভি, রেডিওতে প্রচার হলো গত ২১ এপ্রিল কমিশনের এ ঘোষণা। কিন্তু ২২ এপ্রিল তারা সশস্ত্র বাহিনীকে এই মর্মে সংশোধিত পত্র পাঠায় যে, সেনাবাহিনী নির্বাচনের মাঠে আসবে না। ব্যারাকে মজুত থাকবে। যাহা বাহান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন রইল। অর্থাৎ সরকারের যেমন বেণী তেমনি রইল, চুল ভিজল না। এখন সর্বশেষ ভরসা নির্বাচনে কারচুপির বিরুদ্ধে জনগণের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ। নিরস্ত্র জনগণের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়ই।
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.