পাকিস্তান- কে এই ইমরান খান? by শান্তনু মজুমদার
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীর সাজা বিষয়ে ইমরান
খানের অবস্থানে বিস্ময় প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে কিছু লোককে। পাকিস্তানি
জামায়াত, পাকিস্তানি মুসলিম লিগের কথাবার্তা যেমন-তেমন। কিন্তু ইমরান খানের
অবস্থানে তাঁরা নাকি আসমান থেকে পড়ে যাচ্ছেন।
কিংবা মাথায়
আসমান ভেঙে পড়ার উপক্রম হচ্ছে বলে তাঁরা জানাচ্ছেন। ইমরান খানের রাজনীতির
ব্যাপারে আগে থেকে খোঁজখবরে থাকলে অবশ্য আসমান নিয়ে টানাটানি পড়ার কথা নয়।
পাকিস্তানকে সমর্থন জানানোর বাসনা থেকে যাঁরা খেলার মধ্যে রাজনীতি আনা ঠিক না বলে থাকেন, তাঁদের আগেই বলে রাখা যাক যে খেলোয়াড় ইমরান খান নয়, রাজনীতিক ইমরান খান নিয়ে এখানে কথা হচ্ছে। আর এ কারণেই ছাত্রজীবন ও খেলোয়াড়ি জীবনে ইমরান খানের নানা কীর্তিকলাপ, যেগুলো বিশেষত ভারতীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে বাংলার ঘরে ঘরে ঢুকে আছে, সেগুলোর উল্লেখ বাংলাদেশি যুদ্ধাপরাধীর শাস্তির বিরুদ্ধে তাঁর আস্পর্ধার আলোচনায় জরুরি নয়। জরুরি হচ্ছে এই ব্যক্তির রাজনীতির ধরনটা বোঝা।
জেনেও না-জানার ভানকারীদের কথা আলাদা। কিন্তু যাঁরা ইমরান খানের খবরাখবর রাখার প্রয়োজন মনে করেন না, তাঁদের জানানো যাক যে দেড় দশকের বেশি আগে তেহরিক-ই-ইনসাফ নামক দল নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নামা ইমরান খানের বর্তমান বাজার বেশ ভালো। মে মাসের জাতীয় নির্বাচনে ভালোই ফল করেছে তেহরিক। আর প্রাদেশিক পরিষদে বেশি আসন পাওয়ার সুবাদে ধর্মীয় উগ্রবাদী-অধ্যুষিত খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কোয়ালিশন সরকারের প্রধান শরিক হয়েছে তেহরিক। ইমরানের দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের আরেক প্রভাবশালী শরিক হচ্ছে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামি। চোখ কচলানোর কিছু নেই—পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামি।
আরও আছে, ইমরান খান মনে করেন যে তালেবানরা একটি ‘ধর্মযুদ্ধ’ করছে। গত বছরের অক্টোবর মাসের ১৪ তারিখে পেশোয়ার শহরে একটি হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইমরান খান সুস্পষ্ট ভাষায় এই মত দেন। তালেবানদের অবস্থানকে তিনি ‘বৈধ’ হিসেবেও চিহ্নিত করেন। উল্লেখ্য, খানসাহেবের পরিদর্শনের মাত্র কয়েক দিন আগে এই হাসপাতালটিতেই তালেবানের গুলিতে বিদ্ধ মালালা ইউসুফজাইকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তালেবানের প্রশংসা করার জন্য ঠিক এই হাসপাতালটিই কেন বেছে নিতে হয়েছিল? এ জন্যই, সম্ভবত পাকিস্তানের উদারপন্থীরা ইমরান খানকে ‘তালেবান খান’ ডাকে।
আরও স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৯ সালে সোয়াত অঞ্চলে তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের বিতর্কিত এক রফার প্রতি সর্বপ্রথম সমর্থন জানানো রাজনীতিক ছিলেন ইমরান খান। অবশ্য ইমরান খান মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে পশ্চিমা মিডিয়ার সামনে কথা বলার সময় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ব্যাপারে কোমল থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। আবার ধর্মীয় উগ্রবাদীরাও খানসাহেবকে একজন ‘উদারনীতিক’ হিসেবে চিহ্নিত করে মেরে ফেলার হুমকি-টুমকি দেয় মাঝেমধ্যে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যায়? সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনের মৌসুমটির কথা ধরা যাক। পাকিস্তানজুড়ে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের টানা হামলার মুখে বলতে গেলে নির্বাচনী প্রচারণা করতেই পারেনি সে সময় ক্ষমতাসীন পিপিপি ছাড়াও আওয়ামী ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এএনপি) কিংবা মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) মতো খানিক উদারপন্থী দলগুলো। কোনো কোনো দলের
গায়ে ফুলের টোকাও লাগেনি? শরিফের মুসলিম লিগ এবং অবশ্যই ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ। লক্ষণীয় ব্যাপার, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীর সাজা নিয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আদবহীনতার সময় পক্ষ-বিপক্ষের দলগুলোর বিন্যাসও এভাবেই ছিল।
সেনা এস্টাবলিশমেন্ট ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ইমরান খানের বিশেষ সম্পর্কের ব্যাপারটিও পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে আলোচিত। বর্তমানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লিগ এ ব্যাপারে প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছিল একসময়। সময়টা ২০১১ সালের একেবারে শেষের দিকে—পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) তখন ক্ষমতায়। হঠাৎ করেই দেড় দশক ধরে টিমটিম করতে থাকা ইমরান খানের দলের পক্ষে বেশ জোশ দেখা যেতে শুরু করে; তেহরিকের জনসভাগুলোতে এন্তার জনসমাগম শুরু হয়। এই ব্যাপারটি মধ্যপন্থী পিপিপির চেয়ে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগকে বেশি ভাবিয়ে তোলে। কেননা, নতুন-ডান তেহরিক পুরোনো-ডান মুসলিম লিগের ঘাঁটিগুলো দখল করে ফেলার মতো একটা অবস্থা তৈরি করতে শুরু করেছিল। এমনকি মুসলিম লিগের মূল ঘাঁটি পাঞ্জাবেও বড় বড় অনুষ্ঠান করতে শুরু করে তেহরিক। লাহোরে, করাচিতে ইমরান খান সাহেবের জনসভায় প্রচুর মানুষ দেখা যেত তখন। এমন পরিস্থিতিতেই সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তেহরিকের সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে শুরু করে মুসলিম লিগ। একদিকে ভোটব্যাংক বেহাত হয়ে যাওয়ার ভয়, অন্যদিকে, সেনা এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে ‘ঐতিহাসিক’ সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মুখ খোলে মুসলিম লিগ। দলটি অভিযোগ আনে যে তহবিল জোগানো, জনসভায় লোক ভরানো থেকে শুরু করে সাবেক সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (কিউ) থেকে লোক ভাগিয়ে তেহরিকে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজগুলো গোয়েন্দা সংস্থা করে চলেছে। শরিফের দল এই আক্ষেপও করে যে প্রধান সেনাপতি জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানিকে এ ব্যাপারে একাধিকবার জানানো হলেও কোনো কাজ হয়নি।
ইমরান খানের দলের জন্য সেনা কর্তৃপক্ষের সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারে শরিফের দল এতটাই তেতে ওঠে যে তারা কেবল ব্যক্তি রাজনীতিক নয় বরং দলের আয়-ব্যয়, দলের নেতাদের স্থানে স্থানে ভ্রমণ ব্যয়ের বিশদ বিবরণ প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা প্রতিষ্ঠায় জাতীয় পরিষদে একটি বিল উত্থাপন করার হুমকিও দেয়। ইমরান খান ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে একবার গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি—পাকিস্তানি রাজনীতি ও পাকিস্তানি মিডিয়ার উদারনীতিক অংশটির কাছে তিনি এস্টাবলিশমেন্টের পেয়ারের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত। এবং তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো কখনো কখনো সরকারকে আঘাত করলেও এস্টাবলিশমেন্টকে কখনোই নয়। এই তো মাত্র মে মাসে আহমদিয়াদের অমুসলিম হিসেবে ঘোষিত হয়ে থাকার পক্ষে শক্ত শক্ত কথা বলে এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষের আরেক দফা অবস্থান নিয়েছেন ইমরান খান।
জামায়াতের সঙ্গে প্রদেশে সরকার গঠন, তালেবানদের ব্যাপারে উদারতা, সেনা-ঘনিষ্ঠতা—এত সব ‘বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত’ ব্যাপক ডানপন্থী ইমরান খানের বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গে সঠিক অবস্থানে দাঁড়ানোটাই হতো আশ্চর্যের। পাকিস্তান জানে যে, আজ হোক কাল হোক, একাত্তরের অপরাধসমূহের জন্য পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামরিক নেতৃত্বের বিচারের উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ। আর কাদের মোল্লার সাজার ব্যাপারে তাঁদের চুপ থাকার অর্থ হতো একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ-মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারটি মেনে নেওয়া। দেয়ালের লিখন পড়তে না পারলে যে ভুল হয়, ইমরান খান তথা পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদীরা সেই ভুলই করছে।
কিন্তু বাংলাদেশে যাঁরা ইমরান খানের ভূমিকায় ব্যথা পেয়েছেন, তাঁদের তো ব্যথা পাওয়া চলবে না। জানা থাকতে হবে যে পাকিস্তানের ইমরানের তো এটাই করার কথা। ইমরানে ইমরানে কত তফাত। পাকিস্তানি ইমরান যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। আর বাংলাদেশের ইমরানরা গণজাগরণ মঞ্চ বানায় যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শেষ না করে ঘরে না ফেরার কথা বলে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
পাকিস্তানকে সমর্থন জানানোর বাসনা থেকে যাঁরা খেলার মধ্যে রাজনীতি আনা ঠিক না বলে থাকেন, তাঁদের আগেই বলে রাখা যাক যে খেলোয়াড় ইমরান খান নয়, রাজনীতিক ইমরান খান নিয়ে এখানে কথা হচ্ছে। আর এ কারণেই ছাত্রজীবন ও খেলোয়াড়ি জীবনে ইমরান খানের নানা কীর্তিকলাপ, যেগুলো বিশেষত ভারতীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে বাংলার ঘরে ঘরে ঢুকে আছে, সেগুলোর উল্লেখ বাংলাদেশি যুদ্ধাপরাধীর শাস্তির বিরুদ্ধে তাঁর আস্পর্ধার আলোচনায় জরুরি নয়। জরুরি হচ্ছে এই ব্যক্তির রাজনীতির ধরনটা বোঝা।
জেনেও না-জানার ভানকারীদের কথা আলাদা। কিন্তু যাঁরা ইমরান খানের খবরাখবর রাখার প্রয়োজন মনে করেন না, তাঁদের জানানো যাক যে দেড় দশকের বেশি আগে তেহরিক-ই-ইনসাফ নামক দল নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নামা ইমরান খানের বর্তমান বাজার বেশ ভালো। মে মাসের জাতীয় নির্বাচনে ভালোই ফল করেছে তেহরিক। আর প্রাদেশিক পরিষদে বেশি আসন পাওয়ার সুবাদে ধর্মীয় উগ্রবাদী-অধ্যুষিত খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কোয়ালিশন সরকারের প্রধান শরিক হয়েছে তেহরিক। ইমরানের দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের আরেক প্রভাবশালী শরিক হচ্ছে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামি। চোখ কচলানোর কিছু নেই—পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামি।
আরও আছে, ইমরান খান মনে করেন যে তালেবানরা একটি ‘ধর্মযুদ্ধ’ করছে। গত বছরের অক্টোবর মাসের ১৪ তারিখে পেশোয়ার শহরে একটি হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইমরান খান সুস্পষ্ট ভাষায় এই মত দেন। তালেবানদের অবস্থানকে তিনি ‘বৈধ’ হিসেবেও চিহ্নিত করেন। উল্লেখ্য, খানসাহেবের পরিদর্শনের মাত্র কয়েক দিন আগে এই হাসপাতালটিতেই তালেবানের গুলিতে বিদ্ধ মালালা ইউসুফজাইকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তালেবানের প্রশংসা করার জন্য ঠিক এই হাসপাতালটিই কেন বেছে নিতে হয়েছিল? এ জন্যই, সম্ভবত পাকিস্তানের উদারপন্থীরা ইমরান খানকে ‘তালেবান খান’ ডাকে।
আরও স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৯ সালে সোয়াত অঞ্চলে তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের বিতর্কিত এক রফার প্রতি সর্বপ্রথম সমর্থন জানানো রাজনীতিক ছিলেন ইমরান খান। অবশ্য ইমরান খান মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে পশ্চিমা মিডিয়ার সামনে কথা বলার সময় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ব্যাপারে কোমল থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। আবার ধর্মীয় উগ্রবাদীরাও খানসাহেবকে একজন ‘উদারনীতিক’ হিসেবে চিহ্নিত করে মেরে ফেলার হুমকি-টুমকি দেয় মাঝেমধ্যে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যায়? সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনের মৌসুমটির কথা ধরা যাক। পাকিস্তানজুড়ে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের টানা হামলার মুখে বলতে গেলে নির্বাচনী প্রচারণা করতেই পারেনি সে সময় ক্ষমতাসীন পিপিপি ছাড়াও আওয়ামী ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এএনপি) কিংবা মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) মতো খানিক উদারপন্থী দলগুলো। কোনো কোনো দলের
গায়ে ফুলের টোকাও লাগেনি? শরিফের মুসলিম লিগ এবং অবশ্যই ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ। লক্ষণীয় ব্যাপার, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীর সাজা নিয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আদবহীনতার সময় পক্ষ-বিপক্ষের দলগুলোর বিন্যাসও এভাবেই ছিল।
সেনা এস্টাবলিশমেন্ট ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ইমরান খানের বিশেষ সম্পর্কের ব্যাপারটিও পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে আলোচিত। বর্তমানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লিগ এ ব্যাপারে প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছিল একসময়। সময়টা ২০১১ সালের একেবারে শেষের দিকে—পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) তখন ক্ষমতায়। হঠাৎ করেই দেড় দশক ধরে টিমটিম করতে থাকা ইমরান খানের দলের পক্ষে বেশ জোশ দেখা যেতে শুরু করে; তেহরিকের জনসভাগুলোতে এন্তার জনসমাগম শুরু হয়। এই ব্যাপারটি মধ্যপন্থী পিপিপির চেয়ে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগকে বেশি ভাবিয়ে তোলে। কেননা, নতুন-ডান তেহরিক পুরোনো-ডান মুসলিম লিগের ঘাঁটিগুলো দখল করে ফেলার মতো একটা অবস্থা তৈরি করতে শুরু করেছিল। এমনকি মুসলিম লিগের মূল ঘাঁটি পাঞ্জাবেও বড় বড় অনুষ্ঠান করতে শুরু করে তেহরিক। লাহোরে, করাচিতে ইমরান খান সাহেবের জনসভায় প্রচুর মানুষ দেখা যেত তখন। এমন পরিস্থিতিতেই সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তেহরিকের সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে শুরু করে মুসলিম লিগ। একদিকে ভোটব্যাংক বেহাত হয়ে যাওয়ার ভয়, অন্যদিকে, সেনা এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে ‘ঐতিহাসিক’ সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মুখ খোলে মুসলিম লিগ। দলটি অভিযোগ আনে যে তহবিল জোগানো, জনসভায় লোক ভরানো থেকে শুরু করে সাবেক সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (কিউ) থেকে লোক ভাগিয়ে তেহরিকে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজগুলো গোয়েন্দা সংস্থা করে চলেছে। শরিফের দল এই আক্ষেপও করে যে প্রধান সেনাপতি জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানিকে এ ব্যাপারে একাধিকবার জানানো হলেও কোনো কাজ হয়নি।
ইমরান খানের দলের জন্য সেনা কর্তৃপক্ষের সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারে শরিফের দল এতটাই তেতে ওঠে যে তারা কেবল ব্যক্তি রাজনীতিক নয় বরং দলের আয়-ব্যয়, দলের নেতাদের স্থানে স্থানে ভ্রমণ ব্যয়ের বিশদ বিবরণ প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা প্রতিষ্ঠায় জাতীয় পরিষদে একটি বিল উত্থাপন করার হুমকিও দেয়। ইমরান খান ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে একবার গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি—পাকিস্তানি রাজনীতি ও পাকিস্তানি মিডিয়ার উদারনীতিক অংশটির কাছে তিনি এস্টাবলিশমেন্টের পেয়ারের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত। এবং তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো কখনো কখনো সরকারকে আঘাত করলেও এস্টাবলিশমেন্টকে কখনোই নয়। এই তো মাত্র মে মাসে আহমদিয়াদের অমুসলিম হিসেবে ঘোষিত হয়ে থাকার পক্ষে শক্ত শক্ত কথা বলে এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষের আরেক দফা অবস্থান নিয়েছেন ইমরান খান।
জামায়াতের সঙ্গে প্রদেশে সরকার গঠন, তালেবানদের ব্যাপারে উদারতা, সেনা-ঘনিষ্ঠতা—এত সব ‘বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত’ ব্যাপক ডানপন্থী ইমরান খানের বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গে সঠিক অবস্থানে দাঁড়ানোটাই হতো আশ্চর্যের। পাকিস্তান জানে যে, আজ হোক কাল হোক, একাত্তরের অপরাধসমূহের জন্য পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামরিক নেতৃত্বের বিচারের উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ। আর কাদের মোল্লার সাজার ব্যাপারে তাঁদের চুপ থাকার অর্থ হতো একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ-মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারটি মেনে নেওয়া। দেয়ালের লিখন পড়তে না পারলে যে ভুল হয়, ইমরান খান তথা পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদীরা সেই ভুলই করছে।
কিন্তু বাংলাদেশে যাঁরা ইমরান খানের ভূমিকায় ব্যথা পেয়েছেন, তাঁদের তো ব্যথা পাওয়া চলবে না। জানা থাকতে হবে যে পাকিস্তানের ইমরানের তো এটাই করার কথা। ইমরানে ইমরানে কত তফাত। পাকিস্তানি ইমরান যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। আর বাংলাদেশের ইমরানরা গণজাগরণ মঞ্চ বানায় যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শেষ না করে ঘরে না ফেরার কথা বলে।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
No comments