গদ্যকার্টুন- শঙ্কা আসে ধেয়ে by আনিসুল হক
পাঠকদের কাছে ক্ষমা চাই। কারণ, এই কলামে লিখেছিলাম, নির্বাচন নিয়ে দেশে কোনো অচলাবস্থা দেখা দেবে না, দিলেও সেটা ভয়ংকর কিছু হবে না। বাংলাদেশের মানুষের আছে সৃজনশীলতা, তারা এমন একটা উপায় বের করে নেবে, যা থেকে একটা সুন্দর নির্বাচন সম্পন্ন করা যাবে। আমার সেই ভবিষ্যদ্বাণী চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে, আমার আশা হয়ে গেছে গুড়ে বালি।
আমরা পড়েছি ভয়াবহ সংকটে। এত মৃত্যু, এত ধ্বংস, এত আগুন! জীবন ও জীবিকার ওপরে এমন নিষ্ঠুর আঘাত। প্রত্যেক মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, শিক্ষা, চাকরি—প্রতিটা ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; এবং সবচেয়ে বড় কথা, সংকট থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না, বরং সামনে আরও হানাহানি, আরও আগুন, আরও প্রাণহানি, আরও সম্পদহানির আশঙ্কা ধেয়ে আসছে। এবং রাজনৈতিকভাবে দেশ একটা কানাগলিতে ঢুকে পড়তে যাচ্ছে, যেখান থেকে বেরোনোর উপায় আমাদের জানা নেই।
সমস্যার মূলে অবশ্যই জেদ। এখন এ কথা সহজেই বলে ফেলা যায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল, বিএনপিকে তারা নির্বাচনের বাইরে রাখবে। আমরা বলেছিলাম, আওয়ামী লীগ চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। আওয়ামী লীগের চাওয়া পূরণ করার দায়িত্ব তো বিএনপির নয়। তাই বিএনপির উচিত নির্বাচনে আসা। নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করলে একটা পক্ষে জোয়ার চলে আসবে, সেই জোয়ারে কারচুপির চক্রান্ত খড়কুটার মতো ভেসে যাবে। অরণ্যে রোদন করলে তা কে শুনবে বনের পশু-পাখি-বৃক্ষলতা ছাড়া। কেউ শোনেনি। এখন এ কথাও বলে ফেলা যায় যে বিএনপির নেতৃত্বও আসলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর চান না, তাঁরা চান ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালে তাঁদের যেভাবে অপমানজনকভাবে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল, সেই তেতো অভিজ্ঞতার স্বাদ শেখ হাসিনার সরকারকে পাইয়ে দেওয়া।
দুই পক্ষের মনের ভেতরে মীমাংসা না করার জেদ প্রবল, আপনি-আমি কথা বলে কী করতে পারব? আর উভয় পক্ষই শুধু নিজেরটাই বুঝছে, দেশের মানুষের জীবন, দেশের মানুষের নিরাপত্তা, দেশের ভবিষ্যতের কথা ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবছে কি? তার চেয়েও ভয়াবহ কথা হলো, উভয় পক্ষ আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে তাদের ক্ষমতা গ্রহণ বা ক্ষমতা দখল করে রাখার মধ্যেই কেবল নিহিত রয়েছে দেশের মঙ্গল, এমনকি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ। যদি উভয় পক্ষই এটা ভাবতে থাকে যে আমি ক্ষমতায় না থাকলে দেশ শেষ হয়ে যাবে, তখন আপনি কী করতে পারেন। আমরা শুধু উভয় পক্ষকে বলতে পারি, এই চিন্তার নাম ফ্যাসিবাদী চিন্তা।
আর আওয়ামী লীগ কেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে ভয় পেল? কার পরামর্শে? বছর দুই আগে যখন সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা তুলে দেওয়া হয়, তখন তো শাসকদের জনপ্রিয়তায় এতটা ধস নামেনি। বরং সরকার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে বলে বিভিন্ন জরিপে যা বলা হচ্ছে, তার একটা অন্যতম কারণ মানুষের এক দিনের রাজা হওয়ার সুযোগটা রদ করে দেওয়া। শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ি—এসব তো আছেই। আছে সাংসদ-মন্ত্রী-নেতাদের অনেকের সম্পদ ফুলে-ফেঁপে ওঠা। যেটা এখন নির্বাচনী হলফনামায় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। একজন নেতা জানান, তিনি প্রায় ১৫ কোটি টাকা আয় করেছেন মাছের চাষ করে। মানে বছরে তিন কোটি টাকা। প্রতি কেজি মাছে তাঁর ১০ টাকা লাভ হলে বছরে ৩০ লাখ কেজি মাছ তাঁকে উৎপাদন করতে হয়েছে। তার মানে প্রতিদিন দুই ট্রাক করে মাছ তাঁর খামার থেকে বাজারে এসেছে। তাই তো বলি, দেশে মাছের অভাব দূর হলো কীভাবে? সব ঢাকায় বসে থাকা মন্ত্রী-সাংসদেরা উৎপাদন করেছেন।
তবু আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ভালো কাজও তো করেছিল। সেসবের কথা মানুষ যে বিবেচনা করবে, সেই অবকাশই তো তাকে দেওয়া হলো না। কল্পনা করুন, যদি উচ্চ আদালতের দেওয়া সুযোগ অনুসারে আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রচলিত থাকত, তাহলে আজ বিএনপি আন্দোলন করত কী নিয়ে? আজ জামায়াতের আন্দোলন আর বিএনপির আন্দোলন একাকার হয়ে যেতে পারত না। এমনকি সরকার তো জাতীয় পার্টিকেও নির্বাচনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনার একসময়ের মন্ত্রী আ স ম আবদুর রবও এখন বিএনপি জোটের আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ তো ‘পলিটিকস’টাও ঠিকভাবে করতে পারছে না। এবং পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক চালেও ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ, রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে নেই। অরাজনৈতিক গোষ্ঠী যখন রাজনীতি চালানোর চেষ্টা করে, তার ফল এ রকমই হয়ে থাকে।
১৮-দলীয় জোট খুবই কৌশলী একটা চাল দিয়েছে। দিনের পর দিন অবরোধে দেশের যখন নাভিশ্বাস উঠে গেছে, তখন তারা দিয়েছে ঢাকা চলো কর্মসূচি। এত দিন আমরা দেখলাম বিরোধী জোটের অবরোধ, এরপর দেখব, সরকারি অবরোধ। সরকার এবার ঢাকা আসার সব ধরনের পথ বন্ধ করে দেবে। আমাদের পরিত্রাণ নেই।
কী হবে ২৯ ডিসেম্বর? কী হবে এরপর? হানাহানি হতেই থাকবে। এই নির্বাচন তো আসলে ঠেকানোরও কিছু নেই, যে নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী থাকেন না, তার তো কোনো মানেও নেই আসলে। সরকার ক্ষমতা ছাড়তে চাইবে না, ৫ জানুয়ারিটা পার হয়ে গেলে শপথ গ্রহণ করে নতুন সরকার চেপে বসতে চাইবে জুতমতো। আর বিরোধী জোটই বা তা মেনে নেবে কেন? তারাও খালেদা জিয়ার ভাষায় ‘প্রাণক্ষয়ী’ আন্দোলন চালিয়ে যাবে। সরকার দমন-নিপীড়ন বাড়িয়ে দিতে থাকবে। জুলুম বাড়বে, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো হরণ করা হতে থাকবে। উফ্, আমি কল্পনাও করতে পারছি না, সামনের দিনগুলোয় আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে?
যে আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সাল থেকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে আসছে, তারা কি ক্ষমতায় থাকার জন্য বলপ্রয়োগকেই একমাত্র উপায় হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে?
বলা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগ সরকার সামনের দিনগুলোয় অনেক ভালো কাজ করবে, জনপ্রিয়তা ফিরে পাবে, তখন নির্বাচন দেবে। জনপ্রিয়তা ফিরে পাবে কী করে? আরও আরও মৎস্য চাষ করে? ভালো কাজ করলে যদি জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়, তাহলে গত পাঁচ বছর তারা তা না করে একপক্ষীয় নির্বাচনের পরে করার কথা কেন ভাবল? আচ্ছা, আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা ফিরে পেল, নির্বাচন দিলেই তারা জয়লাভ করবে, তখন নির্বাচনটা হবে কোন পদ্ধতিতে? আবারও সেই বিষচক্র। তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্য কিছু বিরোধীরা কেন মানবে? আর কোনো একটা পক্ষ কোনো একটা ছাড় যদি দেয়ই, তাহলে তা তারা এখন দিচ্ছে না কেন? আর কতজন মারা গেলে আমরা বলব, মানুষ মারা গেছে? আর কজন পুড়লে আমরা বলব, এটা বর্বরতা ছাড়া আর কিছু নয়?
একটা জাতির ইতিহাসকে এক দিন, দুই দিন, এক বছর, দুই বছরের পাল্লায় মাপতে হয় না। তাই আমি আবারও বলব, আজ থেকে ২০ বছর পরের বাংলাদেশটা নিশ্চয়ই একটা উন্নত-আলোকিত স্বদেশই হবে। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতের কথা যদি আমাকে বলতে বলেন, আমি ভালো কিছু দেখছি না। ‘এখন প্রকৃত আশাবাদীর পক্ষে আর কিছুই করার নেই, কেবল হতাশ হওয়া ছাড়া।’
অরণ্যে রোদন হলেও আমাদের কথা আমাদের বলে যেতেই হবে। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চাই। নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন চাই। এবং নির্বাচন করতে হলে বিবদমান জোটগুলোর মধ্যে একটা ন্যূনতম মতৈক্য চাই, সমঝোতা চাই, মীমাংসা চাই। বাংলাদেশে তা-ই হয়, যা বিএনপি আর আওয়ামী লীগ একযোগে চায়। দেশে শান্তি আসুক, এটা বিএনপি আর আওয়ামী লীগকে একযোগে চাইতে হবে। তা না হলে আমাদের কারোরই স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি থাকবে না। আমরা কতটা বর্বর হয়েছি যে কেবল মানুষ হত্যা করছি, তা নয়, আমরা বৃক্ষ নিধন করে চলেছি; আমরা কেবল মানুষ পুড়িয়ে মারছি, তা নয়, আমরা এখন গরু পোড়াতে শুরু করেছি। আমরা কি মানুষ পদবাচ্য নই?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments