সহযাত্রী by মোসাদ্দেক আহমেদ
আজকের বাসযাত্রাটি যে জুতসই হবে না, তা হাবভাবেই স্পষ্ট। একে তো জানালার পাশের বাঞ্ছিত সিটটি মেলেনি, তদুপরি ওই সিটে-বসা লোকটিও লক্ষ্মীছাড়ার একশেষ। খাপছাড়াই তো, বাস ছাড়তে যা দেরি, ছাড়ার পর থেকে লোকটা মোবাইলে অবিরাম বকবক করছে তো করছেই। একটু খেয়াল করতে বোঝা গেল, এ ঠিক অর্থহীন বকবকানি নয়, বরং মিষ্টি প্রেমালাপ। এবার উৎসুক হয়ে ওঠে আশিক, প্রাথমিক বিরক্তিও কিছু কমে। প্রেমালাপকারী লোকটির বয়স ৩২ কি ৩৪-এর ধার ঘেঁষে, এই বয়সে তাকে ঠিক তরতাজা যুবক বলা চলে কি? তবে লোকটার পোশাকে হাল ফ্যাশনের ছাপ আছে, নীল জিনসের প্যান্টের ওপর ছোট ঝুলের শার্ট, তার হাতের মোবাইল সেটটিও দামি ও সুদৃশ্য। অনুমান করা শক্ত নয়, সবই ঘটেছে প্রেমের প্রভাবে। প্রেমের প্রভাব রয়েছে লোকটা কণ্ঠস্বরেও। মোটেই খাটো স্বরে কথা বলছে না সে, বস্তুত তেমন চেষ্টাও নেই। এতে বোঝা যায়, পাঁড় প্রেমিক বটে; দিওয়ানা বলেই বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলে কদাচিৎ মৃদু গলায়, বরং স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলতে ব্যস্ত সে, ‘কী বললে, এখনো তুমি খাওয়াদাওয়া করোনি। না, না, এটা ভারি অন্যায়। প্লিজ...’ আশিক এবার ঈষৎ বিরক্ত হয়, এসব ছেঁদো প্রেমের ডায়ালগ যদি টানা শুনে যেতে হয়, দফারফা হয়ে যাবে। আচ্ছা তেমন বয়স কি আর আছে যে এমন প্যানপ্যানানি ভালো লাগবে। গত বছর ৫০ পেরিয়েছে সে, এক বন্ধু উইশ করে জানিয়েছিল, ৫০ নাকি তেমন বয়স যখন মানুষ যিশু হয়ে যায়। সত্যি কি তা-ই? যিশু না ছাই, বড়জোর সেটা যিসাসের আবরণ হতে পারে। তবে তেমন আবরণেরও দরকার আছে, নইলে ঘর-সংসার চলবে কেন।
মনের কারচুপি যেমনই থাক, সার্থক স্বামী হতে হলে, দায়িত্বশীল বাবা হতে হলে ওইটুকু আবরু লাগেই। বাসটি হঠাৎ নিয়মবিরুদ্ধ গতিতে জোরের ওপর একটা মোড় বাঁক নিচ্ছে। সেটা দেখে বাসের যাত্রীসব হইচই করে উঠলেও আশিক তাতে যোগ দিতে পারে না। পারবে কী করে? তেমন পরিস্থিতি বেহায়া প্রেমিকটি রাখেনি, কানের কাছে এত সব মিঠে গুজুরগাজুর চললে অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার ফুরসত কোথায়। প্রমাদ গোনে আশিক। গন্তব্যস্থল এখনো পাঁচ ঘণ্টার পথ, পথে জ্যাম থাকলে, তা সাত ঘণ্টারও হতে পারে। এত দীর্ঘ সময়কাল লোকটি যদি এভাবেই ড্যাম কেয়ার চালিয়ে যায়, তবেই হয়েছে। যেমনটি ভাবা গিয়েছিল, বাস্তবে ঘটছেও তেমন। লোকটা ম্যারাথন কথালাপ চালিয়ে যাচ্ছে। আশিকের তখন ভিন্ন ভাবনা এল, না হয় বুঝলাম লোকটা খেপেছে, কিন্তু ওপাশের মেয়েটি তো ক্ষান্ত দিতে পারে। না, তেমন লক্ষণ নেই। এমনও হতে পারে, ওপর প্রান্তের মেয়েটি আরেক কাঠি সরেস, সে-ই সব কলকাঠি নাড়াচ্ছে। ভাগ্যিস তখন আশিকের নিজের ফোনটি বেজে উঠল, বউয়ের সঙ্গে দুটো কথা বলার সুযোগ তৈরি হতে চাপা অসন্তোষ কিছু কমে। কিন্তু বউ তো আর প্রেমিকা নয় যে সেও একটানা চোপা চালিয়ে যাবে; গুটিকয় সাংসারিক কথা, তাই দ্রুত ফুরিয়ে যায়। যা-ই হোক, এর পরের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। বাসটি একটি হাইওয়ে হোটেলের লনে এসে ঢুকছে, ১৫ মিনিটের যাত্রাবিরতি। হোটেলে ঢুকে প্রথমে আশিক যা করে, বেসিনের পানিতে আচ্ছামতো মুখটা ধুয়ে নেয়, ভাবখানা যেন এতক্ষণের চেপে-রাখা বিতৃষ্ণা ঝেড়ে ফেলবে। তেমনটা করতে কড়া লিকারের একটা চা নিতেও ভুল করে না।
তেতো দিয়ে তেতো কাটানো আর কি। ১৫ মিনিটের বিরতি তাড়াতাড়িই শেষ হয়। তার মানে, আবার বাসে উঠে সেই প্রেমিক-প্রবরের পাশে গিয়ে বসা আর পানসে আলাপে তেতো হওয়া। না, দ্বিতীয় অংশের যাত্রাটি বরং বিস্ময়ে ভরা। বাসটি কিছুদূর যেতে সহযাত্রীর মধ্যে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এল। অনেকক্ষণ ধরেই লোকটার মুখে কোনো কথা নেই, যদিও যথারীতি কানের কাছে মোবাইল সেটটি ধরা, বদলে লোকটা ফোঁপাচ্ছে। চমকে উঠল আশিক, আজব ব্যাপারই বটে, এভাবে কোনো পুরুষকে স্বচক্ষে কাঁদতে দেখা এই প্রথম। শুধু কি তা-ই, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোকটি অবিশ্রান্ত কেঁদেই যাচ্ছে। এ সময় তার এমনও ভয় হয়, লোকটার ফোঁপানি যদি একবার হাউমাউ কান্নায় চড়ে যায়, তবে গোটা বাসেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে। ভাগ্য ভালো, সেদিকে লোকটি যাচ্ছে না, ফোঁপানিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। তবে কি ওপাশের মেয়েটি এমন কিছু বলেছে, যা তাকে সাংঘাতিক চোট দিয়েছে? যদি তেমন কিছু হয়, তাহলে বুঝতে হবে, মেয়েটি অসম্ভব বদ। এমন নিবেদিতপ্রাণ লোকটিকে শক্ত ধরনের চোট দেওয়া মেয়েটির মোটেই উচিত হয়নি। আশিক একটু আর্দ্র হয়ে যায়, লোকটির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। তবে যা ভাবা গিয়েছিল, তেমনটা নয়। অচিরেই আশিকের ভুল ভাঙে লোকটা কণ্ঠস্বর ফের সচল হওয়ায়, ‘জানো, তোমার কথাই কেবল মনে পড়ছে। তোমাদের বাসায় কত গিয়েছি, তুমি কত যত্ন করে খাইয়েছ—সেসবই মনে দাগ কাটছে, চোখে জল আনছে...।’
এর পরের বাক্যসমষ্টি শোনা গেল না ওভারটেকিং করা দ্রুতগামী একটা বাসের বিকট হর্নের আওয়াজে। তাতে অবশ্য অসুবিধা নেই, পরবর্তী সংলাপসমষ্টি না শুনেও বাকিটুকু গড়গড় করে বলে দিতে পারবে আশিক। কেননা, তাদের ব্যাকালাপের ধরনটি ইতিমধ্যেই প্রকাশ্য হয়ে গেছে। তা ছাড়া এসব সংলাপবিনিময় প্রায়ই এমন স্টেরিওটাইপেরই হয়। বাংলা সিনেমা আর বটতলার উপন্যাসের বদৌলতে এসব আর অবিদিত নয়। তবে এখানে যেটা নতুন, তা ওই সাবালক ধেড়ে লোকটার ভেউ ভেউ করে না হলেও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা। চোখের জলের ওপর মেয়েদের একচেটিয়া রাজত্ব যেখানে প্রতিষ্ঠিত সত্য, সেখানে এই লোকটার কান্নাকাটি প্রকারান্তরে অনধিকারচর্চারই শামিল। তার পরও লোকটির ওপর বিরাগ পোষণ করতে পারছে না আশিক। হয়তো এটাও প্রেমের প্রতি সর্বজনীন পক্ষপাতের প্রভাব। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল আশিক, এর মধ্যে লম্বা পথই পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে। জেগে উঠে দেখে একটা বাজার, বাজারটি পার হচ্ছিল বাস। কিন্তু গন্তব্য এখনো বহুদূর। তার অর্থ, পাশের লোকটাকে অকাতরে সহ্য করে যাওয়া। লোকটা পারেও বটে, পুটুরপাটুর করেই যাচ্ছে। না, এবার যেন একটু অন্য রকম কথা, গানের প্রসঙ্গ এসেছে,
মোবাইল ফোনটি বাঁ কান থেকে সরিয়ে এনে ডান কানে রেখে নিবিষ্ট লোকটি জুত হয়ে বসল, ‘এখন কী মনে হচ্ছে, বলব লক্ষ্মীটি? না, না, একদম হাসবে না। দিলের কসম, তুমি ওই গানটা গাও না সোনা, ওই যে হিন্দি গানটা, কিশোর কুমারের বিখ্যাত গানটা, “চালতে চালতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখ না...”’ বলতে বলতে লোকটা নিজেই কিশোর কুমারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, ‘চালতে চালতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখ না/ কাভি আলবিদানা কেহে না...’ বলে কী লোকটা, আড়চোখে তাকিয়ে আশিক হাঁ হয়ে গেল। তাজ্জবই তো, গানটির ব্যাপারে লোকটার সঙ্গে তার পছন্দ এবার এক হয়ে গেল যে! আর সেটাই আশ্চর্যের। কেননা, গানটি তার কলেজজীবনের একটা সুপার হিট গান। সেই হিসেবে লোকটার যা বয়স, তাতে তো ওই সময় লোকটা নিতান্ত বালকই ছিল। বালকবেলায় তো তেমন ব্যাপার থাকে না, যা যৌবনে থাকে। গানটির প্রসঙ্গ এক ধাক্কায় তাকে যেন সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলোয় নিয়ে গেল, আর তাতে তার পঞ্চাশোর্ধ্ব মুখে এঁটে থাকা যিশুর মুখোশটি টুটে যাওয়ার জোগাড়। এর ফলে আরেক ঘটনা ঘটে, পার্শ্ববর্তী লোকটার প্রেম-পিরিতি নিয়ে এতক্ষণ যে একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভাব ছিল, তা খসে পড়ে। পরন্তু সে-ই এখন জব্দ হয়ে যাচ্ছে, কালের ধুলো আচমকা সরে গেলে বুঝি এমনই হয়। কোথায় যেন পড়েছিল, হ্যাঁ অমিয়ভূষণে পড়েছিল,
মেয়েরা আদুরে গলায় ডাকলে রুপালি শোনায়। আসলে তেমন মিষ্টিমধুর কণ্ঠই ছিল রীনার। দ্যাখো কাণ্ডকারখানা, এত দিন বাদে তার প্রথম যৌবনের সত্তা কিনা জেগে উঠছে! রেলওয়ে কলোনির দিনগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকলে রীনার মুখচ্ছবি ভেসে ওঠেই। এই মধ্যবয়সে এসে রীনাকে পাশ কাটানো সহজ হলেও, তখন, ওই বয়ঃসন্ধিকালে তা একেবারেই সহজ ছিল না। ভালো ছাত্র ছিল বলেই বুঝি এমন হতো, তার চোখে পড়ার জন্য মেয়েটির তৎপরতার শেষ ছিল না। স্বীকার করতে বাধা নেই, মেয়েটির গলায় আলোচ্য হিন্দি গানটি রুপালিই শোনাত, প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আকুতিই ঝরে পড়ত রীনার কণ্ঠমাধুর্যে। কিন্তু ওই ভালো ছাত্র থাকার অহংকার বলে কথা, তখনকার হালচাল তো তেমনই ছিল, ভালো ছাত্ররা মুখ গুঁজে কেবল বই পড়বে, ভুলক্রমেও মেয়েদের দিকে তাকাবে না—সামাজিক ওই মরালিটির ফাঁদে পড়ে মেয়েটিকে শুধু নিরাশই করে গেছে সে। আজ অবশ্য বুঝতে পারে, সমাজ-আরোপিত মরালিটির অধিকাংশই কৃত্রিম, অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা ঢালও বটে। সুতরাং কৃত্রিমতাকে অতটা মান্যতা দেওয়ার মধ্যে কিছু ছিল না, গরিমা তো নয়ই। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল হলো, অনেকটা সময় ধরে সে কেবল এসবই ভাবছে। এভাবে লঘুচিত্ততা পেয়ে বসায় একটু শরমিন্দাই হলো যেন বা। শরমরাঙা হয়ে প্রথমে তেরচা চোখে, পরে সরাসরিই সে তাকাল সহযাত্রীর পানে। আরে ব্যস, আজব ব্যাপার তো, প্রেমিকশিরোমণি লোকটা দেখছি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। কখন ঘুমিয়ে পড়ল এভাবে, এ কি তবে নিরবচ্ছিন্ন কথা বলার ক্লান্তির ফল, কে জানে! তবে কৌতুকের কথা এই, লোকটা যখন প্রেমালাপ থামিয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে নিচ্ছে, তখন কিনা তেমন ভাবনাই পেয়ে বসেছে তাকে। আশিক তার সুখদায়িকা ভাবনায় ডুবে গেল ফের। কথাটা লঘুচিত্ততাই, কিন্তু তা অকৃত্রিম গভীর আবেগকেই প্রকাশ করে। ফলে সেটি কোমল প্রার্থনার মতো হতে পারে, এমনকি তা এই পঞ্চাশোত্তীর্ণ যিশু সাজার বয়সেও!
No comments