যাঁরা আমাদের মেয়র ও কাউন্সিলর হবেন by বদিউল আলম মজুমদার
আজ
ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এসব নির্বাচনের ব্যাপারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ছাড়া এগুলোর
মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রামকে যে পরিকল্পিত, বাসযোগ্য, আধুনিক নগর হিসেবে
গড়ে তোলার স্বপ্ন অনেক মেয়র প্রার্থী আমাদের দেখাচ্ছেন, তা বাস্তবায়িত
হওয়ার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। তাই এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এসবের মাধ্যমে ভালো কিছু হবে কি না, তা মূলত নির্ভর করবে দুটি বিষয়ের
ওপর: কারা নির্বাচিত হবেন এবং এসব প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর যথার্থতা ও
বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কিত সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপর। এ নিবন্ধের মূল
উদ্দেশ্য হলো আসন্ন নির্বাচনে কারা প্রার্থী হলেন, যাঁদের মধ্য থেকে মেয়র ও
কাউন্সিলর হবেন, তাঁদের হলফনামা এবং আয়কর বিবরণীতে প্রদত্ত তথ্যের একটি
বিশ্লেষণ তুলে ধরা।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে ২১, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ৪৯৪, সংরক্ষিত আসনে ১৩৫, সর্বমোট ৬৫০ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ঢাকা উত্তরের চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় মেয়র পদে ১৬, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২৭৭, সংরক্ষিত আসনে ৮৯ জন, সর্বমোট ৩৮২ জন।
পক্ষান্তরে ২৫ মার্চের পর ঢাকা দক্ষিণে মেয়র পদে ২৬, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ৬৩২, সংরক্ষিত আসনে ১৫৩, সর্বমোট ৮১১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ঢাকা দক্ষিণের চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় মেয়র পদে ২০, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ৩৮৭, সংরক্ষিত আসনে ৯৫, সর্বমোট ৫০২ জন।
অন্যদিকে ২৫ মার্চের পর চট্টগ্রামের মেয়র পদে ১৩, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২৮৮, সংরক্ষিত আসনে ৭১, সর্বমোট ৩৭২ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রামে চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় মেয়র পদে ১২, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২১৪, সংরক্ষিত আসনে ৬২, সর্বমোট ২৮৮ জন।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সর্বমোট ১ হাজার ১৭২ জন প্রার্থীর তথ্যের বিশ্লেষণ নিচে তুলে ধরা হলো (যদিও ২৩ এপ্রিল কমিশনের ওয়েবসাইটে চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা দেখানো হচ্ছে ১ হাজার ১৯০)। প্রার্থীর সংখ্যার দিক থেকে ২৮ এপ্রিলের নির্বাচন প্রায় জাতীয় নির্বাচনের সমতুল্য একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ।
আসন্ন নির্বাচনের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো যে এতে বিশেষত মেয়র পদে অনেক তরুণ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে এ নির্বাচনে ৪৮ জন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে একজনও নারী নেই। সাধারণ আসনেও মাত্র ১৭ জন নারী প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, যা অতি নগণ্য।
শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থীদের ৮৮ শতাংশই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদপ্রার্থীদের মাত্র ৪৫ শতাংশ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পক্ষান্তরে চট্টগ্রামের ২৫ শতাংশ মেয়র পদপ্রার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের একটি বিরাট অংশই (৪৮ শতাংশ) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অল্প শিক্ষিত (এসএসসির নিচে), কিন্তু নিরক্ষরতা বা স্বল্প শিক্ষিত হওয়া অযোগ্যতা নয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত প্রতিনিধিরা নিঃসন্দেহে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন।
প্রার্থীদের পেশার দিকে তাকালে দেখা যায় যে তিনটি সিটি করপোরেশনের মেয়র পদপ্রার্থীদের অধিকাংশই (৬৯ শতাংশ) ব্যবসায়ী। সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রায় ৭৯ শতাংশও ব্যবসায়ী। অন্যদিকে সংরক্ষিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ৩২ শতাংশ ব্যবসায়ী এবং ৩৮ শতাংশ গৃহিণী। তবে এ কথা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে নির্বাচিত মেয়রদের সবাই হবেন ব্যবসায়ী এবং সাধারণ আসনেরও ৮০-৯০ শতাংশ হবেন ব্যবসায়ী। অর্থাৎ আমাদের জাতীয় সংসদের মতো সিটি করপোরেশনগুলো হয়ে যাবে ব্যবসায়ীদের আখড়া।
প্রসঙ্গত, প্রার্থীদের অনেকেই ঠিকাদারি ব্যবসায় নিয়োজিত। প্রথম আলোয় (১৮ এপ্রিল ২০১৫) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অন্তত ৯০ জন ঠিকাদার। এঁদের মধ্যে কমপক্ষে ১৩ জন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার (সমকাল, ৩ এপ্রিল ২০১৫)। সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী, করপোরেশনের ঠিকাদারেরা এই নির্বাচনে অংশ নিতে অযোগ্য। তাই এসব ব্যক্তি তাঁদের ঠিকাদারি ব্যবসা অন্যের নামে হস্তান্তর করে সিটি করপোরেশন থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এসব ব্যক্তি নির্বাচিত হলে শিয়ালের কাছে মুরগি পাহারা দেওয়ার মতো অবস্থা হবে।
তিন সিটিতে ৪৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ছয়জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে এবং ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং ছিল। সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ২০৯ জনের (২৪ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে এবং ১৫২ জনের (১৮ শতাংশ) বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। অন্যদিকে সংরক্ষিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে মাত্র ২০ জনের (৯ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে এবং নয়জনের (৪ শতাংশ) বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সাধারণ আসনে ৮৬০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ১৫৫ জনের (১৮ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে। এ দুটি করপোরেশনের ৯৩ জন বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর মধ্যে ৫৪ জন (৫৮ শতাংশ) ফৌজদারি মামলার আসামি। এঁদের মধ্যে অন্তত ১৭ জন হত্যা মামলা এবং ২২ হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। প্রার্থীদের দাবি, এসব মামলা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের করা এবং রাজনৈতিক হয়রানিমূলক (প্রথম আলো, ১৩ এপ্রিল ২০১৫)। প্রসঙ্গত, হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণের বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধেই সর্বাধিক মামলা—বর্তমানে আছে ৩৭টি ও অতীতে ছিল ২৩টি।
প্রার্থী ও তাঁদের ওপর নির্ভরশীলদের আয়, সম্পদ ও দায়-দেনার তথ্য বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে তাঁরা খুব একটা বিত্তবান নন। মোট ৪৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ছয়জনের এবং সাধারণ আসনের প্রার্থীদের মধ্যে মাত্র আটজনের আয় কোটি টাকার ওপরে, যা বিশ্বাস করা দুরূহ। তবে সংরক্ষিত আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী ও তাঁদের নির্ভরশীলদের কারোরই আয় এক কোটি টাকার ওপরে নয়। কোটি টাকার ওপরে আয় করেন এমন প্রার্থীরা হলেন: ঢাকা উত্তরের আনিসুল হক ও তাবিথ আউয়াল, ঢাকা দক্ষিণের মির্জা আব্বাস ও মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন এবং চট্টগ্রামের আ জ ম নাছির উদ্দিন ও মোহাম্মদ মনজুর আলম।
মেয়র প্রার্থী এবং তাঁদের নির্ভরশীলদের মাত্র ১৩ জনের সম্পদ এক কোটি টাকার ওপরে। সাধারণ আসনের প্রার্থীদেরও মাত্র ৫১ জনের সম্পদ এক কোটি টাকার বেশি। আর সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের মাত্র পাঁচজনের সম্পদ এক কোটি টাকার ওপরে। মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে নয়জনের দায়-দেনা রয়েছে, যাঁদের মধ্যে দুজনের দায়-দেনার পরিমাণ তাঁদের সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে হলফনামায় সম্পদের হিসাব দেওয়া হয় অর্জিত মূল্যে, বর্তমান মূল্যে নয়।
মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে পাঁচজন আয়কর দেন না। বাকিদের মধ্যে মাত্র ১৪ জন লাখ টাকার ওপরে এবং মাত্র দুজন কোটি টাকার ওপরে কর দেন। অনেক বিত্তশালী প্রার্থীরও কর প্রদানের পরিমাণ তেমন বেশি নয়।
উল্লিখিত সব তথ্যই প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামা ও আয়কর বিবরণী থেকে নেওয়া। কিন্তু এসব তথ্যের সত্যতা নিয়ে অনেকের মনে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। কালের কণ্ঠে (২১ এপ্রিল ২০১৫) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনে সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ৬০ জন মামলার তথ্য গোপন করেছেন। আমাদের আশঙ্কা যে আয় ও সম্পদের তথ্য গোপনের পরিমাণও ব্যাপক। আইনানুযায়ী, তথ্য গোপনকারী বা ভুল তথ্য প্রদানকারী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার এবং নির্বাচিত হলে পদে থাকার অযোগ্য। তাই নির্বাচন কমিশন হলফনামাগুলো মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময়ে এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে চুলচেরাভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখলে অনেক অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকেই নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। ‘বিরুদ্ধ হলফনামা’ প্রদানের বিধানও এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রসঙ্গত, বেশ কিছু প্রার্থী হলফনামায় সব তথ্য প্রদান করেননি। উদাহরণস্বরূপ, ১৬ জন প্রার্থী তাঁদের হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেননি, যা তথ্য গোপনের শামিল। একইভাবে আটজন মেয়র পদপ্রার্থী আয়কর বিবরণীর পরিবর্তে শুধু কর প্রদানের প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন। আয়কর বিবরণী প্রদান ছাড়া মনোনয়নপত্র অসম্পূর্ণ। তাই আমাদের কাছে বোধগম্য নয়, নির্বাচন কমিশন কোন যুক্তিতে এসব ব্যক্তির প্রার্থিতা বৈধ করল।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে ২১, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ৪৯৪, সংরক্ষিত আসনে ১৩৫, সর্বমোট ৬৫০ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ঢাকা উত্তরের চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় মেয়র পদে ১৬, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২৭৭, সংরক্ষিত আসনে ৮৯ জন, সর্বমোট ৩৮২ জন।
পক্ষান্তরে ২৫ মার্চের পর ঢাকা দক্ষিণে মেয়র পদে ২৬, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ৬৩২, সংরক্ষিত আসনে ১৫৩, সর্বমোট ৮১১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ঢাকা দক্ষিণের চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় মেয়র পদে ২০, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ৩৮৭, সংরক্ষিত আসনে ৯৫, সর্বমোট ৫০২ জন।
অন্যদিকে ২৫ মার্চের পর চট্টগ্রামের মেয়র পদে ১৩, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২৮৮, সংরক্ষিত আসনে ৭১, সর্বমোট ৩৭২ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর চট্টগ্রামে চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় মেয়র পদে ১২, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২১৪, সংরক্ষিত আসনে ৬২, সর্বমোট ২৮৮ জন।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সর্বমোট ১ হাজার ১৭২ জন প্রার্থীর তথ্যের বিশ্লেষণ নিচে তুলে ধরা হলো (যদিও ২৩ এপ্রিল কমিশনের ওয়েবসাইটে চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা দেখানো হচ্ছে ১ হাজার ১৯০)। প্রার্থীর সংখ্যার দিক থেকে ২৮ এপ্রিলের নির্বাচন প্রায় জাতীয় নির্বাচনের সমতুল্য একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ।
আসন্ন নির্বাচনের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো যে এতে বিশেষত মেয়র পদে অনেক তরুণ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে এ নির্বাচনে ৪৮ জন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে একজনও নারী নেই। সাধারণ আসনেও মাত্র ১৭ জন নারী প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, যা অতি নগণ্য।
শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থীদের ৮৮ শতাংশই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদপ্রার্থীদের মাত্র ৪৫ শতাংশ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পক্ষান্তরে চট্টগ্রামের ২৫ শতাংশ মেয়র পদপ্রার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের একটি বিরাট অংশই (৪৮ শতাংশ) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অল্প শিক্ষিত (এসএসসির নিচে), কিন্তু নিরক্ষরতা বা স্বল্প শিক্ষিত হওয়া অযোগ্যতা নয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত প্রতিনিধিরা নিঃসন্দেহে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন।
প্রার্থীদের পেশার দিকে তাকালে দেখা যায় যে তিনটি সিটি করপোরেশনের মেয়র পদপ্রার্থীদের অধিকাংশই (৬৯ শতাংশ) ব্যবসায়ী। সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রায় ৭৯ শতাংশও ব্যবসায়ী। অন্যদিকে সংরক্ষিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ৩২ শতাংশ ব্যবসায়ী এবং ৩৮ শতাংশ গৃহিণী। তবে এ কথা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে নির্বাচিত মেয়রদের সবাই হবেন ব্যবসায়ী এবং সাধারণ আসনেরও ৮০-৯০ শতাংশ হবেন ব্যবসায়ী। অর্থাৎ আমাদের জাতীয় সংসদের মতো সিটি করপোরেশনগুলো হয়ে যাবে ব্যবসায়ীদের আখড়া।
প্রসঙ্গত, প্রার্থীদের অনেকেই ঠিকাদারি ব্যবসায় নিয়োজিত। প্রথম আলোয় (১৮ এপ্রিল ২০১৫) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অন্তত ৯০ জন ঠিকাদার। এঁদের মধ্যে কমপক্ষে ১৩ জন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার (সমকাল, ৩ এপ্রিল ২০১৫)। সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী, করপোরেশনের ঠিকাদারেরা এই নির্বাচনে অংশ নিতে অযোগ্য। তাই এসব ব্যক্তি তাঁদের ঠিকাদারি ব্যবসা অন্যের নামে হস্তান্তর করে সিটি করপোরেশন থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এসব ব্যক্তি নির্বাচিত হলে শিয়ালের কাছে মুরগি পাহারা দেওয়ার মতো অবস্থা হবে।
তিন সিটিতে ৪৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ছয়জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে এবং ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং ছিল। সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ২০৯ জনের (২৪ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে এবং ১৫২ জনের (১৮ শতাংশ) বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। অন্যদিকে সংরক্ষিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে মাত্র ২০ জনের (৯ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে এবং নয়জনের (৪ শতাংশ) বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সাধারণ আসনে ৮৬০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ১৫৫ জনের (১৮ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে। এ দুটি করপোরেশনের ৯৩ জন বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর মধ্যে ৫৪ জন (৫৮ শতাংশ) ফৌজদারি মামলার আসামি। এঁদের মধ্যে অন্তত ১৭ জন হত্যা মামলা এবং ২২ হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। প্রার্থীদের দাবি, এসব মামলা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের করা এবং রাজনৈতিক হয়রানিমূলক (প্রথম আলো, ১৩ এপ্রিল ২০১৫)। প্রসঙ্গত, হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণের বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধেই সর্বাধিক মামলা—বর্তমানে আছে ৩৭টি ও অতীতে ছিল ২৩টি।
প্রার্থী ও তাঁদের ওপর নির্ভরশীলদের আয়, সম্পদ ও দায়-দেনার তথ্য বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে তাঁরা খুব একটা বিত্তবান নন। মোট ৪৮ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ছয়জনের এবং সাধারণ আসনের প্রার্থীদের মধ্যে মাত্র আটজনের আয় কোটি টাকার ওপরে, যা বিশ্বাস করা দুরূহ। তবে সংরক্ষিত আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী ও তাঁদের নির্ভরশীলদের কারোরই আয় এক কোটি টাকার ওপরে নয়। কোটি টাকার ওপরে আয় করেন এমন প্রার্থীরা হলেন: ঢাকা উত্তরের আনিসুল হক ও তাবিথ আউয়াল, ঢাকা দক্ষিণের মির্জা আব্বাস ও মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন এবং চট্টগ্রামের আ জ ম নাছির উদ্দিন ও মোহাম্মদ মনজুর আলম।
মেয়র প্রার্থী এবং তাঁদের নির্ভরশীলদের মাত্র ১৩ জনের সম্পদ এক কোটি টাকার ওপরে। সাধারণ আসনের প্রার্থীদেরও মাত্র ৫১ জনের সম্পদ এক কোটি টাকার বেশি। আর সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের মাত্র পাঁচজনের সম্পদ এক কোটি টাকার ওপরে। মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে নয়জনের দায়-দেনা রয়েছে, যাঁদের মধ্যে দুজনের দায়-দেনার পরিমাণ তাঁদের সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে হলফনামায় সম্পদের হিসাব দেওয়া হয় অর্জিত মূল্যে, বর্তমান মূল্যে নয়।
মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে পাঁচজন আয়কর দেন না। বাকিদের মধ্যে মাত্র ১৪ জন লাখ টাকার ওপরে এবং মাত্র দুজন কোটি টাকার ওপরে কর দেন। অনেক বিত্তশালী প্রার্থীরও কর প্রদানের পরিমাণ তেমন বেশি নয়।
উল্লিখিত সব তথ্যই প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামা ও আয়কর বিবরণী থেকে নেওয়া। কিন্তু এসব তথ্যের সত্যতা নিয়ে অনেকের মনে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। কালের কণ্ঠে (২১ এপ্রিল ২০১৫) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনে সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ৬০ জন মামলার তথ্য গোপন করেছেন। আমাদের আশঙ্কা যে আয় ও সম্পদের তথ্য গোপনের পরিমাণও ব্যাপক। আইনানুযায়ী, তথ্য গোপনকারী বা ভুল তথ্য প্রদানকারী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার এবং নির্বাচিত হলে পদে থাকার অযোগ্য। তাই নির্বাচন কমিশন হলফনামাগুলো মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময়ে এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে চুলচেরাভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখলে অনেক অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকেই নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। ‘বিরুদ্ধ হলফনামা’ প্রদানের বিধানও এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রসঙ্গত, বেশ কিছু প্রার্থী হলফনামায় সব তথ্য প্রদান করেননি। উদাহরণস্বরূপ, ১৬ জন প্রার্থী তাঁদের হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেননি, যা তথ্য গোপনের শামিল। একইভাবে আটজন মেয়র পদপ্রার্থী আয়কর বিবরণীর পরিবর্তে শুধু কর প্রদানের প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন। আয়কর বিবরণী প্রদান ছাড়া মনোনয়নপত্র অসম্পূর্ণ। তাই আমাদের কাছে বোধগম্য নয়, নির্বাচন কমিশন কোন যুক্তিতে এসব ব্যক্তির প্রার্থিতা বৈধ করল।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments