কণ্ঠস্বর-সরকারের ব্যর্থতা অনেক, বিরোধী দলও সফল নয় by রাহাত খান
ইউরোপের রাশিয়া, ব্রিটেন ও নরওয়ে ছাড়া বাকি দেশগুলো অর্থনৈতিক ধসে কাবু। বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি তিরিশ দশকের মহামন্দার ভয়াবহতা অতিক্রম করতে চলেছে কি-না এই প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্ব মহামন্দার এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে কিন্তু বলতেই হয়, তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের বহু ক্ষমতাধর দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।
স্বাচ্ছন্দ্যে না হোক, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মোটামুটি চলমান এবং উন্নয়নের গতিধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই
বাংলাদেশের রাজনীতি এই মুহূর্তে খুব একটা অস্থিরতার মধ্যে আছে, তা বলা যায় না। তবে হ্যাঁ, বয়ান দেওয়া চলছে নানা রকম। চলছে সরকারের প্রতি নানা হুমকি-ধমকি। এ ছাড়া মানি না_ চলবে না, তিস্তামুখী লংমার্চ, ... দাবি পুনর্বহাল করতে হবে_ করতে হবে, এসবও আছে। আছে রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক বিষোদ্গার। আশাবাদ ব্যক্ত করা, আশ্বাস দেওয়া ইত্যাদির কোনো কমতি নেই। তবে বলতেই হয়, সবই উচ্চারণের মধ্যে সীমিত। রোডমার্চ, লংমার্চ ইত্যাদি রাজনীতির অ্যাকশনভিত্তিক কর্মসূচি জনগণের মধ্যে খুব সাড়া জাগাতে পারছে না। বিশেষত প্রধান বিরোধী দল রোডমার্চ এবং বিশাল সব জনসভা থেকে যা কিছু অর্জন করে সেগুলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা চলবে না, বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের বরপুত্র তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, এই দুটি অমার্জনীয় ও অগ্রহণযোগ্য উক্তির কারণে সব অর্জন নস্যাৎ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে নানামুনির নানা মত। কেউ কেউ তাদের মধ্যে খ্যাতনামাও আছেন, বলেন যে, বাংলাদেশের সরকার ও অর্থনীতি দুইয়েরই বারোটা বেজে গেছে। কেউ কেউ বলেন, বর্তমান সরকার পরিচালিত অর্থনীতির দুর্দশা এমনই করুণ যে, আগামী তিন-চার মাস পর সরকার তাদের কর্মচারীদের বেতনই দিতে পারবে না। তাদের মতে, বর্তমান সরকারের পরিচালনা দোষে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অর্থ ও নীতি কোনোটাই নেই।
এটা ঠিক, বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। অর্থনীতির বিশ্লেষক, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এখনও রয়ে গেছে, বেশিরভাগটাই লিগ্যাসি সূত্রে পাওয়া প্রকট দুর্নীতি, কর্মঐতিহ্য গড়ে না ওঠা এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা। অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতার অভাবও প্রবলভাবে উপস্থিত।
তবে বাংলাদেশের চলমান অর্থনীতি সম্পর্কে ভালো এবং ইতিবাচক বক্তব্যও রয়েছে। সেগুলোও অর্থনীতির রাজনীতি-নিরপেক্ষ গবেষক, বিশ্লেষক এবং গবেষকদেরই কথা। তারা মনে করেন, গত দুই-তিন বছর ধরে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মহামন্দা চলছে, বাংলাদেশ অন্য বহু দেশের মতো, এর নেতিবাচক প্রভাব বলয়ের বাইরে নয়। মহামন্দার ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এসে পড়ছে। বিশ্বমন্দা শিগগিরই কাটবে_ এমন লক্ষণ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আরবের 'বসন্ত বিপ্লব' আরব জনগণের জন্য তো বটেই, গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্যও বিশাল সুসংবাদ। তবে তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ায় বছরেরও বেশি সময় লেগেছে একনায়ক গাদ্দাফি, তার সরকার ও বাহিনীকে উচ্ছেদ করতে। এতে করে বিশ্বে জ্বালানি তেল উৎপাদন, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি বেশ কিছুটা এফেক্টেড বা আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বে তেল উৎপাদনে তৃতীয় ও পঞ্চম স্থান অধিকারী ইরান ও ভেনিজুয়েলারের সঙ্গেও পাশ্চাত্য মুক্তির একটা শীতল সম্পর্ক চলে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তার ওপর চীন, ব্রাজিল ও ভারত বিশ্বের এই তিনটি উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তির বাইরে থেকে জ্বালানি সংগ্রহের মাত্রা বেড়েছে আগের তুলনায় চারগুণেরও বেশি। ফলে বিশ্বে জ্বালানি তেলের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ছাড়াও এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
এসবই বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে চলেছে। ইউরোপের রাশিয়া, ব্রিটেন ও নরওয়ে ছাড়া বাকি দেশগুলো অর্থনৈতিক ধসে কাবু। বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি তিরিশ দশকের মহামন্দার ভয়াবহতা অতিক্রম করতে চলেছে কি-না এই প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্ব মহামন্দার এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে কিন্তু বলতেই হয়, তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের বহু ক্ষমতাধর দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। স্বাচ্ছন্দ্যে না হোক, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মোটামুটি চলমান এবং উন্নয়নের গতিধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই। বিশ্ব সংস্থাসহ বিশ্বের বহু উন্নত দেশ উন্নয়নশীল বিশ্বে বাংলাদেশকে একটা মডেল বা আদর্শ ও অনুকরণীয় দেশ বলে মনে করে। বাংলাদেশের এই অর্জন রীতিমতো প্রশংসার দাবি রাখে। ভারতের মতো মজবুত একটা অর্থনীতির দেশ যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্রম-ঊর্ধ্বগতির দরুন হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে এক ভোজ্যতেলের দাম বাড়া ছাড়া মোটা চালসহ বাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যখন-তখন কিছুটা ওঠানামা সত্ত্বেও সহনীয় পর্যায়েই আছে বলে সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে হয়।
গত তিন বছরে বাংলাদেশে সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি অনেকটা স্থিতিস্থাপকতা পেয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না। বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় (২০০১-০৬) সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রসার, রাজনৈতিক হত্যা ইত্যাদি প্রায় পাকিস্তানের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এই জোটের ইচ্ছা কী ছিল তা মহান আল্লাহতায়ালা জানেন। তবু জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিএনপির আগেরবার ও বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-০৬ সালের সরকার এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করার দৃষ্টান্ত থেকে এই উপসংহারে তো পেঁৗছাই যায়, বাংলাদেশকে জেনে বা না জেনে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার পন্থাই বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই নিকট অতীত ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এটাও স্বীকার করা উচিত নয় যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গত তিন বছরে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে শতভাগ সফল হয়েছে। এই সাফল্য যে কোনো দেশে যে কোনো বিচারে শুধু প্রশংসনীয়ই নয়, সাফল্যের একটা মাইলফলক বটে।
এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোটের (২০০১-০৬) তছনছ করে রেখে যাওয়া বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেই সম্পন্ন হয়েছে এবং এটাকেও অল্প সময়সীমার ভেতর যুগান্তকারী সাফল্য না বলার কারণ নেই। আর খাদ্যোৎপাদনে এরই মধ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শতকরা ৮৫টি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইউনিয়নে ইউনিয়নে তথ্যপ্রযুক্তি পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে। বছরের শুরুতেই স্কুলের সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই পেঁৗছে দেওয়া হয়। ভারতের সঙ্গে ঘটেছে সম্পর্কোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য উন্নতি। এগুলো সবই একেকটা বিশাল সাফল্য। দেশের অর্থনীতির ব্যষ্টিক ও সামগ্রিক উন্নতিতে এসবের অবদান রয়েছে অবশ্যই।
মনে হতেই পারে, আমি শুধু মহাজোট সরকারের সাফল্যের কথাই বলছি_ এই সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে ব্যর্থ সে সম্পর্কে কিছুই বলছি না। তবে বিষয়টা তেমন নয়। আমি মোটেই মহাজোট সরকারের গুণকীর্তনের জন্য এই লেখা লিখছি না। মহাজোট সরকার, সরকারের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা অবশ্যই আছে। সেটা বলার সুযোগ থাকলে সংবাদপত্রের কলামে তা তুলে ধরার চেষ্টাও করি। তবে তিন বছরে মহাজোট সরকারের সার্বিক সাফল্যের কয়েকটি তুলে ধরলাম শুধু এই কারণে যে, বর্তমান সরকারের তিন বছরের সাফল্য আমার মতো অনেকের বিবেচনায় যথেষ্টই উল্লেখ করার মতো। যার যা প্রাপ্য তা দিতে কার্পণ্য বোধ করা উচিত নয় বলেই আমি মনে করি।
মহাজোট সরকার পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে আদালতে দেওয়া রায়ের ভিত্তিতে। তবে সংশোধনী করতে গিয়ে মিলিটারি স্বৈরাচারী এবং 'গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী'দের সংবিধানে চাপিয়ে দেওয়া কিছু 'ভণ্ডামি' বজায় রেখে মহাজোট সরকার মিথ্যা ও ভ্রষ্টাচারের কাছেই নতিস্বীকার করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে পাকিস্তানি কায়দার ভণ্ডামিগুলো রেখে দেওয়া ঠিক হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় এটা আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা বলে মনে করি।
হ্যাঁ, দেশে দুর্নীতি আগের মতো 'প্রাতিষ্ঠানিক' না হলেও যথেষ্ট প্রকট। যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বিএনপি-জামায়াত-ছাত্রদলের কায়দায় মহাজোট সরকারের কিছু মন্ত্রী, আমলা, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু লোক নদী ভরাট, জমি দখল, চাকরি-বাণিজ্য, প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর চড়াও হওয়া ইত্যাকার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। অনেকের মতে, তাহলে বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য কী! আমিও তাদের সঙ্গে প্রায় একমত পোষণ করি। পার্থক্যটা কোথায়!
এখানে আমার বলা 'প্রায়' শব্দটির একটা ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত বলে মনে করি। 'প্রায়' বললাম এই কারণে যে, দুর্নীতি, গুপ্তহত্যা, প্রতিদ্বন্দ্বীকে মেরে ফেলা, ছাত্রলীগের (এক শ্রেণীর), ভণ্ডামি, গুণ্ডামি, চাঁদাবাজি, শিক্ষক পেটানো ইত্যাকার ঘটনা ঘটলে এখন অন্তত সেসবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অন্তত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। বিএনপি-জামায়াতের আমলে তাদের দলীয় লোকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতো কস্ফচিৎ-কখনও। বলতে গেলে নেওয়াই হতো না। দলীয় লোক, দলীয় মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও ভাই-বেরাদর, ছাত্রদল, যুবদল যত অপরাধ করুক, ওপরের চাপে এবং নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা (ব্যতিক্রম ছাড়া) নেওয়ার নজির নেই। এখন বিএনপির যারা আইনের শাসনের কথা বলেন, ভবিষ্যতে তাদের সংশোধন ঘটলে সেটা ভিন্ন কথা, তবে অতীতে তারা মনে হয়, দুষ্কার্যকেই মনে করতেন 'প্রজা'হিত সাধন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করাটা মনে করতেন ন্যায় ও কর্তব্য আর দুর্নীতি, চোরাকারবার, সব দোষ ও অপরাধ বিরোধীদের কাঁধে চাপানোই ছিল বোধকরি তাদের কাছে আইনের শাসনের সংজ্ঞা।
হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা আছে বৈকি। দেশের বহু রাস্তার বেহাল দশা, কোথাও কোথাও জনগণের দুর্ভোগ চরমে পেঁৗছেছে। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী অপর্যাপ্ত ফান্ড বরাদ্দের কথা বলতেন আর অর্থমন্ত্রীর কাজ ছিল সেটা অস্বীকার করা। এভাবে দুই মন্ত্রীর দড়ি টানাটানিতে তিন বছর কেটেছে। বাকি দুই বছরে বর্তমান যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী কতটা কী করবেন, করতে পারবেন সেটা সময়ই শুধু বলতে পারে। তবে রাস্তার বেহাল দশা অন্তত মোটামুটিভাবে ঠিক না হলে, অতীতে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া রেল ব্যবস্থার অন্তত দৃশ্যযোগ্য উন্নয়ন না ঘটলে এ জন্য আগামী নির্বাচনে অবশ্যই মহাজোট সরকারকে এর মূল্য দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের (দল ও সরকারের) ব্যর্থতা আছে বৈকি! তবে আওয়ামী লীগের বদলে এমন দলকে দেশের মানুষ নির্বাচনে জয়ী করবে কেন, যারা অতীতের অপকর্মের জন্য ভুল স্বীকার করে না। সংসদীয় দল হওয়া সত্ত্বেও সংসদে যায় না? যারা পায়ে ধরে সাধলেও সংসদে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংলাপে যোগ দেয় না এবং বিরোধী দলের উদ্দিষ্ট ভূমিকা পালনেও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দেয়? বিরোধী দলের কাজ তো শুধু হুমকি-ধমকি দেওয়া এবং তর্জন-গর্জন করা নয়। ক্ষমতায় গেলে প্রতিশোধ নেওয়া হবে_ এসব যারা বলেন তারা কি রাজনীতিকে ছোট করছেন না? বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের সাফল্য যেমন আছে, ব্যর্থতাও তেমনি কিছু কিছু আছে। তবে প্রধান বিরোধী দলের, বিরোধী দল হিসেবেই ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নেই। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
বাংলাদেশের রাজনীতি এই মুহূর্তে খুব একটা অস্থিরতার মধ্যে আছে, তা বলা যায় না। তবে হ্যাঁ, বয়ান দেওয়া চলছে নানা রকম। চলছে সরকারের প্রতি নানা হুমকি-ধমকি। এ ছাড়া মানি না_ চলবে না, তিস্তামুখী লংমার্চ, ... দাবি পুনর্বহাল করতে হবে_ করতে হবে, এসবও আছে। আছে রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক বিষোদ্গার। আশাবাদ ব্যক্ত করা, আশ্বাস দেওয়া ইত্যাদির কোনো কমতি নেই। তবে বলতেই হয়, সবই উচ্চারণের মধ্যে সীমিত। রোডমার্চ, লংমার্চ ইত্যাদি রাজনীতির অ্যাকশনভিত্তিক কর্মসূচি জনগণের মধ্যে খুব সাড়া জাগাতে পারছে না। বিশেষত প্রধান বিরোধী দল রোডমার্চ এবং বিশাল সব জনসভা থেকে যা কিছু অর্জন করে সেগুলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা চলবে না, বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের বরপুত্র তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, এই দুটি অমার্জনীয় ও অগ্রহণযোগ্য উক্তির কারণে সব অর্জন নস্যাৎ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে নানামুনির নানা মত। কেউ কেউ তাদের মধ্যে খ্যাতনামাও আছেন, বলেন যে, বাংলাদেশের সরকার ও অর্থনীতি দুইয়েরই বারোটা বেজে গেছে। কেউ কেউ বলেন, বর্তমান সরকার পরিচালিত অর্থনীতির দুর্দশা এমনই করুণ যে, আগামী তিন-চার মাস পর সরকার তাদের কর্মচারীদের বেতনই দিতে পারবে না। তাদের মতে, বর্তমান সরকারের পরিচালনা দোষে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অর্থ ও নীতি কোনোটাই নেই।
এটা ঠিক, বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। অর্থনীতির বিশ্লেষক, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এখনও রয়ে গেছে, বেশিরভাগটাই লিগ্যাসি সূত্রে পাওয়া প্রকট দুর্নীতি, কর্মঐতিহ্য গড়ে না ওঠা এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা। অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতার অভাবও প্রবলভাবে উপস্থিত।
তবে বাংলাদেশের চলমান অর্থনীতি সম্পর্কে ভালো এবং ইতিবাচক বক্তব্যও রয়েছে। সেগুলোও অর্থনীতির রাজনীতি-নিরপেক্ষ গবেষক, বিশ্লেষক এবং গবেষকদেরই কথা। তারা মনে করেন, গত দুই-তিন বছর ধরে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মহামন্দা চলছে, বাংলাদেশ অন্য বহু দেশের মতো, এর নেতিবাচক প্রভাব বলয়ের বাইরে নয়। মহামন্দার ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এসে পড়ছে। বিশ্বমন্দা শিগগিরই কাটবে_ এমন লক্ষণ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আরবের 'বসন্ত বিপ্লব' আরব জনগণের জন্য তো বটেই, গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্যও বিশাল সুসংবাদ। তবে তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ায় বছরেরও বেশি সময় লেগেছে একনায়ক গাদ্দাফি, তার সরকার ও বাহিনীকে উচ্ছেদ করতে। এতে করে বিশ্বে জ্বালানি তেল উৎপাদন, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি বেশ কিছুটা এফেক্টেড বা আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বে তেল উৎপাদনে তৃতীয় ও পঞ্চম স্থান অধিকারী ইরান ও ভেনিজুয়েলারের সঙ্গেও পাশ্চাত্য মুক্তির একটা শীতল সম্পর্ক চলে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তার ওপর চীন, ব্রাজিল ও ভারত বিশ্বের এই তিনটি উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তির বাইরে থেকে জ্বালানি সংগ্রহের মাত্রা বেড়েছে আগের তুলনায় চারগুণেরও বেশি। ফলে বিশ্বে জ্বালানি তেলের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ছাড়াও এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
এসবই বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে চলেছে। ইউরোপের রাশিয়া, ব্রিটেন ও নরওয়ে ছাড়া বাকি দেশগুলো অর্থনৈতিক ধসে কাবু। বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি তিরিশ দশকের মহামন্দার ভয়াবহতা অতিক্রম করতে চলেছে কি-না এই প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্ব মহামন্দার এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে কিন্তু বলতেই হয়, তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের বহু ক্ষমতাধর দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। স্বাচ্ছন্দ্যে না হোক, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে মোটামুটি চলমান এবং উন্নয়নের গতিধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই। বিশ্ব সংস্থাসহ বিশ্বের বহু উন্নত দেশ উন্নয়নশীল বিশ্বে বাংলাদেশকে একটা মডেল বা আদর্শ ও অনুকরণীয় দেশ বলে মনে করে। বাংলাদেশের এই অর্জন রীতিমতো প্রশংসার দাবি রাখে। ভারতের মতো মজবুত একটা অর্থনীতির দেশ যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্রম-ঊর্ধ্বগতির দরুন হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে এক ভোজ্যতেলের দাম বাড়া ছাড়া মোটা চালসহ বাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যখন-তখন কিছুটা ওঠানামা সত্ত্বেও সহনীয় পর্যায়েই আছে বলে সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে হয়।
গত তিন বছরে বাংলাদেশে সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি অনেকটা স্থিতিস্থাপকতা পেয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না। বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় (২০০১-০৬) সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রসার, রাজনৈতিক হত্যা ইত্যাদি প্রায় পাকিস্তানের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এই জোটের ইচ্ছা কী ছিল তা মহান আল্লাহতায়ালা জানেন। তবু জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিএনপির আগেরবার ও বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-০৬ সালের সরকার এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করার দৃষ্টান্ত থেকে এই উপসংহারে তো পেঁৗছাই যায়, বাংলাদেশকে জেনে বা না জেনে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার পন্থাই বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই নিকট অতীত ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এটাও স্বীকার করা উচিত নয় যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গত তিন বছরে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে শতভাগ সফল হয়েছে। এই সাফল্য যে কোনো দেশে যে কোনো বিচারে শুধু প্রশংসনীয়ই নয়, সাফল্যের একটা মাইলফলক বটে।
এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোটের (২০০১-০৬) তছনছ করে রেখে যাওয়া বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেই সম্পন্ন হয়েছে এবং এটাকেও অল্প সময়সীমার ভেতর যুগান্তকারী সাফল্য না বলার কারণ নেই। আর খাদ্যোৎপাদনে এরই মধ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শতকরা ৮৫টি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইউনিয়নে ইউনিয়নে তথ্যপ্রযুক্তি পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে। বছরের শুরুতেই স্কুলের সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই পেঁৗছে দেওয়া হয়। ভারতের সঙ্গে ঘটেছে সম্পর্কোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য উন্নতি। এগুলো সবই একেকটা বিশাল সাফল্য। দেশের অর্থনীতির ব্যষ্টিক ও সামগ্রিক উন্নতিতে এসবের অবদান রয়েছে অবশ্যই।
মনে হতেই পারে, আমি শুধু মহাজোট সরকারের সাফল্যের কথাই বলছি_ এই সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে ব্যর্থ সে সম্পর্কে কিছুই বলছি না। তবে বিষয়টা তেমন নয়। আমি মোটেই মহাজোট সরকারের গুণকীর্তনের জন্য এই লেখা লিখছি না। মহাজোট সরকার, সরকারের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা অবশ্যই আছে। সেটা বলার সুযোগ থাকলে সংবাদপত্রের কলামে তা তুলে ধরার চেষ্টাও করি। তবে তিন বছরে মহাজোট সরকারের সার্বিক সাফল্যের কয়েকটি তুলে ধরলাম শুধু এই কারণে যে, বর্তমান সরকারের তিন বছরের সাফল্য আমার মতো অনেকের বিবেচনায় যথেষ্টই উল্লেখ করার মতো। যার যা প্রাপ্য তা দিতে কার্পণ্য বোধ করা উচিত নয় বলেই আমি মনে করি।
মহাজোট সরকার পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে আদালতে দেওয়া রায়ের ভিত্তিতে। তবে সংশোধনী করতে গিয়ে মিলিটারি স্বৈরাচারী এবং 'গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী'দের সংবিধানে চাপিয়ে দেওয়া কিছু 'ভণ্ডামি' বজায় রেখে মহাজোট সরকার মিথ্যা ও ভ্রষ্টাচারের কাছেই নতিস্বীকার করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে পাকিস্তানি কায়দার ভণ্ডামিগুলো রেখে দেওয়া ঠিক হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় এটা আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা বলে মনে করি।
হ্যাঁ, দেশে দুর্নীতি আগের মতো 'প্রাতিষ্ঠানিক' না হলেও যথেষ্ট প্রকট। যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বিএনপি-জামায়াত-ছাত্রদলের কায়দায় মহাজোট সরকারের কিছু মন্ত্রী, আমলা, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু লোক নদী ভরাট, জমি দখল, চাকরি-বাণিজ্য, প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর চড়াও হওয়া ইত্যাকার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। অনেকের মতে, তাহলে বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য কী! আমিও তাদের সঙ্গে প্রায় একমত পোষণ করি। পার্থক্যটা কোথায়!
এখানে আমার বলা 'প্রায়' শব্দটির একটা ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত বলে মনে করি। 'প্রায়' বললাম এই কারণে যে, দুর্নীতি, গুপ্তহত্যা, প্রতিদ্বন্দ্বীকে মেরে ফেলা, ছাত্রলীগের (এক শ্রেণীর), ভণ্ডামি, গুণ্ডামি, চাঁদাবাজি, শিক্ষক পেটানো ইত্যাকার ঘটনা ঘটলে এখন অন্তত সেসবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অন্তত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। বিএনপি-জামায়াতের আমলে তাদের দলীয় লোকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতো কস্ফচিৎ-কখনও। বলতে গেলে নেওয়াই হতো না। দলীয় লোক, দলীয় মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও ভাই-বেরাদর, ছাত্রদল, যুবদল যত অপরাধ করুক, ওপরের চাপে এবং নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা (ব্যতিক্রম ছাড়া) নেওয়ার নজির নেই। এখন বিএনপির যারা আইনের শাসনের কথা বলেন, ভবিষ্যতে তাদের সংশোধন ঘটলে সেটা ভিন্ন কথা, তবে অতীতে তারা মনে হয়, দুষ্কার্যকেই মনে করতেন 'প্রজা'হিত সাধন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করাটা মনে করতেন ন্যায় ও কর্তব্য আর দুর্নীতি, চোরাকারবার, সব দোষ ও অপরাধ বিরোধীদের কাঁধে চাপানোই ছিল বোধকরি তাদের কাছে আইনের শাসনের সংজ্ঞা।
হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা আছে বৈকি। দেশের বহু রাস্তার বেহাল দশা, কোথাও কোথাও জনগণের দুর্ভোগ চরমে পেঁৗছেছে। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী অপর্যাপ্ত ফান্ড বরাদ্দের কথা বলতেন আর অর্থমন্ত্রীর কাজ ছিল সেটা অস্বীকার করা। এভাবে দুই মন্ত্রীর দড়ি টানাটানিতে তিন বছর কেটেছে। বাকি দুই বছরে বর্তমান যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী কতটা কী করবেন, করতে পারবেন সেটা সময়ই শুধু বলতে পারে। তবে রাস্তার বেহাল দশা অন্তত মোটামুটিভাবে ঠিক না হলে, অতীতে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া রেল ব্যবস্থার অন্তত দৃশ্যযোগ্য উন্নয়ন না ঘটলে এ জন্য আগামী নির্বাচনে অবশ্যই মহাজোট সরকারকে এর মূল্য দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের (দল ও সরকারের) ব্যর্থতা আছে বৈকি! তবে আওয়ামী লীগের বদলে এমন দলকে দেশের মানুষ নির্বাচনে জয়ী করবে কেন, যারা অতীতের অপকর্মের জন্য ভুল স্বীকার করে না। সংসদীয় দল হওয়া সত্ত্বেও সংসদে যায় না? যারা পায়ে ধরে সাধলেও সংসদে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংলাপে যোগ দেয় না এবং বিরোধী দলের উদ্দিষ্ট ভূমিকা পালনেও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দেয়? বিরোধী দলের কাজ তো শুধু হুমকি-ধমকি দেওয়া এবং তর্জন-গর্জন করা নয়। ক্ষমতায় গেলে প্রতিশোধ নেওয়া হবে_ এসব যারা বলেন তারা কি রাজনীতিকে ছোট করছেন না? বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের সাফল্য যেমন আছে, ব্যর্থতাও তেমনি কিছু কিছু আছে। তবে প্রধান বিরোধী দলের, বিরোধী দল হিসেবেই ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নেই। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments