দেশকে রাজনীতিশূন্য করার পাঁয়তারা by মো: শায়খুল ইসলাম

শেয়ারবাজার ধ্বংস, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু নিয়ে নানা কথা, নিয়োগবাণিজ্যের নামে সরকারদলীয় লোকদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ যেখানে নস্যি সেখানে দিন দিন ঝিমিয়ে পড়া ও বন্ধ হয়ে যাওয়া গার্মেন্টশিল্প তাদের কাছে কিছুই নয়। দেশের সম্পদ হরিলুট হচ্ছে তাই অচল অবস্থায় তা ধ্বংস হলেও তাদের কোনো সমস্যা নেই। এসবের জন্য কথিত বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীরাই দায়ী। দেশ আমাদের, তাই আমরাই মতায় থাকব যেনতেনভাবে। আমরাই দেশের সম্পদ ব্যবহারের একমাত্র হকদার। গত দুই মাসে দেশে আর্থিক তি হয়েছে এক কোটি ৬২ হাজারের বেশি। মানুষ মারা গেছে ২০০-এর বেশি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে কোথায়ও ইসলাম বিরোধিতার কথা নেই, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না এবং ইসলামি সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকদের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হবে বলে পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের ২১ দফার সবার আগে বিবৃত করা হয়। আওয়ামী লীগের একটি দলীয় অবস্থান হচ্ছে, তারা কথায় কথায় ইসলামি রাজনীতিকে ধর্ম ব্যবসায় বলে চালিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আসলে ধর্ম নিয়ে ব্যবসায় তারাই করে আসছে। যারা চরমভাবে ইসলামি আকিদার পরিপন্থী মন্তব্য করেন, যেমন আমি হিন্দু নই মুসলিমও নই, যারা দুর্গা গজে চড়ে আসার কারণে ফসলের ফলন ভালো হয়েছে বলেন, যারা হজ নিয়ে বিকৃত মন্তব্য করেন তারাই আবার ভোটের সময় মাথায় পট্টি দেন, খালেদা জিয়ার কাছে ইসলাম কি নিরাপদ, লেখা পোস্টার প্রকাশ করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেন, মদিনার সনদ অনুযায়ী দেশ পরিচালনার কথা বলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ বলে মুখে ফেনা তোলেন তারা কি ধর্ম ব্যবসায়ী না অন্য কেউ? মতার স্বার্থে বা মোহে আওয়ামী লীগের এরূপ আচরণই যে নিরেট মিথ্যার বেসাতি তা কি কাউকে হলফ করে বলতে হবে?
সরকারি দলের সবাই ২০ দলীয় জোটের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে জঙ্গি ও আইএস আখ্যা দিয়ে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে। সরকারি দল মতা হারানোর ভয়ে এ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শুরু থেকেই এর বিরুদ্ধে নির্জলা মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে আসছে। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য ২০ দলীয় জোটের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বিরুদ্ধে নাশকতার মিথ্যা অভিযোগে গত ১৪ মাসে সারা দেশে ৮৪টি মামলা হয়েছে। তিনি গত ৬ জানুয়ারি থেকে কারাবন্দী রয়েছেন। এ পরিসংখ্যান অন্যান্য শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেও প্রায় একই। সারা দেশে নাশকতার অভিযোগে সরকারবিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে হাজারের বেশি। আসামি করা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখ নেতাকর্মীকে। এতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি দিন দিন সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার এ সঙ্ঘাত ও সঙ্কটকে পুঁজি করে পরিস্থিতিকে আরো ঘনীভূত করার পাঁয়তারা করছে। তারা একদলীয় শাসনব্যবস্থাকে দীর্ঘায়িত করে কূটকৌশলে মতা আঁকড়ে রাখতে চায়।
সরকার বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রতিহত করার নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে দমনের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে অভিযোগ তা খুবই ভয়ঙ্কর ও জঘন্য। বিভিন্ন বাহিনীর নামে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় থানা ও পুলিশ ফাঁড়ির সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানে না বলে পরিবারের লোকজনকে মিথ্যা কথা বলে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এভাবে যাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের অনেককেই বিভিন্ন জায়গায় লাশ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেককেই অনেক দিন পর থানা ও আদালতে আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। বিভিন্ন কাহিনী সাজিয়ে ও বানিয়ে ক্রসফায়ার, ডাকাত ও বন্দুকযুদ্ধ এবং গণপিটুনির নামে হত্যা করা হচ্ছে।
বিরোধী জোটের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও এ সরকার শাস্তির খড়গে এনে দেশকে রাজনীতিশূন্য করার পাঁয়তারা করছে। এ প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে অনেক জনপ্রতিনিধিকে রাজনৈতিকভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে ও শাস্তির খড়গে এনে বহিষ্কার করছে নয়তো এলাকা ছাড়া করছে। একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্য মতে বলা যায়, শাস্তির খড়গে বিরোধী মেয়র, চেয়ারম্যানরা। মামলা, গ্রেফতার ও বহিষ্কারের খড়গের নিচে পড়েছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মেয়র, চেয়ারম্যানরাও। শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই নয়, তারাও এখন নানা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। সিলেট, রাজশাহী, গাজীপুর ও খুলনার সিটি মেয়রদের সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। ইতোমধ্যে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। একইভাবে দেশের উপজেলা, পৌরসভা, ইউপি চেয়ারম্যান ও কমিশনারসহ সব সরকারবিরোধী জনপ্রতিনিধিকে সরিয়ে দেয়ার বহুমুখী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি দল মতা আটকে রাখতে এমন কোনো কৌশল নেই যা করছে না।
এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টার (এএলআরসি) বলেছে, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অবাধে চলছে। সরকার এতে উৎসাহ দিচ্ছে। এমনকি সরকারের তরফে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অব্যাহতি দেয়ার ঘোষণা এসেছে। এতে জড়িতরা হয়ে পড়েছে আরো বেপরোয়া। এখন এরা কারো ধার ধারছে না এবং আইনের তোয়াক্কা করছে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনকে বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগ দিতে এরা আহ্বান জানিয়েছে। বাকস্বাধীনতার ওপরও সরকার চরমভাবে নিয়ন্ত্রণের নগ্ন খড়গ চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার নীতিগত বিরোধিতার কারণে অনেক সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে। এ সরকারের দমন-পীড়নে জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক আমার দেশ, ইসলামিক টেলিভিশন, দিগন্ত টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান, একুশে টিভিসহ অনলাইন পত্রিকার ওপরও সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে সম্পাদক ও মালিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তপে করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হওয়ায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত ৫ মার্চ জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে দেয়া এক ভাষণে তিনি এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। হাইকমিশনার বাংলাদেশে সহিংসতা বন্ধ, রাজনৈতিক সংলাপের পথ বের করা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় চলমান মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় দেয়া উদ্বোধনী ভাষণে হাইকমিশনার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে গত সপ্তাহে একজন মুক্তমনা লেখক (অভিজিৎ রায়) ও তার স্ত্রীর ওপর মর্মান্তিক হামলা হয়েছে, যা রাজনৈতিক সহিংসতার বিস্তৃতির সর্বশেষ উদাহরণ। এ পর্যন্ত অগ্নিসংযোগের ঘটনা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে অনেকে মারা গেছেন। সুশীলসমাজ এবং বাকস্বাধীনতাও এখন আক্রমণের শিকার হচ্ছে। তারা শুধু উগ্রপন্থীদের মাধ্যমেই আক্রান্ত হচ্ছে না; বরং সরকারি দমনমূলক আচরণেরও শিকার হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, গণমাধ্যমের ওপর সরকার যে ভয়ভীতি ও কড়াকড়ি আরোপ করছে সেগুলোই বাকস্বাধীনতার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। স্বৈরতন্ত্র রুখতে, বৈষম্য দূর করতে, ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতেও আমাদের পূর্ণ এবং মুক্ত সুদূরপ্রসারী বাকস্বাধীনতা দরকার। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া কোথাও সুশাসন থাকতে পারে না।
এ দিকে বাংলাদেশে অব্যাহত সহিংসতার ৬০ দিন হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী হুগো সোয়ার। এক বিবৃতিতে হুগো সোয়ার সহিংসতা বন্ধ করতে, আস্থা গঠনের পদপে নিতে, উত্তেজনা কমাতে এবং একটি সর্বজনীন ও সবার অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল, সরকার এবং সমাজের অন্যদের প্রতি আহ্বান জানান।
এহেন সঙ্কট নিরসনে উভয় পকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের বিভিন্ন মহল থেকে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। জনগণকে লাশের বোঝা থেকে রেহাই দিতে চাইলে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সরকারি দলের ভাব বুঝে মনে হচ্ছে জনগণকে আরো কাঠখড় পোড়াতে হবে। তবে দেশের মানুষ চায় দেশের চলমান সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একগুঁয়েমি ছেড়ে সমঝোতার দিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
advsi82@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.