মন্দ ধারণা ইসলামে নিষিদ্ধ by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

কোনো মন্দ ধারণা কখনও কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না; বরং তা হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি করে পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দেয়। মন্দ ধারণা পোষণকারী স্পষ্ট গুনাহে লিপ্ত। আর একটি গুনাহ অন্য গুনাহর দিকে টেনে নেয়। এভাবে মন্দ ধারণা পোষণকারী বিভিন্ন অন্যায়-অপরাধ ও পাপে জড়িয়ে পড়ে আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, 'হে ঈমানদারগণ, তোমরা অধিক ধারণা থেকে দূরে থাক।


কারণ কোনো কোনো ধারণা পাপ। আর তোমরা একজন অন্যজনের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না। একজন অন্যজনের গিবত করো না।'_সূরা হুজরাত : ১২
কোরআনুল কারিমের এই আয়াতে স্পষ্টভাবে একজন মুসলমানের সম্মান ও ইজ্জত রক্ষার আদেশসহ এক মুসলমানকে অন্য মুসলমানের প্রতি অনুমান ও মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে বারণ করা হয়েছে। পরস্পরের প্রতি ভালো ধারণা রাখা ও কারও বিরুদ্ধে সব ধরনের সংশয়-সন্দেহ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ মন্দ ধারণার বশবর্তী হয়ে কারও সম্পর্কে মুখে কিছু উচ্চারণ তো করা যাবেই না, উপরন্তু মন্দ ধারণা সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে সরে আসা এবং মনে থাকা অবস্থায়ই তা দূর করে ফেলার প্রতি তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, 'তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, ধারণাভিত্তিক কথা সবচেয়ে বড় মিথ্যা। তোমরা একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না আর তোমরা পরস্পর হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করো না এবং পরস্পর শত্রুতা ও দুশমনি পোষণ করো না; বরং হে আল্লাহর বান্দারা ভাই ভাই হয়ে থাকো।'-বুখারি
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদিসে আছে। তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তোমাদের কেউ যখন তার মুসলিম ভাইয়ের কাছে যায় তখন যেন সে তার খাবার থেকে খায় ও পানীয় থেকে পান করে এবং অনুসন্ধান না করে।'-বায়হাকী থেকে মিশকাতে
কোরআনুল কারিমের উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসে মুসলমানদের পরস্পরে আন্তরিকতা এবং বিশুদ্ধ জীবনাচারের ক্ষেত্রে অযথা সন্দেহ পোষণকে শুধু নিরুৎসাহিতই নয় বরং তা নিষেধ করা হয়েছে। এ ধরনের সন্দেহ পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে অলীক ধারণা পোষণ করে কোনো মুসলমানের দেওয়া উপহার অথবা দাওয়াতের ক্ষেত্রে হারাম-হালালের প্রসঙ্গ তুলতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ সব মুসলমান সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করা উচিত যে, সে নিজে হালাল খায় এবং বন্ধু-বান্ধবকেও হালাল খাওয়ায়।
কিন্তু আমরা আমাদের সমাজে কী দেখছি? অতি সম্প্রতি রাজধানীর শান্তিনগর ও উত্তরখানে চোর সন্দেহে দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘুষখোর সন্দেহে গত ৬ অক্টোবর ডিবির তিন পরিদর্শককে আটক করে বেধড়ক মারধর করে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোমানা মনজুরকে সন্দেহজনিত কলহের জের ধরে চোখ হারাতে হয়েছে। এ ছাড়া প্রায়ই দেখা যায়, চোর সন্দেহে গৃহপরিচারিকা থেকে শুরু করে হোটেলবয়, কলেজছাত্র ও নানা বয়সী মানুষকে মারধরের শিকার হতে হয়। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অনেককে গণপিটুনিতে প্রাণও দিতে হচ্ছে; পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। গত শবেবরাতে আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে তো পিটিয়ে মেরেই ফেলা হয়েছে। এমন ঘটনা দেশে প্রায়ই ঘটছে। এভাবে সন্দেহের ভিত্তিতে কোনো কাজ করা ধর্ম ও আইন পরিপন্থী কাজ। ইসলাম যেখানে কারও প্রতি মন্দ ধারণা করতে বারণ করেছে, সেখানে শুধু ধারণার ভিত্তিতে কাউকে হয়রানি করা বা মারধর করাকে অবশ্যই সমর্থন করে না। মন্দ ধারণা ও সন্দেহের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান খুব স্পষ্ট।
আমাদের মনে রাখা উচিত, কোনো মন্দ ধারণা কখনও কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না; বরং তা হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি করে, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দেয়। মন্দ ধারণা পোষণকারী স্পষ্ট গুনাহে লিপ্ত। আর একটি গুনাহ অন্য গুনাহর দিকে টেনে নেয়। এভাবে মন্দ ধারণা পোষণকারী বিভিন্ন অন্যায়-অপরাধ ও পাপে জড়িয়ে পড়ে। আর পরিণতিতে এ মন্দ ধারণাই তার জন্য লাঞ্ছনা ও অনুশোচনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো, নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখা এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধকে অটল রাখা। সবার সঙ্গে হাসিমুখে, স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়ে কথা বলা এবং দেখা-সাক্ষাৎ করা। মানুষের প্রতি সুধারণা পোষণ করা। অন্যের কাজকর্ম দেখার সময় ভালো ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখা।
উলামায়ে কেরাম লিখেছেন, মন্দ ধারণা তাকেই বলে, যে ধারণার স্বপক্ষে বাহ্যিক কোনো কারণ কিংবা সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। এমন ধারণাকে কোরআন-হাদিসে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তা থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে।
সুতরাং বাহ্যিকভাবে যার মধ্যে সততা ও সত্যবাদিতা পরিলক্ষিত হয় তার সম্পর্কে অন্যায় ধারণা পোষণ করা হারাম বলে বিবেচিত হবে। তবে যদি কারও মধ্যে সুস্পষ্টভাবে এসব পরিলক্ষিত হয় এবং তার স্বভাব-প্রকৃতিও মন্দ হয়, আর এ ব্যাপারে যদি সমাজে তার কুখ্যাতিও থাকে, তাহলে এমন লোক সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করা হারাম হবে না।
তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত হলো, কোরআনুল কারিমের এই আয়াতখানা স্মরণে রাখা। ইরশাদ হচ্ছে, 'যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান (জানাশোনা) নেই সে বিষয়ের পেছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও হৃদয় প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।'-সূরা আল ইসরা :৩৬
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.