স্থানীয় সরকার- উপজেলা নির্বাচন ও ইসির করণীয় by তোফায়েল আহমেদ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের নির্দেশনা (ধারা ৫৯) অনুযায়ী অত্যন্ত প্রাচীন ও কার্যকর ‘প্রশাসনিক একক’ হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার গঠন ও কার্যকর করা একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এ বাধ্যবাধকতা জেলা ও বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। দাবি করার আগেই তফসিল ঘোষণা। এখনো জাতীয় রাজনীতির বেদনাদায়ক স্মৃতি সবাইকে তাড়িত করছে। বিশেষ করে, ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক নানামুখী সহিংসতায় চাপা পড়ে আছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিতর্কিত অনেক বিষয়। অতীতে সব সামরিক শাসক ‘বিরাজনীতিকরণ’-এর অন্যতম কৌশল হিসেবে স্থানীয় নির্বাচনকে ব্যবহার করেছেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা সাময়িকভাবে মুখ রক্ষার মতো সফলতাও পেয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচনের টোপ দিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ-উত্তেজনা প্রশমনের সাময়িক দম নেওয়ার ফুরসত সৃষ্টি করেছেন। জেনারেল আইয়ুব, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ—সবাই একই কৌশল ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে প্রয়োগ করেছেন।
এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয় সরকারগুলো কিছুটা ব্যতিক্রম। স্থানীয় সরকারকে নিয়ে তাদের রাজনীতির কৌশলটা কখনোই ‘বুদ্ধিদীপ্তভাবে রাজনৈতিক’ ছিল না। এবারেই প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীনেরা জাতীয় রাজনীতির দাবার ছকে স্থানীয় সরকারের একটি বাস্তব অবস্থান দেখতে পেয়েছেন। ক্ষমতাসীন মহাজোট দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন বর্জনকারী অপর জোটের রাজনীতি মোকাবিলায় এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেছে। তবে নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে ‘সকল ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ার’ তত্ত্বটি বোধ হয় এখানেও প্রযোজ্য। বিরোধী জোটও পাল্টা কৌশল হিসেবেই এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এতে এক-দেড় মাস আগের অংশগ্রহণবিহীন যে নির্বাচনী চিত্র, তা পুরোপুরি বদলে গিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন সরকার ও নির্বাচন কমিশন আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে বিষয়টি গ্রহণ করলে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু স্থানীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
এ নির্বাচনের ইতিবাচকতা: এ নির্বাচন একদিকে জাতীয় রাজনীতির একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। প্রথমত, সব দলের অংশগ্রহণে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল, ভোটের হার ও প্রার্থীসংখ্যার বিচারে এ নির্বাচন রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ নিয়ে আসতে পারে। অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের ধারাবাহিকতা এ নির্বাচনের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পর পর দুবার উপজেলা পরিষদ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলে এ পরিষদের কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা আসবে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের সব দলের স্থানীয় নেতৃত্বে সাংগঠনিকভাবে নিজেদের সংহত করার সুযোগ নিচ্ছে, পাচ্ছে এবং এ প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা জাতীয় রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ গুণগত পরিবর্তনের প্রধান দিক হবে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন এবং এ পরিষদের ধারাবাহিকতা রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের প্রশিক্ষিত নেতৃত্ব সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। সে হিসাবে জাতীয় নেতৃত্বকাঠামোয় ইতিবাচক ও গঠনমূলক নেতৃত্বের বিকাশ সম্ভব হবে। ঢাকামুখী ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৃণমূল থেকে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।
গ্রামগঞ্জে জোটের বাতাস এখন প্রবল। প্রার্থী-সমর্থকদের উৎসাহ বিপুল। সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা গেলে এ নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীর অংশগ্রহণ ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলো গুম, খুন, ধরপাকড়ের অভিযোগ করেছে। সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে সরব ও সক্রিয় ভূমিকায় দেখতে চাইবে সবাই।
নির্বাচন কমিশন ও সরকার: ৪৮৭টি উপজেলার তিনটি পদের নির্বাচন পাঁচ-ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রথম ধাপে ৯৭টি উপজেলায় ১৯ ফেব্রুয়ারি, একটি উপজেলায় ২৪ ফেব্রুয়ারি; দ্বিতীয় ধাপে ১১৭টি উপজেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি, তৃতীয় ধাপে ৮৩টি উপজেলায় ১৫ মার্চ এবং চতুর্থ ধাপে ৯২টি আসনে ২৩ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আরও দুই ধাপে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সব উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হবে। একাধিক ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর চাপটা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। তাই আশা করা যায়, আচরণবিধি মেনে চলা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি কম। তবে সর্বোচ্চ সতর্কতার বিকল্প নেই। আশা করি, সরকার ও নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের করণীয় সম্পর্কে জাতি এখনো সন্দেহমুক্ত হতে পারছে না। নিচের কয়েকটি বিষয়ে তাদের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।
১. সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ করার জন্য এ পর্যন্ত নেওয়া পদক্ষেপগুলো নিয়ে কমিশন সরব ও সক্রিয় নয়। তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর ওপর প্রচার-প্রচারণা, ক্যাম্পেইন ইত্যাদি চোখে পড়ছে না, যা তাদের করা উচিত।
২. নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রতিটি উপজেলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও একক প্রার্থী নির্ধারণের জন্য রাজনৈতিক দল থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য কোনো কোনো প্রার্থীকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার শামিল, যা সুস্পষ্টভাবে নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। আইন পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন উদ্যোগী হচ্ছে না।
৩. মন্ত্রী, সাংসদেরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলে সেটি আচরণবিধির লঙ্ঘন কি না, সে বিষয়েও বক্তব্য নেই। কারণ, তাঁরা ‘প্রটোকল’ নিয়ে ওসি, ইউএনওসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান ও বিচরণ করছেন।
৪. নির্বাচন কমিশন কানে তুলা ও পিঠে কুলা বেঁধে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামাগুলো বেমালুম হজম করে আছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য এখনো তারা ওয়েবসাইটে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়নি। ইতিমধ্যে দেরিতে হলেও উপজেলা পরিষদের তথ্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এ কাজটি আরও দ্রুততার সঙ্গে হওয়া উচিত। না করা হলে তা আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ভোটারের অধিকার হরণ হিসেবে গণ্য হবে।
৫. উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েল অনুযায়ী, প্রার্থী কর্তৃক প্রদত্ত হলফনামার তিন কপি নির্বাচন কমিশনে জমা করা আবশ্যক। এর মধ্যে এক কপি নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে কপি করে নেওয়ার জন্য প্রদান করার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রথম দফা নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা পেতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তাই প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, আয় ও সম্পদের তুলনামূলক চিত্র প্রস্তুত করে সময়মতো ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করা দুরূহ হয়ে পড়ছে। শুধু সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা নয়, তথ্যভিত্তিক ভোটার ক্ষমতায়নেও নির্বাচন কমিশনকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
৬. নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট যেকোনো তথ্য ভোটারদের সময়মতো না পৌঁছানো তথ্য অধিকার আইনেরও লঙ্ঘন। এ বিষয়ে জাতীয় তথ্য অধিকারবিষয়ক কমিশন এবং নির্বাচন কমিশনের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ আশা করি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এ বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ নাগরিক সমাজ আশা করতে পারে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার কমিশন।
No comments