সাদাকালো-বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধা-কথা by আহমদ রফিক
বিজয় দিবসের উৎসবসজ্জা পার করে এলাম অর্জনের তৃপ্তি নিয়ে। ঢাকা মহানগর নতুন সাজে। 'গরিব দেশের কি এসব সাজে, এই যে দামি কাপড়ের এত নিশান পথে পথে?'- বলছিলেন বঙ্গবন্ধুর একদা একান্তজন সাংবাদিক আমিনুল হক বাদশা। বিজয় দিবস উপলক্ষে লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছেন।
এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বিজয় দিবস অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তা তিনি। অনেক তিক্ততা নিয়ে কথা বললেন। বললেন ব্যক্তিগত বেদনার কথাও। ক্ষোভের সঙ্গে আন্দোলনে শহীদ মনু মিয়ার কথা।
তাঁকে বলি, বছরের একটি দিন ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ না হয় সাড়ম্বরে পালন হলো। কিন্তু ওই যে শহীদ মনু মিয়ার মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধা মনু মিয়া মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাঁদের জন্য কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না কেন? এত ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন, নানা সংগঠন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য! কী করছে তারা? প্রতি ১৬ ডিসেম্বরে বা ২৬ মার্চে দেখি মনু মিয়া, মতি মিয়া বা ফাতেমা খাতুনদের মতো নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধার নাম, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে জিতে এসেও জীবনযুদ্ধে পরাজিত। এটা কি বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন আধুনিক রাষ্ট্রের কপালে কলঙ্ক তিলক নয়? আবেগে এক মত হলেন আমিনুল হক বাদশা।
আমরা তো নিয়মিত গান গাই- 'বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না'। হ্যাঁ, আমরা খ্যাতিমান উচ্চবর্গীয় বা শিক্ষিত শ্রেণীর নামি মুক্তিযোদ্ধাদের ভুলিনি। ভুলিনি যাঁরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত বা নব্য বিত্তবান শ্রেণীর সদস্য। হঠাৎ মনে আসে তারুণ্যে বিপ্লবীদের নিয়ে লেখা মনোজ বসুর রোমান্টিক বইটির সূচনা বাক্যটি : 'কুন্তলদা তোমাকে ভুলি নাই। ট্রামে বাসে...' ইত্যাদি। হ্যাঁ, ব্রিটিশ ভারতের নামি বিপ্লবীদের কথা দেশের সাংস্কৃতিক ভুবন মনে রেখেছে, মর্যাদা দিয়েছে, অন্যরা, সাধারণ কেতার যোদ্ধারা হারিয়ে গেছেন। এটাই হয়তো স্বাভাবিক।
কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা তো একটু ভিন্ন। যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা প্রতিরোধযুদ্ধ হিসেবে, ক্রমে তা স্বাধীনতাযুদ্ধের রূপ নিয়ে বাঙালির জনযুদ্ধে পরিণত। দেশের টানে, প্রাণের টানে অসংখ্য তরুণ, ছাত্র-অছাত্র, যুবক বা যৌবনোত্তর মাঠ-ভুঁইয়ের মানুষ, কৃষক-কারিগর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় সীমান্ত পার হয়ে যোগ দিয়েছেন প্রশিক্ষণ শিবিরে। সেখান থেকে রণাঙ্গনে। তাঁদের বীরত্ব ও অসামান্যতা নিয়ে দু-চার কথা বলেছেন কর্নেল আবু তাহের কিংবা ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। তরুণ কবিও লিখেছেন দু-চার পঙ্ক্তি : 'লাঙল ফেলিয়া বাহে এই হাতে অস্ত্র নিছিলাম' ইত্যাদি। তাঁদের অনেকে রণাঙ্গনে বীরের মর্যাদায় আত্মাহুতি দিয়েছেন। দিয়ে বেঁচে গেছেন। বেঁচে গেছেন মানবেতর জীবনযাপনের যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু যাঁরা বেঁচে ফিরেছেন, তাঁদের অস্ত্র ধরার হাতে গত ৪০ বছরে হরেকরকম জিনিস স্থান পেয়েছে। রিকশার হাতল, চায়ের পেয়ালা, ঝাড়ু, কাঁচি, এমনকি মুর্দা, যাকে বলে লাশ। তাঁদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। তাঁদের মাথাগুনতি সম্পন্ন হলেও জীবন গরঠিকানায়। তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র মাথা ঘামায়নি। অথচ তাঁদের মতো অনেকের হাত ধরে, তাঁদের সাহসে ও বিক্রমে নয়া রাষ্ট্রের জন্ম- আমাদের কাব্যিক ভাষায়- লাল সূর্যের উদয়।
কিন্তু কবিতা প্রেরণাদায়ক হলেও সব সময় অন্নের সংস্থান করতে পারে না। পারে না যখন সমাজটা শ্রেণীস্বার্থের টানে চলতে থাকে। তখন অর্থনৈতিক বাস্তবতা অসহায়দের সহায় হতে পারে। পারে রাষ্ট্রযন্ত্র যদি মানবধর্মকে স্বধর্ম বলে মানে। কর্তব্যবোধ যদি তাদের বিচারে প্রাধান্য পায়। কিন্তু বাস্তবে তা পায়নি। আর পায়নি বলে নিম্নবর্গীয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিজয় বা স্বাধীনতার ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে বঞ্চনার ইতিহাস। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওই অবিবেচনার বিরুদ্ধে সমাজ প্রতিবাদ করেনি, গণসংস্কৃতিও তাদের সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালন করতে ভুলে গেছে। বাম ঘরানার রাজনীতিও সচেতন হয়নি।
তাই যশোরের মুক্তিযোদ্ধা মাতবর গাজী লাশ টানার কাজ করেন। স্বাধীনতার রণাঙ্গনে অনেক লাশ দেখেছেন তিনি। যেমন আপনজনের, তেমনি শত্রুর। সেই লাশই তাঁর জীবনে সত্য হয়ে রইল। স্বাধীনতার অমৃতের এক কণাও তাঁর কপালে জোটেনি। যশোর থেকে ফখরে আলম লিখেছেন : 'মুক্তিযুদ্ধের সময় একের পর এক শত্রুসেনা হত্যা করে তাদের লাশ ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন মাতবর গাজী। এখন তিনি খুঁজে বেড়ান অপমৃত্যুজনিত লাশ। গ্রামগঞ্জ থেকে এ ধরনের লাশ তিনি ভ্যানে করে নিয়ে আসেন মণিরামপুর থানায়। পরে তা ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যান যশোর সদরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ময়নাতদন্ত শেষে সেই লাশ পৌঁছে দেন স্বজনদের কাছে। এটা তাঁর পেশাও। ভাগ্যের কী চমৎকার পরিহাস! আসলে পরিহাস আমাদের বহু-নন্দিত রাষ্ট্রযন্ত্রের।
৬৫ বছর বয়সী মাতবর গাজীর ভাষ্য : 'একা একাই যুদ্ধি গিছি। কারোর কাছে কিছু চাইনে। আমাইর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।' তুলনায় কিছুটা ভালোই তো চা-দোকানি মুক্তিযোদ্ধা মনু মিয়া। বয়স ৬৭ বছর। স্ত্রীসহ সাতসকালে চায়ের সরঞ্জাম বয়ে বাহেরচরের স্কুলমাঠে গাছতলায় বসে চা বিক্রি করেন দাউদকান্দির মনু মিয়া। মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে এই স্বাধীনতা দিয়েছে। অন্তত চা বেচে দুমুঠো অন্নের সংস্থান তো করা গেছে! আগে নৌকা চালাতেন। এখন বয়স বেড়েছে। গায়ে তেমন শক্তি নেই। এ ছাড়া অপুষ্টির ছাপ তো আছেই। আমরা খবর রাখি না মুক্তিযোদ্ধা মনু মিয়ার।
আর মৌলভীবাজারের মতি মিয়া? হাতে রাইফেল তুলে নিয়ে পাকিস্তানি শত্রুর মোকাবিলা করেছেন যে মতি মিয়া, তাঁর সে হাত এখন অসাড়, পঙ্গু। নিজের কাছেই সে হাত একটা বোঝা। দুর্বহ সে বোঝা, দুঃসহ তাঁর মর্ম যন্ত্রণা। উপযুক্ত চিকিৎসা হলে অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। কিন্তু চিকিৎসার অর্থ-সামর্থ্য কোথায়? শহরের পৌরসভা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরি মতি মিয়ার পক্ষে এ অবস্থায় ছোট্ট চাকরিটা বাঁচিয়ে রাখা দায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে দিনমজুরি করেছেন, মাঝেমধ্যে রিকশা চালিয়েছেন, করেছেন হরেক রকম কাজ। কারণ জীবন বড় নির্মম।
এ তালিকা অনেক অনেক দীর্ঘ; কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কিংবা উচ্চাসনে বসা মুক্তিযোদ্ধাদের এসব কথা মনে পড়ে না। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো তাঁদেরই কারো পাশাপাশি বুকে হেঁটে বা ঘাসের ওপর শুয়ে লড়াই করেছেন। এখন টক শোতে সেসব উজ্জ্বল কাহিনী উপহার দেন। কিন্তু মনে পড়ে না সহযোদ্ধা মতি মিয়া বা মনু মিয়া কিংবা টগবগে তরুণ আতাউর রহমানের কী হলো। কোথায় হারিয়ে গেল সেই সহযোদ্ধা, যাঁর স্বপ্ন তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে মিশে একাকার হয়েছিল একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলোতে। মনে পড়ার কথা নয়। বিত্ত বা খ্যাতি বড় ভয়ংকর বিষয়।
গরিব ঘরের সেসব তরুণ এখন বয়োবৃদ্ধ, জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক। যুদ্ধজয় আর জীবনের যুদ্ধে জয় তো এক কথা নয়! বৈষম্যপীড়িত সমাজে কখনোই নয়। তাই আমার চেনা, প্রতিদিনের দেখা মুক্তিযোদ্ধা মানুষটির মুখমণ্ডল আলোর দীপ্তি ছড়ায় টিভিতে, মুক্তমঞ্চে, দামি সভার অনুষ্ঠানে। আর রিকশাচালক আতাউর রহমান অস্ত্রধরা হাতে রিকশার হাতল চেপে ধরে ভাবেন, এ জন্য কি যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম? জীবনযুদ্ধটা কি জীবনবাজি ধরা যুদ্ধের চেয়েও দামি? 'সোনার চেয়ে দামী'র লেখক বেঁচে থাকলে এসব দেখে হয়তো কলম উল্টে নতুন উপন্যাস লিখতেন 'জীবনযুদ্ধ জনযুদ্ধের চেয়ে দামী'।
এ সত্যটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন রাজশাহীর মনসুর আলী প্রামাণিক। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা যাঁর জন্য এক ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। কারণ এই মুক্তিযোদ্ধাকে ৭৫ বছর বয়সেও এখন বোঝা বইতে হয়। যেমন বইতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা হেলালউদ্দিনকে। দিনমজুর হিসেবে কখনো অন্যের জমিতে কাজ করতে হয় মনসুর আলীকে। নিজের জমি বলতে কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় তাঁকে দুহাত ভরে দিয়েছে শুধুই হতাশা। হতাশার চেয়ে বেদনা যে ৪০ বছর হয়ে গেল রাজাকার-আলবদরদের বিচার হলো না। তারা বহাল তবিয়তে সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে আনন্দে আছে। তবে তাঁর সান্ত্বনা হলো, শেষ পর্যন্ত ওই অপরাধীদের বিচার হতে যাচ্ছে। কিন্তু সান্ত্বনা তো তাঁর অন্ন জোগায় না, পেট ভরায় না।
গাইবান্ধার দশম শ্রেণীর ছাত্র আলী মনসুর কিসের টানে পড়াশোনা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন? গরিব পরিবারের এ ছেলে নিছক দেশ স্বাধীন করার নেশায় কৈশোর উপেক্ষা করে এলাকার তরুণদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেন। এ পর্যন্ত যাঁদের কথা বলেছি, তাঁরা ও তাঁদের সঙ্গীরা কোনো দলের সদস্য নন। দেশ, মাটি, পাকিস্তানি বর্বরতা তাঁদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই আলী মনসুর, একদা বংশীবাদক শিল্পী আলী মনসুর, এখন স্কুলের ঘণ্টা বাজান। পিওনের কাজ করে সংসার চলে না। তবু চালাতে হয়। দলবাজির রাজনীতিতে কে কার খবর রাখে?
রাখে না বলেই লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা ঈশ্বরদীর আকমল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করেও স্বাধীন দেশের জীবনযুদ্ধে পরাজিত। রোগাক্রান্ত এ মানুষটির চিকিৎসা করানোর সাধ্যও নেই। শুধু কি পুরুষই এ পথের যাত্রী? না। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ফাতেমা খাতুন কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ছিলেন। সখীপুরের নিবন্ধিত ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা ফাতেমা বেগম, সাংবাদিকের প্রতিবেদন মতে, 'এখন ঝাড়ুদার'। বঙ্গবীর কি এর খবর রাখেন?
জীবন এমনই অদ্ভুত। আর অদ্ভুত বলেই দিরাইয়ের (সুনামগঞ্জের) বীরাঙ্গনা আলীফজান বিবির জীবন এখন দুর্ভাগ্যতাড়িত। দিরাই থেকে হাবিব সরোয়ার জানান, 'বীরাঙ্গনা আলীফজান বিবির কেউ খোঁজ রাখে না। একদিন তাঁর সবই ছিল। স্বাধীনতার ৪১ বছর অতিবাহিত হলেও তিনি সমাজে আজও অবহেলিত, স্বামী পরিত্যক্ত। বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে ৪০ বছর পার করেছেন।' কী তাঁর অপরাধ? অপরাধ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে লাঞ্ছিত। তাঁকে দেখার কেউ নেই। নামেই বীরাঙ্গনা! কেন খবর নেন না, ব্যবস্থা করেন না দিরাই সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্য, যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী? এ পাপ সমাজের, এ পাপ রাজনীতিকদের ও সবার।
ঘটনার শেষ নেই। কত লেখা যাবে? কালি শেষ হয়ে যাবে। ভাবতে পারা যায় চুয়াডাঙ্গার 'মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফার কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি' (সালাহউদ্দিন কাজল)? এ দায় কার? খবরে প্রকাশ, 'ভৈরবে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক' ইত্যাদি কাজে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। গোয়ালন্দের খবর- 'দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন যুদ্ধাহত হালিমা বেগম'। 'চা বিক্রি করে চলেন দুই মুক্তিযোদ্ধা খোকন দেবনাথ ও জালালউদ্দিন।'
এ গল্পের বা কাহিনীর শেষ নেই। এখন প্রশ্ন : কে তাঁদের দুঃসহ জীবনযাত্রা সুসহ করার দায় নেবেন? যুক্তি বলে, যাঁদের অস্ত্রের জোরে দেশের স্বাধীনতা, তাঁদের দেখভাল সে দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রেরই প্রাথমিক দায়। সে দায় তারা এড়াতে পারে না। তবে ওই স্বাধীনতার দয়ায় যাঁরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, তাঁদের দায়ও কম নয়। তাঁদের বিত্তবৈভবের অপচয় থেকে গড়ে উঠতে পারে 'মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশন'। এ কাজে এমন কিছু হারাতে হবে না তাঁদের। যে অমৃতের জাদুতে তাঁদের পাহাড়সম উচ্চতায় অর্জন, তার সামান্য অংশ ব্যয়ে দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ কিছুটা শোধ হতে পারে।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক
তাঁকে বলি, বছরের একটি দিন ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ না হয় সাড়ম্বরে পালন হলো। কিন্তু ওই যে শহীদ মনু মিয়ার মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধা মনু মিয়া মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাঁদের জন্য কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না কেন? এত ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন, নানা সংগঠন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য! কী করছে তারা? প্রতি ১৬ ডিসেম্বরে বা ২৬ মার্চে দেখি মনু মিয়া, মতি মিয়া বা ফাতেমা খাতুনদের মতো নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধার নাম, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে জিতে এসেও জীবনযুদ্ধে পরাজিত। এটা কি বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন আধুনিক রাষ্ট্রের কপালে কলঙ্ক তিলক নয়? আবেগে এক মত হলেন আমিনুল হক বাদশা।
আমরা তো নিয়মিত গান গাই- 'বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না'। হ্যাঁ, আমরা খ্যাতিমান উচ্চবর্গীয় বা শিক্ষিত শ্রেণীর নামি মুক্তিযোদ্ধাদের ভুলিনি। ভুলিনি যাঁরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত বা নব্য বিত্তবান শ্রেণীর সদস্য। হঠাৎ মনে আসে তারুণ্যে বিপ্লবীদের নিয়ে লেখা মনোজ বসুর রোমান্টিক বইটির সূচনা বাক্যটি : 'কুন্তলদা তোমাকে ভুলি নাই। ট্রামে বাসে...' ইত্যাদি। হ্যাঁ, ব্রিটিশ ভারতের নামি বিপ্লবীদের কথা দেশের সাংস্কৃতিক ভুবন মনে রেখেছে, মর্যাদা দিয়েছে, অন্যরা, সাধারণ কেতার যোদ্ধারা হারিয়ে গেছেন। এটাই হয়তো স্বাভাবিক।
কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা তো একটু ভিন্ন। যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা প্রতিরোধযুদ্ধ হিসেবে, ক্রমে তা স্বাধীনতাযুদ্ধের রূপ নিয়ে বাঙালির জনযুদ্ধে পরিণত। দেশের টানে, প্রাণের টানে অসংখ্য তরুণ, ছাত্র-অছাত্র, যুবক বা যৌবনোত্তর মাঠ-ভুঁইয়ের মানুষ, কৃষক-কারিগর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় সীমান্ত পার হয়ে যোগ দিয়েছেন প্রশিক্ষণ শিবিরে। সেখান থেকে রণাঙ্গনে। তাঁদের বীরত্ব ও অসামান্যতা নিয়ে দু-চার কথা বলেছেন কর্নেল আবু তাহের কিংবা ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। তরুণ কবিও লিখেছেন দু-চার পঙ্ক্তি : 'লাঙল ফেলিয়া বাহে এই হাতে অস্ত্র নিছিলাম' ইত্যাদি। তাঁদের অনেকে রণাঙ্গনে বীরের মর্যাদায় আত্মাহুতি দিয়েছেন। দিয়ে বেঁচে গেছেন। বেঁচে গেছেন মানবেতর জীবনযাপনের যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু যাঁরা বেঁচে ফিরেছেন, তাঁদের অস্ত্র ধরার হাতে গত ৪০ বছরে হরেকরকম জিনিস স্থান পেয়েছে। রিকশার হাতল, চায়ের পেয়ালা, ঝাড়ু, কাঁচি, এমনকি মুর্দা, যাকে বলে লাশ। তাঁদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। তাঁদের মাথাগুনতি সম্পন্ন হলেও জীবন গরঠিকানায়। তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র মাথা ঘামায়নি। অথচ তাঁদের মতো অনেকের হাত ধরে, তাঁদের সাহসে ও বিক্রমে নয়া রাষ্ট্রের জন্ম- আমাদের কাব্যিক ভাষায়- লাল সূর্যের উদয়।
কিন্তু কবিতা প্রেরণাদায়ক হলেও সব সময় অন্নের সংস্থান করতে পারে না। পারে না যখন সমাজটা শ্রেণীস্বার্থের টানে চলতে থাকে। তখন অর্থনৈতিক বাস্তবতা অসহায়দের সহায় হতে পারে। পারে রাষ্ট্রযন্ত্র যদি মানবধর্মকে স্বধর্ম বলে মানে। কর্তব্যবোধ যদি তাদের বিচারে প্রাধান্য পায়। কিন্তু বাস্তবে তা পায়নি। আর পায়নি বলে নিম্নবর্গীয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিজয় বা স্বাধীনতার ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে বঞ্চনার ইতিহাস। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওই অবিবেচনার বিরুদ্ধে সমাজ প্রতিবাদ করেনি, গণসংস্কৃতিও তাদের সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালন করতে ভুলে গেছে। বাম ঘরানার রাজনীতিও সচেতন হয়নি।
তাই যশোরের মুক্তিযোদ্ধা মাতবর গাজী লাশ টানার কাজ করেন। স্বাধীনতার রণাঙ্গনে অনেক লাশ দেখেছেন তিনি। যেমন আপনজনের, তেমনি শত্রুর। সেই লাশই তাঁর জীবনে সত্য হয়ে রইল। স্বাধীনতার অমৃতের এক কণাও তাঁর কপালে জোটেনি। যশোর থেকে ফখরে আলম লিখেছেন : 'মুক্তিযুদ্ধের সময় একের পর এক শত্রুসেনা হত্যা করে তাদের লাশ ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন মাতবর গাজী। এখন তিনি খুঁজে বেড়ান অপমৃত্যুজনিত লাশ। গ্রামগঞ্জ থেকে এ ধরনের লাশ তিনি ভ্যানে করে নিয়ে আসেন মণিরামপুর থানায়। পরে তা ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যান যশোর সদরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ময়নাতদন্ত শেষে সেই লাশ পৌঁছে দেন স্বজনদের কাছে। এটা তাঁর পেশাও। ভাগ্যের কী চমৎকার পরিহাস! আসলে পরিহাস আমাদের বহু-নন্দিত রাষ্ট্রযন্ত্রের।
৬৫ বছর বয়সী মাতবর গাজীর ভাষ্য : 'একা একাই যুদ্ধি গিছি। কারোর কাছে কিছু চাইনে। আমাইর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।' তুলনায় কিছুটা ভালোই তো চা-দোকানি মুক্তিযোদ্ধা মনু মিয়া। বয়স ৬৭ বছর। স্ত্রীসহ সাতসকালে চায়ের সরঞ্জাম বয়ে বাহেরচরের স্কুলমাঠে গাছতলায় বসে চা বিক্রি করেন দাউদকান্দির মনু মিয়া। মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে এই স্বাধীনতা দিয়েছে। অন্তত চা বেচে দুমুঠো অন্নের সংস্থান তো করা গেছে! আগে নৌকা চালাতেন। এখন বয়স বেড়েছে। গায়ে তেমন শক্তি নেই। এ ছাড়া অপুষ্টির ছাপ তো আছেই। আমরা খবর রাখি না মুক্তিযোদ্ধা মনু মিয়ার।
আর মৌলভীবাজারের মতি মিয়া? হাতে রাইফেল তুলে নিয়ে পাকিস্তানি শত্রুর মোকাবিলা করেছেন যে মতি মিয়া, তাঁর সে হাত এখন অসাড়, পঙ্গু। নিজের কাছেই সে হাত একটা বোঝা। দুর্বহ সে বোঝা, দুঃসহ তাঁর মর্ম যন্ত্রণা। উপযুক্ত চিকিৎসা হলে অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। কিন্তু চিকিৎসার অর্থ-সামর্থ্য কোথায়? শহরের পৌরসভা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দপ্তরি মতি মিয়ার পক্ষে এ অবস্থায় ছোট্ট চাকরিটা বাঁচিয়ে রাখা দায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে দিনমজুরি করেছেন, মাঝেমধ্যে রিকশা চালিয়েছেন, করেছেন হরেক রকম কাজ। কারণ জীবন বড় নির্মম।
এ তালিকা অনেক অনেক দীর্ঘ; কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কিংবা উচ্চাসনে বসা মুক্তিযোদ্ধাদের এসব কথা মনে পড়ে না। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো তাঁদেরই কারো পাশাপাশি বুকে হেঁটে বা ঘাসের ওপর শুয়ে লড়াই করেছেন। এখন টক শোতে সেসব উজ্জ্বল কাহিনী উপহার দেন। কিন্তু মনে পড়ে না সহযোদ্ধা মতি মিয়া বা মনু মিয়া কিংবা টগবগে তরুণ আতাউর রহমানের কী হলো। কোথায় হারিয়ে গেল সেই সহযোদ্ধা, যাঁর স্বপ্ন তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে মিশে একাকার হয়েছিল একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলোতে। মনে পড়ার কথা নয়। বিত্ত বা খ্যাতি বড় ভয়ংকর বিষয়।
গরিব ঘরের সেসব তরুণ এখন বয়োবৃদ্ধ, জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক। যুদ্ধজয় আর জীবনের যুদ্ধে জয় তো এক কথা নয়! বৈষম্যপীড়িত সমাজে কখনোই নয়। তাই আমার চেনা, প্রতিদিনের দেখা মুক্তিযোদ্ধা মানুষটির মুখমণ্ডল আলোর দীপ্তি ছড়ায় টিভিতে, মুক্তমঞ্চে, দামি সভার অনুষ্ঠানে। আর রিকশাচালক আতাউর রহমান অস্ত্রধরা হাতে রিকশার হাতল চেপে ধরে ভাবেন, এ জন্য কি যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম? জীবনযুদ্ধটা কি জীবনবাজি ধরা যুদ্ধের চেয়েও দামি? 'সোনার চেয়ে দামী'র লেখক বেঁচে থাকলে এসব দেখে হয়তো কলম উল্টে নতুন উপন্যাস লিখতেন 'জীবনযুদ্ধ জনযুদ্ধের চেয়ে দামী'।
এ সত্যটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন রাজশাহীর মনসুর আলী প্রামাণিক। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা যাঁর জন্য এক ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। কারণ এই মুক্তিযোদ্ধাকে ৭৫ বছর বয়সেও এখন বোঝা বইতে হয়। যেমন বইতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা হেলালউদ্দিনকে। দিনমজুর হিসেবে কখনো অন্যের জমিতে কাজ করতে হয় মনসুর আলীকে। নিজের জমি বলতে কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় তাঁকে দুহাত ভরে দিয়েছে শুধুই হতাশা। হতাশার চেয়ে বেদনা যে ৪০ বছর হয়ে গেল রাজাকার-আলবদরদের বিচার হলো না। তারা বহাল তবিয়তে সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে আনন্দে আছে। তবে তাঁর সান্ত্বনা হলো, শেষ পর্যন্ত ওই অপরাধীদের বিচার হতে যাচ্ছে। কিন্তু সান্ত্বনা তো তাঁর অন্ন জোগায় না, পেট ভরায় না।
গাইবান্ধার দশম শ্রেণীর ছাত্র আলী মনসুর কিসের টানে পড়াশোনা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন? গরিব পরিবারের এ ছেলে নিছক দেশ স্বাধীন করার নেশায় কৈশোর উপেক্ষা করে এলাকার তরুণদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেন। এ পর্যন্ত যাঁদের কথা বলেছি, তাঁরা ও তাঁদের সঙ্গীরা কোনো দলের সদস্য নন। দেশ, মাটি, পাকিস্তানি বর্বরতা তাঁদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই আলী মনসুর, একদা বংশীবাদক শিল্পী আলী মনসুর, এখন স্কুলের ঘণ্টা বাজান। পিওনের কাজ করে সংসার চলে না। তবু চালাতে হয়। দলবাজির রাজনীতিতে কে কার খবর রাখে?
রাখে না বলেই লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা ঈশ্বরদীর আকমল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করেও স্বাধীন দেশের জীবনযুদ্ধে পরাজিত। রোগাক্রান্ত এ মানুষটির চিকিৎসা করানোর সাধ্যও নেই। শুধু কি পুরুষই এ পথের যাত্রী? না। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ফাতেমা খাতুন কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ছিলেন। সখীপুরের নিবন্ধিত ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা ফাতেমা বেগম, সাংবাদিকের প্রতিবেদন মতে, 'এখন ঝাড়ুদার'। বঙ্গবীর কি এর খবর রাখেন?
জীবন এমনই অদ্ভুত। আর অদ্ভুত বলেই দিরাইয়ের (সুনামগঞ্জের) বীরাঙ্গনা আলীফজান বিবির জীবন এখন দুর্ভাগ্যতাড়িত। দিরাই থেকে হাবিব সরোয়ার জানান, 'বীরাঙ্গনা আলীফজান বিবির কেউ খোঁজ রাখে না। একদিন তাঁর সবই ছিল। স্বাধীনতার ৪১ বছর অতিবাহিত হলেও তিনি সমাজে আজও অবহেলিত, স্বামী পরিত্যক্ত। বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে ৪০ বছর পার করেছেন।' কী তাঁর অপরাধ? অপরাধ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে লাঞ্ছিত। তাঁকে দেখার কেউ নেই। নামেই বীরাঙ্গনা! কেন খবর নেন না, ব্যবস্থা করেন না দিরাই সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্য, যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী? এ পাপ সমাজের, এ পাপ রাজনীতিকদের ও সবার।
ঘটনার শেষ নেই। কত লেখা যাবে? কালি শেষ হয়ে যাবে। ভাবতে পারা যায় চুয়াডাঙ্গার 'মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফার কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি' (সালাহউদ্দিন কাজল)? এ দায় কার? খবরে প্রকাশ, 'ভৈরবে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক' ইত্যাদি কাজে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। গোয়ালন্দের খবর- 'দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন যুদ্ধাহত হালিমা বেগম'। 'চা বিক্রি করে চলেন দুই মুক্তিযোদ্ধা খোকন দেবনাথ ও জালালউদ্দিন।'
এ গল্পের বা কাহিনীর শেষ নেই। এখন প্রশ্ন : কে তাঁদের দুঃসহ জীবনযাত্রা সুসহ করার দায় নেবেন? যুক্তি বলে, যাঁদের অস্ত্রের জোরে দেশের স্বাধীনতা, তাঁদের দেখভাল সে দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রেরই প্রাথমিক দায়। সে দায় তারা এড়াতে পারে না। তবে ওই স্বাধীনতার দয়ায় যাঁরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, তাঁদের দায়ও কম নয়। তাঁদের বিত্তবৈভবের অপচয় থেকে গড়ে উঠতে পারে 'মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশন'। এ কাজে এমন কিছু হারাতে হবে না তাঁদের। যে অমৃতের জাদুতে তাঁদের পাহাড়সম উচ্চতায় অর্জন, তার সামান্য অংশ ব্যয়ে দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ কিছুটা শোধ হতে পারে।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক
No comments