রেসিপি পুরনো, কিন্তু রাঁধুনির হাত ভালো by দাউদ হোসাইন রনি
খুবই সাধারণ এবং গতানুগতিক একটা গল্প। কক্সবাজারে বেড়াতে যান কাজী হায়াৎ ও রেহানা জলি দম্পতি। একমাত্র মেয়ে বুবলি সেখান থেকে কিডন্যাপ হয়। এই ছোট্ট মেয়েটিকে কিডন্যাপারদের কাছ থেকে উদ্ধার করে আনে অনাথ শিশু শান্ত। বুবলির বাবা শান্তকে পুরস্কৃত করার বদলে পুলিশের হাতে তুলে দেন। বুবলি এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। শান্ত পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসে বুবলির খোঁজে।
একজন শিল্পপতির আশ্রয় পেয়েই শান্তরূপী শাকিব বিশাল বড়লোক। তাঁর নতুন নাম আগুন। বুবলিরূপী অপু বিশ্বাস নামকরা আইনজীবী। দুজনেরই বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু একজন আরেকজনকে ভুলতে পারছেন না। ছবির শেষ দৃশ্যে নাটকীয়ভাবে দুজনের মিলন হয়। এ ধরনের গল্প নিয়ে কম করে হলেও শতাধিক ছবি নির্মিত হয়েছে। তবে বহু চর্বিত মাংসপিণ্ড নিয়ে পরিচালক যে আইটেমটি রান্না করেছেন, তা একেবারে খারাপ হয়নি। রেসিপি খারাপ হলেও অনেক সময় রাঁধুনির হাত-যশের কারণে অপছন্দের খাবারও খেতে খারাপ লাগে না। এ ছবিটিও সে রকমই। গতানুগতিক হয়েও কিছু কিছু দৃশ্য, সংলাপ এবং প্রয়োগ অসাধারণ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটা গ্রহণযোগ্য যুক্তি রাখার চেষ্টা করেছেন। এই গল্পটি মুখস্থ থাকা সত্ত্বেও পরের দৃশ্যে কী হবে, দর্শক সেটা আগেভাগে বলতে পারছেন না। এটা ভালো। কিন্তু এই ভালো লাগার ধারাবাহিকতাটা পর্দায় বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায়নি।
গল্পের শুরুটা বেশ নড়বড়ে। এক ঝাঁক আনাড়ি অভিনয়শিল্পী নিয়ে শুরু করাটা মোটেও শুভবুদ্ধির পরিচয় নয়। শাকিব, মিশা সওদাগর এমনকি অপু বিশ্বাস যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন, ততক্ষণ পর্দা উজ্জ্বল। বাকি সময়টা লেজে-গোবরে। কিডন্যাপার, মেয়ে শিশুশিল্পী, হাসপাতালের রিসিপশনিস্টসহ ছোট চরিত্রের অভিনয়শিল্পী(!)দের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে দৃশ্যগুলো দাঁড়িয়ে যেত। হেলিকপ্টারে চড়ে গল্পে ঢুকেছেন শাকিব খান। মিশা সওদাগরের গাড়িবহরের সামনে গিয়ে হেলিকপ্টার থেকে নেমে মিশার সাঙ্গপাঙ্গদের 'ধোলাই' করেন শাকিব। হেলিকপ্টারের ব্যবহার চমৎকার। কিন্তু হেলিকপ্টারের ব্যবহার কেন করা হয়েছে, এর ব্যাখ্যাটা অপরিষ্কার। একটা হাস্যকর কাণ্ডও ঘটেছে এখানে, নায়ক একের পর এক গুলি করছেন, কিন্তু ভিলেনদের সামনে গিয়ে সেটা বোমার মতো ফুটছে! আর মারামারির যা সাউন্ড! এই শব্দগুলো কবে যে বিতাড়িত হবে আমাদের সিনেমা থেকে, আল্লা মালুম। অবশ্য বছরের পর বছর ধরে নিয়মিত দর্শকদের যেভাবে বোকা বানিয়ে রাখা হয়েছে, এরপর নতুন কিছু দিলে তারা সেটা নিতেও চান না। এই ছবি দিয়েই উদাহরণ দিই। [মিউট শট] আদালতে অপু আসামিকে জেরা করছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক চলছে। অথচ দর্শক ভাবছেন হলের সাউন্ড প্রবলেম। চিৎকার চেঁচামেচি করে সিট চাপড়াতে লাগলেন। এই দর্শকরা এটা বোঝেন না, সাউন্ড প্রবলেম হলে তো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শোনা যেত না!
অভিনয়ে শাকিব খান, মিশা, অপু এবং ছেলে শিশুশিল্পী বেশ ভালো করেছেন। শাকিবকে বেশ স্লিম মনে হয়েছে, আবার অপুকে মনে হয়েছে বেশ মোটা। 'মেকওভার' বিষয়ে শাকিবের আরো মনোযোগী হওয়া উচিত। কানের দুল, লিপস্টিক, কড়া মেকাপ_এগুলো ছাড়াই তিনি বেশ সুপুরুষ। এই ছবিতে সব কিছু একটু বেশি বেশি মনে হয়েছে। এখনকার আধুনিক ছেলেরা নিশ্চয়ই দুই কানে [তাও আবার ডিজাইন করা] দুল পরে ঘুরে বেড়ায় না! সব সময় পর্দায় অপুর যে কণ্ঠস্বর শোনা যায়, এই ছবিতে সে কণ্ঠ নেই। শুরুতে দর্শকের মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও অপু পার পেয়ে গেছেন। কারণ অভিনয়ে খুবই ভালো করেছেন। চরিত্রানুযায়ী ড্রেসআপও ছিল চমৎকার। নতুন হিসেবে চঞ্চলা চঞ্চু খারাপ করেননি। ক্লোজ শটে তিনি যতটা সাবলীল, লং শটে ততটা নন। নাচে খুবই দুর্বল।
এডিটিং ভালো, তবে নিখুঁত নয়। ক্যামেরা, ডাবিং ও ডামির ব্যবহার ভালো হয়নি। বেশ কয়েকটি দৃশ্য ঝাপসা মনে হয়েছে। ছবির গান মোটামুটি মানের। কানিজ সুবর্ণা আর টুটুলের গানটি ছাড়া বাকি গানগুলোর সুরে নতুনত্ব নেই। যদিও শুনতে খারাপ লাগেনি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক পুরনো 'গোডাউন' থেকে নেওয়া। 'বাতাসটা এসে কী বলে গেল'_স্বামী কেন আসামী ছবির এই গান মনে হয় পরিচালকের খুবই প্রিয়। আগের ছবির মতো এই ছবিতেও এ গানের মিউজিক ব্যবহার করেছেন।
পরিচালকের আগের ছবির জের টানলে, এই ছবিটা একটু ম্লান। রাজু ফুরিয়ে যাচ্ছেন না তো!
* বাঙালির দেশপ্রেম কি কমে যাচ্ছে? একজন চলচ্চিত্র সমালোচকের গবেষণার আওতায় এ প্রশ্নের উত্তর থাকার কথা নয়। সিনেমা শুরুর আগে জাতীয় সংগীত ও পতাকা প্রদর্শনের নিয়ম আছে। পতাকা উড়ছে আর দর্শকরা দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছেন_দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে। রাজধানীর পূর্ণিমা হলে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। পতাকা উড়ছে, অথচ কারো মধ্যেই সম্মান জানানোর তাগিদ নেই। একজনই দাঁড়ালেন। জানা গেল তিনি একেবারেই নতুন দর্শক। দাঁড়িয়ে গিয়ে লোকটা শুধু শুধু অন্যদের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হলেন! একটা সময় ছিল [নব্বই দশক পর্যন্ত], সবাই দাঁড়িয়ে যেতেন। দু-একজন যদি কোনো কারণে দাঁড়াতে না পারতেন, অন্যরা তাঁদের দিকে অবাক হয়ে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতেন যেন সাক্ষাৎ 'রাজাকার' দেখছেন। এ সময়ে এসে দৃশ্যটা এরকম বদলে গেল কেন! এর কী ব্যাখ্যা আছে মনস্তাত্তি্বকদের কাছে? ব্যাখ্যা যা-ই থাকুক, বিষয়টা কিন্তু সত্যিই ভাববার।
ম প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন সিনেমা 'ব্যবচ্ছেদ'-এর টেবিলে ছুরি-কাঁচির নিচে শুয়ে পড়ছে। ফালি ফালি করে কাটা হয় এর প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সিনেমা হলগুলো ব্যবচ্ছেদের টেবিল থেকে দূরে থাকবে কেন? চলচ্চিত্র যদি শিল্প হয়, তবে সেটা প্রদর্শনের স্থানও হবে শিল্পালয়। দর্শক-প্রেক্ষাগৃহ-ভালো সিনেমা; সিনেমা-বাণিজ্যের সঙ্গে এ তিনটির সম্পর্ক না থাকলে কিভাবে চলে? 'পূর্ণিমা' নামটি যত সুন্দর, এর ভেতর ও বাহির ঠিক ততটাই অসুন্দর। চারদিকে মনুষ্যকীর্তির [মূত্র] গন্ধ! তার ওপর যত ধরনের দুর্নীতি আছে, সবই এখানে পাবেন। বাইরে টিকিটের দাম লেখা ষাট, কিনতে গেলে দিতে হবে বাষট্টি। শহরের অন্য হলগুলোর তুলনায় এখানে টিকিটের দামও বেশি। বেশি দাম দিয়েও রেহাই নেই। হলে ঢুকলেই মনে হবে আদিম কোনো গুহায় আপনি ঢুকে পড়েছেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র তো দূরের কথা, বৈদ্যুতিক পাখাই নেই। যে দু-তিনটা আছে, সেগুলোর নিচে বসার জন্য আপনাকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হবে। সাউন্ডের সমস্যা, পর্দা কাঁপে, সিট নড়বড়ে, উপরি পাওনা হিসেবে ছারপোকা তো আছেই! এত কিছুর পরও কিছু দর্শক যে সিনেমা দেখতে আসেন, সেটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়।
ব্যবচ্ছেদ
ছবির নাম : মনের ঘরে বসত করে
পরিচালক : জাকির হোসেন রাজু
অভিনয়ে : শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, মিশা সওদাগর, কাজী হায়াৎ, আসিফ ইকবাল, চঞ্চলা চঞ্চু প্রমুখ
মুক্তির তারিখ : ১৪ অক্টোবর
রেটিং : ২.৫/৫
No comments