ঢাকা না বাঁচুক, দল বাঁচলেই চলবে? by ফারুক ওয়াসিফ

সময়মতো মেয়র প্রার্থী আসেননি, ভূমিকম্প এসেছে। ভূমিকম্প-টুমিকম্প কিছু না; মানুষ নাচে রাজনীতির তালে, কাঁপে বন্দুকের ভয়ে। মেয়র নির্বাচনের ঠিক আগে শক্তিশালী ভূমিকম্প ঢাকাবাসীকে সতর্ক করে গেল। তবু কীভাবে যেন আমরা বেঁচে যাব, এই দুরারোগ্য আশাবাদই আমাদের সম্বল। কিন্তু আসলেই আরেকটু শক্তিশালী ভূমিকম্পে পুরো ঢাকা শহরই তো রানা প্লাজা হয়ে যাবে! ঢাকা নিজেই যখন গণবিধ্বংসী অস্ত্র, তখন মেয়র প্রার্থীদের কেউ আছেন মশার সমস্যা নিয়ে, কেউ আছেন নিজের যোগ্যতার প্রেমে।
ভোর থেকেই বৃষ্টি। বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের আসার কথা সাড়ে ১২টায়, মালিবাগের চৌধুরীপাড়ায়। এলেন বেলা একটারও পরে। তাঁর আগেই এল নেপালি ভূমিকম্প। মানুষ টের পেল মাথাটা ঘুরছে। মাথায় আরও বেশি ঘুরছে মেয়র নির্বাচন!
দেশবাসী গত জাতীয় নির্বাচনে ঠিকমতো ভোট দিতে পারেনি। বড় বিরোধী জোট নির্বাচন বয়কট করে। মেয়র নির্বাচন যেন সেই নাকের বদলে নরুন পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। নাক গেছে তো কী, নাকফুল হলেই যেন চলে! শনিবার দুপুরে তাবিথ আউয়ালের নির্বাচনী মিছিলের শোরগোল থেকেও মনে হলো, জাতীয় নির্বাচনে লড়তে না পারলেও সিটি নির্বাচন নিয়ে কর্মীরা অখুশি না।
১২টার দিকেই মালিবাগের মাটির মসজিদের রাস্তা দিয়ে ৩০-৩৫ জন তরুণের মিছিল বাস মার্কার স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে এল। মুখে তাবিথ আউয়াল আর বিএনপির জয়ধ্বনি। সরকারের অভিযোগ, দলটি সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু জানে না। কিন্তু মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বিএনপিপন্থী কাউন্সিলর প্রার্থী ‘মেছের ভাই’য়ের বাড়ি অভিমুখে একের পর এক মিছিল আসা দেখে মনে হবে, মিছিল ছাড়া আর কিছুই তারা করতে জানে না। শ তিনেক লোকের জটলাটি ভেঙে গেল বৃষ্টিতে। মেছের সাহেবের বাড়ির নিচতলায় তাঁর নির্বাচনী কার্যালয়। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কর্মীরা আশ্রয় নিল সেখানে। দফায় দফায় চা আসছে। মেছের সাহেবের ভূতপূর্ব ভাড়াটে জনির পাশে দাঁড়াই। ঘরে তখন ঢুকছেন জনা দশেক তরুণী। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, এঁরা বিএনপির কর্মী হলেও মূলত মেছের সাহেবের আত্মীয়। নির্বাচন উপলক্ষে পরিবারের যুবা-তরুণেরা লেগে পড়েছেন। বিএনপির সাংগঠনিক শক্তির চেয়ে এর নেতাদের সামাজিক ভিত্তিই বেশি কার্যকর মনে হলো মালিবাগের চৌধুরীপাড়ায়।
ব্যবসায়ী আলম ভাইয়ের ডাকে এসেছে সদ্য তরুণ এক দল ছেলে। তাদের একজনের নামও আউয়াল, গাড়ি চালায়, বিশ্বাস করে ‘তাবিথ ভাই’ যোগ্য প্রার্থী। বললাম, আপনি কি তাঁকে দেখেছেন, তাঁর সম্পর্কে কিছু জানেন? বলল, ‘জানি না, বড় ভাই কইছে, উনি ভালা মানুষ।’ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, ব্যক্তি আউয়াল বিষয় না, বিষয় হলো বিএনপি।
রাজধানীর উত্তরের বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও ইতিহাস যা-ই থাক, বিএনপি সমর্থকদের কাছে সেসব বড় বিষয় না। সম্ভবত, সরকারের বিভিন্ন আচরণে বিরক্ত অনেক ভোটারের কাছেও প্রার্থীর চাইতে বড় হয়ে উঠছে দলের হার–জিত। তারই প্রমাণ মিলল তাবিথ আউয়াল উপস্থিত হওয়া মাত্রই।
যথারীতি সমর্থকেরা তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরে। মুহুর্মুহু স্লোগান ওঠে। অনেকেই ছবি তোলা শুরু করে। কিন্তু প্রচার মিছিল আর শুরু হয় না। কে সামনে কে পেছনে থাকবে সেসব ঠিক করতেই বেলা যায়। মিছিল শুরু হলেও বিশৃঙ্খলার জন্য মেয়র প্রার্থীকে দেখাই গেল না। কেবল দূরের দর্শকেরা দেখতে পায়, মানুষের ভিড়ে ডুবে যেতে যেতে একটি হাত উঁচু হয়ে আছে। যেন সাগরে ডুবন্ত মানুষের উঁচানো হাত।
একটু দূরে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দুজন মানুষের কথা শুনছি। একজন বলল, ‘খালেদা জিয়া রাস্তায় নামায় সরকার ঘাবড়ে গেছে। তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী যদি কারও হাত ধরে ভোট চায়, হ্যা কি দিব না? দিব।’ বললাম, ‘কিন্তু সরকার তো তাঁকে জঙ্গিবাদ ও পেট্রলবোমার নেত্রী বলে।’ অলি যার নাম, তিনি মুখটা ঘুরিয়ে একটু রাগ নিয়েই বললেন, ‘কারা মারছে তা দেখায় না ক্যান? মিডিয়া আছে, একটা কথা কইলেই হইলো? মানুষ কি কিছু বুজে না?’ কিন্তু তাঁর পাশের জন, যাঁর নাম অপু তিনি বললেন, ‘দ্যাখেন, সরকার অনেক রাস্তাঘাট করছে ঠিকই, কিন্তু ভোটাধিকার দেয় নাই।’ বরিশালের সরকারদলীয় মেয়র হিরনের প্রসঙ্গ তুলে বললেন, ‘মানুষটা দিনরাত খেটে শহরটাকে পরিষ্কার করল, কিন্তু সরকারের ওপরে রাগে মানুষ ভোট দিল তার বিপক্ষে। আসলে আমাদের জনগণই খারাপ। টেলিস্কোপ মার্কার জোনায়েদ সাকি পরিবর্তনের কথা কইতাছেন, কিন্তু দেইখেন তিনি থাকবেন তিন নম্বরে। কারণ, আমরা পরিবর্তন চাই না।
যুবক অপু মনে হলো রাজনীতি নিয়ে কিছুটা ভাবনাচিন্তা করেন। বললেন, ‘মির্জা আব্বাসকে নামতে না দিয়ে সরকার তারে আরও জনপ্রিয় কইরা তুলল।’ অবশেষে তাবিথ আউয়ালের মিছিল শুরু হলে অলি দৌড়ে গেলেন মিছিলে, অপু আর আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। সাদা পাঞ্জাবি পরা ১০-১২ জনের একটি দল রাস্তার মানুষদের তাবিথ আউয়ালের বাস মার্কার প্রচারপত্র দিচ্ছিল। তাঁদের মধ্যে বয়সী লোকটির কাছে পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?’ পাশে দাঁড়ানো মাদ্রাসাছাত্রটি বললেন, ‘উনি সুনামগঞ্জের সাবেক এমপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব।’ সিলেটের এই আইনজীবী দলবল নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন বিএনপির প্রার্থীকে জেতাতে! বললেন, ‘এটা পুলিশি রাষ্ট্র, এই নির্বাচনকে আমরা সরকারের বিপক্ষে গণরায় আদায়ের সুযোগ হিসেবে নিয়েছি।’
ঢাকা গতকাল ভূমিকম্পে দুলেছে। এর উৎস নেপাল। সেখানকার শত শত মানুষের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি। ভূমিকম্পে সবাই ভয় পায়, কিন্তু নির্ভয় আমাদের নগর প্রশাসকেরা। অদ্ভুত স্বার্থপরের কারণে তাঁরা ভাবেন, আর যাদের যা-ই হোক, তাঁদের কিছু হবে না। মানুষও ভুলে যায়। তলা ফাঁকা হয়ে যাওয়া ঢাকার মাটির ওপরের মানুষেরা আতঙ্কে রাস্তায় নেমে আসে। তারপর যখন দেখে, ছাদ ভেঙে পড়েনি; তখন ভুলে যায় ধ্বংসের বিপদ। অনেকেই আবার ঢুকে পড়ে যার যার গর্তে। এই দেড় কোটি ঢাকাবাসী দুজন মেয়র নির্বাচিত করবেন। তাঁর দায়িত্ব হবে ঢাকা ও তার অধিবাসীদের জীবন ও পরিবেশ বাঁচানো। অথচ দুই রাজকীয় দলের প্রার্থীরা রাজনীতির জন্য মেয়র হতে চান, মানুষ বাঁচানোর জেদ ও আবেগ তাঁদের বুকে জাগে বলে মনে হলো না। কিন্তু শুধু দল বাঁচলে কি ঢাকা বাঁচবে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.