সোহরাওয়ার্দীতে অন্য রকম চিত্র by মাহমুদ মানজুর
টানা
দুই মাসের হরতাল-অবরোধ-সহিংসতার জের ধরে পঙ্গুতে (জাতীয় অর্থোপেডিক
হাসপাতাল) গুলিবিদ্ধ আর ঢামেক (ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ) হাসপাতালের বার্ন
ইউনিটে ঝলসানো রোগী-স্বজনের উপচে পড়া ভিড়। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার বলি এসব
রোগীকে কেন্দ্র করে দুই হাসপাতালে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর
মিডিয়াকর্মীদের সরব উপস্থিতিও। অথচ একই সময়ে রাজধানীর অন্যতম মেডিক্যাল
কলেজ হাসপাতাল শহীদ সোহরাওয়ার্দীতে রোগীর সংখ্যা নেমে এসেছে অর্ধেকে। নেই
পুলিশ কিংবা গণমাধ্যমকর্মীদের তৎপরতা। সোহরাওয়ার্দীর অত্যাধুনিক বার্ন
ইউনিটসহ মেডিসিন, ডেন্টাল, শিশু বিকাশ কেন্দ্র, অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জন,
চর্ম ও যৌন রোগ, শিশু, গাইনি, এজমা সেন্টার, নিউরোলজি ও কার্ডিওলজি
বিভাগসহ ১১টি বিভাগে রয়েছে রোগী-স্বল্পতায়। মঙ্গলবার ৮৭৫ শয্যাবিশিষ্ট এ
হাসপাতালে গিয়ে এমনটাই দেখা যায়। জরুরি বিভাগের রোগী ভর্তির রেজিস্ট্রি
খাতা থেকে জানা যায়, রোববার দিবাগত রাত ১২টা থেকে সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত
এখানে রোগী ভর্তি হয়েছেন ২৪ জন। অন্যদিকে হাসপাতালটির বহির্বিভাগ খোলা
থাকে সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। মঙ্গলবার এ সময়ে শ’খানিক রোগী এলেও
ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা মাত্র ২১ জন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগী ভর্তির
কর্তব্যরত রেজিস্ট্রার খোরশেদ জানান, হরতাল-অবরোধের কারণে এখন রোগীদের
আগমন এবং ভর্তির সংখ্যা অনেক কমেছে। গত ১৫ ঘণ্টায় রোগী এসেছে মাত্র ২৪ জন।
অথচ দুই মাস আগে প্রতিদিন গড়ে জরুরি বিভাগে রোগী আসতেন ন্যূনতম ৫০ থেকে ৬০,
বহির্বিভাগে আসতেন শতাধিক। সত্যি বলতে, আগে রোগীদের চাপে আমাদের হিমশিম
খেতে হতো। আর এখন অলস বসে সময় কাটাতে হয়। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে
অসংখ্য রোগী এখন গ্রাম থেকে ঢাকার হাসপাতালে আসার সাহস পাচ্ছেন না। তা ছাড়া
বাসে-ট্রেনে ভয় পেট্রলবোমার। অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়াও এখন দ্বিগুণ। এসব
কারণেই রোগীর সংখ্যা গত দুই মাসে ক্রমেই কমেছে। অন্যদিকে একই কথা স্বীকার
করে ৫ নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডের কর্তব্যরত নার্স বলেন, হাসপাতালের পরিবেশ এখন
বেশ স্বাভাবিক। বেডের অভাবে কোন রোগীকে মাটিতে অথবা বারান্দায় কষ্ট করতে
হচ্ছে না। আমাদের ওপর চাপও কম। ঠাণ্ডা মাথায় রোগীদের সেবা করতে পারছি।
হরতাল-অবরোধ উঠে গেলে রোগীদের চাপ বেড়ে যাবে। এদিকে পুরো হাসপাতালের
বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতি ওয়ার্ডেই বেশ কয়েকটি করে বিছানা
খালি। টাঙ্গাইল থেকে আসা খন্দকার মিজান জানান, তৃতীয় শ্রেণীপড়ুয়া ছেলেকে
নিয়ে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হাসপাতালে আসার কথা ছিল তার। কারণ ছেলের ডান
পায়ের পোড়া অংশে ক্ষত দেখা দিয়েছে। বাড়িতে আগুন নিয়ে খেলতে গিয়ে চার বছর
আগে পুড়েছে ছেলের ডান পা। মাস দুয়েক হলো সেই পোড়ায় ক্ষত দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় ডাক্তার বলেছেন, দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসতে। হরতাল-অবরোধের কারণে দুই
মাস অপেক্ষা করেছি। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় এক রকম বাধ্য হয়ে
জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন এই কৃষক। ভর্তি
করিয়েছেন সোহরাওয়ার্দীর বার্ন ইউনিটে। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধে আতঙ্ক নিয়েই
ঢাকা এসেছি। তবে এখানে এসে ভালই আছি। রোগীর চাপ খুব কম। এ হাসপাতালে আমার
কানের চিকিৎসার জন্য ছয় মাস আগেও এসেছি। তখন দেখেছি রোগীরা রাত-দিন গিজগিজ
করতেন। তখন ডাক্তার-নার্স-দারোয়ানরাও চরম দুর্ব্যবহার করতেন। আর এখন সবাই
বেশ আন্তরিক। মনে হয় এখন তানাদের মাথা ঠাণ্ডা, রোগীর চাপ নাই তো, তাই।
এদিকে হরতাল-অবরোধ-সহিংসতায় দগ্ধদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের
দোতলায় ৭ নম্বর ওয়ার্ডে আট শয্যার একটি পৃথক ইউনিট খোলা হয়েছে। বার্ন
ইউনিটের পাঁচটি শয্যাও খালি করে রাখা হয়েছে। পেট্রলবোমায় দগ্ধদের
সু-চিকিৎসার আশায় আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটার, পোস্ট অপারেটিভ কক্ষ, অটোক্লেভ
কক্ষ, ড্রেসিংরুম থেকে শুরু করে সব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসক-নার্স
সবাইকে প্রস্তুত রেখেছে কর্তৃপক্ষ। দগ্ধ রোগীদের জন্য এ ধরনের প্রস্তুতি
থাকলেও রোগী পাচ্ছে না এ হাসপাতালের আধুনিক বার্ন ইউনিট। এ ইউনিটে
কর্তব্যরত একজন নার্স বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রলবোমায়
দগ্ধরা চিকিৎসা নিতে শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন
ইউনিটে ছুটে যান। কারণ ঢাকার বাইরে দুর্ঘটনায় কেউ দগ্ধ হয়ে স্থানীয়
হাসপাতালে ভর্তি করার পর সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন
ইউনিটে রোগীদের রেফার করা হয়। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সমৃদ্ধ বার্ন
ইউনিট থাকার পরও রোগীদের রেফার করা হয় না। এ কারণে পূর্ণাঙ্গ
চিকিৎসাব্যবস্থা থাকার পরও দগ্ধ রোগীদের এ হাসপাতালে সচরাচর আসতে দেখা যায়
না। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম মুজিবুর রহমান বলেন,
হরতাল-অবরোধ না থাকার সময়ে অস্বাভাবিক চাপে থাকি। তখন সারা দেশ থেকে হাজার
হাজার রোগী ও স্বজন প্রতিদিন আমাদের কাছে আসেন। তখন চাপ সামাল দিতে আমরা
হাঁপিয়ে উঠি। সেই তুলনায় এখন রোগীর সংখ্যা কমেছে, যেটাকে আমি কম না বলে
স্বাভাবিক বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
No comments