ফিলিস্তিনের জন্ম সনদ! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
ইহুদিদের জন্য নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার নামে যে অবিচার ও অনৈতিক কাজ সাধিত হয়েছে, তার নজির আধুনিক বিশ্বে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
সত্য বটে, ইহুদিদের অধিকার আছে একটি রাষ্ট্রের মালিক হওয়ার। পরের জায়গায়, পরের জমিনে জোরজবরদস্তি করে ইহুদিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সর্বময় কর্তৃত্ব প্রথমে গ্রহণ করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। ১৯০৩ সালের ব্রিটেনের সঙ্গে আজকের 'নখদন্তবিহীন' সিংহ প্রতীকধারী ব্রিটেনের কোনো রকম তুলনাই হয় না। মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে বিস্ফোরক হিসেবে ইসরায়েল নামের অস্তিত্ব। তার সূচনাপর্বে বর্তমান ইসরায়েলের প্রধানতম অভিভাবক ও শক্তিপ্রদায়ক যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রকম ভূমিকা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র তখন নিজের বিনির্মাণে ব্যস্ত, আর বিশ্বের মোড়ল ইউরোপ। ইসরায়েলের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পেছনে ইউরোপীয় শক্তির ভূমিকা ছিল সর্বব্যাপী; এর ইতিহাস দীর্ঘ। ক্ষুদ্র পরিসরের লেখায় ইতিহাসের এত বিস্তারিত বর্ণনা সম্ভব নয়।
ব্রিটিশরা ইহুদিদের অভিভাবক হিসেবে প্রথম যে প্রস্তাবনা কাগজ-কলমে উপস্থাপন করে, ইতিহাসে তা ব্রিটিশ উগান্ডা প্রোগ্রাম নামে পরিচিত। ব্রিটিশদের পদানত তখন আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ। আর ব্রিটিশ-মিত্র হিসেবে খ্যাত ফ্রান্স, ইতালির দখলে আফ্রিকার আরো অনেক দেশ।
ব্রিটিশ কলোনিয়াল সেক্রেটারি জোসেফ চ্যাম্বারলেন থিয়োডোর হার্জেলের জায়োনিস্ট গ্রুপের কাছে উগান্ডা বিষয়ক প্রস্তাবটি প্রথম দাপ্তরিকভাবে পেশ করেন ১৯০৩ সালে। প্রস্তাবে বলা হয়, বর্তমান কেনিয়া ও উগান্ডার অন্তর্ভুক্ত মাউ সমতল ভূমির পাঁচ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হবে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রটি। বলা হয়ে থাকে, রাশিয়ায় ইহুদি নির্যাতনের বদলা হিসেবে উগান্ডা প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।
১৯০৩ সালে ব্যাসেলে অনুষ্ঠিত জায়োনিস্ট কংগ্রেসে প্রস্তাবটি নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক হয়। বলা হয়, এ প্রস্তাব 'হলিল্যান্ড' সম্পর্কিত ধারণার পরিপন্থী এবং এটি 'অস্থায়ী নৈশকালীন আশ্রয়' ছাড়া আর কিছুই নয়। লক্ষণীয়, জায়োনিস্টরা বুঝতে পারে ইউরোপের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়করা তাদের পক্ষে আছেন, সুতরাং দরকষাকষির পুরো সুযোগ তাদের আছে এবং পরিশেষে জয়ও তাদের হবে! ইহুদিদের স্বপ্ন অটোমান ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং এখন কোনো অস্থায়ী প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান তাদের পক্ষে আত্মঘাতী হবে। এ ছাড়া তাদের যুক্তি ছিল, পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে হিব্রুর দূরতম সম্পর্কও কখনো ছিল না। রুশ প্রতিনিধি ভোটাভুটির পূর্বমুহূর্তে উষ্মা প্রকাশ করে সম্মেলন বর্জন করে চলে আসেন। ২৯৫-১৭৭ ভোটে এই মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হলো, বিষয়টি নিয়ে আরো আলোচনা-পর্যালোচনা করা হবে। আশ্চর্যের বিষয়, উগান্ডা প্রস্তাবের পক্ষে বেশ কিছু ইহুদি সমর্থন জানায় এবং তাদের অনেকে আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় বসতও গাড়ে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী ইহুদিরা অবশ্য বাইবেলোক্ত জুডিয়া ও সামারিয়ার (বর্তমানে যা পশ্চিম তীর নামে পরিচিত) ওপর বেশি জোর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিকল্প কিছু দেখে না।
এরপর অনেক বছর শেষে বালফোর ঘোষণা ১৯১৭ সালে নতুন করে ইসরায়েল ইস্যুকে সামনে নিয়ে এলো। বালফোর ঘোষণার প্রবক্তা আর্থার বালফোর ছিলেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ লর্ড রবার্ট সেসিলের ভাগ্নে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তখন খুব চালু ছিল 'বব তোমার মামা' ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত বাক্যটি। ১৯০২ সালে তিনি মামা সেসিলের স্থলাভিষিক্ত প্রধানমন্ত্রী হন; কিন্তু তিন বছর পরই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান। বালফোর লীগ অব নেশনসের চার্টার অনুসরণ করে কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের আদলে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি ১৯১৯ সালে ভার্সেই চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। বিশ্বযুদ্ধ শেষে পরিবর্তিত বিশ্ব মানচিত্র সুষম করার দায়দায়িত্ব তিনি নিজের ওপর নিজেই ন্যস্ত করেন।
ফিলিস্তিনে সম্ভাব্য জায়োনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা তখন থেকে জোরালোভাবে আলোচিত হতে থাকে।
বালফোর ঘোষণায় বলা হয়, হিজ ম্যাজেস্টিস সরকার ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সব কিছুই করবে। তবে এটাও স্পষ্ট করে বলা দরকার, এর ফলে ইহুদি নন, এমন জাতিসত্তার নাগরিক ও ধর্মীয় স্বার্থবিরোধী কিছু করা চলবে না। অন্যান্য দেশে বসবাসরত ইহুদিদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের পরিপন্থী কিছুও করা যাবে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডের ওপর ব্রিটেনকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়, যা সে অটোমানদের কাছ থেকে যুদ্ধে জয় করে। ১৯৩৬ সালে পিল কমিশন প্রস্তাব করে, অধিকৃত ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হোক। কিন্তু সরকারের কাছে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি এবং এর ফলে ১৯৩৬-৩৯ সাল পর্যন্ত আরব বিদ্রোহ সংঘটিত হয় বলে ধারণা করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন সমস্যাকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের কাছে অর্পণ করে। এর ফলে জাতিসংঘ প্রস্তাব ১৮১ (২)-এ সিদ্ধান্ত হয়, ক. স্বাধীন আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং জেরুজালেম নগরীকে বিশেষ আন্তর্জাতিক মর্যাদা দেওয়া হবে। ইহুদি রাষ্ট্র পাবে ৫৬ শতাংশ ভূমি, যা ৮২ শতাংশ ইহুদির আশ্রয়স্থল হবে এবং তা হবে জেরুজালেম থেকে বিচ্ছিন্ন।
প্রস্তাব ইহুদিরা সানন্দচিত্তে গ্রহণ করলেও বেশির ভাগ আরবের কাছে তা অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর প্রস্তাবটি ম্যান্ডেটরি ক্ষমতা হিসেবে ব্রিটেন ও জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের কাছে পাঠানো হয় প্রস্তাব প্রতিপালনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য। জাতিসংঘে প্রস্তাবটির ওপর ভোট গ্রহণ করা হলে ৩৩-১৩ ভোটে তা পাস হয়। ১০টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। এ প্রস্তাবের বিরোধিতাকারী সব আরব রাষ্ট্র জাতিসংঘের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে নালিশ করে। তাদের বক্তব্য- জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক কোর্টে নালিশটি খারিজ হয়ে যায়। প্রস্তাবনা : ১৮১ (২) : পার্ট-১; ফিউচার কনসটিটিউশন অ্যান্ড গভর্নমেন্ট অব প্যালেস্টাইন : ক. টার্মিনেশন অব ম্যান্ডেট, পার্টিশন অ্যান্ড ইনডিপেনডেনস : ধারা ৩। এতে বলা হয়, স্বাধীন আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র এবং জেরুজালেমের বিশেষ মর্যাদা বলবৎ হবে যেদিন দখলদারি রাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হবে এবং ভূখণ্ডটি স্বাধীন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। দখলদার বাহিনীর অবস্থান কিছুতেই ১৯৪৮ সালের ১ অক্টোবর অতিক্রম করতে পারবে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ফিলিস্তিন ছিল ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। আর ব্রিটিশ অধিকৃত এ অঞ্চলের বিস্তৃতি ছিল পশ্চিম এশিয়া, ভূমধ্যসাগর আর জর্দান নদীর মধ্যবর্তী বিশাল ভূমি।
বালফোর ঘোষণা তো অঞ্চলটিকে দুই ভাগে ভাগ করে দিল এবং এখানেও ঘটল অবিচার ও একচক্ষু নীতির নির্লজ্জ প্রকাশ। ইসরায়েলকে দেওয়া হলো রাষ্ট্রের মর্যাদা আর ফিলিস্তিনকে স্টেটহুড! নাকের বদলে নরুণ পাওয়ার মতো ব্যাপার। ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্ব এমন একপেশে সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পেয়েছিল মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অনৈক্যের কারণে। চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি সম্পূর্ণ বিষয়টিকে এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। কার জমি, কে কাকে মালিকানা দেয়? শোনা যায়, বালফোর ঘোষণার প্রণেতারও নাকি শেষ পর্যায়ে উপলব্ধি হয়েছিল কাজটি ঠিক নৈতিক হয়নি! কিন্তু এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়তি নির্ধারিত ধ্রুব হয়ে যায়।
ইসরায়েলের অসহিষ্ণুতা ও বিশ্বশক্তির প্রশ্রয়ের বড় প্রমাণ দ্রুততম সময়ে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা। জাতিসংঘ প্রস্তাব গৃহীত হলো ২৯ নভেম্বর ১৯৪৭, আর ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসল পরের বছর ১৪ মে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুসলিম রাষ্ট্রগুলো মাঝেমধ্যে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সবচেয়ে বড় আক্রমণটি করে মিসর, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের আমলে। ১৯৬৭ সালের ক্ষণস্থায়ী এই যুদ্ধে ইসরায়েলের কোনো ক্ষতি তো হলোই না; উল্টো আরবদের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিল, যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিম তীর ও গাজা। ইসরায়েলের সেনাপ্রধান আইজাক রবিন রসিকতা করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট নাসের যুদ্ধে জয়ী হতে চান বলে মনে হয়নি। তা না হলে সিনাই অঞ্চলে মাত্র দুই ডিভিশন সেনা নিয়ে এত বড় সেনা অভিযান পরিচালনা করার কথা নয়।
দুই.
ইতিহাসের অবিচারের শিকার ফিলিস্তিনবাসীরা নিজ দেশে পরবাসী হিসেবে বাস করছে। তাদের এক কবি লিখেছেন, 'মালিকের বিহনে এখন বাড়ির উঠোনে হায়েনা আর শেয়ালের আনাগোনা'। দীর্ঘ ৬১ বছর পর, শেষ পর্যন্ত ৩০ নভেম্বর (২০১২) ফিলিস্তিন জাতিসংঘের অধিবেশনে ভোটাভুটিতে বিশাল ব্যবধানে নন-স্টেট অবজারভার স্ট্যাটাস অর্জন করল। এটুকু প্রাপ্তিকেই ফিলিস্তিনের প্রধান মাহমুদ আব্বাস অভিহিত করলেন 'জন্ম সনদ হিসেবে'। যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের প্রবল বিরোধিতার মুখে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ১৩৮-৯ ভোটে। ৪১টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। বিরুদ্ধে ভোটদানকারীদের মধ্যে যথারীতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনের এ পর্যবেক্ষকের মর্যাদা লাভ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ধরনের নৈতিক পরাজয়, এমনকি জতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এ মর্যাদা প্রাপ্তির পর যা বলেছেন, তা-ও এত দিন ছিল তাঁর কণ্ঠে অশ্রুতপূর্ব।
নভেম্বর ২০১২-তে বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাসেই জাতিসংঘে এ কূটনৈতিক বিপর্যয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অকল্পনীয়ই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্ররা এবার বোধকরি বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে এ প্রস্তাবনা পাস হওয়ার পরপর ইসরায়েল ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে ঘোষণা করেছে তারা অধিকৃত অঞ্চলে তিন হাজার ৬০০টি অ্যাপার্টমেন্ট ও আটটি হোটেল তৈরি করবে। ইসরায়েলের এ ঘোষণা তাদের মিত্রদের সমর্থন পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এর ফলে শান্তি প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। এখন দেখার বিষয়, মুসলিম রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ওআইসি কিভাবে বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে।
শুধু কাগুজে বিবৃতিতে কাজ হবে না। ইসরায়েলের মিত্ররা সর্বশক্তি দিয়ে দেশটিকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এর কারণ জায়নবাদ নামক নব্য আর্থিক মতবাদ, যা অত্যন্ত সবল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক
ব্রিটিশরা ইহুদিদের অভিভাবক হিসেবে প্রথম যে প্রস্তাবনা কাগজ-কলমে উপস্থাপন করে, ইতিহাসে তা ব্রিটিশ উগান্ডা প্রোগ্রাম নামে পরিচিত। ব্রিটিশদের পদানত তখন আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ। আর ব্রিটিশ-মিত্র হিসেবে খ্যাত ফ্রান্স, ইতালির দখলে আফ্রিকার আরো অনেক দেশ।
ব্রিটিশ কলোনিয়াল সেক্রেটারি জোসেফ চ্যাম্বারলেন থিয়োডোর হার্জেলের জায়োনিস্ট গ্রুপের কাছে উগান্ডা বিষয়ক প্রস্তাবটি প্রথম দাপ্তরিকভাবে পেশ করেন ১৯০৩ সালে। প্রস্তাবে বলা হয়, বর্তমান কেনিয়া ও উগান্ডার অন্তর্ভুক্ত মাউ সমতল ভূমির পাঁচ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হবে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রটি। বলা হয়ে থাকে, রাশিয়ায় ইহুদি নির্যাতনের বদলা হিসেবে উগান্ডা প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।
১৯০৩ সালে ব্যাসেলে অনুষ্ঠিত জায়োনিস্ট কংগ্রেসে প্রস্তাবটি নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক হয়। বলা হয়, এ প্রস্তাব 'হলিল্যান্ড' সম্পর্কিত ধারণার পরিপন্থী এবং এটি 'অস্থায়ী নৈশকালীন আশ্রয়' ছাড়া আর কিছুই নয়। লক্ষণীয়, জায়োনিস্টরা বুঝতে পারে ইউরোপের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়করা তাদের পক্ষে আছেন, সুতরাং দরকষাকষির পুরো সুযোগ তাদের আছে এবং পরিশেষে জয়ও তাদের হবে! ইহুদিদের স্বপ্ন অটোমান ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং এখন কোনো অস্থায়ী প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান তাদের পক্ষে আত্মঘাতী হবে। এ ছাড়া তাদের যুক্তি ছিল, পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে হিব্রুর দূরতম সম্পর্কও কখনো ছিল না। রুশ প্রতিনিধি ভোটাভুটির পূর্বমুহূর্তে উষ্মা প্রকাশ করে সম্মেলন বর্জন করে চলে আসেন। ২৯৫-১৭৭ ভোটে এই মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হলো, বিষয়টি নিয়ে আরো আলোচনা-পর্যালোচনা করা হবে। আশ্চর্যের বিষয়, উগান্ডা প্রস্তাবের পক্ষে বেশ কিছু ইহুদি সমর্থন জানায় এবং তাদের অনেকে আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় বসতও গাড়ে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী ইহুদিরা অবশ্য বাইবেলোক্ত জুডিয়া ও সামারিয়ার (বর্তমানে যা পশ্চিম তীর নামে পরিচিত) ওপর বেশি জোর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিকল্প কিছু দেখে না।
এরপর অনেক বছর শেষে বালফোর ঘোষণা ১৯১৭ সালে নতুন করে ইসরায়েল ইস্যুকে সামনে নিয়ে এলো। বালফোর ঘোষণার প্রবক্তা আর্থার বালফোর ছিলেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ লর্ড রবার্ট সেসিলের ভাগ্নে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তখন খুব চালু ছিল 'বব তোমার মামা' ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত বাক্যটি। ১৯০২ সালে তিনি মামা সেসিলের স্থলাভিষিক্ত প্রধানমন্ত্রী হন; কিন্তু তিন বছর পরই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান। বালফোর লীগ অব নেশনসের চার্টার অনুসরণ করে কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের আদলে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি ১৯১৯ সালে ভার্সেই চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। বিশ্বযুদ্ধ শেষে পরিবর্তিত বিশ্ব মানচিত্র সুষম করার দায়দায়িত্ব তিনি নিজের ওপর নিজেই ন্যস্ত করেন।
ফিলিস্তিনে সম্ভাব্য জায়োনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা তখন থেকে জোরালোভাবে আলোচিত হতে থাকে।
বালফোর ঘোষণায় বলা হয়, হিজ ম্যাজেস্টিস সরকার ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সব কিছুই করবে। তবে এটাও স্পষ্ট করে বলা দরকার, এর ফলে ইহুদি নন, এমন জাতিসত্তার নাগরিক ও ধর্মীয় স্বার্থবিরোধী কিছু করা চলবে না। অন্যান্য দেশে বসবাসরত ইহুদিদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের পরিপন্থী কিছুও করা যাবে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডের ওপর ব্রিটেনকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়, যা সে অটোমানদের কাছ থেকে যুদ্ধে জয় করে। ১৯৩৬ সালে পিল কমিশন প্রস্তাব করে, অধিকৃত ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হোক। কিন্তু সরকারের কাছে এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি এবং এর ফলে ১৯৩৬-৩৯ সাল পর্যন্ত আরব বিদ্রোহ সংঘটিত হয় বলে ধারণা করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন সমস্যাকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের কাছে অর্পণ করে। এর ফলে জাতিসংঘ প্রস্তাব ১৮১ (২)-এ সিদ্ধান্ত হয়, ক. স্বাধীন আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং জেরুজালেম নগরীকে বিশেষ আন্তর্জাতিক মর্যাদা দেওয়া হবে। ইহুদি রাষ্ট্র পাবে ৫৬ শতাংশ ভূমি, যা ৮২ শতাংশ ইহুদির আশ্রয়স্থল হবে এবং তা হবে জেরুজালেম থেকে বিচ্ছিন্ন।
প্রস্তাব ইহুদিরা সানন্দচিত্তে গ্রহণ করলেও বেশির ভাগ আরবের কাছে তা অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর প্রস্তাবটি ম্যান্ডেটরি ক্ষমতা হিসেবে ব্রিটেন ও জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের কাছে পাঠানো হয় প্রস্তাব প্রতিপালনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য। জাতিসংঘে প্রস্তাবটির ওপর ভোট গ্রহণ করা হলে ৩৩-১৩ ভোটে তা পাস হয়। ১০টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। এ প্রস্তাবের বিরোধিতাকারী সব আরব রাষ্ট্র জাতিসংঘের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে নালিশ করে। তাদের বক্তব্য- জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক কোর্টে নালিশটি খারিজ হয়ে যায়। প্রস্তাবনা : ১৮১ (২) : পার্ট-১; ফিউচার কনসটিটিউশন অ্যান্ড গভর্নমেন্ট অব প্যালেস্টাইন : ক. টার্মিনেশন অব ম্যান্ডেট, পার্টিশন অ্যান্ড ইনডিপেনডেনস : ধারা ৩। এতে বলা হয়, স্বাধীন আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র এবং জেরুজালেমের বিশেষ মর্যাদা বলবৎ হবে যেদিন দখলদারি রাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হবে এবং ভূখণ্ডটি স্বাধীন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। দখলদার বাহিনীর অবস্থান কিছুতেই ১৯৪৮ সালের ১ অক্টোবর অতিক্রম করতে পারবে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ফিলিস্তিন ছিল ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। আর ব্রিটিশ অধিকৃত এ অঞ্চলের বিস্তৃতি ছিল পশ্চিম এশিয়া, ভূমধ্যসাগর আর জর্দান নদীর মধ্যবর্তী বিশাল ভূমি।
বালফোর ঘোষণা তো অঞ্চলটিকে দুই ভাগে ভাগ করে দিল এবং এখানেও ঘটল অবিচার ও একচক্ষু নীতির নির্লজ্জ প্রকাশ। ইসরায়েলকে দেওয়া হলো রাষ্ট্রের মর্যাদা আর ফিলিস্তিনকে স্টেটহুড! নাকের বদলে নরুণ পাওয়ার মতো ব্যাপার। ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্ব এমন একপেশে সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পেয়েছিল মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অনৈক্যের কারণে। চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি সম্পূর্ণ বিষয়টিকে এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। কার জমি, কে কাকে মালিকানা দেয়? শোনা যায়, বালফোর ঘোষণার প্রণেতারও নাকি শেষ পর্যায়ে উপলব্ধি হয়েছিল কাজটি ঠিক নৈতিক হয়নি! কিন্তু এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়তি নির্ধারিত ধ্রুব হয়ে যায়।
ইসরায়েলের অসহিষ্ণুতা ও বিশ্বশক্তির প্রশ্রয়ের বড় প্রমাণ দ্রুততম সময়ে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা। জাতিসংঘ প্রস্তাব গৃহীত হলো ২৯ নভেম্বর ১৯৪৭, আর ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসল পরের বছর ১৪ মে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুসলিম রাষ্ট্রগুলো মাঝেমধ্যে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সবচেয়ে বড় আক্রমণটি করে মিসর, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের আমলে। ১৯৬৭ সালের ক্ষণস্থায়ী এই যুদ্ধে ইসরায়েলের কোনো ক্ষতি তো হলোই না; উল্টো আরবদের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিল, যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিম তীর ও গাজা। ইসরায়েলের সেনাপ্রধান আইজাক রবিন রসিকতা করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট নাসের যুদ্ধে জয়ী হতে চান বলে মনে হয়নি। তা না হলে সিনাই অঞ্চলে মাত্র দুই ডিভিশন সেনা নিয়ে এত বড় সেনা অভিযান পরিচালনা করার কথা নয়।
দুই.
ইতিহাসের অবিচারের শিকার ফিলিস্তিনবাসীরা নিজ দেশে পরবাসী হিসেবে বাস করছে। তাদের এক কবি লিখেছেন, 'মালিকের বিহনে এখন বাড়ির উঠোনে হায়েনা আর শেয়ালের আনাগোনা'। দীর্ঘ ৬১ বছর পর, শেষ পর্যন্ত ৩০ নভেম্বর (২০১২) ফিলিস্তিন জাতিসংঘের অধিবেশনে ভোটাভুটিতে বিশাল ব্যবধানে নন-স্টেট অবজারভার স্ট্যাটাস অর্জন করল। এটুকু প্রাপ্তিকেই ফিলিস্তিনের প্রধান মাহমুদ আব্বাস অভিহিত করলেন 'জন্ম সনদ হিসেবে'। যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের প্রবল বিরোধিতার মুখে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ১৩৮-৯ ভোটে। ৪১টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। বিরুদ্ধে ভোটদানকারীদের মধ্যে যথারীতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনের এ পর্যবেক্ষকের মর্যাদা লাভ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ধরনের নৈতিক পরাজয়, এমনকি জতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এ মর্যাদা প্রাপ্তির পর যা বলেছেন, তা-ও এত দিন ছিল তাঁর কণ্ঠে অশ্রুতপূর্ব।
নভেম্বর ২০১২-তে বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাসেই জাতিসংঘে এ কূটনৈতিক বিপর্যয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অকল্পনীয়ই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্ররা এবার বোধকরি বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে এ প্রস্তাবনা পাস হওয়ার পরপর ইসরায়েল ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে ঘোষণা করেছে তারা অধিকৃত অঞ্চলে তিন হাজার ৬০০টি অ্যাপার্টমেন্ট ও আটটি হোটেল তৈরি করবে। ইসরায়েলের এ ঘোষণা তাদের মিত্রদের সমর্থন পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এর ফলে শান্তি প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। এখন দেখার বিষয়, মুসলিম রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ওআইসি কিভাবে বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে।
শুধু কাগুজে বিবৃতিতে কাজ হবে না। ইসরায়েলের মিত্ররা সর্বশক্তি দিয়ে দেশটিকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এর কারণ জায়নবাদ নামক নব্য আর্থিক মতবাদ, যা অত্যন্ত সবল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক
No comments