জ্বালানি নিরাপত্তা- নবায়নযোগ্য জ্বালানিই উত্তম বিকল্প by মহিউদ্দিন আহমদ
দেশে ক্রমেই বেড়ে যাওয়া রাজনৈতিক সংকট ও
সহিংসতার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে নাগরিক জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন
জ্বালানিনিরাপত্তা। এ নিয়েও রাজনীতি হয়েছে এবং হচ্ছে বিস্তর।
বিদ্যুৎ
ছাড়া আধুনিক জীবন অচল। মুশকিল হলো, বিদ্যুৎ আসবে কোথা থেকে? বাংলাদেশে
জ্বালানির প্রাথমিক উৎসগুলো পর্যালোচনা করে দেখলে বোঝা যায় জলবিদ্যুৎ তৈরির
সুযোগ নেই বললেই চলে। গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। তেল আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র
চালালে খরচ অনেক বাড়ে, আমদানিজনিত অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুরপাক খেতে হয়। বাকি
থাকল কয়লা। আমাদের দেশে কয়লাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থাটি প্রায়
অনুপস্থিত।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সর্বশেষ (২ ডিসেম্বরের ২০১৩) হিসাব অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হয়েছে দিনের বেলায় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৭২১ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যার পর সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ৮৩০ মেগাওয়াট। গত ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল মোট ১০ হাজার ২১৩ মেগাওয়াট। এখন ৫০০ মেগাওয়াট আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, বিদ্যুতের বড় অংশের (৬৪ দশমিক ৫০ শতাংশ) উৎস হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস, তারপর ফার্নেস তেল (১৯ দশমিক ২২ শতাংশ), ডিজেল (৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ), কয়লা (২ দশমিক ৪৫ শতাংশ), জলবিদ্যুৎ (২ দশমিক ২৫ শতাংশ) এবং আমদানি (৪ দশমিক ৯০ শতাংশ); বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫৮ শতাংশ আসে রাষ্ট্রীয় খাত থেকে।
এ অবস্থায় সরকার সিদ্ধান্ত নিল রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাতে কয়লাভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির। স্থাপিত হবে মহেশখালী, বাঁশখালী, বরগুনা, মুন্সিগঞ্জ, আশুগঞ্জ, আনোয়ারা, লেবুছড়া, মাওয়া ওই সব জায়গায়। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারতীয় বিনিয়োগ নিয়ে বাগেরহাটের রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অনেক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কয়েকটি পরিবেশবাদী এনজিও এবং নাগরিক সংগঠন রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করে। তাদের যুক্তি, এর ফলে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং এটা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না।
আসলে সত্য কোনটি: বাংলাদেশের মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহারের দিক থেকে পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ডে, ৫৩ হাজার ৩৭৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা। যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু বিদ্যুতের গড় ব্যবহার ১৩ হাজার ২৪৬ কিলোওয়াট ঘণ্টা, কানাডায় ১৬ হাজার ৪০৬, যুক্তরাজ্যে পাঁচ হাজার ৫১৬ এবং জাপানে সাত হাজার ৮৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টা। প্রতিবেশী ভারতে ৬৮৪, পাকিস্তানে ৪৪৯, শ্রীলঙ্কায় ৪৯০ এবং চীনে তিন হাজার ২৯৪ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বাংলাদেশে মাত্র ২৫৯ কিলোওয়াট ঘণ্টা। দ্রুত শিল্পায়ন এবং জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হলে বিদ্যুৎ তৈরির অবকাঠামো আরও বিস্তৃত করতে হবে, বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কীভাবে?
জ্বালানির প্রাথমিক উৎস হিসেবে কয়লার ব্যবহার দুনিয়াজুড়েই অনেক বেশি। গত দশকে (২০০১-১০) পৃথিবীতে কয়লার ব্যবহার বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৯০০-র বেশি নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা আছে বর্তমানে, বিনিয়োগ হবে চার ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১১ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে অতিরিক্ত যে পরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরি হবে, তার ৫৮ শতাংশ আসবে কয়লা থেকে। কয়লা সবচেয়ে সস্তা জ্বালানির উৎস। অথচ আমাদের দেশে তা পড়ে আছে মাটির নিচে। সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় না দিয়ে আমরা তা ফেলে রেখেছি। আমদানি করা কয়লা দিয়ে আপাতত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রসঙ্গে প্রতিবেশ এলাকা আছে সাতটি। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে আওয়ামী লীগের সরকার ৪০ হাজার হেক্টর জুড়ে এই এলাকাগুলো চিহ্নিত করেছিল। এর অন্যতম হলো সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সুতরাং কোনো কারণে এর ক্ষতি হোক, আমরা তা চাই না। কিন্তু যাঁরা এই কেন্দ্র অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন, তাঁদের যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে তেপান্তরের মাঠ নেই, ধু-ধু মরুভূমি নেই। তাহলে কোথায় হবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র? যেখানে এসব কেন্দ্র তৈরি হবে, সেখানেই তো মানুষ আছে, পশুপাখি আছে, নদী আছে, নদীতে মাছ আছে, স্কুল আছে, কোটি কোটি শিশু আছে। কোথায় দূষণ হবে না? রামপাল নিয়ে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁরা কিন্তু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। প্রস্তাবিত একটি কেন্দ্র রামপাল থেকে সরিয়ে নিতে বলছেন। তাঁরাই বলুন, সরিয়ে কোথায় নেওয়া হবে? কোথায় দূষণ হবে না?
জৈব জ্বালানি তৈরি ও ব্যবহার পরিবেশ দূষিত করে, এটা মোটামুটি জানা কথা। গ্যাস ব্যবহার করলে দূষণের মাত্রা হয় কম, তেলে একটু বেশি এবং কয়লায় অনেক গুণ বেশি। কয়লাকে বলা হয় সবচেয়ে নোংরা জ্বালানি (ডার্টি এনার্জি)। এটা আপাতত সস্তা, দেশে পর্যাপ্ত মজুতও আছে, কিন্তু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাহলে আমাদের বিকল্প কী? বিদ্যুতের অধিকার একটি সর্বজনীন নাগরিক অধিকার। আমরা যারা ঢাকায় বসে পরিবেশদূষণকারী ক্ষতিকর জ্বালানি ব্যবহার করছি, অন্যদের জন্য আমাদের কী ব্যবস্থাপত্র থাকছে? একটা সোলার প্যানেল লাগিয়ে ২০ ওয়াটের একটা বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করে গ্রামের গরিব মানুষের আর কত দিন ধোঁকা দেব?
শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রচুর পরিমাণে জৈব জ্বালানি ব্যবহার করে পৃথিবীর পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বছরে ১৮ দশমিক ৬ টন, যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ টন, কানাডায় ১৬ দশমিক ৩ টন, রাশিয়ায় ১২ টন, জার্মানিতে ৯ দশমিক ৬ টন, যুক্তরাজ্যে ৮ দশমিক ৫ টন, ইতালিতে ৭ দশমিক ৪ টন, ফ্রান্সে ৫ দশমিক ৯ টন, চীনে ৫ দশমিক ৫ টন, ভারতে ১ দশমিক ৫ টন। অথচ আমাদের দেশে আধা টনও নয়।
পরিবেশের ক্রমাবনতি দেখে শিল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষেরা এখন নবায়নযোগ্য শুদ্ধ জ্বালানির (ক্লিন এনার্জি) দিকে ঝুঁকছে, পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের বিস্তর জ্ঞান এবং সবক দিচ্ছে, কিন্তু নিজেদের দেশে জৈব জ্বালানির ব্যবহার এবং অপচয়মূলক ভোগ কমানোর কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে না। এটাও একধরনের সাম্রাজ্যবাদী ধাপ্পা। আশির দশকে মালয়েশিয়ার যখন ‘শিল্পবিপ্লব’ চলছিল, তখন পশ্চিমের অনেক দেশ মালয়েশিয়াকে ‘পরিবেশ নষ্ট করে উন্নয়ন’-এর জন্য তিরস্কার করেছিল। মাহাথির তাদের কথায় কান দেননি।
মালয়েশিয়া এখন এশিয়ার পরাক্রমশালী অর্থনীতির দেশ এবং ক্রমেই এই দেশটিতে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিনিয়োগ বাড়ছে। চীন একই পথ অনুসরণ করছে। ভারতও তা-ই। কিছু কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন অবশ্য এসব প্রবণতার বিরোধিতা করছে, আন্দোলন করছে। তারা শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে নিয়মিত অনুদানও পায়। তাদের প্রতি আমার নীতিগত সমর্থন ও সংহতি আছে। পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষা করার দায়-দায়িত্ব কি শুধুই গরিব মানুষের?
পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে নবায়নযোগ্য শুদ্ধ জ্বালানির বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে জার্মানি। ২০১০ সালে এই খাত থেকে জার্মানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৫৩ গিগাওয়াট। এটা আসে প্রধানত সূর্যের আলো ও বাতাস থেকে। এ পথে আমাদেরও যেতে হবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর বিনিয়োগের। অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন খরচ বেশি। যদিও দীর্ঘমেয়াদি এটা লাভজনক। কিন্তু এই বিনিয়োগ কোথা থেকে আসবে?
তাই দাবি উঠেছে, যারা পৃথিবীর পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে অনেক দিন ধরে, তাদের উচিত হলো দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বিকল্প জ্বালানি তৈরির সফলতা অর্জনের জন্য ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে বিনিয়োগে সহযোগিতা করা, ‘সাহায্য’ হিসেবে নয়। দুনিয়াজুড়ে যে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, ‘পরিবেশ রাজনীতি’ তার বাইরে নয়। এটা আমাদের বুঝতে হবে। তাই সবার জন্য চাই সমান্তরাল মাঠ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। তুমি বছরে ১৮ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়াবে বাতাসে, আর পরিবেশ নিয়ে ভাবব আমি, তা হবে না। আকাশে কোনো দেয়াল নেই। অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে কয়লা পুড়িয়ে দূষণ হলে তার মূল্য কেন দেবে আমার দেশের গরিব মানুষ? (তথ্যসূত্র: বিশ্বব্যাংক সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক, ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট, এশিয়া-প্যাসিফিক মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।)
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi 2005@gmail.com
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সর্বশেষ (২ ডিসেম্বরের ২০১৩) হিসাব অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হয়েছে দিনের বেলায় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৭২১ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যার পর সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ৮৩০ মেগাওয়াট। গত ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল মোট ১০ হাজার ২১৩ মেগাওয়াট। এখন ৫০০ মেগাওয়াট আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, বিদ্যুতের বড় অংশের (৬৪ দশমিক ৫০ শতাংশ) উৎস হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস, তারপর ফার্নেস তেল (১৯ দশমিক ২২ শতাংশ), ডিজেল (৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ), কয়লা (২ দশমিক ৪৫ শতাংশ), জলবিদ্যুৎ (২ দশমিক ২৫ শতাংশ) এবং আমদানি (৪ দশমিক ৯০ শতাংশ); বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫৮ শতাংশ আসে রাষ্ট্রীয় খাত থেকে।
এ অবস্থায় সরকার সিদ্ধান্ত নিল রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাতে কয়লাভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির। স্থাপিত হবে মহেশখালী, বাঁশখালী, বরগুনা, মুন্সিগঞ্জ, আশুগঞ্জ, আনোয়ারা, লেবুছড়া, মাওয়া ওই সব জায়গায়। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারতীয় বিনিয়োগ নিয়ে বাগেরহাটের রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অনেক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কয়েকটি পরিবেশবাদী এনজিও এবং নাগরিক সংগঠন রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করে। তাদের যুক্তি, এর ফলে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং এটা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না।
আসলে সত্য কোনটি: বাংলাদেশের মানুষ বিদ্যুৎ ব্যবহারের দিক থেকে পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ডে, ৫৩ হাজার ৩৭৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা। যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু বিদ্যুতের গড় ব্যবহার ১৩ হাজার ২৪৬ কিলোওয়াট ঘণ্টা, কানাডায় ১৬ হাজার ৪০৬, যুক্তরাজ্যে পাঁচ হাজার ৫১৬ এবং জাপানে সাত হাজার ৮৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টা। প্রতিবেশী ভারতে ৬৮৪, পাকিস্তানে ৪৪৯, শ্রীলঙ্কায় ৪৯০ এবং চীনে তিন হাজার ২৯৪ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বাংলাদেশে মাত্র ২৫৯ কিলোওয়াট ঘণ্টা। দ্রুত শিল্পায়ন এবং জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হলে বিদ্যুৎ তৈরির অবকাঠামো আরও বিস্তৃত করতে হবে, বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কীভাবে?
জ্বালানির প্রাথমিক উৎস হিসেবে কয়লার ব্যবহার দুনিয়াজুড়েই অনেক বেশি। গত দশকে (২০০১-১০) পৃথিবীতে কয়লার ব্যবহার বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৯০০-র বেশি নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা আছে বর্তমানে, বিনিয়োগ হবে চার ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১১ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে অতিরিক্ত যে পরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরি হবে, তার ৫৮ শতাংশ আসবে কয়লা থেকে। কয়লা সবচেয়ে সস্তা জ্বালানির উৎস। অথচ আমাদের দেশে তা পড়ে আছে মাটির নিচে। সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় না দিয়ে আমরা তা ফেলে রেখেছি। আমদানি করা কয়লা দিয়ে আপাতত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রসঙ্গে প্রতিবেশ এলাকা আছে সাতটি। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে আওয়ামী লীগের সরকার ৪০ হাজার হেক্টর জুড়ে এই এলাকাগুলো চিহ্নিত করেছিল। এর অন্যতম হলো সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সুতরাং কোনো কারণে এর ক্ষতি হোক, আমরা তা চাই না। কিন্তু যাঁরা এই কেন্দ্র অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন, তাঁদের যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে তেপান্তরের মাঠ নেই, ধু-ধু মরুভূমি নেই। তাহলে কোথায় হবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র? যেখানে এসব কেন্দ্র তৈরি হবে, সেখানেই তো মানুষ আছে, পশুপাখি আছে, নদী আছে, নদীতে মাছ আছে, স্কুল আছে, কোটি কোটি শিশু আছে। কোথায় দূষণ হবে না? রামপাল নিয়ে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁরা কিন্তু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। প্রস্তাবিত একটি কেন্দ্র রামপাল থেকে সরিয়ে নিতে বলছেন। তাঁরাই বলুন, সরিয়ে কোথায় নেওয়া হবে? কোথায় দূষণ হবে না?
জৈব জ্বালানি তৈরি ও ব্যবহার পরিবেশ দূষিত করে, এটা মোটামুটি জানা কথা। গ্যাস ব্যবহার করলে দূষণের মাত্রা হয় কম, তেলে একটু বেশি এবং কয়লায় অনেক গুণ বেশি। কয়লাকে বলা হয় সবচেয়ে নোংরা জ্বালানি (ডার্টি এনার্জি)। এটা আপাতত সস্তা, দেশে পর্যাপ্ত মজুতও আছে, কিন্তু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাহলে আমাদের বিকল্প কী? বিদ্যুতের অধিকার একটি সর্বজনীন নাগরিক অধিকার। আমরা যারা ঢাকায় বসে পরিবেশদূষণকারী ক্ষতিকর জ্বালানি ব্যবহার করছি, অন্যদের জন্য আমাদের কী ব্যবস্থাপত্র থাকছে? একটা সোলার প্যানেল লাগিয়ে ২০ ওয়াটের একটা বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করে গ্রামের গরিব মানুষের আর কত দিন ধোঁকা দেব?
শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রচুর পরিমাণে জৈব জ্বালানি ব্যবহার করে পৃথিবীর পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বছরে ১৮ দশমিক ৬ টন, যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ টন, কানাডায় ১৬ দশমিক ৩ টন, রাশিয়ায় ১২ টন, জার্মানিতে ৯ দশমিক ৬ টন, যুক্তরাজ্যে ৮ দশমিক ৫ টন, ইতালিতে ৭ দশমিক ৪ টন, ফ্রান্সে ৫ দশমিক ৯ টন, চীনে ৫ দশমিক ৫ টন, ভারতে ১ দশমিক ৫ টন। অথচ আমাদের দেশে আধা টনও নয়।
পরিবেশের ক্রমাবনতি দেখে শিল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষেরা এখন নবায়নযোগ্য শুদ্ধ জ্বালানির (ক্লিন এনার্জি) দিকে ঝুঁকছে, পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের বিস্তর জ্ঞান এবং সবক দিচ্ছে, কিন্তু নিজেদের দেশে জৈব জ্বালানির ব্যবহার এবং অপচয়মূলক ভোগ কমানোর কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে না। এটাও একধরনের সাম্রাজ্যবাদী ধাপ্পা। আশির দশকে মালয়েশিয়ার যখন ‘শিল্পবিপ্লব’ চলছিল, তখন পশ্চিমের অনেক দেশ মালয়েশিয়াকে ‘পরিবেশ নষ্ট করে উন্নয়ন’-এর জন্য তিরস্কার করেছিল। মাহাথির তাদের কথায় কান দেননি।
মালয়েশিয়া এখন এশিয়ার পরাক্রমশালী অর্থনীতির দেশ এবং ক্রমেই এই দেশটিতে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিনিয়োগ বাড়ছে। চীন একই পথ অনুসরণ করছে। ভারতও তা-ই। কিছু কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন অবশ্য এসব প্রবণতার বিরোধিতা করছে, আন্দোলন করছে। তারা শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে নিয়মিত অনুদানও পায়। তাদের প্রতি আমার নীতিগত সমর্থন ও সংহতি আছে। পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষা করার দায়-দায়িত্ব কি শুধুই গরিব মানুষের?
পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে নবায়নযোগ্য শুদ্ধ জ্বালানির বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে জার্মানি। ২০১০ সালে এই খাত থেকে জার্মানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৫৩ গিগাওয়াট। এটা আসে প্রধানত সূর্যের আলো ও বাতাস থেকে। এ পথে আমাদেরও যেতে হবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর বিনিয়োগের। অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন খরচ বেশি। যদিও দীর্ঘমেয়াদি এটা লাভজনক। কিন্তু এই বিনিয়োগ কোথা থেকে আসবে?
তাই দাবি উঠেছে, যারা পৃথিবীর পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে অনেক দিন ধরে, তাদের উচিত হলো দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বিকল্প জ্বালানি তৈরির সফলতা অর্জনের জন্য ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে বিনিয়োগে সহযোগিতা করা, ‘সাহায্য’ হিসেবে নয়। দুনিয়াজুড়ে যে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, ‘পরিবেশ রাজনীতি’ তার বাইরে নয়। এটা আমাদের বুঝতে হবে। তাই সবার জন্য চাই সমান্তরাল মাঠ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। তুমি বছরে ১৮ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়াবে বাতাসে, আর পরিবেশ নিয়ে ভাবব আমি, তা হবে না। আকাশে কোনো দেয়াল নেই। অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে কয়লা পুড়িয়ে দূষণ হলে তার মূল্য কেন দেবে আমার দেশের গরিব মানুষ? (তথ্যসূত্র: বিশ্বব্যাংক সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক, ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট, এশিয়া-প্যাসিফিক মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।)
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi 2005@gmail.com
No comments