নদী ও বনের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি বাঁধ-জলবায়ু তহবিলের টাকায় বন কেটে বাঁধ!
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গঠন করা সরকারি তহবিলের টাকায় নেওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্পের কারণে ৩৯ হাজার গাছ কাটা পড়তে যাচ্ছে। এই প্রকল্পে একটি নদী, দুটি চ্যানেল ও তিনটি বনের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি বাঁধ বা ক্রসড্যাম নির্মাণ করা হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে উপকূলের মানুষের সুরক্ষায় প্রায় সাত কিলোমিটার দীর্ঘ এই আড়াআড়ি বাঁধ তৈরি করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের (সিসিটিএফ) প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এটি হলে উপকূলীয় জেলা ভোলা ও পটুয়াখালীর মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে এবং নতুন জমি জেগে উঠবে বলে দাবি করছে পাউবো।
সরেজমিন গিয়ে এবং প্রকল্পের কাগজপত্র থেকে জানা গেছে, বুড়া গৌরাঙ্গ নদ ও এর চর মন্তাজ চ্যানেল এবং তেঁতুলিয়া নদীর চর মাইনকার চ্যানেলের ওপর দিয়ে যাবে বাঁধটি। গাছ কাটা পড়ার কারণ, অবস্থানের দিক থেকে বুড়া গৌরাঙ্গের পর চর বেস্টিন বন, মন্তাজ চ্যানেল, চর বনানী বন, মাইনকার চ্যানেল এবং শেষে মাইনকার চর সংরক্ষিত বনের ওপর দিয়ে যাবে বাঁধটি। ফলে এই তিনটি শ্বাসমূলীয় বনের প্রায় ৩৯ হাজার গাছ কাটা পড়বে বলে বন বিভাগ মনে করছে।
বন বিভাগের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, গাছ কাটা পড়া ছাড়াও বাঁধটি হলে উপকূলের সাড়ে পাঁচ হাজার একর বনভূমি হুমকির মুখে পড়বে। চারটি নদী ও ১০টি খালের গতিপথ বদলে যেতে পারে। এলাকার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। ওই নদী ও জলাশয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল ৩০ হাজার জেলের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
জানতে চাইলে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী স্থানীয় সাংসদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা ওই কাজের অনুকূলে কার্যাদেশ দিয়ে দিয়েছি এবং ঠিকাদাররা কাজ শুরু করে দিয়েছে।’ প্রকল্পটির কারণে বনের ক্ষতি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মন্ত্রী বলেন, ‘এটা বন বিভাগের কাজ। ক্ষতি হলে তারা দেখবে। আমাদের দায়িত্ব প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা, আমরা সেটা করে দিচ্ছি।’
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে লিখিতভাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) প্রতিবেদন জমা না দিয়ে এই বাঁধটি নির্মাণ করা ঠিক হবে না। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী, এ ধরনের বাঁধ নির্মাণের আগে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক, যাতে বাঁধটি নির্মিত হলে কী ধরনের পরিবেশগত প্রভাব পড়বে, তা বোঝা যায় এবং সে অনুযায়ী পরিবেশ রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
গত রোববার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে জলবায়ু ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় ইআইএ করার বিষয়টি লিখিতভাবে পাউবোকে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড সূত্রে জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাশনের চর মাইনকা থেকে পটুয়াখালীর চর মন্তাজ পর্যন্ত সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন ও ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ সালের নভেম্বরে হাতে নেওয়া হয়। বাঁধটি দৈর্ঘ্যে ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটার ও প্রস্থে হবে সাড়ে ১০০ মিটার। বাঁধের ৩ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার পড়বে পটুয়াখালীতে, বাকিটুকু ভোলায়।
‘চর মাইনকা-চর ইসলাম ও চর মন্তাজ ক্রসড্যামের মাধ্যমে ভূমি পুনরুদ্ধার’ নামের প্রকল্পটির প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয় ৪৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। গত ১৭ ডিসেম্বর চরফ্যাশনের চর নলুয়ার নজরুলনগর ইউনিয়নে বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-গলাচিপার একাংশ) আসনের সাংসদ মাহবুবুর রহমান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাঁধ বিশেষজ্ঞ এ এম এম শফিউল্লাহ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ক্রসড্যাম নির্মাণ করে ভূমি জাগানোর পদ্ধতি অনেক জায়গায় সফল হলেও এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমন অন্য এলাকা ডুবে যেতে পারে। জেগে ওঠা অংশের বিপরীত দিকে জলাবদ্ধতা ও নদীর পাড় ভাঙন হতে পারে। এ জন্য ইআইএ করার বিধান রাখা হয়েছে।
নদী ও বনভূমির মতো প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মধ্যে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাবধান হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে শফিউল্লাহ বলেন, এমন যাতে না হয় যে ৪৬ কোটি টাকার প্রকল্প করে পরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করতে শতকোটি টাকা খরচ করতে হয়।
কাটা পড়বে কেওড়া গাছ: ভোলা বন বিভাগ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চর মাইনকা-চর ইসলাম বিটে প্রায় ৯০০ একর সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে। বাঁধের কারণে ভোলা বন বিভাগের ৩ দশমিক ৯ কিলোমিটার সংরক্ষিত বন উজাড় হয়ে যাবে। এখানে আনুমানিক ২৫ হাজার গাছ কাটা পড়বে। পটুয়াখালী বন বিভাগ সূত্র জানায়, চর মন্তাজে অবস্থিত কেওড়া বাগানের ১৪ হাজার ১৪০টি গাছ কেটে ফেলতে হতে পারে।
ভোলা উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোল্লা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোলার সংরক্ষিত বনের প্রায় ২৫ হাজার গাছ কাটা পড়বে। ইচ্ছে করলেই সংরক্ষিত বন কাটা যায় না। এর জন্য দরকার আন্তমন্ত্রণালয়ের সমন্বয় ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন। বন বিভাগ থেকে ওই গাছ কাটার কোনো অনুমতিপত্র আমরা পাইনি।’ তিনি জানান, প্রকল্প প্রণয়নের সময় অজ্ঞাত কারণে ‘বনভূমিকে’ বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।
নৌপথ, জেলে ও জলাশয়ের ক্ষতির আশঙ্কা: চর মন্তাজ রেঞ্জের চর বেস্টিন ও চর বনানী অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকা দিয়ে দাঁড়ভাঙা, বুড়া গৌরাঙ্গ, চর মন্তাজ চ্যানেল, তেঁতুলিয়া—এই চারটি নদী বয়ে গেছে। এ ছাড়া গোলের খাল, বনানী খাল, কাজীর খালসহ কমপক্ষে ১০টি খাল রয়েছে। বাঁধ হলে এসব নদী-খালের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৩০ হাজার জেলে পরিবার ব্যাপক ক্ষতির শিকার হবে।
ভোলার পশ্চিমে তেঁতুলিয়া, পূর্বে মেঘনা নদী আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। চরফ্যাশন উপজেলার কচ্ছপিয়া ও কুকরি-মুকরি বনের মাঝে মেঘনা নদী থেকে উঠে আসা একটি শাখা নদী পশ্চিমে তেঁতুলিয়ায় গিয়ে মিশেছে। এই শাখা নদীর নাম ‘চর মানিকা চ্যানেল’, যার প্রস্থ প্রায় ৭০০ মিটার। এরও দক্ষিণে চর কুকরি-মুকরি বনের চর মনুরার দক্ষিণ পাশ দিয়ে পশ্চিমে আরেকটি শাখা মেঘনা থেকে উঠে বুড়া গৌরাঙ্গ নদী হয়ে তেঁতুলিয়ায় মিশেছে। এ শাখা নদীটির নাম ‘চর মন্তাজ চ্যানেল’। এর প্রস্থ প্রায় ৫০০ মিটার। এ দুটি শাখা নদী ছাড়াও আশপাশে রয়েছে বুড়া গৌরাঙ্গ নদ, কুকরি-মুকরি চ্যানেল, চর বেস্টিন চ্যানেল, চর বেজলিন চ্যানেলসহ অর্ধশতাধিক ছোট-বড় খাল। এসব নদী ও খাল দিয়েই ওই অঞ্চলে জোয়ার-ভাটা হয়।
বর্ষা মৌসুমে ভোলার চরফ্যাশন, লালমোহন ও পটুয়াখালীর গলাচিপার লক্ষাধিক জেলে এসব শাখা নদী, খালসহ মেঘনা, তেঁতুলিয়ায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। জেলেরা এসব নদী ও শাখা নদীকে ব্যবহার করে সহজেই সাগরে যেতে পারেন।
চর নলুয়ার জেলে বাহার মাঝি, চর কচ্ছপিয়া মাছঘাটের জেলে জসিম সওদাগর, সামরাজ এলাকার আবু জাহের ঢালী, জাহানপুরের ফারুক মিয়াসহ একাধিক জেলে জানান, এখানে বাঁধ হলে হয়তো চর পড়বে। তবে এ অঞ্চলের লক্ষাধিক জেলে না খেয়ে মরবেন। কারণ, জেগে ওঠা জমি তো আর গরিব জেলেরা পাবেন না। দক্ষিণ সাগর থেকে ধেয়ে আসা জোয়ারের ঢেউ বাঁধে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে। এতে পূর্ব ভোলা তীব্র ভাঙনের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। বর্ষায় উত্তরের বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানি নামতে না পেরে এ অঞ্চলে বন্যা দেখা দেবে।
কাজ বন্ধের নির্দেশ: কলাপাড়া পাউবো সূত্র জানায়, প্রকল্পের তিনটি গুচ্ছের মধ্যে চর মন্তাজ অংশের কাজ পায় বরিশালের রুপালি কনস্ট্রাকশন, চরআন্ডা অংশের কাজ পায় এমকো কনস্ট্রাকশন এবং চর মাইনকা অংশের কাজ পায় ভোলার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্প বাস্তবায়নে বন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও ঠিকাদাররা মাটি কাটার কাজ শুরু করেন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু ট্রাস্ট ইউনিটের উপসচিব রাশেদুল ইসলাম পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী ও চর মন্তাজ এলাকা পরিদর্শন শেষে প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
বনের মাটি কাটার কথা স্বীকার করে রুপালি কনস্ট্রাকশনের মালিক অমল বিশ্বাস জানান, বৃহৎ স্বার্থে ভালো কাজ করতে গিয়ে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পাউবো ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: কলাপাড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সফি উদ্দিন দাবি করেন, ‘ক্রসড্যাম নির্মিত হলে এক হাজার হেক্টর জমি বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি ভোলা ও পটুয়াখালীর মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হবে। এ জন্য বন কেটে নদীর মধ্য দিয়ে ক্রসড্যাম টানা হচ্ছে।’
পরিবেশ বিপর্যয় পর্যবেক্ষণ জরিপ হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনেছি, তিন-চার বছর আগে একটি জরিপ হয়েছে। কিন্তু কারা করেছে তা বলতে পারব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি ভালো প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বন বিভাগ তা করতে দিচ্ছে না। চার মাস ধরে বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রেখেছে তারা।’
ভোলার জেলা প্রশাসক মেসবাহুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে এবং সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি মন্ত্রীর উদ্বোধনের পর জানতে পেরেছি। এতে পরিবেশ বিপর্যয় হবে কি না সে রকম কোনো জরিপের ঘটনা জানা নেই।’
[প্রতিবেদক: এম জসীম উদ্দীন, বরগুনা; নেয়ামতউল্যাহ, ভোলা; শংকর দাস, পটুয়াখালী ও নেছার উদ্দীন আহম্মেদ, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)]
সরেজমিন গিয়ে এবং প্রকল্পের কাগজপত্র থেকে জানা গেছে, বুড়া গৌরাঙ্গ নদ ও এর চর মন্তাজ চ্যানেল এবং তেঁতুলিয়া নদীর চর মাইনকার চ্যানেলের ওপর দিয়ে যাবে বাঁধটি। গাছ কাটা পড়ার কারণ, অবস্থানের দিক থেকে বুড়া গৌরাঙ্গের পর চর বেস্টিন বন, মন্তাজ চ্যানেল, চর বনানী বন, মাইনকার চ্যানেল এবং শেষে মাইনকার চর সংরক্ষিত বনের ওপর দিয়ে যাবে বাঁধটি। ফলে এই তিনটি শ্বাসমূলীয় বনের প্রায় ৩৯ হাজার গাছ কাটা পড়বে বলে বন বিভাগ মনে করছে।
বন বিভাগের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, গাছ কাটা পড়া ছাড়াও বাঁধটি হলে উপকূলের সাড়ে পাঁচ হাজার একর বনভূমি হুমকির মুখে পড়বে। চারটি নদী ও ১০টি খালের গতিপথ বদলে যেতে পারে। এলাকার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। ওই নদী ও জলাশয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল ৩০ হাজার জেলের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
জানতে চাইলে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী স্থানীয় সাংসদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা ওই কাজের অনুকূলে কার্যাদেশ দিয়ে দিয়েছি এবং ঠিকাদাররা কাজ শুরু করে দিয়েছে।’ প্রকল্পটির কারণে বনের ক্ষতি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মন্ত্রী বলেন, ‘এটা বন বিভাগের কাজ। ক্ষতি হলে তারা দেখবে। আমাদের দায়িত্ব প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা, আমরা সেটা করে দিচ্ছি।’
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে লিখিতভাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) প্রতিবেদন জমা না দিয়ে এই বাঁধটি নির্মাণ করা ঠিক হবে না। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী, এ ধরনের বাঁধ নির্মাণের আগে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক, যাতে বাঁধটি নির্মিত হলে কী ধরনের পরিবেশগত প্রভাব পড়বে, তা বোঝা যায় এবং সে অনুযায়ী পরিবেশ রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
গত রোববার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে জলবায়ু ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় ইআইএ করার বিষয়টি লিখিতভাবে পাউবোকে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড সূত্রে জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাশনের চর মাইনকা থেকে পটুয়াখালীর চর মন্তাজ পর্যন্ত সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন ও ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ সালের নভেম্বরে হাতে নেওয়া হয়। বাঁধটি দৈর্ঘ্যে ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটার ও প্রস্থে হবে সাড়ে ১০০ মিটার। বাঁধের ৩ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার পড়বে পটুয়াখালীতে, বাকিটুকু ভোলায়।
‘চর মাইনকা-চর ইসলাম ও চর মন্তাজ ক্রসড্যামের মাধ্যমে ভূমি পুনরুদ্ধার’ নামের প্রকল্পটির প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয় ৪৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। গত ১৭ ডিসেম্বর চরফ্যাশনের চর নলুয়ার নজরুলনগর ইউনিয়নে বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-গলাচিপার একাংশ) আসনের সাংসদ মাহবুবুর রহমান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাঁধ বিশেষজ্ঞ এ এম এম শফিউল্লাহ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ক্রসড্যাম নির্মাণ করে ভূমি জাগানোর পদ্ধতি অনেক জায়গায় সফল হলেও এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমন অন্য এলাকা ডুবে যেতে পারে। জেগে ওঠা অংশের বিপরীত দিকে জলাবদ্ধতা ও নদীর পাড় ভাঙন হতে পারে। এ জন্য ইআইএ করার বিধান রাখা হয়েছে।
নদী ও বনভূমির মতো প্রাকৃতিক ব্যবস্থার মধ্যে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাবধান হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে শফিউল্লাহ বলেন, এমন যাতে না হয় যে ৪৬ কোটি টাকার প্রকল্প করে পরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করতে শতকোটি টাকা খরচ করতে হয়।
কাটা পড়বে কেওড়া গাছ: ভোলা বন বিভাগ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চর মাইনকা-চর ইসলাম বিটে প্রায় ৯০০ একর সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে। বাঁধের কারণে ভোলা বন বিভাগের ৩ দশমিক ৯ কিলোমিটার সংরক্ষিত বন উজাড় হয়ে যাবে। এখানে আনুমানিক ২৫ হাজার গাছ কাটা পড়বে। পটুয়াখালী বন বিভাগ সূত্র জানায়, চর মন্তাজে অবস্থিত কেওড়া বাগানের ১৪ হাজার ১৪০টি গাছ কেটে ফেলতে হতে পারে।
ভোলা উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোল্লা মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোলার সংরক্ষিত বনের প্রায় ২৫ হাজার গাছ কাটা পড়বে। ইচ্ছে করলেই সংরক্ষিত বন কাটা যায় না। এর জন্য দরকার আন্তমন্ত্রণালয়ের সমন্বয় ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন। বন বিভাগ থেকে ওই গাছ কাটার কোনো অনুমতিপত্র আমরা পাইনি।’ তিনি জানান, প্রকল্প প্রণয়নের সময় অজ্ঞাত কারণে ‘বনভূমিকে’ বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।
নৌপথ, জেলে ও জলাশয়ের ক্ষতির আশঙ্কা: চর মন্তাজ রেঞ্জের চর বেস্টিন ও চর বনানী অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকা দিয়ে দাঁড়ভাঙা, বুড়া গৌরাঙ্গ, চর মন্তাজ চ্যানেল, তেঁতুলিয়া—এই চারটি নদী বয়ে গেছে। এ ছাড়া গোলের খাল, বনানী খাল, কাজীর খালসহ কমপক্ষে ১০টি খাল রয়েছে। বাঁধ হলে এসব নদী-খালের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৩০ হাজার জেলে পরিবার ব্যাপক ক্ষতির শিকার হবে।
ভোলার পশ্চিমে তেঁতুলিয়া, পূর্বে মেঘনা নদী আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। চরফ্যাশন উপজেলার কচ্ছপিয়া ও কুকরি-মুকরি বনের মাঝে মেঘনা নদী থেকে উঠে আসা একটি শাখা নদী পশ্চিমে তেঁতুলিয়ায় গিয়ে মিশেছে। এই শাখা নদীর নাম ‘চর মানিকা চ্যানেল’, যার প্রস্থ প্রায় ৭০০ মিটার। এরও দক্ষিণে চর কুকরি-মুকরি বনের চর মনুরার দক্ষিণ পাশ দিয়ে পশ্চিমে আরেকটি শাখা মেঘনা থেকে উঠে বুড়া গৌরাঙ্গ নদী হয়ে তেঁতুলিয়ায় মিশেছে। এ শাখা নদীটির নাম ‘চর মন্তাজ চ্যানেল’। এর প্রস্থ প্রায় ৫০০ মিটার। এ দুটি শাখা নদী ছাড়াও আশপাশে রয়েছে বুড়া গৌরাঙ্গ নদ, কুকরি-মুকরি চ্যানেল, চর বেস্টিন চ্যানেল, চর বেজলিন চ্যানেলসহ অর্ধশতাধিক ছোট-বড় খাল। এসব নদী ও খাল দিয়েই ওই অঞ্চলে জোয়ার-ভাটা হয়।
বর্ষা মৌসুমে ভোলার চরফ্যাশন, লালমোহন ও পটুয়াখালীর গলাচিপার লক্ষাধিক জেলে এসব শাখা নদী, খালসহ মেঘনা, তেঁতুলিয়ায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। জেলেরা এসব নদী ও শাখা নদীকে ব্যবহার করে সহজেই সাগরে যেতে পারেন।
চর নলুয়ার জেলে বাহার মাঝি, চর কচ্ছপিয়া মাছঘাটের জেলে জসিম সওদাগর, সামরাজ এলাকার আবু জাহের ঢালী, জাহানপুরের ফারুক মিয়াসহ একাধিক জেলে জানান, এখানে বাঁধ হলে হয়তো চর পড়বে। তবে এ অঞ্চলের লক্ষাধিক জেলে না খেয়ে মরবেন। কারণ, জেগে ওঠা জমি তো আর গরিব জেলেরা পাবেন না। দক্ষিণ সাগর থেকে ধেয়ে আসা জোয়ারের ঢেউ বাঁধে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে। এতে পূর্ব ভোলা তীব্র ভাঙনের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। বর্ষায় উত্তরের বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানি নামতে না পেরে এ অঞ্চলে বন্যা দেখা দেবে।
কাজ বন্ধের নির্দেশ: কলাপাড়া পাউবো সূত্র জানায়, প্রকল্পের তিনটি গুচ্ছের মধ্যে চর মন্তাজ অংশের কাজ পায় বরিশালের রুপালি কনস্ট্রাকশন, চরআন্ডা অংশের কাজ পায় এমকো কনস্ট্রাকশন এবং চর মাইনকা অংশের কাজ পায় ভোলার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্প বাস্তবায়নে বন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও ঠিকাদাররা মাটি কাটার কাজ শুরু করেন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু ট্রাস্ট ইউনিটের উপসচিব রাশেদুল ইসলাম পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী ও চর মন্তাজ এলাকা পরিদর্শন শেষে প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।
বনের মাটি কাটার কথা স্বীকার করে রুপালি কনস্ট্রাকশনের মালিক অমল বিশ্বাস জানান, বৃহৎ স্বার্থে ভালো কাজ করতে গিয়ে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পাউবো ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: কলাপাড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সফি উদ্দিন দাবি করেন, ‘ক্রসড্যাম নির্মিত হলে এক হাজার হেক্টর জমি বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি ভোলা ও পটুয়াখালীর মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হবে। এ জন্য বন কেটে নদীর মধ্য দিয়ে ক্রসড্যাম টানা হচ্ছে।’
পরিবেশ বিপর্যয় পর্যবেক্ষণ জরিপ হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনেছি, তিন-চার বছর আগে একটি জরিপ হয়েছে। কিন্তু কারা করেছে তা বলতে পারব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি ভালো প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বন বিভাগ তা করতে দিচ্ছে না। চার মাস ধরে বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রেখেছে তারা।’
ভোলার জেলা প্রশাসক মেসবাহুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তেঁতুলিয়া নদীর মধ্যে এবং সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি মন্ত্রীর উদ্বোধনের পর জানতে পেরেছি। এতে পরিবেশ বিপর্যয় হবে কি না সে রকম কোনো জরিপের ঘটনা জানা নেই।’
[প্রতিবেদক: এম জসীম উদ্দীন, বরগুনা; নেয়ামতউল্যাহ, ভোলা; শংকর দাস, পটুয়াখালী ও নেছার উদ্দীন আহম্মেদ, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)]
No comments