বট পাতায় বিয়ের দাওয়াত- by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
মোড়ানো কাগজটা নীল ফিতায় বাঁধা। তার সঙ্গে গুঁজে দেওয়া একটি আধফোটা গোলাপ। ফিতা খুলতেই একটি বট পাতা—আপনা-আপনি খুলে যায়। সবুজ পাতার মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত। হাতে নিলেই যে কারও মনে হবে, বট পাতা নয়, যেন লাল-সবুজের পতাকা।
এই পাতার পতাকাকে এবার দাওয়াতপত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামের জাহেদা বেগম। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে তাঁর ছোট ছেলের বিয়ের আয়োজন করেছিলেন তিনি। অতিথিদের দাওয়াত করেছিলেন এই বট পাতার মাধ্যমে। জাহেদা বেগমের তিন ভাইয়ের সবাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাঁদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। তখন তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন জাহেদাকেও বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে ফিরে এলেন ভাইয়েরা। তাই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা নিয়ে জাহেদার অহংকার অনেক। ছোট ছেলের বিয়ের দিন তিনি ঠিক করেছিলেন বিজয় দিবসে। ছেলেকে বলেছিলেন, ‘বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথিদের দাওয়াত করতে হবে খুবই আন্তরিকভাবে। একটা দামি কার্ড পাঠিয়ে দিলেই মানুষ খুশি হয় না। নিমন্ত্রণ পেয়ে যাতে মানুষ খুশি হয় সেই কাজ তোমাকে করতে হবে।’
জাহেদার ছোট ছেলের নাম জাহিদুল ইসলাম। গ্রামীণ ব্যাংকের চাকুরে জাহিদ ‘ওরা ১১ জন’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালান। মায়ের মনের কথা বুঝতে পেরে বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। নিজে খুব ভালো উপায় বের করতে না পেরে ছুটে গেলেন চারুকলাপড়ুয়া বন্ধু আরাফাত রুবেলের কাছে। আরাফাত চারুকলায় ছাপচিত্র মাধ্যমে পড়েছেন। তিনি চট করে একটা বট পাতা নিয়ে তার মাঝখানে লাল রং লাগিয়ে দিলেন। মুহূর্তে সবুজ পাতাটি যেন পতাকার চেহারা পেয়ে গেল। এর মাঝখানে তিনি লিখলেন, ‘জাহিদের বিয়েতে আপনার নিমন্ত্রণ। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৩—জাহিদ’র মা।’ এরপর পাতাটির বোটার দিকে জাহিদের একটা পোর্ট্রেট স্কেচ করলেন। র্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে নীল ফিতায় বেঁধে ফেললেন তারপর। সঙ্গে গুঁজে দিলেন একটি আধফোটা গোলাপ। কটিতে ছিল গাঁদা ফুল।
এদিকে ব্যতিক্রমী এই দাওয়াতপত্র পেয়ে সব অতিথিই ভীষণ উচ্ছ্বসিত। রাজশাহীর পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজ্জাকুল ইসলাম ছিলেন বিয়ের অনুষ্ঠানের একজন অতিথি। তিনি জানান, এমন অভিনব দাওয়াতপত্র জীবনে এই প্রথম পেয়েছেন। তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও বের করেছেন সময়।
বিয়ের আগের দিন রাতের ঘটনা। বট পাতায় দাওয়াতপত্রের নকশাকার আরাফাত রুবেল যখন জাহিদের পক্ষ থেকে দাওয়াতপত্রটি দিতে গেলেন রাজশাহী শহরের কাদিরগঞ্জ এলাকায় কনেপক্ষের বাসায়, সেখানে তখন চলছে কনে স্বর্ণকে ক্ষীর খাওয়ানোর অনুষ্ঠান। আনুষ্ঠানিকভাবে কনের মা আয়েশা সিদ্দিকা ও বাবা এন্তাজ হোসেন দাওয়াতপত্রটি গ্রহণ করলেন। কনের মা ফিতা খুলে দাওয়াতপত্রটি মেলে ধরলে বাড়িভর্তি অতিথিরা বট পাতার ওপর হাতে আঁকা বরের ছবিসহ এমন নান্দনিক দাওয়াতপত্র দেখে করতালি দিয়ে ফেটে পড়লেন উল্লাসে। কনে স্বর্ণের চোখেও সে সময় বিস্ময়ভরা আনন্দ! পরে অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বিজয় দিবসে বিয়ে। তার ওপর এমন অসাধারণ দাওয়াতপত্র! আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।’
No comments