শিক্ষাই হওয়া উচিত প্রধান অগ্রাধিকার -সাক্ষাৎকারে : বিয়ন লোমবোর্গ by এ কে এম জাকারিয়া
ড.
বিয়ন লোমবোর্গ টাইম ম্যাগাজিন–এর চোখে দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০
ব্যক্তির একজন। তিনি বিশ্বের প্রথম সারির থিঙ্কট্যাংক কোপেনহেগেন
কনসেনসাসের প্রেসিডেন্ট। জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল
(এমডিজি)–পরবর্তী বৈশ্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে এখন
কাজ করছেন। বাংলাদেশে এসেছিলেন এখানকার উন্নয়নের মূল লক্ষ্যগুলো নিয়ে কাজ
শুরুর সূচনা করতে। এ সময় কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো
: জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি) সাফল্যের পর নতুন
বৈশ্বিক লক্ষ্য ঠিক করার প্রক্রিয়া রয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় আপনার সংগঠন
কোপেনহেগেন কনসেনসাস কীভাবে ভূমিকা রাখাতে চাইছে?
বিয়োন লোমবোর্গ : এমডিজির সাফল্যের পর জাতিসংঘ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল মেয়াদি উন্নয়নের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে। নতুন এই লক্ষ্য নির্ধারণে জাতিসংঘ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্র যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। এবার জাতিসংঘ বিভিন্ন মহল থেকে প্রায় চৌদ্দ শ লক্ষ্যের একটি তালিকা পেয়েছে। এর মধ্য থেকে জাতিসংঘ ১৬৯টি প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করেছে। এমডিজিতে যেখানে মাত্র নয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, সে তুলনায় এবারের লক্ষ্যের সংখ্যা চিন্তা করে দেখুন। এটা হয়তো সবার জন্য ও সবকিছু ভালো করার লক্ষ্য থেকে করা হচ্ছে, কিন্তু এর সবগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, সেটা বড় বিবেচনার বিষয়। আমরা এই লক্ষ্যগুলো আরও সুনির্দিষ্ট করার কাজটি করছি।
প্রথম আলো : আমরা জেনেছি যে কোপেনহেগেন কনসেনসাস কস্ট-বেনিফিট বা খরচ এবং সে তুলনায় প্রাপ্তি বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ্যগুলো ঠিক করার কৌশল নিয়েছে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
বিয়োন লোমবোর্গ : দেখুন, আগামী ১৫ বছরের জন্য যে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হবে, সেখানে প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার উন্নয়ন–সহায়তা হিসেবে ব্যয় হবে। ফলে লক্ষ্যগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত, যাতে ব্যয় করা প্রতিটি ডলার বা টাকার সদ্ব্যবহার হয়। কোপেনহেগেন কনসেনসাসের পক্ষ থেকে আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সবচেয়ে কার্যকর লক্ষ্যগুলো নির্ধারণের কাজ করে যাচ্ছি। আমরা এ জন্য ১২১ জন একাডেমিশিয়ান, যাঁদের মধ্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীও রয়েছেন এবং বেশির ভাগই অর্থনীতিবিদ, তাঁদের দিয়ে লক্ষ্যগুলো পর্যালোচনা করিয়েছি। সব লক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে আমরা ঠিক করেছি যে কোনগুলোয় নজর দেওয়া উচিত, তাতে খরচের পরিমাণ কত এবং কোনগুলোয় সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে। মূলত আমরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ্যগুলো ঠিক করেছি।
প্রথম আলো : জাতিসংঘ প্রাথমিক পর্যায়ে ১৬৯টি লক্ষ্য বাছাই করেছে। আপনারা সবচেয়ে কার্যকর ও কস্ট-বেনিফিট বিবেচনায় নিয়ে কতগুলো লক্ষ্য বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করছেন?
বিয়োন লোমবোর্গ : বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য কার্যকর ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণে আমরা ইনডেপথ পর্যালোচনা করেছি। এর মধ্য দিয়ে কস্ট-বেনিফিট পর্যালোচনা করে আমরা উন্নয়নের জন্য ২২টি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। এর মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি ও জেন্ডার ইস্যু থেকে শুরু করে জ্বালানি—সবই রয়েছে। আগেই বলেছি, জাতিসংঘ যে ১৬৯টি লক্ষ্য বাছাই করেছে, তার সবগুলোর মধ্যে হয়তো সদিচ্ছার পরিচয় রয়েছে, কিন্তু এর অনেকগুলোই ফলদায়ক নয়। আমি আপনাদের আমার দ্য নোবেল লরিয়েটস গাইড টু দ্য স্মার্টেস্ট টার্গেটস ফর দ্য ওয়ার্ল্ড বইটি দিয়েছি। সেখানে আমি পরিষ্কার করেছি যে এমন অনেক লক্ষ্যের কথা আমরা শুনেছি, যেগুলো সদিচ্ছা হিসেবে হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু আমরা জানি না কীভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে। যেমন, শুধু কর্মসংস্থানের কথা বলে লাভ নেই। আমরা যদি ভালো শিক্ষা, খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারি, তবে সেটাই যোগ্য কর্মী তৈরির নিশ্চয়তা দেবে, যা কর্মসংস্থানের সহায়ক হবে। ফলে উন্নয়নের সেই স্মার্ট দিকগুলোই আগে নির্ধারণ করতে হবে, যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য এবং যা কাজে দেবে।
প্রথম আলো : আপনি যে স্মার্ট টার্গেটের কথা বললেন, সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
বিয়োন লোমবোর্গ : একটি উদাহরণ দিই, আমরা যেমন সব সময়ই শিক্ষা ও এর মান নিয়ে কথা বলি, কিন্তু কীভাবে শিক্ষা ও এর মান বাড়ানো সম্ভব, সেটা আমরা বিবেচনার বাইরে রেখেছি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার উন্নয়ন বলতে বুঝে এসেছি চেয়ার, টেবিল ও শ্রেণিকক্ষ। নব্বইয়ের দশকে ইন্দোনেশিয়ায় এসব অবকাঠামো প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। অর্থাৎ শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে মাত্র ২ শতাংশ। আমরা মনে করি, শিক্ষারই সবচেয়ে বেশি প্রধান্য পাওয়া উচিত, কিন্তু সে জন্য এর বাইরেও কিছু দিকে নজর দেওয়া জরুরি। যেমন পুষ্টি, একটি শিশুকে যদি ভালো পুষ্টি দেওয়া যায়, তবে তার মস্তিষ্কের বিকাশ ভালো হবে, লেখাপড়ায় স্বাভাবিকভাবেই সে ভালো করবে, সে অনেক বেশি কর্মক্ষম হবে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে পুষ্টির পেছনে এক টাকা খরচ করলে ৪০ টাকার ফল পাওয়া যায়। সুতরাং লক্ষ্যগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যেখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে সবচেয়ে ভালো ও কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।
প্রথম আলো : আপনারা যে লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করেছেন, সেগুলো কি সব দেশের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য?
বিয়োন লোমবোর্গ : আমরা বৈশ্বিক বিবেচনা থেকেই লক্ষ্যগুলো ঠিক করেছি। তবে এর মধ্য থেকে কোন দেশের জন্য কোনগুলো বেশি প্রধান্য পাওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করা যায়। যেমন, আমরা এখন বাংলাদেশ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আমরা বাংলাদেশের জন্য ১০টি প্রধান চ্যালেঞ্জ বা লক্ষ্য ঠিক করতে চাই এবং এ নিয়ে সব মহলের মধ্যে মতৈক্যে আসতে চাই। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা বিভিন্ন তরুণ ফোরাম করে কী করা উচিত এবং কোন ইস্যুতে জোর দেওয়া উচিত, সে ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ নিয়েছি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা এ ধরনের তরুণদের ফোরাম থেকে তাঁদের চাওয়াগুলো জানতে চাইব।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি ১০টি লক্ষ্য ঠিক করার ক্ষেত্রে আপনারা কী প্রক্রিয়া অবলম্বন করবেন?
বিয়োন লোমবোর্গ : দেখুন, বৈশ্বিকভাবে উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে কার্যকর লক্ষ্যগুলো আমরা ইতিমধ্যে ঠিক করেছি। আমরা বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও নোবেল বিজয়ীদের পরামর্শ নিয়ে কাজটি করেছি। তাঁরাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে স্মার্ট টার্গেটগুলো কী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা ১০টি সবচেয়ে জরুরি লক্ষ্য ঠিক করতে চাই। প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব চাওয়া থাকে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে কাজটি মূলত বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরাই করবেন, তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরাও সঙ্গে কাজ করবেন। তাঁরা ঠিক করবেন যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অবকাঠামোর ক্ষেত্রে কী করা যায়। জ্বালানির ক্ষেত্রে করণীয় কী বা পরিবেশ রক্ষায় কী করা উচিত। একই সঙ্গে আমরা হিসাব করে দেখাতে চাই যে কোন খাতে কী পরিমাণ খরচ হবে এবং তার বিপরীতে যে সুফল পাওয়া যাবে, তার দাম কত। এভাবেই সবচেয়ে জরুরি ১০টি লক্ষ্য ঠিক করা হবে। এ জন্য সব মহলের মধ্যে মতৈক্য বা ‘বাংলাদেশ কনসেনসাস’ তৈরি করা জরুরি। আমরা সেটাই করতে চাই।
প্রথম আলো : সব দেশের জন্যই কি আপনারা এভাবে কাজ শুরু করেছেন?
বিয়োন লোমবোর্গ : না, আমরা প্রথম কাজটি শুরু করেছি বাংলাদেশ নিয়ে। সামনে অন্য দেশ নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা আছে, তবে এটা নির্ভর করবে এ ধরনের কাজ করার জন্য তহবিল পাওয়ার ওপর। আমরা বাংলাদেশের ওপর বছর দেড়েক কাজ করব। এ সময় আমরা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্যগুলো ঠিক করব। বাংলাদেশের জন্য প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট রয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এখানে বছরে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করে। আমরা বাংলাদেশের সরকার, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, ইউএসএআইডি বা ডিএফআইডির মতো বিভিন্ন দাতা সংস্থা বা স্থানীয় এনজিওগুলোর সামনে এটাই তুলে ধরব যে কোন লক্ষ্যগুলো সবচেয়ে জরুরি এবং কোথায় অর্থ খরচ করে সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যাবে।
প্রথম আলো : বৈশ্বিক উষ্ণতা ও কার্বন নিঃসরণ প্রশ্নে কিয়োটে প্রোটকলের অবস্থান নিয়ে আপনার ভিন্নমত রয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমানো নিয়ে আপনার ভিন্নমতের যুক্তি কী?
বিয়োন লোমবোর্গ : বৈশ্বিক উষ্ণতা অবশ্যই একটি গুরুতর ইস্যু। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই বড় উদ্বেগের। কিয়েটো প্রোটকলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটা কার্যকর করার যা খরচ বা মূল্য, সে তুলনায় প্রাপ্তি খুবই সামান্য। এই প্রটোকল সফল করতে হলে, যদিও তা সফল হওয়ার সুযোগ কম, বছরে খরচ করতে হবে ২৮০ বিলিয়ন ডলার। এর বিনিময়ে ১০ থেকে ১৫ বছরে যে ফল পাওয়া যাবে, তা খুবই সামান্য। সে কারণেই আমি বলি যে কিয়েটো প্রোটকল একটি দুর্বল ও অদক্ষ পরিকল্পনা। আসলে যত দিন গ্রিন এনার্জি সস্তা করা না যাবে, তত দিন এ ক্ষেত্রে কার্যকর কিছুই হবে না।
প্রথম আলো : উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি সম্পর্ক রয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে গ্রিন এনার্জি বিষয়টি ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাংলাদেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, তাতে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার মতো ক্ষতিকর জ্বালানি ছাড়া পথ নেই। অথচ এ নিয়ে পরিবেশবাদীদের প্রবল আপত্তি রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবিলা করবে?
বিয়োন লোমবোর্গ : গ্রিন এনার্জি বিষয়টি এখনো বড়লোকের সন্তুষ্টির একটি বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। বেশি দামের গ্রিন এনার্জি ব্যবহার করে তাঁরা সন্তুষ্টি পেতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের কয়লা বা এ ধরনের জ্বালানি ব্যবহার ছাড়া কোনো পথ নেই। চীনের মতো দেশ কয়লা ব্যবহার করছে, বিশ্বের আরও অনেক দেশ একই কাজ করছে। জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টি নির্ভর করে দামের ওপর। যে জ্বালানির দাম কম, সেটাই ব্যবহৃত হবে। ফলে আমরা যদি পরিবেশ নিয়ে সচেতন হতে চাই, তবে গ্রিন এনার্জি কীভাবে সস্তা করা যায়, সে জন্য সেই খাতে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
বিয়োন লোমবোর্গ : ধন্যবাদ।
বিয়োন লোমবোর্গ : এমডিজির সাফল্যের পর জাতিসংঘ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল মেয়াদি উন্নয়নের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে। নতুন এই লক্ষ্য নির্ধারণে জাতিসংঘ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্র যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। এবার জাতিসংঘ বিভিন্ন মহল থেকে প্রায় চৌদ্দ শ লক্ষ্যের একটি তালিকা পেয়েছে। এর মধ্য থেকে জাতিসংঘ ১৬৯টি প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করেছে। এমডিজিতে যেখানে মাত্র নয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, সে তুলনায় এবারের লক্ষ্যের সংখ্যা চিন্তা করে দেখুন। এটা হয়তো সবার জন্য ও সবকিছু ভালো করার লক্ষ্য থেকে করা হচ্ছে, কিন্তু এর সবগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, সেটা বড় বিবেচনার বিষয়। আমরা এই লক্ষ্যগুলো আরও সুনির্দিষ্ট করার কাজটি করছি।
প্রথম আলো : আমরা জেনেছি যে কোপেনহেগেন কনসেনসাস কস্ট-বেনিফিট বা খরচ এবং সে তুলনায় প্রাপ্তি বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ্যগুলো ঠিক করার কৌশল নিয়েছে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
বিয়োন লোমবোর্গ : দেখুন, আগামী ১৫ বছরের জন্য যে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হবে, সেখানে প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার উন্নয়ন–সহায়তা হিসেবে ব্যয় হবে। ফলে লক্ষ্যগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত, যাতে ব্যয় করা প্রতিটি ডলার বা টাকার সদ্ব্যবহার হয়। কোপেনহেগেন কনসেনসাসের পক্ষ থেকে আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সবচেয়ে কার্যকর লক্ষ্যগুলো নির্ধারণের কাজ করে যাচ্ছি। আমরা এ জন্য ১২১ জন একাডেমিশিয়ান, যাঁদের মধ্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীও রয়েছেন এবং বেশির ভাগই অর্থনীতিবিদ, তাঁদের দিয়ে লক্ষ্যগুলো পর্যালোচনা করিয়েছি। সব লক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে আমরা ঠিক করেছি যে কোনগুলোয় নজর দেওয়া উচিত, তাতে খরচের পরিমাণ কত এবং কোনগুলোয় সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে। মূলত আমরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ্যগুলো ঠিক করেছি।
প্রথম আলো : জাতিসংঘ প্রাথমিক পর্যায়ে ১৬৯টি লক্ষ্য বাছাই করেছে। আপনারা সবচেয়ে কার্যকর ও কস্ট-বেনিফিট বিবেচনায় নিয়ে কতগুলো লক্ষ্য বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করছেন?
বিয়োন লোমবোর্গ : বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য কার্যকর ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণে আমরা ইনডেপথ পর্যালোচনা করেছি। এর মধ্য দিয়ে কস্ট-বেনিফিট পর্যালোচনা করে আমরা উন্নয়নের জন্য ২২টি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। এর মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি ও জেন্ডার ইস্যু থেকে শুরু করে জ্বালানি—সবই রয়েছে। আগেই বলেছি, জাতিসংঘ যে ১৬৯টি লক্ষ্য বাছাই করেছে, তার সবগুলোর মধ্যে হয়তো সদিচ্ছার পরিচয় রয়েছে, কিন্তু এর অনেকগুলোই ফলদায়ক নয়। আমি আপনাদের আমার দ্য নোবেল লরিয়েটস গাইড টু দ্য স্মার্টেস্ট টার্গেটস ফর দ্য ওয়ার্ল্ড বইটি দিয়েছি। সেখানে আমি পরিষ্কার করেছি যে এমন অনেক লক্ষ্যের কথা আমরা শুনেছি, যেগুলো সদিচ্ছা হিসেবে হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু আমরা জানি না কীভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে। যেমন, শুধু কর্মসংস্থানের কথা বলে লাভ নেই। আমরা যদি ভালো শিক্ষা, খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারি, তবে সেটাই যোগ্য কর্মী তৈরির নিশ্চয়তা দেবে, যা কর্মসংস্থানের সহায়ক হবে। ফলে উন্নয়নের সেই স্মার্ট দিকগুলোই আগে নির্ধারণ করতে হবে, যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য এবং যা কাজে দেবে।
প্রথম আলো : আপনি যে স্মার্ট টার্গেটের কথা বললেন, সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
বিয়োন লোমবোর্গ : একটি উদাহরণ দিই, আমরা যেমন সব সময়ই শিক্ষা ও এর মান নিয়ে কথা বলি, কিন্তু কীভাবে শিক্ষা ও এর মান বাড়ানো সম্ভব, সেটা আমরা বিবেচনার বাইরে রেখেছি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার উন্নয়ন বলতে বুঝে এসেছি চেয়ার, টেবিল ও শ্রেণিকক্ষ। নব্বইয়ের দশকে ইন্দোনেশিয়ায় এসব অবকাঠামো প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। অর্থাৎ শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে মাত্র ২ শতাংশ। আমরা মনে করি, শিক্ষারই সবচেয়ে বেশি প্রধান্য পাওয়া উচিত, কিন্তু সে জন্য এর বাইরেও কিছু দিকে নজর দেওয়া জরুরি। যেমন পুষ্টি, একটি শিশুকে যদি ভালো পুষ্টি দেওয়া যায়, তবে তার মস্তিষ্কের বিকাশ ভালো হবে, লেখাপড়ায় স্বাভাবিকভাবেই সে ভালো করবে, সে অনেক বেশি কর্মক্ষম হবে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে পুষ্টির পেছনে এক টাকা খরচ করলে ৪০ টাকার ফল পাওয়া যায়। সুতরাং লক্ষ্যগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যেখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে সবচেয়ে ভালো ও কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।
প্রথম আলো : আপনারা যে লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করেছেন, সেগুলো কি সব দেশের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য?
বিয়োন লোমবোর্গ : আমরা বৈশ্বিক বিবেচনা থেকেই লক্ষ্যগুলো ঠিক করেছি। তবে এর মধ্য থেকে কোন দেশের জন্য কোনগুলো বেশি প্রধান্য পাওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করা যায়। যেমন, আমরা এখন বাংলাদেশ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আমরা বাংলাদেশের জন্য ১০টি প্রধান চ্যালেঞ্জ বা লক্ষ্য ঠিক করতে চাই এবং এ নিয়ে সব মহলের মধ্যে মতৈক্যে আসতে চাই। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা বিভিন্ন তরুণ ফোরাম করে কী করা উচিত এবং কোন ইস্যুতে জোর দেওয়া উচিত, সে ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ নিয়েছি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা এ ধরনের তরুণদের ফোরাম থেকে তাঁদের চাওয়াগুলো জানতে চাইব।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি ১০টি লক্ষ্য ঠিক করার ক্ষেত্রে আপনারা কী প্রক্রিয়া অবলম্বন করবেন?
বিয়োন লোমবোর্গ : দেখুন, বৈশ্বিকভাবে উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে কার্যকর লক্ষ্যগুলো আমরা ইতিমধ্যে ঠিক করেছি। আমরা বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও নোবেল বিজয়ীদের পরামর্শ নিয়ে কাজটি করেছি। তাঁরাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে স্মার্ট টার্গেটগুলো কী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা ১০টি সবচেয়ে জরুরি লক্ষ্য ঠিক করতে চাই। প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব চাওয়া থাকে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে কাজটি মূলত বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরাই করবেন, তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরাও সঙ্গে কাজ করবেন। তাঁরা ঠিক করবেন যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অবকাঠামোর ক্ষেত্রে কী করা যায়। জ্বালানির ক্ষেত্রে করণীয় কী বা পরিবেশ রক্ষায় কী করা উচিত। একই সঙ্গে আমরা হিসাব করে দেখাতে চাই যে কোন খাতে কী পরিমাণ খরচ হবে এবং তার বিপরীতে যে সুফল পাওয়া যাবে, তার দাম কত। এভাবেই সবচেয়ে জরুরি ১০টি লক্ষ্য ঠিক করা হবে। এ জন্য সব মহলের মধ্যে মতৈক্য বা ‘বাংলাদেশ কনসেনসাস’ তৈরি করা জরুরি। আমরা সেটাই করতে চাই।
প্রথম আলো : সব দেশের জন্যই কি আপনারা এভাবে কাজ শুরু করেছেন?
বিয়োন লোমবোর্গ : না, আমরা প্রথম কাজটি শুরু করেছি বাংলাদেশ নিয়ে। সামনে অন্য দেশ নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা আছে, তবে এটা নির্ভর করবে এ ধরনের কাজ করার জন্য তহবিল পাওয়ার ওপর। আমরা বাংলাদেশের ওপর বছর দেড়েক কাজ করব। এ সময় আমরা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্যগুলো ঠিক করব। বাংলাদেশের জন্য প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট রয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এখানে বছরে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করে। আমরা বাংলাদেশের সরকার, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, ইউএসএআইডি বা ডিএফআইডির মতো বিভিন্ন দাতা সংস্থা বা স্থানীয় এনজিওগুলোর সামনে এটাই তুলে ধরব যে কোন লক্ষ্যগুলো সবচেয়ে জরুরি এবং কোথায় অর্থ খরচ করে সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যাবে।
প্রথম আলো : বৈশ্বিক উষ্ণতা ও কার্বন নিঃসরণ প্রশ্নে কিয়োটে প্রোটকলের অবস্থান নিয়ে আপনার ভিন্নমত রয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমানো নিয়ে আপনার ভিন্নমতের যুক্তি কী?
বিয়োন লোমবোর্গ : বৈশ্বিক উষ্ণতা অবশ্যই একটি গুরুতর ইস্যু। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই বড় উদ্বেগের। কিয়েটো প্রোটকলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটা কার্যকর করার যা খরচ বা মূল্য, সে তুলনায় প্রাপ্তি খুবই সামান্য। এই প্রটোকল সফল করতে হলে, যদিও তা সফল হওয়ার সুযোগ কম, বছরে খরচ করতে হবে ২৮০ বিলিয়ন ডলার। এর বিনিময়ে ১০ থেকে ১৫ বছরে যে ফল পাওয়া যাবে, তা খুবই সামান্য। সে কারণেই আমি বলি যে কিয়েটো প্রোটকল একটি দুর্বল ও অদক্ষ পরিকল্পনা। আসলে যত দিন গ্রিন এনার্জি সস্তা করা না যাবে, তত দিন এ ক্ষেত্রে কার্যকর কিছুই হবে না।
প্রথম আলো : উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি সম্পর্ক রয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে গ্রিন এনার্জি বিষয়টি ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাংলাদেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, তাতে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার মতো ক্ষতিকর জ্বালানি ছাড়া পথ নেই। অথচ এ নিয়ে পরিবেশবাদীদের প্রবল আপত্তি রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবিলা করবে?
বিয়োন লোমবোর্গ : গ্রিন এনার্জি বিষয়টি এখনো বড়লোকের সন্তুষ্টির একটি বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। বেশি দামের গ্রিন এনার্জি ব্যবহার করে তাঁরা সন্তুষ্টি পেতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের কয়লা বা এ ধরনের জ্বালানি ব্যবহার ছাড়া কোনো পথ নেই। চীনের মতো দেশ কয়লা ব্যবহার করছে, বিশ্বের আরও অনেক দেশ একই কাজ করছে। জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টি নির্ভর করে দামের ওপর। যে জ্বালানির দাম কম, সেটাই ব্যবহৃত হবে। ফলে আমরা যদি পরিবেশ নিয়ে সচেতন হতে চাই, তবে গ্রিন এনার্জি কীভাবে সস্তা করা যায়, সে জন্য সেই খাতে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
বিয়োন লোমবোর্গ : ধন্যবাদ।
No comments