কে বড় স্বৈরাচার? by এম আবদুল্লাহ
জাতীয়
পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার চেয়েও বড় স্বৈরাচার বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এখনকার প্রধানমন্ত্রী আমার চেয়েও বড় স্বৈরাচার। আমি গুলি করে
মানুষ মারি নাই, মানুষ হত্যা করি নাই। এখন প্রতিদিন নূর হোসেন, বিশ্বজিৎ
মরছে। কিন্তু আমাদের চোখে পানি আসে না।’ গত ৮ মার্চ রোববার দুপুরে জাতীয়
পার্টির চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে দলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের
যৌথ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এরশাদ বলেন, ‘গণতন্ত্র
এখন কবরে, নির্বাসনে’। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতির এক
আলোচিত চরিত্র। তার স্ববিরোধী বক্তব্য, রাজনৈতিক ডিগবাজি, সকাল-বিকেল রূপ
পরিবর্তন বাংলাদেশের মানুষকে যুগপৎভাবে বিস্মিত করে এবং আনন্দ দেয়। এটা বোধ
করি তিনিও জানেন। এরশাদের বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সম্ভবত তার
সহধর্মিণী রওশন এরশাদ থেকে শুরু করে ঘনিষ্ঠ আপনজন এবং আশপাশের রাজনৈতিক
সহকর্মীসহ সবারই সম্যক ধারণা রয়েছে। কিন্তু গত রোববারের বক্তব্য নিয়ে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে আলোচনার ঝড় বইছে, যেভাবে লিংক শেয়ারের ছড়াছড়ি
দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে অনেকেই ‘আনপ্রেডিক্টেবল খেলোয়াড়’ এরশাদের
বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করছেন। যার নামের সাথে ‘স্বৈরাচার’ শব্দটি একরকম
একাকার হয়ে গেছে, তিনি যখন তার নেত্রীকে নিজের চেয়ে বড় ‘স্বৈরাচার’ হিসেবে
সার্টিফাই করেন; তখন অনেকেই তা আমলে নেন। তার নেত্রী বলছি এ জন্য যে,
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে এখনো
দায়িত্বে আছেন এবং সব রকম প্রটোকল ও সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন।
স্বৈরাচার হিসেবে কে বড়, কে ছোট তা পরিমাপ করার জন্য এখনো ব্যারোমিটার আবিষ্কার হয়নি। তবে কিছু মাপকাঠি এবং সূচক বিশ্লেষণে এরশাদের বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করা যেতে পারে। তার আগে জেনে নেয়া যাক ‘স্বৈরাচার’-এর গুণাগুণ কী?
অভিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বৈরাচারী হলো এমন শাসনব্যবস্থা, যাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম মতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে। স্বৈরশাসন বা একনায়কতন্ত্রকে সামাজিকভাবে নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়। এই শাসনব্যবস্থায় কার্যত আইনসভার অস্তিত্ব নেই বলে শাসনকর্তা তার খেয়াল-খুশিমতো দেশ পরিচালনা করেন। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে দেখা যায়। এ শাসনব্যবস্থা মূলত স্বেচ্ছাচারমূলক।
গ্রিক মনীষী অ্যারিস্টটলের ভাষায়- ‘স্বৈরশাসনে একজন একনায়ক সব শাসনকাজ পরিচালনা করে থাকেন। একনায়ক রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা এবং চরম মতার উৎস, মতা প্রয়োগে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা মানসিকতা নিয়ে তিনি ফ্যাসিবাদ কায়েম করেন। তার কাজকর্মের জন্য তাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। তার আদেশ-নির্দেশ সবাই মেনে চলতে বাধ্য হয়। স্বৈরশাসন ব্যবস্থায় একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। বহু মত, বহু দলকে অগ্রাহ্য করা হয়। একনায়ক তার পছন্দমতো উপদেষ্টাদের নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। উপদেষ্টামণ্ডলী তার কাছে দায়ী থাকেন ও তার সন্তুষ্টির ওপর তাদের কার্যকাল নির্ভর করে।’
অ্যারিস্টটল স্বৈরশাসনের সংজ্ঞায় আরো বলেন, ‘এ ধরনের শাসনে জনসাধারণের স্বাতন্ত্র্য থাকে না। এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী। এই শাসনব্যবস্থার কোনো সমালোচনা কেউ করতে পারে না। বিভিন্ন মতবাদ জোরপূর্বক দমন করা হয়। একনায়কতন্ত্র উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটায়। এ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিকতা-বিরোধী। একটি স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থা। এই শাসনব্যবস্থা অস্থায়ী। কারণ, একনায়কের মৃত্যুর সাথে সাথে এ শাসনও শেষ হয়ে যায়।’
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার চেয়ে বড় স্বৈরাচারী হিসেবে তকমা দেয়ার ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের এ সংজ্ঞার সাথে মিলিয়ে দেখেছেন কি না তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। স্বৈরতন্ত্রের বিপরীত শাসনব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র। কোন সরকার কতটা গণতন্ত্রী আর কোন মাত্রার স্বৈরতন্ত্রী তা বোঝার জন্য সাধারণত সেই সরকারের সময় রাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গ কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করছে তার দিকে নজর দেয়া হয়। আইনসভা, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ- তিনটির বাইরে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমকে আমলে নেয়া হয়। এগুলো কতটা গণপ্রতিনিধিত্বমূলক বা কোন মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত তা পর্যবেক্ষণ করলেই ওই সময়কার রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার স্বরূপ ফুটে ওঠে।
সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণে গেলে দেখা যাবে, এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছেন রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। সেই ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে দেশে একজন মানুষও মরেনি। যদিও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের যোগসূত্র রয়েছে বলে প্রবল ধারণা রয়েছে। জিয়ার হত্যা এবং প্রতিহত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাদ দিলে এরশাদের ক্ষমতা দখল ছিল রক্তপাতহীন। পক্ষান্তরে বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যে সরকার রয়েছে তার জন্য রক্ত ঝরেছে প্রচুর। জীবন গেছে শতাধিক মানুষের। কেবল ৫ জানুয়ারির একতরফা ভাগাভাগি আর তামাশার নির্বাচনের দিনই নিহত হয়েছে ২৫ জন। আর ওই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন করা আর প্রতিহত করার সঙ্ঘাতে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। বিশ্বগণমাধ্যম ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আরো অনেক বিশেষণের সাথে ‘প্রাণঘাতী নির্বাচন’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। এ বিবেচনায় এরশাদের দাবি সমর্থনযোগ্য বৈকি।
দ্বিতীয় মাপকাঠি যদি ধরা হয় রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিরোধী আন্দোলন দমন, তাতে দেখা যায় এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর জারি করেন সামরিক আইন। তার পর দল গঠন করে আন্দেলনরতদের বর্জনের মুখে দু’টি নির্বাচন করে ৯ বছর দেশ শাসন করেন। এই ৯ বছরে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও বামদলগুলোসহ পুরনো সব রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে অবশেষে ’৯০-এর ৬ ডিসেম্বর এরশাদকে পদত্যাগে বাধ্য করে। এই দীর্ঘ আন্দোলনের সময় বহু বিরোধী কর্মী হতাহত হয়েছে। তবে বড় ধরনের হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ’৯০-এর নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর, এ দুই মাসে।
’৯০-এর ২ ডিসেম্বর ‘আন্দোলনের বুলেটিন’ নামে এক প্রকাশনায় দেয়া তথ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওই বছরের ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্দোলনরতদের ওপর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে ২৫ জন নিহত হয়েছিলেন। ওই বুলেটিনে তাদের নাম ছিল। সর্বশেষ আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছিল নূর হোসেন ও ডা: শামসুল আলম মিলন। তার আগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসহ নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
প্রকারান্তরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দফায় দ্বিতীয় মেয়াদের বর্তমান সরকারের সময়ে প্রথম এক বছর কোনো আন্দোলন হয়নি। দ্বিতীয় বছরের প্রথম দু’মাসের আন্দোলন শেষে তৃতীয় মাস চলছে। নব্বইয়ের নভেম্বর-ডিসেম্বরের সাথে যদি বর্তমান সরকারের গেল জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির তুলনা করা হয় তাতেও দেখা যাবে সরকারি বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা এরশাদের সময়ের তিন গুণ। সম্প্রতি সংবাদপত্রে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর হাতে বিরোধী নেতাকর্মী হত্যা ও গুমের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় দু’মাসে ৭৯ জনের হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এদের সুনির্দিষ্ট তালিকা ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রথম আলো ১০ মার্চ ২০১৫ মঙ্গলবার ৬৪ দিনের অবরোধ হরতালের যে রক্ষণশীল পরিসংখ্যান দিয়েছে তাতে দেখা যায়, মোট ১১৯ জন নিহত হয়েছেন। তন্মধ্যে ৬৩ জন নিহত হয়েছেন পেট্রলবোমায়। বাকিরা কথিত বন্দুকযুদ্ধ, সংঘর্ষ ও গুলিতে নিহত হয়েছেন। এই পরিসংখ্যানও এরশাদের দাবিকে সমর্থন করে। অন্তত সরকারি বাহিনীর হাতে লাশ পড়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার এরশাদের চেয়ে বেশ এগিয়ে রয়েছে।
এর বাইরে গণমাধ্যম ও বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতার মাপকাঠিতে যদি বিবেচনা করা হয় তা-ও এরশাদের দাবিকে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ কম। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা যে, এরশাদ আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছিল। কিন্তু মাত্রা বর্তমান সময়ের চেয়ে কোনোমতেই বেশি ছিল না। সে সময় সংবাদপত্রের সংখ্যা অনেক কম ছিল এবং বেসরকারি টেলিভিশন ছিল না। ফলে টেলিভিশনের ওপর চলমান নগ্ন হস্তক্ষেপের বিষয়টি এ পর্যালোচনায় বাদ রাখছি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব, বন্ধ করে দেয়া, সাংবাদিকদের কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া, গণমাধ্যমজুড়ে ত্রাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে এরশাদ শাসনের দৃষ্টান্তগুলোকে অনেকখানি ম্লান করে দেয়ার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে বর্তমান সরকার। এরশাদ আমলে দৈনিক ইনকিলাব বন্ধ হয়েছিল, এবারো দু’দফা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ওই সময় পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ও সাংবাদিককে কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া, দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, কম্পিউটারসহ মুদ্রণ সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া, প্রেসে তালা লাগিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি, যা এবার ঘটেছে। এরশাদের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন বন্ধ করে দেয়া হলেও পত্রিকার সম্পাদক অন্তত দেশ ছেড়ে মুক্ত আলোবাতাসে ছিলেন। এবার আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে সম্পাদককে কমান্ডো স্টাইলে গ্রেফতার করে দু’দফায় বছরের পর বছর জেলে পুরে রাখা হয়েছে। প্রবীণ সাংবাদিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে বিনা মামলায় ধরে নিয়ে রিমান্ডে হয়রানি করা হয়েছে। দুর্নীতির রিপোর্ট করায় জনপ্রিয় অনলাইন শীর্ষনিউজ.কম ও শীর্ষকাগজের সম্পাদক একরামুল হককে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার ও রিমান্ডের ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। গণমাধ্যমে এ ধরনের আরো অনেক নিপীড়নমূলক উদাহরণ বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে যা এ স্বল্প পরিসরে বর্ণনার সুযোগ কম।
এরশাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত নানা রকম ব্যঙ্গচিত্র, প্রচারপত্র বিলি হতে দেখা যায়। একটি প্রচারপত্রের এক দিকে ছাপা হয়েছিল একটি কবিতা। কবি শামসুর রাহমানের লেখা কবিতার শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ চায় না তোমাকে’। ওই প্রচারপত্রের অন্য দিকে ছিল কামরুল হাসানের সেই বিখ্যাত কার্টুন ‘বিশ্ব বেহায়া’। সংবাদপত্রগুলোতেও কিছু সময় বাদ দিলে বেশির ভাগ সময় এরশাদ সরকারের সমালোচনা করা গেছে।
এখন প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করলে, তার ছবি বিকৃত করলে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে সাত বছর পর্যন্ত জেল দেয়ার নতুন নজির দেখা যাচ্ছে। এরশাদ তেমনটা করলে ‘বাংলাদেশ চায় না তোমাকে’ শিরোনামে আক্রমণাত্মক ভাষার কবিতার জন্য কবি শামসুর রাহমানকে এবং ‘বিশ্ব বেহায়া’ ব্যঙ্গচিত্রের জন্য শিল্পী কামরুল হাসানের কী পরিণতি ভোগ করতে হতো তা আল্লাহ মালুম।
রাজনৈতিক অধিকারের দিকে তাকালে দেখা যাবে এরশাদ সরকার প্রধান কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় বছরের পর বছর তালা দিয়ে রাখেনি। মিছিল, সমাবেশ হয়েছে হররোজ। মাঝে মধ্যে বাধা এসেছে এরশাদ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বাধার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করেছে, তার পর টিয়ারগ্যাস ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করেছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রথমে ফাঁকা গুলি এবং পরে গুলি করলেও তা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে খুবই সীমিত আকারে। আর এখন? স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় নিষিদ্ধ।
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধান কার্যালয় তালাবদ্ধ। যত দিন ওই অফিসে দলীয় নেতাদের যাওয়ার সুযোগ ছিল তত দিনও পুলিশ বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ ছিল। আর মিছিল দেখলে গুলি দিয়ে পুলিশি অ্যাকশন শুরু হয়। আগে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া, যথেষ্ট যুক্তি-প্রমাণ ছাড়া গুলি ছুড়লে পুলিশকে জবাবদিহি করতে হতো। এখন উল্টো। গণমাধ্যমে কোনো সরকারবিরোধী মিছিলের খবর এলে ওই এলাকার কর্তব্যরত পুলিশকে জবাবদিহি করতে হয়- কেন দেখামাত্র গুলি করে ওদের খুলি উড়িয়ে দেয়া হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের নির্বিচারে গ্রেফতার আর রিমান্ডে নির্যাতনের ক্ষেত্রেও শুধু এরশাদ আমল নয়, সর্বকালের সর্বযুগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বর্তমান সরকার। ফলে এরশাদের মুখে ‘বড় স্বৈরাচার’-এর তকমা বর্তমান সরকারপ্রধানকে দেয়া অন্যায্য মনে করছেন না অনেকেই।
এর বাইরে প্রশাসনকে দলীয়করণ, বিচারব্যবস্থাকে কব্জা করাসহ অন্য সব ক্ষেত্রে বিশদ আলোচনায় না গিয়েও বলা যায় এরশাদকে ছাড়িয়ে গেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে তার বিশেষ দূত তার প্রতি কোনো অবিচার করেছেন বলে অন্তত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎপর বিশাল জনগোষ্ঠী মনে করছেন না। আর প্রধানমন্ত্রী নিজে বা তার দলের কেউ এ লেখা পর্যন্ত এরশাদের সাথে দ্বিমত করতে দেখিনি। ফলে ধরেই নেয়া যায় যে, এরশাদের নতুন সার্টিফিকেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাদরে গ্রহণ করবেন এবং তার সরকার ও দল তা কবুল করে নেবে। তাহলে অন্তত প্রথমবারের মতো এরশাদ একটি সত্য উচ্চারণ করেছেন বলে যারা মতামত দিচ্ছেন তাদের প্রতি সুবিচার করা হবে।
লেখক : সিনিয়র সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে
স্বৈরাচার হিসেবে কে বড়, কে ছোট তা পরিমাপ করার জন্য এখনো ব্যারোমিটার আবিষ্কার হয়নি। তবে কিছু মাপকাঠি এবং সূচক বিশ্লেষণে এরশাদের বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করা যেতে পারে। তার আগে জেনে নেয়া যাক ‘স্বৈরাচার’-এর গুণাগুণ কী?
অভিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বৈরাচারী হলো এমন শাসনব্যবস্থা, যাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম মতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে। স্বৈরশাসন বা একনায়কতন্ত্রকে সামাজিকভাবে নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়। এই শাসনব্যবস্থায় কার্যত আইনসভার অস্তিত্ব নেই বলে শাসনকর্তা তার খেয়াল-খুশিমতো দেশ পরিচালনা করেন। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে দেখা যায়। এ শাসনব্যবস্থা মূলত স্বেচ্ছাচারমূলক।
গ্রিক মনীষী অ্যারিস্টটলের ভাষায়- ‘স্বৈরশাসনে একজন একনায়ক সব শাসনকাজ পরিচালনা করে থাকেন। একনায়ক রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা এবং চরম মতার উৎস, মতা প্রয়োগে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা মানসিকতা নিয়ে তিনি ফ্যাসিবাদ কায়েম করেন। তার কাজকর্মের জন্য তাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। তার আদেশ-নির্দেশ সবাই মেনে চলতে বাধ্য হয়। স্বৈরশাসন ব্যবস্থায় একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। বহু মত, বহু দলকে অগ্রাহ্য করা হয়। একনায়ক তার পছন্দমতো উপদেষ্টাদের নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। উপদেষ্টামণ্ডলী তার কাছে দায়ী থাকেন ও তার সন্তুষ্টির ওপর তাদের কার্যকাল নির্ভর করে।’
অ্যারিস্টটল স্বৈরশাসনের সংজ্ঞায় আরো বলেন, ‘এ ধরনের শাসনে জনসাধারণের স্বাতন্ত্র্য থাকে না। এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী। এই শাসনব্যবস্থার কোনো সমালোচনা কেউ করতে পারে না। বিভিন্ন মতবাদ জোরপূর্বক দমন করা হয়। একনায়কতন্ত্র উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটায়। এ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিকতা-বিরোধী। একটি স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থা। এই শাসনব্যবস্থা অস্থায়ী। কারণ, একনায়কের মৃত্যুর সাথে সাথে এ শাসনও শেষ হয়ে যায়।’
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার চেয়ে বড় স্বৈরাচারী হিসেবে তকমা দেয়ার ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের এ সংজ্ঞার সাথে মিলিয়ে দেখেছেন কি না তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। স্বৈরতন্ত্রের বিপরীত শাসনব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র। কোন সরকার কতটা গণতন্ত্রী আর কোন মাত্রার স্বৈরতন্ত্রী তা বোঝার জন্য সাধারণত সেই সরকারের সময় রাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গ কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করছে তার দিকে নজর দেয়া হয়। আইনসভা, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ- তিনটির বাইরে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমকে আমলে নেয়া হয়। এগুলো কতটা গণপ্রতিনিধিত্বমূলক বা কোন মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত তা পর্যবেক্ষণ করলেই ওই সময়কার রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার স্বরূপ ফুটে ওঠে।
সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণে গেলে দেখা যাবে, এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছেন রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। সেই ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে দেশে একজন মানুষও মরেনি। যদিও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের যোগসূত্র রয়েছে বলে প্রবল ধারণা রয়েছে। জিয়ার হত্যা এবং প্রতিহত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাদ দিলে এরশাদের ক্ষমতা দখল ছিল রক্তপাতহীন। পক্ষান্তরে বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যে সরকার রয়েছে তার জন্য রক্ত ঝরেছে প্রচুর। জীবন গেছে শতাধিক মানুষের। কেবল ৫ জানুয়ারির একতরফা ভাগাভাগি আর তামাশার নির্বাচনের দিনই নিহত হয়েছে ২৫ জন। আর ওই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন করা আর প্রতিহত করার সঙ্ঘাতে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। বিশ্বগণমাধ্যম ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আরো অনেক বিশেষণের সাথে ‘প্রাণঘাতী নির্বাচন’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। এ বিবেচনায় এরশাদের দাবি সমর্থনযোগ্য বৈকি।
দ্বিতীয় মাপকাঠি যদি ধরা হয় রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিরোধী আন্দোলন দমন, তাতে দেখা যায় এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর জারি করেন সামরিক আইন। তার পর দল গঠন করে আন্দেলনরতদের বর্জনের মুখে দু’টি নির্বাচন করে ৯ বছর দেশ শাসন করেন। এই ৯ বছরে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও বামদলগুলোসহ পুরনো সব রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে অবশেষে ’৯০-এর ৬ ডিসেম্বর এরশাদকে পদত্যাগে বাধ্য করে। এই দীর্ঘ আন্দোলনের সময় বহু বিরোধী কর্মী হতাহত হয়েছে। তবে বড় ধরনের হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ’৯০-এর নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর, এ দুই মাসে।
’৯০-এর ২ ডিসেম্বর ‘আন্দোলনের বুলেটিন’ নামে এক প্রকাশনায় দেয়া তথ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওই বছরের ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্দোলনরতদের ওপর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে ২৫ জন নিহত হয়েছিলেন। ওই বুলেটিনে তাদের নাম ছিল। সর্বশেষ আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছিল নূর হোসেন ও ডা: শামসুল আলম মিলন। তার আগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসহ নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
প্রকারান্তরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দফায় দ্বিতীয় মেয়াদের বর্তমান সরকারের সময়ে প্রথম এক বছর কোনো আন্দোলন হয়নি। দ্বিতীয় বছরের প্রথম দু’মাসের আন্দোলন শেষে তৃতীয় মাস চলছে। নব্বইয়ের নভেম্বর-ডিসেম্বরের সাথে যদি বর্তমান সরকারের গেল জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির তুলনা করা হয় তাতেও দেখা যাবে সরকারি বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা এরশাদের সময়ের তিন গুণ। সম্প্রতি সংবাদপত্রে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর হাতে বিরোধী নেতাকর্মী হত্যা ও গুমের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় দু’মাসে ৭৯ জনের হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এদের সুনির্দিষ্ট তালিকা ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রথম আলো ১০ মার্চ ২০১৫ মঙ্গলবার ৬৪ দিনের অবরোধ হরতালের যে রক্ষণশীল পরিসংখ্যান দিয়েছে তাতে দেখা যায়, মোট ১১৯ জন নিহত হয়েছেন। তন্মধ্যে ৬৩ জন নিহত হয়েছেন পেট্রলবোমায়। বাকিরা কথিত বন্দুকযুদ্ধ, সংঘর্ষ ও গুলিতে নিহত হয়েছেন। এই পরিসংখ্যানও এরশাদের দাবিকে সমর্থন করে। অন্তত সরকারি বাহিনীর হাতে লাশ পড়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার এরশাদের চেয়ে বেশ এগিয়ে রয়েছে।
এর বাইরে গণমাধ্যম ও বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতার মাপকাঠিতে যদি বিবেচনা করা হয় তা-ও এরশাদের দাবিকে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ কম। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা যে, এরশাদ আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছিল। কিন্তু মাত্রা বর্তমান সময়ের চেয়ে কোনোমতেই বেশি ছিল না। সে সময় সংবাদপত্রের সংখ্যা অনেক কম ছিল এবং বেসরকারি টেলিভিশন ছিল না। ফলে টেলিভিশনের ওপর চলমান নগ্ন হস্তক্ষেপের বিষয়টি এ পর্যালোচনায় বাদ রাখছি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব, বন্ধ করে দেয়া, সাংবাদিকদের কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া, গণমাধ্যমজুড়ে ত্রাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে এরশাদ শাসনের দৃষ্টান্তগুলোকে অনেকখানি ম্লান করে দেয়ার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে বর্তমান সরকার। এরশাদ আমলে দৈনিক ইনকিলাব বন্ধ হয়েছিল, এবারো দু’দফা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ওই সময় পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ও সাংবাদিককে কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া, দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, কম্পিউটারসহ মুদ্রণ সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া, প্রেসে তালা লাগিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি, যা এবার ঘটেছে। এরশাদের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন বন্ধ করে দেয়া হলেও পত্রিকার সম্পাদক অন্তত দেশ ছেড়ে মুক্ত আলোবাতাসে ছিলেন। এবার আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে সম্পাদককে কমান্ডো স্টাইলে গ্রেফতার করে দু’দফায় বছরের পর বছর জেলে পুরে রাখা হয়েছে। প্রবীণ সাংবাদিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে বিনা মামলায় ধরে নিয়ে রিমান্ডে হয়রানি করা হয়েছে। দুর্নীতির রিপোর্ট করায় জনপ্রিয় অনলাইন শীর্ষনিউজ.কম ও শীর্ষকাগজের সম্পাদক একরামুল হককে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার ও রিমান্ডের ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। গণমাধ্যমে এ ধরনের আরো অনেক নিপীড়নমূলক উদাহরণ বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে যা এ স্বল্প পরিসরে বর্ণনার সুযোগ কম।
এরশাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত নানা রকম ব্যঙ্গচিত্র, প্রচারপত্র বিলি হতে দেখা যায়। একটি প্রচারপত্রের এক দিকে ছাপা হয়েছিল একটি কবিতা। কবি শামসুর রাহমানের লেখা কবিতার শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ চায় না তোমাকে’। ওই প্রচারপত্রের অন্য দিকে ছিল কামরুল হাসানের সেই বিখ্যাত কার্টুন ‘বিশ্ব বেহায়া’। সংবাদপত্রগুলোতেও কিছু সময় বাদ দিলে বেশির ভাগ সময় এরশাদ সরকারের সমালোচনা করা গেছে।
এখন প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করলে, তার ছবি বিকৃত করলে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে সাত বছর পর্যন্ত জেল দেয়ার নতুন নজির দেখা যাচ্ছে। এরশাদ তেমনটা করলে ‘বাংলাদেশ চায় না তোমাকে’ শিরোনামে আক্রমণাত্মক ভাষার কবিতার জন্য কবি শামসুর রাহমানকে এবং ‘বিশ্ব বেহায়া’ ব্যঙ্গচিত্রের জন্য শিল্পী কামরুল হাসানের কী পরিণতি ভোগ করতে হতো তা আল্লাহ মালুম।
রাজনৈতিক অধিকারের দিকে তাকালে দেখা যাবে এরশাদ সরকার প্রধান কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় বছরের পর বছর তালা দিয়ে রাখেনি। মিছিল, সমাবেশ হয়েছে হররোজ। মাঝে মধ্যে বাধা এসেছে এরশাদ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বাধার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করেছে, তার পর টিয়ারগ্যাস ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করেছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রথমে ফাঁকা গুলি এবং পরে গুলি করলেও তা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে খুবই সীমিত আকারে। আর এখন? স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় নিষিদ্ধ।
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধান কার্যালয় তালাবদ্ধ। যত দিন ওই অফিসে দলীয় নেতাদের যাওয়ার সুযোগ ছিল তত দিনও পুলিশ বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ ছিল। আর মিছিল দেখলে গুলি দিয়ে পুলিশি অ্যাকশন শুরু হয়। আগে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া, যথেষ্ট যুক্তি-প্রমাণ ছাড়া গুলি ছুড়লে পুলিশকে জবাবদিহি করতে হতো। এখন উল্টো। গণমাধ্যমে কোনো সরকারবিরোধী মিছিলের খবর এলে ওই এলাকার কর্তব্যরত পুলিশকে জবাবদিহি করতে হয়- কেন দেখামাত্র গুলি করে ওদের খুলি উড়িয়ে দেয়া হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের নির্বিচারে গ্রেফতার আর রিমান্ডে নির্যাতনের ক্ষেত্রেও শুধু এরশাদ আমল নয়, সর্বকালের সর্বযুগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বর্তমান সরকার। ফলে এরশাদের মুখে ‘বড় স্বৈরাচার’-এর তকমা বর্তমান সরকারপ্রধানকে দেয়া অন্যায্য মনে করছেন না অনেকেই।
এর বাইরে প্রশাসনকে দলীয়করণ, বিচারব্যবস্থাকে কব্জা করাসহ অন্য সব ক্ষেত্রে বিশদ আলোচনায় না গিয়েও বলা যায় এরশাদকে ছাড়িয়ে গেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে তার বিশেষ দূত তার প্রতি কোনো অবিচার করেছেন বলে অন্তত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎপর বিশাল জনগোষ্ঠী মনে করছেন না। আর প্রধানমন্ত্রী নিজে বা তার দলের কেউ এ লেখা পর্যন্ত এরশাদের সাথে দ্বিমত করতে দেখিনি। ফলে ধরেই নেয়া যায় যে, এরশাদের নতুন সার্টিফিকেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাদরে গ্রহণ করবেন এবং তার সরকার ও দল তা কবুল করে নেবে। তাহলে অন্তত প্রথমবারের মতো এরশাদ একটি সত্য উচ্চারণ করেছেন বলে যারা মতামত দিচ্ছেন তাদের প্রতি সুবিচার করা হবে।
লেখক : সিনিয়র সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে
No comments